ডঃ জুরাইন, আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি?
পার।
আমার সন্দেহ হচ্ছে, যে প্রাণী তিনটি দেখছি, সেগুলি অন্য কোনো গ্রহ থেকে এখানে এসেছে। এরা এ গ্রহের প্রাণী নয়।
এ রকম মনে হওয়ার কোনো কারণ আছে কি?
জ্বি স্যার, আছ। প্রাণীগুলির চলাফেরার জন্যে এই গ্রহ উপযোগী নয়। সমস্ত গ্রহটি প্রকাণ্ড সব পাথরে ঢাকা। পাথরগুলি মসৃণ। প্রাণীটি মসৃণ জিনিসের উপর দিয়ে চলাফেরা করতে পারে না। লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই, গ্যালাক্সি-ওয়ানের মেঝেতে এরা বারবার পিছলে পড়ে যাচ্ছিল।
তুমি বলতে চাচ্ছ, প্রাণীটি এই গ্রহের অধিবাসী হলে মসৃণ জাগয়ায় চলাফেরার ক্ষমতা তার মধ্যে থাকত। জীবনের বিকাশ হত সেই দিকে?
জ্বি স্যার।
ভালো বলেছ নিমায়ের। চমৎকার যুক্তি।
ধন্যবাদ স্যার।
নিমায়ের কল্পনাও করে নি, ডঃ জুরাইন এত সহজে তার যুক্তি মেনে নেবেন। ডঃ জুরাইন একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। এরা বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কারোর কথায় কান দেয় না। নিমায়ের এক জন সামান্য সিকিউরিটি গার্ড, কিন্তু ডঃ জুরাইন তার যুক্তি প্রশংসা করলেন।
অনুসন্ধানকারী দলের সঙ্গে একটি প্রথম শ্রেণীর রোবট সব সময়ই থাকে, কিন্তু এ দলটির সঙ্গে ছিল না। এদের সঙ্গে একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর রোবট আছে। এই জাতীয় রোবট রুটিন কাজ করবার ব্যাপারে সুদক্ষ, কিন্তু এরা যুক্তির মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছতে পারে না। এরা নিজ থেকে কখনো কোনো আলোচনায় অংশগ্রহণ করে না। প্রশ্ন করলেই শুধু উত্তর দিয়ে থাকে। এই বার খানিকটা ব্যতিক্রম হল। রোবটটি হঠাৎ কথা বলে উঠল, ৬ জুরাইন। আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
ডঃ জুরাইন অবাক হয়ে তাকালে।
কি ব্যাপার?
আমি একটি সুরেলা ধ্বনি পাচ্ছি। ধ্বনিটি ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে।
ডঃ জুরাইনের বিস্ময়ের সীমা রইল না।
কই, আমি তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না। নিমায়ের, তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ?
না স্যার।
রোবটটি শান্তস্বরে বলল, আপনাদের শ্রবণশক্তি আমার মতো তীক্ষ্ণ নয়। আপনারাও শুনবেন। আমরা সেই সুরেলা ধ্বনির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সত্যি সত্যি সুরধ্বনি শোনা গেল। ডঃ জুরাইনের মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করল। সুরটি খুবই চেনা। নিমায়ের উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ডঃ জুরাইন, আপনি কি সুরটি চিনতে পারছেন?
হ্যাঁ।
কী ব্যাপার ডঃ জুরাইন?
বুঝতে পারছি না।
সুরটি যে নিওলিথী সুর, সে সম্পর্কে আপনার কি কোনো সন্দেহ আছে?
না।
আপনার কি মনে হয়, আমরা নিওলিথি সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাব?
হ্যাঁ–কোথাও না কোথাও দেখবে ছটি অদ্ভুতদৰ্শন আকাশছোঁয়া ঘর। বাতাস এসে সেই ঘরগুলিকে ধাক্কা দিচ্ছে আর তৈরি হচ্ছে এই অপার্থিব নিওলিথি সুর।
স্পেস-স্যুটের শীতলতায়ও ডঃ জুরাইন ঘামতে থাকলেন।
স্যার, আমাদের উচিত গ্যালাক্সিওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
কথার উত্তর দিল রোবটটি। সে তার যান্ত্রিক শীতল স্বরে বলল, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, ওদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।
কখন থেকে যোগাযোগ নেই।
এক ঘণ্টা বার মিনিট তেইশ সেকেন্ড।
এতক্ষণ বল নি কেন?
আপনারা জানতে চান নি, তাই।
ডঃ জুরাইন বহু কষ্টে রাগ সামলালে। নিময়ের চেঁচিয়ে উঠল, স্যার, দেখুন দেখুন।
নিওলিথি ঘর ছটি দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত সবুজ রঙ বেরুচ্ছে তার দেয়াল থেকে। মনে হচ্ছে সেই সবুজ রঙ সমস্ত অঞ্চলটিকেই যেন আলোকিত করে তুলেছে।
আহ, কী অদ্ভুত!
স্যার, নিওলিথি সভ্যতার সমস্ত ঘর-বাড়ি কি সবুজ পাওয়া গেছে?
হ্যাঁ। তবে রঙের গাঢ়ত্বের তারতম্য আছে। কোনো কোনো জায়গায় রঙ হালকা সবুজ। কোথাও পাওয়া গেছে গাঢ় রঙ।
স্যার আপনি কি স্বচক্ষে এর আগে নিওলিথি ঘর দেখেছেন?
না, গ্যালাক্সি-ওয়ানের কেউ দেখে নি। মনের মধ্যে একটি অন্য রকম ভাব হয়।
তা ঠিক। খুবই ঠিক।
ঘরগুলি শুধু যে অদ্ভুত তাই নয়, এদের বিশালত্বও কল্পনাতীত। অপার্থিব সুরে ধ্বনি বেজে যাচ্ছে। যেন একটি বুভাঙা হাহাকার। নিমায়ের চোখে গভীর আবেগে জল এসে গেল।
তারা তিন জন তিন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এত কিছু দেখার আছে এখানে, এত কিছু আছে শেখার। ভাষাটা শিখে ফেললে অনেক সহজ হত। কিন্তু এটি শিখতে সময় লাগছে। কারণ মানুষগুলি প্রায় সময়ই চিন্তা করে এক রকম, কিন্তু বলে অন্য রকম। যেমন ক্যাপ্টেন কীম একবার সিকিউরিটির একজনকে জিজ্ঞেস করল, এই সম্পর্কে তোমার কি মত?
লোকটি হাসিমুখে বলল, স্যার, এটি খুব ভালো ব্যবস্থা।
অথচ লোকটি মনে মনে ভাবছে-ব্যবস্থাটি একটুও কাজ করবে না। এর চেয়ে মন্দ আর কিছু হতে পারে না। কোনটি ঠিক এর মধ্যে ব্যবস্থাটি কি আসলেই মন্দ না ভালো? তাহলে মন্দের অর্থ কী, আবার ভালোর অর্থইবা কী?
এ ছাড়াও এই মানুষগুলি কথা বলতে প্রচুর সময় নেয়। তারা যেমন একটি শব্দকেই অসংখ্য কম্পনের মধ্যে উচ্চারণ করে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করে, মানুষ তা পারে না। সামান্য মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যেও এর অনেকগুলি শব্দ পাশাপাশি ব্যবহার করে। এবং একেক বার করে একেক রকম ভাবে, তাতে অর্থের কী তারতম্য হয় কে জানে? যেমন সামান্য খাওয়ার কথাই ধরা যাক। একবার বলছে, চল খাই। আবার বলছে খাই চল। এর মানে কি? এদের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। আরেকটি মজার জিনিস হচ্ছে, এরা অকারণে কথা বলে। কোনো সমস্যা ছাড়াই কয়েক জন মিলে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। এদের ধরনধারণ এ রকম, যেন চিন্তা করার মতো কোনো সমস্যা নেই। এই সব নিয়ে এদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে ইচ্ছা হয়।