সে ইশারা করে গোলাকৃতি একটি বাক্স দেখাল। বাক্সটি তার কাঁধের কাছে ঝুলছে। মশার আওয়াজের মতো পিপিন একটি শব্দ আসছে সেখান থেকে।
এই যন্ত্রের সাহায্যে যে কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর ভাষা বুঝতে পারা যায় এবং সে ভাষায় কথা বলা যায়। প্রাণীদের মস্তিষ্কের নিওরোনে বিভিন্ন ধ্বনির যে লাইব্রেরি আছে এবং শব্দবিন্যাসের যে সমস্ত ধারা তা এই যন্ত্রটি ধরতে পারে।
বাবলুর একটু ভয় ভয় লাগল। লোকটি বলল, এই যে চারদিকে ঝিঝি পোকা ডাকছে এরা কী বলছে তা তুমি বুঝতে পারবে যদি যন্ত্রটা তোমার কাঁধে ঝুলিয়ে দেই, দেব?
বাবলু ভয়ে ভয়ে বলল, দিন, কিন্তু ব্যথা লাগবে না তো?
উঁহু। মাথা খানিকটা ভো-ভো করবে হয়ত! দিয়েই দেখ।
হইয়েৎসুঁন যন্ত্রটা বাবলুর কাঁধে বসিয়ে দিতেই বাবলু শুনল, ঝিঝি পোকাগুলো কথা বলছে।
পোকা চাই। খাবারের জন্যে পোকা চাই।
এ লোক দুটি যাচ্ছে না কেন? কী করছে, কী করছে? এরা দুজন কী করছে?
জাদুকর ২৬৯
পোকা চাই। পোকা চাই। পোকা চাই।
বাবলু স্তম্ভিত হয়ে গেল। লোকটি বলল, মানুষ যেভাবে কথা বলে এরা কিন্তু সেভাবে কথা বলে না। ডানার সঙ্গে ডানা ঘসে শব্দ করে। ভাবের আদান
প্রদানের কত অদ্ভুত ব্যবস্থাই না প্রাণিজগতে আছে।
বাবলু তার কথায় কান দিচ্ছিল না। কারণ, সে পরিষ্কার শুনতে পেল। জামগাছের একটি পাখির বাসা থেকে ফিসফিস করে কথাবার্তা হচ্ছে।
আহা, এই লোক দুটি কি বকবক শুরু করেছে? ঘুমুতে দেবে না নাকি?
ঠিক বলেছ। মানুষদের মধ্যে কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছুই নেই। এগুলো মহাবোকা।
বলতে বলতে পাখিগুলো খিকখিক করে হাসতে লাগল।
লোকটি বলল, বাবলু যন্ত্রটি এবার খুলে ফেলা যাক। তোমার অভ্যাস নেই তো, মাথা ধরে যাবে।
বাবলু বলল, আমি যদি এখন ওদের সঙ্গে কথা বলি ওরা আমার কথা বুঝতে পারবে?
দু একটা কথা বুঝতে পারে। তবে বেশির ভাগই বুঝবে না। ওদের বুদ্ধিবৃত্তি নিম্নস্তরের। অবশ্যি সবার না। পৃথিবীতে অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী আছে। যেমন ধরো তিমি মাছ।
তিমি মাছ বুদ্ধিমান?
অত্যন্ত বুদ্ধিমান। শুধু হাত নেই বলে যন্ত্রপাতি তৈরি করতে পারে না। ডলফিনও খুব বুদ্ধিমান। ওদের যদি হাত থাকত তাহলে পৃথিবীর চেহারা পাল্টে যেত।
ওদের হাত নেই কেন?
প্রকৃতির খেয়াল। প্রকৃতির খেয়ালিপনার জন্যে তিমি এবং ডলফিনের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীদেরও পশুর মতো জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
হইয়েৎসুঁন একটি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে যন্ত্রটা বাবলুর কাঁধ থেকে নিয়ে নিল।
এবার তোমার ব্যাপারটা চিন্তা করা যাক। কী ঠিক করলে? জাহাজের খালাসি হবে?
না।
তবে কি? অন্ধকারে জামগাছের নিচে বসে থাকবে?
উঁহু। আমি আপনার সঙ্গে যাব।
তাই বুঝি?
জি।
কিন্তু তা সম্ভব নয়। আমাদের চলাফেরার জন্যে রকেট বা স্পেসশিপ নেই। আমরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাই সরাসরি বস্তু স্থানান্তর প্রক্রিয়ায়। তোমাকে দিয়ে তা হবে না। তাছাড়া আমি এখন যাব তোমাদের বৃহস্পতি গ্রহের একটি চাদে। তার নাম হচ্ছে টিটান। সেখানে অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী আছে।
আমিও আপনার সঙ্গে টিটানে যাব।
একেবারেই অসম্ভব। সে জায়গাটা বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাসে ভরপুর। তার উপর আছে সালফার ডাই-অক্সাইড। আমার তাতে কিছু হবে না। কিন্তু তুমি মারা যাবে সঙ্গে সঙ্গে।
বাবলু মুখ কালো করে চুপ করে রইল। লোকটি শান্তস্বরে বলল, তুমি বরং ভালমত পড়াশোনা শুরু করে। কারণ, তোমাদের এখানে অনেক কিছুই শেখার আছে। অংকে সাড়ে আট পেলে হবে না।
বাবলু কোন উত্তর দিল না। লোকটি বলল, মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে প্রথম শ্ৰেণীর। ইচ্ছে করলেই এরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমাদের ছাড়িয়ে যাবে।
বাবলু মুখ কালো করে বলল, আমি অংক-টংক কিছু শিখতে চাই না।
হইয়েন হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, মানুষেরা প্রাণী হিসেবে কিন্তু খুব অদ্ভুত। এরা প্রায় সময়ই যা ভাবে তা বলে না। মুখে এক কথা বলে কিন্তু মনের কথা ভিন্ন। তুমি মনে মনে ভাবছ এখন থেকে খুব মন দিয়ে অংক শিখবে যাতে এ ধরনের যন্ত্র বানাতে পার কিন্তু মুখে বলছ অন্য কথা। ঠিক না?
বাবলু থেমে থেমে বলল, আপনি কী করে বুঝলেন?
আমার কাছে ছোটখাটো একটা কমুনিকেটর যন্ত্র আছে। তা দিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীরা কী ভাবছে তা অনেক দূর থেকে টের পাওয়া যায়। যেমন ধরো, যন্ত্রটা তোমার কাধে ঝুলিয়ে দিলে তুমি বুঝতে পারবে তোমার বাবা এবং তোমার ধীরেন স্যার এই মুহূর্তে কী ভাবছেন। তারা দুজনেই হারিকেন নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তোমাদের স্কুলের দপ্তরি আনিস মিয়া বাসায় গিয়ে খবর দেয়ার পর থেকেই তোমার বাবা খুব অস্থির হয়ে পড়েছেন। তোমার বাবার মনের অবস্থাটা বুঝতে চাও?
বাবলু মাথা নাড়ল, সে বুঝতে চায়। লোকটি যন্ত্রটা কাঁধে ঝুলিয়ে দিতেই বাবল শুনল, বাবা মনে মনে বলছেন, আমার পাগলা ছেলেটা কোন অন্ধকারে একা একা বসে আছে কে জানে।
সাড়ে আট পেয়েছে তো কী হয়েছে? আহা বেচারা! আমার ভয়ে বাড়িও আসতে পারছে না। নাহ্ আর কোনদিন রাগারাগি করব না। ভাবতে ভাবতে বাবা চোখ মুছলেন।
ধীরেন স্যারও ঠিক একই রকম কথা ভাবছে। আহারে বাচ্চা ছেলেটা কোথায় না কোথায় বসে আছে অন্ধকারে। খাতায় গরু লেখাটা খুবই অন্যায় হয়েছে। সেই লজ্জাতেই বাড়ি যাচ্ছে না। নাহ, ছাত্রদের সঙ্গে আরেকটু দ্র। ব্যবহার করা দরকার। আর এই রকম রাগারাগি করব না। বাবলুটাকে রোজ এক ঘণ্টা করে অংক শেখাব।