- বইয়ের নামঃ জাদুকর
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
বাবলু অংকে পেয়েছে সাড়ে আট
আজ হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার অংক খাতা দিয়েছে।
বাবলু পেয়েছে সাড়ে আট। শুধু তাই নয়, খাতার উপর লাল পেনসিল দিয়ে ধীরেন স্যার বড় বড় করে লিখে দিয়েছেন, গবু। কী সর্বনাশ!
বাবলু খাতা উল্টে রাখল। যাতে গবু লেখাটা কারো চোখে না পড়ে। কিন্তু ধীরেন স্যার মেঘস্বরে বললেন, এই, বেঞ্চির উপর উঠে দাঁড়া।
বাবুল বেঞ্চির উপর উঠে দাঁড়াল। তোর অংক খাতায় কী লিখে দিয়েছি সবাইকে দেখা।
সে মুখ কালো করে সবাইকে দেখাল খাতাটা। ফাস্ট বেঞ্চে বসা কয়েকজন ভ্যাকভ্যাক করে হেসে ফেলল। ধীরেন স্যার গর্জন করে উঠলেন। এ্যাই, কে হাসে! মুখ সেলাই করে দেব।
হাসি বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ধীরেন স্যারকে সবাই যমের মতো ভয় করে। আড়ালে ডাকে যম স্যার। ফার্স্ট বেঞ্চে আবার একটু খিকখিক শব্দ হল। ধীরেন স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন। আরেকবার হাসির শব্দ শুনলে চড় দিয়ে দাঁত খুলে ফেলব। নাট্যশালা নাকি? এ্যা?
ক্লাস পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে গেল। ধীরেন স্যার থমথমে গলায় বললেন, এ্যাই বাবলু, তুই ঘণ্টা না পড়া পর্যন্ত বেঞ্চির উপর দাঁড়িয়ে থাকবি।
বাবলু উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। বেঞ্চির উপর এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা তেমন কিছু না। কিন্তু বাসায় ফিরে বাবাকে কী বলবে এই ভেবেই বাবলুর গায়ে ক্ষণে ক্ষণে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগল। বাবা মোটেই সহজ পাত্ৰ নন। ধীরেন স্যারের মতো মাস্টারও তার কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু। বাড়িতে আজ ভূমিকম্প হয়ে যাবে, বলাই বাহুল্য। বাবলু এই ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও কুলকুল করে ঘামতে লাগল।
বাবলু ভেবে পেল না অংকের মতো একটা ভয়াবহ জিনিস কী করে পড়াশুনার মধ্যে ঢুকে গেল। কী হয় অংক শিখে? তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বাঁদরের উঠবার দরকারটা কী? আচ্ছা ঠিক আছে, উঠছে উঠে পড়ক। কিন্তু প্রথম মিনিটে উঠে দ্বিতীয় মিনিটে আবার পিছলে পড়বার প্রয়োজনটা কী? বাবলু একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।
স্কুল ছুটি হল পাঁচটায়। বাবলু বাড়ি না গিয়ে স্কুলের বারান্দায় মুখ কালো করে বসে রইল। স্কুলের দপ্তরি আনিস মিয়া বলল, বাড়িত যাও ছোট ভাই।
বাবলু বলল, আমি আজকে এইখানেই থাকব।
কও কী ভাই! বিষয় কী?
বিষয় কিছু না। তুমি ভাগো।
আনিস মিয়া একগাল হেসে বলল, পরীক্ষায় ফেইল করছ, কেমন? বাড়িত থাইক্যা নিতে না আসলে যাই না। ঠিক না?
আনিস মিয়া দাঁত বের করে হাসতে লাগল। বাবলু স্কুল থেকে ছুটে বাইরে চলে আসল। সরকার বাড়ির জামগাছের নিচে বসে রইল একা একা।
জায়গাটা অসম্ভব নির্জন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক ঘুঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। বাবলুকে ভয় দেখানোর জন্যেই হয়ত অসংখ্য ঝিঝি এক সঙ্গে ডাকতে লাগল। বিলের দিক থেকে শব্দ আসতে লাগল, হম হম। ডানপাশের ঝােপ কেমন যেন নড়ে উঠল। বাবলু শার্টের লম্বা হাতায় ঘনঘন চোখ মুছতে লাগল।
এই ছেলে, কাঁদছ কেন?
অন্ধকারে ঠিক পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাবলুর মনে হল লম্বমত একজন লোক ঝােপটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির হাতে ভারি একটা ব্যাগ জাতীয় কিছু। পিঠেও এরকম একটা বোঁচকা ফিতা দিয়ে বাঁধা।
এই খোকা, কী হয়েছে?
বাবলু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি অংকে সাড়ে আট পেয়েছি।
তাই নাকি?
জ্বী। আর ধীরেন স্যার আমার খাতার উপর লিখেছেন—গরু।
বাবলু খাতাটা বের করে লোকটির দিকে এগিয়ে দিল। লোকটি এগিয়ে এসে খাতাটি নিল। সে বেশ লম্বা। এই অন্ধকারেও প্রকাণ্ড বড় একটা চশমা পরা থাকায় প্রায় সমস্তটা মুখ ঢাকা পড়ে আছে।
লোকটি গম্ভীর গলায় বলল, খাতার উপর গরু লেখাটা অন্যায় হয়েছে, বুদ্ধিবৃত্তির উপর সরাসরি কটাক্ষ করা হয়েছে। তার উপর এত বড় বড় করে লেখার প্রয়োজনই বা কী? ছোট করে লিখলেই হত।
বাবলু শব্দ করে কেঁদে উঠল।
উহুঁ, কাঁদবে না। কাঁদার সময় নয়। কী করা যায় এখন তাই নিয়ে। আমাদের চিন্তা করতে হবে। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে।
বাবলু ধরা গলায় বলল, আমি স্কুলেও যাব না। বাসায়ও ফিরে যাব না। বাকি জীবনটা জামগাছের নিচে বসে কাটাব। না, জাহাজের খালাসি হয়ে বিলাত চলে যাব।
বুদ্ধিটা মন্দ না। কিন্তু চট করে কিছু-একটা করা ঠিক হবে না। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। তোমার নাম তো জানা হল না।
আমার নাম বাবলু। ক্লাস সেভেনে পড়ি। আপনি কে?
ইয়ে আমার নাম হল গিয়ে হইয়েৎসুঁন।
কী বললেন?
আমার নামটা একটু অদ্ভুত, আমি বিদেশী কি না!
কী করেন আপনি?
আমি একজন পর্যটক। আমি ঘুরে বেড়াই।
বাবলু কৌতূহলী হয়ে বলল, আপনার দেশ কোথায়?
আসো, তোমাকে দেখাচ্ছি।
হইয়েৎসুঁন আকাশের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল, ঐ যে দেখছ ছায়া ছায়া, ওইটা হচ্ছে ছায়াপথ। মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি। স্প্রিংয়ের মতো। এর মাঝামাঝি একটি সৌরমণ্ডল আছে। আমরা তাকে বলি নখুঁততিনি তার ন নম্বর গ্রহটিতে আমি থাকতাম।
বাবলু একটু সরে বসল। পাগল নাকি লোকটা! কথা বলছে দিব্যি ভাল মানুষের মতো।
বুঝলে বাবলু, বলতে গেলে আমরা বেশ কাছাকাছি থাকি। পৃথিবীও কিন্তু মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে পড়েছে। হা হা হা।
আপনারাও বুঝি বাংলায় কথা বলেন?
উহুঁ। তোমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলছি কারণ আমার সঙ্গে একটি অনুবাদক যন্ত্র আছে।