ডাক্তার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি কি বলছেন কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
স্বপ্নের কথা বলছি। মানে গুছিয়ে বলতে পারছি না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মানে–
নিশানাথ বাবু থেমে গেলেন এবং অবাক হয়ে ডাক্তারের দিকে তাকালেন, কারণ কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে হল এই ডাক্তারের নাম মাসুদুর রহমান। ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীর নাম ইয়াসমিন। তাঁদের তিন ছেলে। বড় ছেলে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পিছলে পড়ে হাতের একটা হাড় ভেঙে ফেলেছে। হাড়টা ঠিকমতো সেট হয় নি বলে ডাক্তার সাহেব খুব চিন্তিত।
নিশানাথ বাবু ভেবে পেলেন না–এইসব কথা তাঁর মনে আসছে কেন? তিনি কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন নাকি? বোঝাই যাচ্ছে এসব তাঁর কল্পনা। ডাক্তার সাহেবের নাম নিশ্চয়ই মাসুদুর রহমান নয়। তাঁর স্ত্রীর নামও নিশ্চয়ই ইয়াসমিন নয়। অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে এটাই সত্যি। এরকম মনে হবার কী মানে থাকতে পারে?
ডাক্তার সাহবে বললেন, স্বপ্নের ব্যাপারটা তো শেষ করলেন না।
নিশানাথ বাবু বললেন, ঐসব কিছু না, বাদ দিন। মাথা গরম হয়েছিল, তাই আজে-বাজে স্বপ্ন দেখেছি। এখন আর দেখি না।
আমি আপনাকে ট্রাংকুলাইজার দিচ্ছি। শোবার সময় একটা করে খাবেন।
জ্বি আচ্ছা।
কয়েক দিন বিশ্রাম নিন। ভালোমতো খাওয়াদাওয়া করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। মাথার চুল নিয়ে মোটেও ভাববেন না। নানান কারণে মাথার চুল পড়ে যেতে পারে। এটা কিছুই না।
ডাক্তার সাহেব ব্লাডশোরের যন্ত্রপাতি ব্যাগে ভরছেন। নিশানাথ বাবু আচমকা বললেন, ডাক্তার সাহেব, আপনার নাম কি মাসুদুর রহমান?
ডাক্তার সাহেব হাসিমুখে বললেন, জি। আপনি কি আমাকে চেনেন?
জ্বি, চিনি। আপনার ছেলের হাত জোড়া লেগেছে?
লেগেছে। তবে একটু সমস্যা আছে বলে মনে হয়। আপনি কি আমার ছেলেকেও চেনেন নাকি?
নিশানাথ বাবু হা-সূচক মাথা নাড়লেন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ওকে অবশ্যি এ পাড়ার সবাই চেনে। বড়ো যন্ত্ৰণা করে। আপনার সঙ্গে কখনো কোনো বেয়াদবি করে নি তো?
জ্বি না।
কেউ যখন বলে আপনার ছেলেকে চিনি, তখনি একটু ব্ৰিত বোধ করি। ঐ দিন বাসার ছাদ থেকে কার মাথায় যেন পানি ঢেলে দিয়েছে। এগারো বছর বয়েস-এর মধ্যেই কি রকম দুষ্ট বুদ্ধি! আচ্ছা যাই।
ডাক্তার সাহেব চলে যাবার পর নিশানাথ বাবু প্রায় এক ঘণ্টা মূর্তির মতো বসে রইলেন। ব্যাপারটা কী হল তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। এই এক ঘণ্টায় আরেকটি বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। নিশানাথ বাবুর সামনের পার্টির দুটি দাঁত পড়ে গেল। তাঁর দাঁতে কোনো সমস্যা নেই অথচ পাকা ফল যেভাবে পড়ে, ঠিক সেইভাবে দাঁত পড়ে গেল! এর মানে কী? কী হচ্ছে এসব? তাঁর ভয় করতে লাগল। তিনি এক মনে গায়ত্রী মন্ত্ৰ জপ করতে লাগলেন।
জীব ও জড়ে যে ঈশ্বর, জল ও অগ্নিতে যে ঈশ্বর, যে ঈশ্বর আকাশে ও পাতালে সেই ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ।
তুষার এবং রাত্রি
তুষার এবং রাত্রি দুজনই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তুষারের মুখ ভাবলেশহীন, তবে রাত্রি একটু পরপর কেঁপে উঠছে। হাসি থামানর চেষ্টা করছে। সে বুঝতে পারছে কাজটা খুব অন্যায় হচ্ছে, তবু নিজেকে সামলাতে পারছে না। স্যারকে কী অদ্ভুত যে দেখাচ্ছে। মাথায় একটু চুলও নেই। আবার সামনের পার্টির দুটো দাঁত নেই। তাও সহ্য করা যেত, কিন্তু এখন তাদের পড়াবার সময় খুখুট করে তিনটে দাঁত পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্যে চেহারাটা হয়ে গেল অন্য রকম।
নিশানাথ বাবু বললেন, হাসিস না।
রাত্রি বলল, হাসি এলে কী করব? তবে আপনাকে দেখে আসছি না, স্যার। অন্য একটা ব্যাপারে হাসছি।
কী ব্যাপার?
আছে একটা ব্যাপার। আমাদের স্কুলের একটা কাণ্ড।
রাত্রি খুকধুক করে আসছে। হাসি চাপার চেষ্টা করছে, পারছে না। তুষার বলল, ও কিন্তু আপনাকে দেখেই হাসছে, স্যার।
উহুঁ। আমি স্যারকে দেখে আসছি না। স্কুলের একটা ঘটনা মনে পড়েছে এই জন্যে হাসছি–হি হি হি হি।
রাত্রি যে মিথ্যা কথা বলছে নিশানাথ বাবু তা বুঝতে পারছেন। আগেও বুঝতে পারতেন। মিথ্যা কথা বললে রাত্রির গলা অন্য রকম হয়ে যায়। আজও তার গলা অন্য রকম হয়ে গেছে। তবে নিশানাথ বাবু গলার স্বরের। পরিবর্তন থেকে নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পদ্ধতিতে জানতে পারছেন রাত্রি মিথ্যা বলছে। এই পদ্ধতি তিনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, কারণ পদ্ধতিটি যে কী, তিনি নিজেও জানেন না। যেমন আজকের কথাই ধরা যাক। ছেলেমেয়ে দুটি বসে আছে তাঁর সামনে। নিশানাথ বাবু কোনো এক জটিল প্রক্রিয়ায় ইচ্ছামতো এদের দুজনের মাথার ভেতর ঢুকে যেতে পারছেন। মাথার ভেতরটা অনেকটা কুয়োর মতো। গহীন কুয়ো। এত গহীন যে ভয় হয় এর বোধহয় কোনো শেষ নেই।
নিশানাথ বাবু জানেন না অন্যের মাথার ভেতর চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি কী। তিনি শুধু জানেন যে তিনি তা পারেন। সেই গহীন কূপের ভিতরে তিনি যখন নামেন তখন তাঁর রোমাঞ্চ বোধ হয়। কুয়োর দেয়ালগুলিতে থরে থরে কত কিছুই না সাজানো মানুষের স্মৃতি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। কুয়োর গহীন থেকে উঠে আসে মানুষের চিন্তা, কল্পনা ও ভাবনা। একই সঙ্গে এক জন মানুষ কত কিছু নিয়েই না ভাবতে পারে।
মানুষের মাথার ভেতরে ঢুকতে পারার এই অদ্ভুত ক্ষমতার ব্যাপারটি নিশানাথ দু দিন আগে বুঝতে পেরেছেন। এই দুদিনে অনেকের মাথার ভেতর তিনি উঁকি দিয়েছেন। এ বাড়ির মালী, দারোয়ান, ড্রাইভার, রাস্তার ও-পাশে ভাই ভাই লণ্ড্রীর ছেলেটা, ডেল্টা ফার্মেসির রোগা লোক।