মহসিন সাহেব বললেন, তোমরা যাও, আলোকে নিয়ে এস। ব্যাটালিয়ান নিয়ে রওনা হওয়া যাক।
তুষার বলল, ও যাবে না, বাবা।
তুমি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর, না জিজ্ঞেস করেই বলছ কেন যাবে না। যেতেও তো পারে।
কখনো তো যায় না।
যেতেও তো পারে। আমার কাছে নিয়ে এস, আমি বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করাব।
আলো মাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যায় না। এই বাড়ির দেয়ালের বাইরে পা ফেলতেই তার আপত্তি। বাধ্য হয়ে যদি কখনো যেতে হয় চোখমুখ শক্ত করে রাখে। একটু পরপর চমকে উঠে। অচেনা কাউকে দেখলেই এমন ভাব করে যাতে মনে হয় সে কোনো একটি বিচিত্র কারণে ভয় পাচ্ছে।
মহসিন সাহেব খুব খুশি হলেন। কারণ আলো যেতে রাজি হয়েছে। গাড়িতে তিনি আলোকে তার পাশে বসালেন।
রাত্রি এবং তুষার বসল পেছনের সীটে। রাত্রি বলল, তুমি কিন্তু আস্তে গাড়ি চালাবে, বাবা। তুমি এত স্পীডে গাড়ি চালাও যে ভয় লাগে।
আজ রিকশার চেয়েও আস্তে চালাব।
রাত্রি এবং তুষার দুজনই খিলখিল করে হেসে উঠল। আলো মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। সে হাসির কোনো কারণ বুঝতে না পেরে অস্বস্তি বোধ করছে। আলোর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কত মজার মজার ব্যাপার চারদিকে হয়, সে কিছু বুঝতে পারে না। তাকে কেউ বুঝিয়ে দিতেও চেষ্টা করে না। এই দুজন এত হাসছে কেন? আলোর কান্না পেতে লাগল। সে অবশ্যি কাঁদল না। চোখ-মুখশক্ত করে বসে রইল।
মহসিন সাহেব বলরেন, আজ আমি এক হাতে গাড়ি চালাব। সাঁই সই বন বন।
রাত্রি বলল, আরেকটা হাত দিয়ে তুমি কী করবে বাবা?
আরেকটা হাত আমি আলো মায়ের কোলে ফেলে রাখব।
এই কথায় দুজন আবার হেসে উঠল। আলো এদের হাসিহাসি মুখ গাড়ির ব্যাকভিউ মিররে দেখতে পাচ্ছে। তার আরো মন খারাপ হয়ে গেল। এরা এত আনন্দ করছে কেন? গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মহসিন সাহেব দুই হাতেই স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছেন। স্লো স্পীডে তিনি গাড়ি চালাতে পারেন না। দেখতে দেখতে গাড়ি ফোর্থ গিয়ারে চলে গেল।
তুষার বলল, বাবা।
বল।
তুমি কি আজ সকালে স্যারকে দেখেছ, বাবা?
না।
দেখলে তুমি হাসতে হাসতে মরে যেতে।
কেন?
স্যারের মাথায় একটা চুলও নেই। সব পড়ে গেছে।
তাই নাকি?
হুঁ। স্যারকে কী যে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। রাত্রি ফিক করে হেসে ফেলেছে। হাসাটা কি উচিত হয়েছে, বাবা?
মোটেই উচিত হয় নি।
আমিও হেসেছি। তবে মনে মনে। কেউ দেখতে পায় নি।
তুমি খুবই বুদ্ধিমানের কাজ করেছ।
ওর সব চুল পড়ে গেল কেন, বাবা?
বয়স হয়েছে তো, সেই জন্যে পড়ে গেছে। বয়স হলে মাথার চুল পড়ে যায়।
কেন পড়ে যায়?
মাথার চুল হচ্ছে মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য। বুড়ো মানুষদের মাথা ঠাণ্ডা রাখার দরকার নেই, তাই চুল পড়ে যায়।
দাঁত পড়ে যায় কেন, বাবা?
বুড়ো মানুষদের শক্ত খাবার খাওয়ার প্রয়োজন নেই, এই জন্যে দাঁতও পড়ে যায়।
মহসিন সাহেব মীরপুর রোড ধরলেন। তিনি চিড়িয়াখানার দিকে যাচ্ছেন। চিড়িয়াখানা ব্যাপারটা তার কাছে খুব অপছন্দের। আজ যাচ্ছেন ছোটমেয়ের জন্যে। একমাত্র চিড়িয়াখানায় গেলেই আলোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
মহসিন সাহেব গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিলেন। তিনি লক্ষ করেছেন দ্রুতগতি তাঁকে চিন্তায় সাহায্য করে। যদিও এই মুহূর্তে তেমন কোনো চিন্তা তার মাথায় নেই। অস্পষ্টভাবে নিশানাথ বাবুর কথা তাঁর মনে আসছে। দীপও আজ সকালে চুল পড়ার কথা বলেছিল। লোকটির দিন বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে। হঠাৎ ভালো-মন্দ কিছু হয়ে গেলে সমস্যা হবে। ডেড বডি কী করা হবে? হিন্দুদের দেহ সত্বারের অনেক সমস্যা আছে বলে শুনেছেন। নিশানাথ বাবুর আত্মীয়স্বজন ঢাকায় কেউ আছেন। কিনা জিজ্ঞেস করা হয় নি। জানা থাকা দরকার।
এক জন ডাক্তার নিশানাথ বাবুকে দেখছেন।
ডাক্তারের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাঁর শরীর এখন ভালই লাগছে, তবু দীপা ডাক্তার আনিয়েছেন। এখন দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তারের পাশে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনার অসুবিধা কী?
নিশানাথ বাবু বললেন, তেমন কোনো অসুবিধা নেই।
ডাক্তার সাহেব বিস্মিত হয়ে দীপার দিকে তাকালেন। দীপা বললেন, দেখুন না হঠাৎ করে ওঁর মাথার সব চুল পড়ে গেল!
এটা এমন কিছু না। অন্য কোনো অসুবিধা না থাকলেই হল। আছে অন্য কোনো সমস্যা?
জ্বি না, মাঝে মাঝে খুব মাথার যন্ত্রণা হয়।
এখনো হচ্ছে?
জ্বি না।
দীপা বললেন, ওঁর সাইনাসের সমস্যা আছে।
বেশি করে লেবুর সরবত খাবেন। ভিটামিন সি এইসব ক্ষেত্রে খুব উপকারী। ভিটামিন সি-কে এখন বলা হচ্ছে দিরা ভিটামিন।
ডাক্তার সাহেব বোধহয় বাড়ি যাবার তাড়া আছে, দ্রুত কাজ সারতে চাইছেন। দীপা বললেন, আপনি দয়া করে ওঁর প্ৰেশারটা একটু দেখুন।
ডাক্তার সাহেবের ব্যাগ খুলে অপ্রসন্ন মুখে প্রেশারের যন্ত্রপাতি বের করলেন। পেশার মাপার আর কোনো ইচ্ছা ছিল না। এই ডাক্তার এ বাড়িতে প্রথম এসেছেন। এঁদের ডাক্তার হচ্ছে দীপার ছোট বোন তৃণা। আজ তৃণাকে পাওয়া যায় নি। তার বোধহয় আবার হাসপাতালে নাইট ডিউটি পড়েছে।
আপনার প্ৰেশার নৰ্মাল। আপনার বয়সের তুলনায় খুবই নর্ম্যাল।
দীপা বললেন, চাচা, আপনার অন্য কোনো সমস্যা থাকলে বলুন।
নিশানাথ বাবু বললেন, আমার আর তো কোনো সমস্যা নেই, মা।
স্বপ্নের কথা বলুন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, কিসের স্বপ্ন?
দীপা বললেন, চাচা কি একটা স্বপ্ন যেন বারবার দেখছেন। বলুন না, চাচা। ডাক্তারদের কাছে কিছু গোপন করতে নেই।
নিশানাথ বাবু বিব্রত গলায় বললেন, একটা মেয়ে–তার নাম নাসিমা। কামিজ পরা। মেয়েটার মন খুব খারাপ।