আছে।
খুব বেশি?
না, খুব বেশি না।
সাইনাসের জন্যে এক্সরে করাবার কথা ছিল যে, তা কি করিয়েছেন।
হ্যাঁ। একটা ঝামেলা হয়েছে এক্সরেতে, আবার করাতে হবে।
রাতে আপনি কী খাবেন?
কিছু খাব না, মা। উপোস দেব। উপোস দিলে ঠিক হয়ে যাবে।
চালের আটার রুটি করে দেব?
আচ্ছা দাও।
দীপা চলে যেতে পা বাড়িয়েছেন তখন নিশানাথ বাবু বললেন, একটু বস মা। এই দুমিনিট।
দীপা বিস্মিত হয়ে ফিরে এলেন। নিশানাথ বাবুর সামনের চেয়ারটায় বসলেন। নিশানাথ বাবু বললেন, বিশ্রী সব স্বপ্ন দেখছি, বুঝলে মা। মনটা খারাপ হয়ে গেছে।
কী স্বপ্ন?
একই স্বপ্ন বারবার ঘুরে ফিরে দেখছি। একটা ঘরে কামিজ-পরা অল্পবয়স্ক একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার নাম নাসিমা। নাসিমার মন খুব খারাপ। অথচ তার মন খুব ভালো থাকার কথা ছিল। সে একটা ট্রাকের সামনে লাফিয়ে পড়ল, অবশ্যি নাসিমার কিছু হল না।
আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকুন। শরীর দুর্বল, এই জন্য স্বপ্নট দেখছেন।
নিশানাথ বাবু চুপ করে রইলেন। দীপা বললেন, আপনি কি আর কিছু বলবেন, চাচা?
না, মা।
আমি তাহলে যাই। দারোয়ানকে বলে যাচ্ছি সে গেট বন্ধ করবার পর আপনার রুমের সামনে শুয়ে থাকবে।
লাগবে না মা, শরীরটা এখন আগের চেয়ে ভালো লাগছে।
নিশানাথ বাবু বিছানায় যে পড়লেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে যাও, মা। আলো চোখে লাগছে।
দীপা বাতি নিভিয়ে ঘর থেকে বেরুলেন। তাঁকে খানিকটা চিন্তিত মনে হল। নিশানাথ বাবুর স্বপ্নের ব্যাপারটা তাঁর ভালো লাগল না। তিনি কোথায় যেন শুনেছেন, মানুষ পাগল হবার আগে আগে একই স্বপ্ন বারবার দেখে।
রাতে নিশানাথ বাবুর প্রবল জ্বর এল। জ্বরের প্রকোপে তিনি থরথর করে। কাঁপতে লাগলেন। দারোয়ান তাঁর রুমের বাইরেই ক্যাম্প খাট পেতে শুয়েছে। নিশানাথ বাবু বেশ কয়েক বার ডাকলেন, এই কুদ্দুস, এ-ই। এই কুদ্দুস মিয়া। দারোয়ানের ঘুম ভাঙল না। দারোয়ানদের সাধারণত খুব গাঢ় ঘুম হয়।
ভোর হবার ঠিক আগে আগে তাঁর জ্বর ছেড়ে গেল। শরীরটাও কেমন ঝরঝরে মনে হল। সামান্য ক্লান্তির ভাব ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। তিনি বাগানে বেড়াতে গেলেন। ভোরবেলার এই ভ্ৰমণ তাঁর কাছে বড়োই আনন্দদায়ক মনে হল।
সূর্য ওটার পর হাত মুখ ধুতে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ করলেন তাঁর মাথায় একটিও চুল নেই। এক রাত্রিতে মাথার সব চুল উঠে গেছে। কেন এরকম হল তিনি বুঝতে পারলেন না। কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকেসামান্য চুল মানুষের চেহারা যে এতটা বদলে দিতে পারে, তা তিনি আগে কখনো ভাবেন নি। নিজেকে দেখে তাঁর নিজেরই খুব হাসি পেতে লাগল। তিনি প্রথমে মৃদু স্বরে তারপর বেশ শব্দ করেই হেসে উঠলেন। তাঁর হাসির শব্দে কৌতূহলী হয়ে কুদুস উকি দিল। তার চোখে ভয়-মেশানো দৃষ্টি। কুদ্দুস বলল, কি হইছে মাস্টর সাব?
কিছু হয় নি কুদ্দুস। হাসছি।
নিশানাথ বাবুর হঠাৎ মনে হল, কুদ্দুস মনে মনে তাকে পাগল বলে ডাকছে। এরকম মনে হল কেন? তিনি স্পষ্ট শুনলেন কুদুস বলছে, আহা মানুষটা পাগল হইয়া যাইতেছে। আহা রে।
কুদ্দুস।
জ্বি।
তুমি মনে মনে কী ভাবছিলে?
কিছু ভাবছিলাম না মাস্টর সাব। আফনের মাথার চুল বেবাক গেল কই?
পড়ে গিয়েছে। আমাকে দেখতে কেমন অদ্ভুত লাগছে, তাই না কুদ্দুস? মনে হচ্ছে আমি একটা ভূত। শ্যাওড়া গাছে থাকি।
কুদ্দুস জবাব দিল না।
নিশানাথ অবির হাসতে শুরু করলেন। কুদুস চোখ বড়ো বড়ো করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
আজ খুব শুভদিন
তুষার এবং রাত্রির জন্যে আজ খুব শুভদিন।
আজ বাবা তাদের স্কুলে নামিয়ে দেবেন। মাসে এক দিন মহসিন সাহেব তার ছেলেময়েদেরকে স্কুলে নামিয়ে দেন এবং স্কুল থেকে ফেরত আনেন। ফেরত আনার সময় খুব মজা হয়। বাচ্চারা যা চায় তাই তিনি করেন। তুষার যদি বলে–বাবা আইসক্রিম খাব তাহলে তিনি আইসক্রিম পার্লারের সামনে গাড়ি দাঁড় করান। রাত্রি একবার বলেছিল—সাভার স্মৃতিসৌধ দেখতে ইচ্ছা করছে বাবা। মহসিন সাহেব বলেছেন–চল যাই, দেখে আসি। তখন ঝনঝম বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় পানি। মহসিন সাহেব তার মধ্যে গাড়ি ঘুরিয়েছিলেন।
আজও নিশ্চয়ই এরকম কিছু হবে। রাত্রি ঠিক করে রেখেছে ফেরার পথে সে বাবাকে বলবে গল্পের বই কিনে দিতে। তুষার এখনো কিছু ঠিক করতে পারে নি। কী চাওয়া যায় সে ভেবে পাচ্ছে না। এই জন্যে তার খুব মন খারাপ।
গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে মহসিন সাহেব বললেন, আজ স্কুলে না গেলে কেমন হয়?
তুষার ভেবে পেল না–বাবা ঠাট্টা করছেন, না সত্যি সত্যি বলছেন।
মহসিন সাহেব বললেন, মাঝে মাঝে স্কুল পালানো ভাল। আমি যখন তুষারের মতো ছিলাম তখন স্কুল পালাম।
রাত্রি বলল, সত্যি বাবা?
হুঁ সত্যি।
স্কুল পালিয়ে কী করতে?
মার্বেল খেলতাম। আমাদের সময় সবচেয়ে মজার খেলা ছিল মার্বেল। এখন আর কাউকে খেলতে দেখি না। তোমরা কেউ মার্বেল দেখেছ?
না।
চল, দোকানে গিয়ে খুজব। যদি পাওয়া যায়, তোমাদের জন্যে কিনব। কীভাবে খেলতে হয় শিখিয়ে দেব। আজ সারা দুপুর মার্বেল খেলা হবে।
আনন্দে তুষারের বুক কাঁপতে লাগল। আজ কী ভীষণ সৌভাগ্যের দিন, স্কুলের ইংলিশ গ্রামার শেখা হয় নি। তার জন্যে আজ আর বকা খেতে হবে না।
রাত্রি অবশ্যি তুষারের মতো এত খুশি হল না। স্কুল তার খুব ভালো লাগে। স্কুলে তার দুজন প্রাণের বন্ধু আছে। তাদের সঙ্গে কথা না বললে রাত্রির ভালো লাগে না।