মহসিন সাহেবের এক ছেলে, দুই মেয়ে। বড়ো ছেলে ল্যাবরেটরি স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। পড়াশোনায় মোটামুটি ধরনের, তবে সুন্দর ছবি আঁকে। দ্বিতীয় সন্তানরাত্রি পড়ে ভিকারুননেসা স্কুলে ক্লাস ফাইভে। এই মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী। স্মৃতিশক্তিও অসাধারণ। কোন জিনিস এক বার পড়লে দ্বিতীয় বার পড়ার দরকার হয় না। মহসিন সাহেবের তৃতীয় সন্তান আলো–ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে রূপবতী। তার দিকে তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া মুশকিল। আলো এবং রাত্রির বয়সের তফাত এক বৎসর। আলো জন্ম থেকেই মূক ও বধির। এই মেয়েটিকে নিয়ে বাবা-মার দুঃখের কোনো সীমা নেই।
মহসিন সাহেবের স্ত্রী দীপা মেয়েটিকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখেন। মাঝে মাঝে থমথমে গলায় বলেন, মা, তুই এত সুন্দর হচ্ছিস কেন? তুই তো বিপদে পড়বি, মা। আলো চোখ বড়ো বড়ো করে মার দিকে তাকিয়ে থাকে। মার কথা সে শুনতে পায় না, মা কী বলছেন বুঝতে পারে না। মার কথা শেষ হওয়া মাত্র সে হাসে। সেই হাসি এতই মধুর যে দীপার ইচ্ছা করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে।
রাত প্রায় আটটা বাজে। তুষারএবং রাত্রি ভিডিও গেম নিয়ে বসেছে। রাত্রি গত জন্মদিনে এই যন্ত্রটি উপহার হিসেবে পেয়েছে। অনেকগুলি খেলার ক্যাসেট আছে। তবে তাদের পছন্দ হয়েছে ঘোড়ার খেলাটা। খেলা শুরু হতেই টিভি পর্দায় দেখা যায় অনেক জীবজন্তুর মাঝখানে ল্যাসো হাতে এক ঘঘাড়সওয়ার বসে আছে। খেলার বিষয়টি হচ্ছে জীবজন্তু ধরা। কালো ছাগল তিন পয়েন্ট, সাদা হরিণ পঁচিশ পয়েন্ট, বসে থাকা বাঘ এক শ পয়েন্ট। জন্তুগুলি ধরা বেশ কঠিন, কারণ এরা দ্রুত দৌড়াতে থাকে।
রাত্রির জয়স্টিকের কনট্রোল খুবই চমৎকার। সে পাঁচ হাজার পর্যন্ত করতে পারে। তুষার অনেক কষ্টে এক বার এগারো শ করেছিল। ছোট ববানের কাছে পরাজিত হবার লজ্জায় সে খানিকটা মিয়মাণ। এখন খেলছে। রাত্রি। তুষার ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। ওদের থেকে অনেকটা দূরে সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে আলো। সেও গভীর মনোযোগে খেলা দেখছে।
দীপা ট্রেতে করে ছেলেমেয়েদের জন্যে দুধের গ্লাস নিয়ে ঢুকলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, এখন গেম নিয়ে বসেছ কেন? পড়াশোনা নেই?
রাত্রি খেলা বন্ধ না করেই বলল, স্যার আজ পড়াবে না মা। স্যারের শরীর ভালো না।
দীপা বললেন, উনি পড়াবেন না বলেই তোমরা পড়বে না কেমন কথা? পরীক্ষায় খারাপ করবে তো।
রাত্রি বলল, আমি কি কখনো খারাপ করেছি?
কখনো কর নি বলেই যে ভবিষ্যতেও করবে না, তা তো না। না পড়লে কী ভাবে ভালো করবে?
রাত্রি খেলা বন্ধ করে মার দিকে তাকিয়ে হাসল। মিষ্টি করে বলল, পড়তে যাচ্ছি মা।
দীপা বললেন, আরেকটা কথা, তোমরা যখন খেলা নিয়ে বস, তখন আলোকে ডাক না কেন? সে একা একা দূরে বসে থাকে। ওর নিশ্চয়ই খেলতে ইচ্ছা করে।
তুষার বলল, ও খেলতে পারে না, মা।
না পারলে ওকে শিখিয়ে দেবে। তোমরা আছ কেন? ওর বুঝি খেলতে ইচ্ছা করে না? যেটারি একা একা দূরে বসে আছে।
রাত্রি বলল, আমি ওকে ডেকেছি মা। ও তো আসতে চায় না। ও আমাদের পছন্দ করে না।
কে বলল পছন্দ করে না?
কাছে গেলে খামচি দেয়।এই দেখ খামচির দাগ।
দীপা দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করে বললেন, ঠিক আছে। যাও, হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। দুধ টেবিলে রইল। পড়তে বসার আগে দুধ খেয়ে নেবে। নটা বাজতেই খেতে আসবে। আর শোন, তোমাদের স্যারের যে অসুখ তোমরা কি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলে?
রাত্রি বলল, হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। না গেলে জানব কি করে যে তাঁর অসুখ। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন। মাথায় খুব যন্ত্ৰণা।
তুষার বলল, দারোয়ান ভাই বলেছেন, স্যারের মাথায় কুকুরের বাচ্চা হয়েছে। এক বার তো তাঁকে কুকুর কামড়ে দিয়েছে, তাই। মেয়েদের যদি কুকুরে কামড় দেয় তাহলে তাদের পেটে বাচ্চা হয়, আর ছেলেদের যদি কামড়ায় তাহলে তাদের মগজে বাচ্চা হয়। খুব ছোট ছোট বাচ্চা ইদুরের চেয়েও ছোট।
দীপা খুব রাগ করলেন। নতুন দারোয়ানটা রোজই কিছু না কিছু উদ্ভট কথা বলবে। তাকে মানা করে দেওয়া হয়েছে, তার পরেও এই কাণ্ড। তাছাড়া তার ঘরের পাশের ঘরে এক জন অসুস্থ মানুষ পড়ে আছে, এই খবরটা তাঁকে জানাবে না? ডাক্তার ডাকতে হতে পারে। বুড়ো মানুষ। হয়তোবা হাসপাতালে নিতে হতে পারে। রাতে নিশ্চয়ই ভাত খাবেন না। পথ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরে চালের আটা আছে কিনা কে জানে! থাকলে চালের আটার রুটি করার কথা বলে দিতে হবে।
দীপা নিশানাথ বাবুকে দেখতে যাবার জন্যে রওনা হলেন। ইট বিছানো রাস্তা অনেকখানি পার হতে হয়। দুপাশে উঁচু হয়ে ঘাস জমেছে। এক সপ্তাহও হয় নি কাটা হয়েছে, এর মধ্যেই ঘাস এত বড়ো হয়ে গেল। মালী। কোনো কিছুই লক্ষ করে না। বর্ষাকাল সাপখোপের সময়। এই সময়ে বাগান পরিষ্কার না রাখলে চলে?
নিশানাথ বাবুর ঘর অন্ধকার।
দীপা ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালালেন। নিশানাথ বললেন, কে?
দীপা বললেন, চাচা, আমি দীপা।
মহসিন নিশানাথ বাবুকে স্যার ডাকেন। তাঁর ছেলে-মেয়েরাও ডাকে স্যার। শুধু দীপা ডাকেন চাচা।
দীপাকে দেখে নিশানাথ বাবু উঠে বসলেন এবং কোমল গলায় বললেন, কেমন আছ গো মা?
আমি ভালেই আছি। আপনি কেমন আছেন? অসুখ নাকি বাঁধিয়ে বসেছেন।
তেমন কিছু না। জ্বর-জ্বর লাগছে। শুয়ে আছি।
দীপা হাত বাড়িয়ে নিশানাথ বাবুর কপাল স্পর্শ করলেন। এই অসম্ভব ক্ষমতাবান মানুষের কন্যা এবং ধনবান মানুষের স্ত্রীর আন্তরিকতায় নিশানাথ বাবুর চোখে পানি আসার উপক্রম হল। দীপা বললেন, আপনার গায়ে তো বেশ জ্বর। মাথায় যন্ত্রণা কি আছে?