নিশানাথ বাবু চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মাঝে মাঝে জিভ বের করে ঠোঁট ভেজাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরপর বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তাঁর বড় ধরনের কোনো কষ্ট হচ্ছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনার নামটা জানা হল না।
নিশানাথ বাবু চমকে চোখ মেলে তাকালেন। মনে হচ্ছে তিনি ডাক্তার সাহেবের প্রশ্ন ঠিক বুঝতে পারছেন না।
আমাকে বলছেন?
জ্বি।
কী বলছেন?
আপনার নাম জানতে চাচ্ছিলাম।
নিশানাথ। আমার নাম নিশানাথ।
শরীরটা কেমন লাগছে?
ভালো।
কিছু খাবেন?
না। বাসায় যাব।
বাসা কোথায়?
মালীবাগে।
বয়স কত আপনার?
ঠিক জানি না। পাঁচপঞ্চাশ-ষাট হবে।
ও আচ্ছা–শরীরটা এখন কেমন লাগছে?
ভালো।
নিশানাথ বাবু খানিকটা বিস্ময় বোধ করলেন। এই লোক সারাক্ষণ তাকে শরীর কেমন শরীর কেমন জিজ্ঞেস করছে কেন? তাহলে কি তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন কিংবা এক্সরে নেওয়ার সময় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন?
ডাক্তার সাহেব বললেন, মালীবাগে কি আপনার নিজের বাড়ি।
না। আমার এক ছাত্রের বাড়ি। আমি ঐ বাড়িতে থাকি। আর আমার ছাত্রের ছেলে-মেয়ে দুটোকে পড়াই।
ও আচ্ছা। আপনার নিকট আত্মীয়-স্বজন কে কে আছেন?
তেমন কেউ নেই। যারা আছেন–ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন।
আপনি যান নি কেন?
ইচ্ছা করল না। আমি এখন উঠি?
আরে না, আরেকটু বসুন, চা খান।
নিশানাথ বাবু বসলেন। তার খুব ক্লান্তি লাগছে। কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে। চা এলো। তিনি চায়ে চুমুক দিলেন–কোনোরকম স্বাদ পেলেন না। তবু ছোট ঘোট চুমুক দিতে ল গলেন, এখন না খাওয়াটা অভদ্রতা হয়।
বজলু ডাক্তার সাহেবকে একটা কাগজ দিয়ে গেছে। সেখানে লেখা কত ডোজ রেডিয়েশন এই রুগীর মাথার ভেতর দিয়ে পাস করেছে। সংখ্যাটির দিকে তাকিয়ে ডাক্তার সাহেব ঢোক গিললেন। এ কী ভয়াবহ অবস্থা।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আর কোনো এক্সরে নেওয়া হয় নি তো?
জ্বি না। তবে যন্ত্র এখন ঠিক আছে।
ঠিক থাকুক আর না থাকুক, আর কোনো এক্সরে যেন না করা হয়।
জ্বি আচ্ছা।
নিশানাথ বাবু বললেন, আমি এখন উঠি?
ডাক্তার সাহেব বললেন, আমি ঐ দিক দিয়েই যাব। আপনাকে নামিয়ে দেব। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।
নিশানাথ বাবু ডাক্তারের ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কী অসাধারণ এক জন মানুষ! আজকালকার দিনে এ রকম মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে।
গাড়িতে উঠতে উঠতে ডাক্তার সাহেব বললেন, আমার কার্ডটা রাখুন। টেলিফোন নাম্বার আছে। কোনো অসুবিধা হলে টেলিফোন করবেন।
নিশানাথ বাবু অবাক হয়ে বললেন, কি অসুবিধা?
না, মানে–বয়স হয়েছে তো এই বয়সে শরীর তো সব সময় খারাপ থাকে। পরিচয় যখন হয়েছে তখন যোগাযোগ রাখা। আপনি শিক্ষক মানুষ।
নিশানাথ বাবুর হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হল। কী অসম্ভব ভদ্র এই ডাক্তার। এঁকে ধন্যবাদের কিছু কথা বলা দরকার। বলতে পারলেন না। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। তিনি গাড়ির পেছনের সীটে বসে ঝিমুতে লাগলেন।
বাসায় ফিরে শরীরটা আরো খানিকটা খারাপ হল। নিজের ঘরে ঢুকে অবেলায় ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটা ঠিক স্পষ্ট নয়, আবার স্পষ্টও : ছোট্ট একটা ঘর। ঘরে একটা মেয়ে একা একা বসে আছে। মেয়েটিকে তিনি আগে কখনো দেখেন নি। কিন্তু তিনি তার নাম জানেন। মেয়েটার নাম নাসিমা, সে কলেজে পড়ে। তার আজ জন্মদিন। এরকম খুশির দিনেও তার মন খুব খারাপ। সে খুব কাঁদছে।
দীর্ঘ স্বপ্ন। তবে এই স্বপ্নে কোনো কথাবার্তা নেই। এই স্বপ্নের জিনিসগুলি স্থির, কোনো নড়াচড়া নেই! যেন কয়েকটা সাদাকালো ফটোগ্রাফ। আবার ঠিক সাদাকালেও নয়। এক ধরনের রঙ আছে, সেই রঙ পরিচিত নয়। ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
বাড়ির নাম পদ্মপত্র
বাড়ির নাম পদ্মপত্র।
বিশাল কম্পাউন্ডের ভেতর বাগানবাড়ির মতো বাড়ি। ঢাকা শহরের মাঝখানে জমিদারি সময়কার এক বাড়ি। বাড়ির আদি মালিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার রিডার ডঃ প্রশান্ত মলিক। তাঁর খুব গাছপালার শখ ছিল। যেখানে যত বিচিত্র গাছ পেয়েছেন তার সবই এনে লাগিয়েছিলেন। দিনমানে গাছের কারণে অন্ধকার হয়ে থাকত। লোকজন তখন এই বাড়ির নাম দিল জঙ্গলবাড়ি। ডঃ মল্লিকের বৃক্ষপ্ৰীতি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তেই লাগল। তাঁর খানিকটা মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণও দেখা দিল। ঘুম হত না, নিজের তৈরি বাগানে সারা রাত হাঁটতেন এবং গাছের সঙ্গে ল্যাটিন ভাষায় কথা বলতেন। ডঃ মল্লিক ল্যাটিন ভাষায়ও সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পর তাঁর সর্বকনিষ্ঠ কন্যাটিরও মাথা খারাপ হয়ে যায়। বাড়ির নাম তখন হয়ে যায় পাগলাঝাড়ি।
ডঃ মল্লিকের স্ত্রী দেশবিভাগের তিন বছরের মাথায় বাড়ি বিক্রি করে তার অপ্রকৃতস্থ কন্যাকে নিয়ে চলে যান জলপাইগুড়ি। এই বাড়ি তারপর চার বার হাতবদল হয়ে বর্তমানে আছে মহসিন সাহেবের হাতে। আগের বাড়ির কিছুই নেই। গাছপালার অধিকাংশই কেটে ফেলা হয়েছে। বাড়ির পেছনে জলজ গাছ লাগানর জন্যে একটা ঝিলের মতো ছিল, সেই ঝিল ভরাট করে চার কামরার এ প্যাটার্নের ঘর করা হয়েছে। ঘরগুলিতে মহসিন সাহেবের ড্রাইভার, মালী এবং দারোয়ান থাকে। বছর দুই ধরে আছে নিশানাথ বাবু।
নিশানাথ বাবু একসময় মহসিন সাহেবেরও প্রাইভেট টিউটর ছিলেন। অঙ্ক করাতেন। খুব যত্ন করেই করাতেন। পড়ানর ফাঁকে ফাঁকে মজার মজার গল্প করতেন। মহসিন সাহেব শিশু অবস্থায় সেইসব গল্প শুনে মুগ্ধ ও বিস্মিত হতেন। তাঁর সেই বিস্ময়ের কিছুটা এখনো অবশিষ্ট আছে বলে নিশানাথ বাবুকে যত্ন করে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছেন। নিশানাথ বাবুর দায়িত্ব সন্ধ্যার পর মহসিন সাহেবের পুত্র-কন্যাকে নিয়ে বসা, পড়া দেখিয়ে দেওয়া। এই দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। দায়িত্বের বাইরে যা করেন তা হচ্ছে গাছপালার যত্ন। প্রায় সময়ই মালীর সঙ্গে তাঁকেও নিড়ানি হাতে বাগানে বসে থাকতে দেখা যায়।