মহসিন স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্ৰম হল। দীপা বললেন, কী যন্ত্রণা বলতো দেখি! দুটা ইস্ত্ৰিই ওঁর কাছে দিয়ে আসতে হয়েছে।
তুমি দিয়ে এসেছ?
হ্যাঁ। না দিয়ে কী করব বল? যা হৈচৈ করছেন।
মহসিন ঠাণ্ডা মাথায় দ্বিতীয় সিদ্ধান্তই নিলেন। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর খুব বেগ পেতে হল না। তিনি নিজেকে বোঝালেন, অসুস্থ, বৃদ্ধ একজন মানুষের অকারণে বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয় না। এই বৃদ্ধ তো এমনিতেই মারা যাচ্ছে। দু দিন আগে মারা গেলে কারোর কোন ক্ষতি হবে না। এক জন অথর্ব বুড়োকে হত্যা করাও কঠিন কিছু নয়। সহজ, খুবই সহজ। অনেক পদ্ধতি আছে। সেই অনেক পদ্ধতির যে কোনো একটি গ্রহণ করা যায়। যেমন নাকের উপর একটা বালিশ চেপে ধরা। দীর্ঘ সময় চেপে ধরার কোনোই প্রয়োজন নেই। দুই থেকে তিন মিনিটের মামলা।
এই মামলা সেরে ফেলা উচিত। মোটেই দেরি করা উচিত নয়। আজ রাতে সেরে ফেলাই ভালো। দেরি করা যায় না। কিছুতেই না।
দীপা বললেন, তোমাকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?
এম্নি। শরীরটা মনে হয় ভালো না।
যাও, শুয়ে থাক।
তিনি শুয়ে রইলেন। ঠাণ্ডা মাথায় তাঁকে ভাবতে হবে। খুব ঠাণ্ডা মাথায়। সময় নেই। হাতে একেবারেই সময় নেই।
দীপা বললেন, মাথায় হাতু বুলিয়ে দেব?
তিনি বললেন, দাও।
তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। দীপা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, কিন্তু তিনি ঘুমুচ্ছেন না। ঘুমুবার উপায় নেই। তাঁকে জেগে থাকতে হবে। ভাবতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। খুব ঠাণ্ডা মাথায়।
রাত দুটার মতো বাজে
রাত দুটার মতো বাজে।
মহসিন খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামলেন। দীপা অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই সে তৃপ্তির একটা শব্দ করল। খানিকক্ষণের জন্যে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। একবার মনে হল আবার বিছানায় ফিরে আসবেন। পরমুহূর্তেই সেই পরিকল্পনা বাতিল করে খালি পায়ে সিড়ি বেয়ে একতলায় নেমে গেলেন। খুব সাবধানে দরজা খুলে বারান্দায় এলেন। যদিও এত সাবধানতার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি হাঁটছেন নিজের বাড়িতে। কেউ তাঁকে দেখলেও কিছু যায় আসে না। তিনি যাচ্ছেন নিশানাথের ঘরে। এর মধ্যেও অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। তিনি তো যেতেই পারেন। নিশানাথ একজন রুগী মানুষ। রাত-বিরেতে তাঁকে দেখতে যাওয়াই তো স্বাভাবিক।
নিশানাথের ঘরে ঢোকাও কোনো সমস্যা নয়। তাঁর ঘরের দরজা খোলা থাকে, যাতে সময়ে-অসময়ে তাঁর ঘরে যাওয়া যায়।
মহসিন ছোট-ঘোট পা ফেলে এগোচ্ছেন। আকাশ মেঘলা। তাঁর শীতশীত করছে। পায়েও ঠাণ্ডা লাগছে। চটি জোড়া পরে নিলে হত। নিশানাথ বাবুর ঘরের কাছাকাছি আসতেই তিনি কপালের বাঁ দিকে ভেতা এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করলেন। হালকা যন্ত্ৰণা। তিনি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। যন্ত্রণাটা কেমন করে জানি সারা মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে। এর মানে কী? নিশানাথ কি তার মাথায় ঢুকে পড়েছে? এও কি সম্ভব! এটা কি বিশ্বাস্য?
অসম্ভব নয়। এই অদ্ভুত পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়। ইস্ত্রির কথা দীপাকে বলা হয়েছে যখন, তখন সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। মহসিন দ্রুত এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। তাঁর হাতে সময় নেই।
সময় নেই নিশানাথের হাতেও। নিশানাথ মহসিনের মাথার ভেতর ঢুকে গেছেন। তাঁকেও অতিদ্রুত কাজ করতে হচ্ছে। মহসিনের মাথা থেকে মুশরাত জাহান নামের মেয়েটির সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলতে হবে। কঠিন কাজ। একটি স্মৃতি দশটি স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। অন্যগুলি নষ্ট না করে সেই স্মৃতি নষ্ট করা যায় না। স্মৃতির জাল দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম। মাকড়সার জালের মতো তা ছড়ানো। এই জাল থেকে একটি সুতো ছিঁড়ে ফেলতে হবে। এমন ভাবে ছিড়তে হবে যেন জালের কোনো ক্ষতি না হয়। কঠিন কাজ। অতি কঠিন কাজ হাতে সময় এত অল্প। মহসিনের মনের ভেতর থেকে কুটিল ক্রোধ, ভয়ঙ্কর ঘৃণাও নষ্ট করে দিতে হবে, যেন প্রবল ভালোবাসা জেগে ওঠে দীপা নামের অসাধারণ মেয়েটির দিকে। যে মেয়েটির জন্ম দেবী অংশে। সময় নেই। মোটেই সময় নেই। কঠিন কাজ। ভয়ঙ্কর কঠিন কাজ।
মহসিন নিশানাথের ঘরে ঢুকে পড়েছেন। নিশানাথ কাত হয়ে শুয়ে আছেন। পায়ের কাছে কোলবালিশ। মহসিন কোলবালিশ হাতে তুলে নিলেন। তাঁর হাত একটু কাঁপছে। মাথায় যন্ত্রণা প্রবল হয়ে উঠছে। উঠুক। তিনি তাঁর কাজ শেষ করবেন। সারা জীবন তিনি তাঁর পরিকল্পনা অক্ষরে অক্ষরে কাজে খাটিয়েছেন। আজও খাটাবেন। এর কোনো নড় চড় হবে না। কিন্তু মাথা যেন এলোমলো হয়ে যাচ্ছে। বড় অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। বমি-বমি ভাব হচ্ছে। হোক। যা ইচ্ছা হোক। তিনি নিচু হয়ে নিশানাথের মুখের উপর বালিশ চেপে ধরলেন।
সময় শেষ হয়ে এসেছে। আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত। নিশানাথ মৃত্যুর স্বরূপ বুঝতে পারছেন। বড়োই আফসোস, কাউকে তা জানাতে পারছেন না। কারণ তাঁর কাজ শেষ হয় নি। এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। মহসিন এই মুহূর্তে একটি খুন করছে। এই খুনের স্মৃতিও তার মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে সে স্বাভাবিক মানুষের জীবন যাপন করতে পারবে না। এই স্মৃতিও নষ্ট করতে হবে। সময় নেই। এক অণুপল সময়ও নষ্ট করা যাবে না। আহ্, যদি কিছু সময় থাকত, তাহলে মৃত্যুর স্বরূপ অন্য কাউকে বলে যেতে পারতেন পুধু একটি কথা যদি বলতে পারতেন যদি জানিয়ে যেতে পারতেন ভয়াবহ নয়, কুৎসিত নয়। মৃত্যুর সৌন্দর্য জন্মের চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। কাকে জানাবেন? মহসিনকে? মন্দ কি? কেউ এক জন জানুক।