তৃণা উঠে বসতে-বসতে বলল, দুলাভাইয়ের সঙ্গে আমার কিছু কথা বলা দরকার আপা। দুলাভাই কখন আসবেন?
ও এসেছে।
এসেছেন? কোথায়?
নিচে। নিশানাথ চাচাকে দেখতে গিয়েছে। ওর সঙ্গে কি কথা বলবি?
তৃণা জবাব দিল না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল।
নিশানাথকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না–তিনি জেগে আছেন না ঘুমিয়ে আছেন। ইজিচেয়ারে লম্বালম্বি শুয়ে থাকা একজন মানুষ, যার চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। বাইরের কেউ হঠাৎ দেখলে চমকে উঠবে। মহসিনের সঙ্গে তাঁর রোজই দেখা হচ্ছে, তবু মহসিন চমকে উঠলেন কী কুৎসিতই না মানুষটাকে লাগছে। শরীরে মনে হচ্ছে পানি এসে গেছে। পা দুটো ফোলা অথচ পায়ের আঙ্গুলগুলো শুকিয়ে পাখির নখের মতো হয়ে আছে। মহসিন মৃদু স্বরে বললেন, স্যার কি জেগে আছেন?
নিশানাথ খসখসে গলায় বললেন, বুঝতে পারছি না, বাবা। এখন এমন হয়েছে-কখন জেগে থাকি, কখন ঘুমিয়ে থাকি বুঝতে পারি না।
আপনি বিশ্রাম করুন।
আর বিশ্রাম, আমি যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি বাবা। কোথায় যাব তাইবা কে জানে?
মহসিন কিছু বললেন না। মৃতপ্রায় মানুষটির সামনে তার দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না, আবার চলে যেতেও বাধোবাধো লাগছে।
নিশানাথ বললেন, তুমি একটু বস।
বারান্দায় বসবার জায়গা নেই। মহসিন দাঁড়িয়ে রইলেন। নিশানাথ বললেন, অমার গলার স্বরটা কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে–তুমি কি লক্ষ করেছ? করেছ?
জ্বি করেছি।
নিজের গলার স্বর নিজেই চিনতে পারি না। যখন কথা বলি মনে হয় অন্য কেউ কথা বলছে।
আমার মনে হয় কথা না বলে এখন চুপচাপ শুয়ে থাকাই ভালো।
সব ভালো জিনিস তো বাবা সব সময় করা যায় না। এখন আমার সারাক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছা করে। আমার পরিকল্পনা কি জান? আমার পরিকল্পনা হচ্ছে, মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি কথা বলব। মৃত্যু কী এই সম্পর্কে বলব–রানিং কমেট্রি। যখন কথা বলতে পারব না, তখন কারো মাথার ভেতর ঢুকে যাব। তাকে জানিয়ে যাব ব্যাপারটা কী।
মহসিন আড়চোখে ঘড়ি দেখলেন। এক জন অসুস্থ মানুষের আবোলতাবোল কথা শুনতে তাঁর ভালো লাগছে না। অথচ উঠে যাওয়া যাচ্ছে না।
মহসিন।
জ্বি স্যার।
আমি একটা পরীক্ষা করতে চাই–বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা।
কী পরীক্ষা? আমার যে অংশ অন্যের মাথায় ঢেকে, সেই অংশের কোনো মৃত্যু আছে কি না তা জানা। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে ঐ অংশটাও কি মরে যায়, না ঐ অংশ বেঁচে থাকে। যদি বেঁচে থাকে, সে কোথায় থাকে।
আমি মনে হয় আপনার কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছি না।
নিশানাথ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললেন, আমি নিজেই নিজের কথা বুঝি না, তুমি কী করে বুঝবে?
মহসিন আবার ঘড়ি দেখলেন। আর থাকা যায় না, এবার উঠতে হয়।
মহসিন।
জ্বি স্যার।
আমার কথা কি তোমার কাছে পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে?
জ্বি না। তবে আমার মনে হয় এইসব জটিল বিষয় নিয়ে আপনার চিন্তা করা উচিত না। আপনার উচিত চুপহপ বিশ্রাম করা, যাতে স্নায়ু উত্তেজিত না হয়।
মহসিন, আমার মনে হয় তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না। আমার কথাগুলি যে পাগলের প্রলাপ নয়, কিন্তু আমি প্রমাণ করে দিতে পারি। খুব সহজেই পারি।
আমি তার কোনো প্রয়োজন দেখছি না, স্যার।
তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর, এটা আমি চাই। কারণ মৃত্যু কী, তা বোঝার জন্যে আমি তোমার সাহায্য চাই। তোমার সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব নয়। তুমি যদি আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস কর, তাহলেই সাহায্য করবে।
আমি আপনার প্রতিটি কথা বিশ্বাস করছি।
না, করছ না। আমি এখন তোমার মাথার ভেতর ঢুকব। এ ছাড়া তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে না।
মহসিন সাহেব বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকালেন আর ঠিক তখনই বাঁ দিকের কপালে সূক্ষ যন্ত্ৰণা বোধ করলেন। এই যন্ত্ৰণা দীর্ঘস্থায়ী হল না। তিনি বুঝতেও পারলেন না নিশানাথ তার মাথায় ঢুকে গেছেন। মস্তিষ্কের অতলান্তিক কুয়ায় অতি দ্রুত নেমে যাচ্ছেন। কুয়ার গহিন থেকে প্রবল আকর্ষণী শক্তি নিশানাথকে নিচে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এ কী! তিনি এ কী দেখছেন?
এটা কি মহসিনের মস্তিষ্ক? এই কুয়ার চারপাশের দেয়ালে থরে থরে সাজান স্মৃতিগুলি কি সত্যি তাঁর এককালের প্রিয় ছাত্র মহসিনের? মৃদুভাষী মহসিন। ছেলেমেয়ের অতি আদরের বাবা। দীপার ভালোবাসার মানুষ। শান্ত, বিবেচক, বুদ্ধিমান ও হৃদয়বান একজন মানুষ। না-না-না, তিনি যা দেখছেন তা ভুল! কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। এটা নিশ্চয়ই অন্য কারোর মস্তিষ্ক।
কারণ এই মস্তিষ্কের মানুষটি খুব ঠাণ্ডা মাথায় একটি খুনের পরিকল্পনা করেছে। খুন করা হবে একটি মেয়েকে, যার নাম দীপা। যে মেয়েটি তারই। স্ত্রী। এমনভাবে হত্যাকাণ্ডটি হবে যে কেউ বুঝতে পারবে না কেউ সন্দেহ করবে না। শশাকে ও কষ্টে মানুষটি ভেঙে পড়ার অভিনয় করবে। তারপর এক সময় শশাকের তীব্রতা কমে যাবে। সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বাচ্চাগুলির দেখাশোনার জন্যেই তখন সবাই তাকে বিয়ে করবার জন্যে চাপ দেবে। সে বিয়ে করবে। এ বাড়িতে একটি মেয়ে এসে উঠবে, যার মাথার চুল ছোট-ছোট করে কাটা, যার গায়ের রঙ শ্যামলা, যার চোখ বড় বড়, যার নাম নুশরাত জাহান, যাকে আদর করে এই লোকটি নুশা বলে। দীপাকে হত্যা না করেও এই লোকটি নুশাকে ঘরে আনতে পারে। খুব সহজেই পারে। দীপাকে ত্যাগ করলেই হয়। তা সে করবে না, কারণ তাতে সামাজিকভাবে সে হেয় হবে তার চেয়েও বড়ো কথা দীপাকে ত্যাগ করা মানে দীপার বিশাল সম্পত্তি ত্যাগ করা। এই সম্পদ দীপা তার বাবার কাছ থেকে নিয়ে এসেছে। ঐ চেয়ে হত্যাই ভালো। কেউ কোনো দিন জানবে না। জানার কোনো উপায় নেই। কারণ পরিকল্পনা করা হয়েছে ভেবেচিন্তে।