তৃণা ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি তাহলে সত্যি সত্যি মানুষের মাথায় ঢুকতে পারেন?
হ্যাঁ পারি।
অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
নিশানাথ দুঃখিত গলায় বললেন, মানুষের মাথায় ঢাকার ব্যাপারটা অন্যায়। খুবই অন্যায়। খুবই গৰ্হিত কাজ। তুমি কিছু মনে কর না তৃণা।
না, আমি কিছু মনে করি নি। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না–যদিও জানি আপনার ক্ষমতাটা সর্তি। এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। আমি আরেকটু বসি আপনার সঙ্গে?
বস।
আপনার খবর প্রকাশিত হলে মেডিকেল সায়েন্সের জগতে কী রকম হৈচৈ শুরু হয়ে যাবে, সেটা কি আপনি জানেন?
না। জানি না।
তৃণা কাঁপা গলায় বলল, এই দেখুন আমার গা কাঁপছে। আচ্ছা, আপনি শুরু থেকে বলুন তো কখন আপনি প্রথম আপনার এই ক্ষমতার কথা বুঝতে পারলেন?
নিশানাথ জবাব দিলেন না। তাঁর মাথায় তীব্র যন্ত্রণা আবার শুরু হয়েছে। চারপাশের জগৎ ঘঘালাটে হয়ে আসতে শুরু করেছে। তিনি দুর্বল স্বরে বললেন, মা, তুমি এখন যাও।
আমার পুরো ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছা করছে। না জেনে আমি যেতে পারব না।
নিশানাথ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, সব তোমাকে বলব। এখন না। এখন পারব না। তোমাকে আমি খবর দেব। আমি নিজে নিজে চিন্তা করে অনেক কিছু বের করেছি। সে সবও তোমাকে বলব। আজ না। অন্য এক দিন।
কবে সেই অন্য এক দিন?
খুব শিগগিরিই। আমার হাতেও সময় নেই। আমি বাঁচব না। বাচার আগে কাউকে বলতে চাই। কারো সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই।
নিশানাথ চাদর দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেললেন। যেন চেনা পৃথিবী থেকে লুকোতে চাচ্ছেন।
তৃণা দীপার খোঁজে রান্নাঘরে ঢুকেছে। দীপা পরিজ তৈরি করছেন নিশানাথ বাবুর সকালের নাশতা। সকালে চালের আটার রুটি করে দিয়েছিলেন, খেতে পারেন নি। পরিজ খেতে পারেন। তৃণা দীপার পাশে এসে দাঁড়ায়। দীপা বোনের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে?
কিছু হয় নি তো।
তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
জানি না। আপা, আমাকে এক কাপ চা করে দাও।
তুই হাসপাতালে যাবি না?
বুঝতে পারছি না। হয়ত যাব না।
রুগী কেমন দেখলি?
তৃণা জবাব দিল না। তার কথা বলতে ভালো লাগছে না। দীপা বললেন, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ।
শরীর খারাপ লাগলে উপরে গিয়ে শুয়ে থাক।
দুলাভাই কি বাসায় আছেন, আপা?
না। ও কাল রাতে ফেরে নি।
কখন ফিরবেন?
জানি না।
তৃণা রান্নাঘর থেকে বেরুল। অন্যমনস্ক ভাঙ্গিতে কিছুক্ষণ বারান্দায় হাঁটল। তারপর উঠে গেল দোতলায়। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবে। শরীর ভালো লাগছে না। একটু আগে চায়ের তৃষ্ণা হচ্ছিল, এখন তাও হচ্ছে না।
আলো তার শশাবার ঘরের অন্ধকার কোণে একটা বই নিয়ে বসে আছে। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় বইটিতে কেন্দ্ৰীভূত। তৃণা ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখল। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সে এগিয়ে গেল। আলো ছোট খালাকে দেখে জড়সড় হয়ে গেল। ছোট ছোট করে শ্বাস নিচ্ছে, দ্রুত চোখের পাতা ফেলছে। সে কি ভয় পেয়েছে।
তৃণা নরম গলায় বলল, কেমন আছ?
আলো চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। ছোটখালার কথা সে কিছুই বুঝতে পারে নি। শুধু বুঝেছে ছোটখালা তাকে নরম স্বরে কিছু বলেছেন। যা বলেছেন তাতে আদর ও ভালোবাসা মাখানো। কেউ আদর ও ভালোবাসা মাখিয়ে কিছু বললে আলোর চোখে পানি এসে যায়। তাকে ইচ্ছা করে আদরও ভালোবাসা মাখিয়ে কিছু বলতে। কী করে বলতে হয় তা সে জানে না।
তৃণা আরো কাছে এগিয়ে এল। একটা হাত রাখল আলোর মাথায়। আলোর হাতের বইটি মেঝেতে পড়ে গেল। তৃণা লক্ষ করল মঞ্চত একটা সাদা কাগজ এবং পেনসিল। কাগজে কী সব লেখা। তৃণা কাজটা হাতে নিল। গোটা গোটা হরফে নানান শব্দ লেখা–
সাফল্য
প্ৰতিজ্ঞা
শ্ৰবণ
মন্দির
দিবস
তৃণা লেখার দিকে ইঞ্চিত করে বিক্রিত গলায় বলল, এগুলি তুমি লিখেছ? আলো এই প্রশ্ন বুঝতে পারল সে হ্যা-সূচক মাথা নাড়ল। তৃণা বলল, কেন লিখেছ? আলো এই প্ৰশ্ন বুঝতে পারল না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
তৃণা কী যেন লতে গেল। তার আগেই আলো কাগজ টেনে নিয়ে পেনসিল দিয়ে গুটি গুটি করে লিখতে শুরু করল। লেখা শেষ হবার পর তৃণার দিকে কাগজটি বাড়িয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। তার বড়ো লজ্জা লাগছে।
কাগজে গোটাটো করে লেখা–খালা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
এর মানে কী? মূক-বধির একটি মেয়ে হঠাৎ করে কেন কাগজে লিখবে খালা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
এর অর্থ কি সে জানে? কেউ হয়তো এই একটি বাক্য লেখা শিখিয়ে দিয়েছে। অক্ষর-পরিচয়হীন মানুষ যেমন নিজের নাম সই করতে শেখে। হয়তো এও সে রকম কিছু।
কে তোমাকে লেখা শিখিয়েছে?
আলো প্রশ্নের জবাব দিল না। তৃণার দিকে কাগজ এগিয়ে দিয়ে ইঙ্গিত করল লিখে দেবার জন্যে। বিস্মিত তৃণা লিখল, তুমি কি লিখতে পার?
আলো উত্তরে লিখল, হ্যাঁ।
কে তোমাকে শিখিয়েছে?
স্যার।
নিশানাথ বাবু?
হ্যাঁ।
কখন শেখালেন?
এর উত্তরে আলো কিছু লিখল না।
তৃণা লিখল, তুমি বই পড়তে পার?
পারি।
বই পড়ে বুঝতে পার?
পারি।
চশমা কী জান?
চোখে দেয়।
প্ৰতিজ্ঞা কী জান?
না।
কাগজের খণ্ডটিতে আর লেখার জায়গা নেই। তৃণা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। কী হচ্ছে এ বাড়িতে? এ বাড়ির মানুষজন কি জানে কী হচ্ছে?
তণা আলোর খাটে শুয়ে পড়ল। তার মাথা ধরেছে। বমি-বমি লাগছে। দীপা চা নিয়ে এসে দেখলেন তৃণা মড়ার মতো পড়ে আছে। তিনি কোমল গলায় বললেন, তোর তো মনে হচ্ছে সত্যি শরীর খারাপ। ডাক্তারদের শরীর খারাপ করলে কি ডাক্তার ডাকার নিয়ম আছে? থাকলে বল এক জন ডাক্তারকে খবর দিই।