নিঃশ্বাস কি বন্ধ করে রাখব?
যা ইচ্ছা করুন।
মাসুদ বজলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ঝামেলা শেষ কর তো। এক জনকে নিয়ে বসে থাকলে হবে না।
বজলু বোতাম টিপল। ছোট্ট একটা অঘটন তখন ঘটল। প্যানেলে একটি লাল বাতি জ্বলে উঠল। যার অর্থ কোথাও কোনো ম্যালফাংশান হয়েছে। বজলুর কোনো ভাবান্তর হল না, কারণ এই অতি আধুনিক যন্ত্রটি যে কোনো ম্যালফাংশানে আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়। নির্ধারিত রেডিয়েশনের এক পিকো রেম বেশি ডোজও যাবার কোনো উপায় নেই।
মাসুদ বলল, কী হয়েছে?
বজলু বলল, ম্যালফাংশান। আরেকটা প্লেট দিতে হবে।
মাসুদ বলল, শালার যন্ত্রণা!
ঠিক তখন বজলু অস্ফুট শব্দ করল। কারণ বড়ো ধরনের কিছু ঝামেলা হয়েছে। মেশিন বন্ধ হয় নি। স্ট্যান্ড-বাই বাটনের লাল আলো জ্বলে নি। ডিজিটাল মিটারের সংখ্যা দ্রুত পাল্টাচ্ছে রেডিয়েশন এখনো যাচ্ছে। বজলুর গলা শুকিয়ে গেল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। কত রেডিয়েশন গেল? ২৫০ রেম (REM)? কী সর্বনাশ! বুড়ো মানুষটা বেঁচে আছে তো?
এ রকম হবে কেন? কেন এরকর্ম হবে? এখন কী করা?
বজলু স্টপ বাটন টিপলংঘন্ত্রটির সমস্ত কার্যকলাপ এতে বন্ধ হবে। স্টপ বাটন পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দেবে। পাওয়ার থাকবে শুধু মেকানিক্যাল অংশে। রেডিয়েশন ইউনিটে থাকবে না।
আশ্চর্য! স্টপ বাটন টেপার পরও রেডিয়েশন বন্ধ হল না। বজলুর হাত কাঁপতে লাগল। সে মনে মনে বলল, ইয়া রহমানু, ইয়া রাহিমু।
মাসুদ বলল, কী হল?
বজলু বলল, রুগীকে তাড়াতাড়ি সরান। রেডিয়েশন যাচ্ছে।
কি বলছ ছাগলের মতো?
আল্লাহর কসম।
বজলু স্ট্যান্ড-বাই বাটন টিপে আবার স্টপ বাটনে চলে গেল। লাভ হল না। রেডিয়েশন কন্ট্রোল নবে হাত দিল। কিছু একটা করা দরকার। মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রুগীকে সরানও যাচ্ছে না। রুগীকে সরাতে হলে রেডিয়েশন সোর্স সরাতে হবে। তাও সরানো যাচ্ছে না।
মাসুদ ছুটে গেল ডাক্তার সাহেবের ঘরে।
কামিজ-পরা মেয়েটি এখনো আছে। সে সম্ভবত মজার কোনো গল্প বলছিল। তার মুখ হাসি-হাসি। ডাক্তার সাহেবও হাসছেন। দরজা নক নাকরে ঢাকা ঠিক হয় নি। মাসুদ গ্রাহ্য করল না।
কাঁপা গলায় বলল, তাড়াতাড়ি আসেন স্যার।
রেডিওলজিস্ট কাটাকাটা গলায় বললেন, কত বার বলেছি হুট করে ঢুকবে না।
আপনি আসেন তো স্যার। কেন? ঝামেলা হয়েছে। বিরাট ঝামেলা।
ডাক্তার সাহেব এক্সরে রুমে ঢুকে দেখলেন সব ঠিকঠাক। মেশিন বন্ধ। রহমান কপালের ঘাম মুছছে। নিশানাথ বারু এখনো শুয়ে আছেন।
মাসুদ কানে কানে ডাক্তার সাহেবকে ঘটনাটা বলল। ডাক্তারের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি বললেন, কত রেডিয়েশন পাস করেছে?
বজলু জবাব দিল না। আবার মাথায় ঘাম মুছল। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছে। ডাক্তার সাহেব ডিজিটাল মিটারে সংখ্যা দেখলেন। রেডিয়েশনের পরিমাণ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। রুগী এর পরেও বেঁচে আছে কী করে?
নিশানাথ বাবু বললেন, শেষ হয়েছে?
ডাক্তার সাহেব বললেন, জ্বি জ্বি শেষ। শেষ, ভাই আপনি উঠে বলুন। মাসুদ, ওঁকে উঠিয়ে বসাও।
মাসুদকে উঠিয়ে বসাতে হল না। নিশানাথ বাবু নিজেই উঠে বসলেন। নিচু গলায় বললেন, কোনো ঝামেলা হয়েছে।
মাসুদ শুকনো গলায় বলল, কোনো ঝামেলা হয় নি। একটু দেরি হল আর কি, যন্ত্রপাতির কারবার!
নিশানাথ বাবু বললেন, কোনো ব্যথা পাই নাই।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আসুন তো আমার সঙ্গে, আসুন।
বাসায় চলে যাব। দেরি হয়ে গেছে।
একটু বসে যান। চা খান এক কাপ।
মাথাটা কেমন খালি খালি লাগছে।
ও কিছু না। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তার সাহেব নিশানাথ বাবুকে তাঁর ঘরে নিয়ে বসালেন। কামিজ-পরা মেয়েটি এখনো আছে। তার নাম নাসিমা। আজ তার জন্মদিন। সে অনেক দিন ধরে ভাবছে আজকের দিনটি অন্য রকম ভাবে কাটাবে। যার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে, শুধু তার সঙ্গেই গল্প করবে। ফরহাদ নামের এই ডাক্তারের সঙ্গে গল্প করতে তার ভালো লাগে। শুধু যে ভালো লাগে তাই নয়, অসম্ভব ভালো লাগে। যখন তিনি থাকেন না, নাসিমা মনে মনে তাঁর সঙ্গে গল্প করে। নাসিমা জানে, কাজটা ভালো হচ্ছে না, খুব খারাপ হচ্ছে। তার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই ডাক্তার ফরহাদ বিবাহিত। দুটি ছেলেমেয়ে আছে। ফরহাদ সাহেবের স্ত্রী, যাকে সে এ্যানি ভাবী বলে–তিনিও চমক্কার এক জন মানুষ।
নাসিমা জানে, এই চমৎকার পরিবারে সে ধীরে ধীরে একটা সমস্যার সৃষ্টি করছে। আগে এ্যানি ভাবী তার সঙ্গে অনেক গল্প করতেন। এখন দেখা হলে শুকনো গলায় বলেন কি ভালো? বলেই মুখ ফিরিয়ে নেন। যেন তার সঙ্গে কথা বলা অপরাধ, সে একজন অস্পৃশ্য মেয়ে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, নাসিমা, তুমি বাসায় চলে যাও।
নাসিমার চোখে পানি এসে গেল। আজ তার জন্মদিন। স্কলারশিপের জমান সব টাকা নিয়ে সে এসেছে ফরহাদ ভাইকে নিয়ে সে চাইনিজ খাবে। একটা শাড়ি কিনবে। ফরহাদ ভাইকে বলবে শাড়ির রঙ পছন্দ করে দিতে। তারপর ঠিক সেই রঙের একটা শার্ট সে ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে কিনবে।
নাসিমা, আমার জরুরী কাজ আছে। তুমি এখন যাও। তোমাদের কলেজ কি আজ বন্ধ?
নাসিমা জবাব দিল না। মুখ জানালার দিকে ফিরিয়ে নিল, কারণ চোখ বেয়ে গালে পানি এসে পড়েছে। ডাক্তার সাহেব তা দেখতে পেলেন না। নাসিমা প্ৰায় ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে কোনো একটা চলন্ত ট্রাকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে, কিংবা কোনো একটা দশ তলা দালানের ছাদে উঠে সেখান থেকে ঝাঁপ দিতে।