এমি। অনেক দিন ওকে দেখি না।
আচ্ছা, ওকে আসতে বলব। নিশানাথ চাচার শরীরের অবস্থা নিয়েও ওর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
ওঁর শরীর কি আবার খারাপ হয়েছে?
হুঁ। আজ তো খুব ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার সাহেব বললেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে–
ডাক্তার বললে তাই কর। তবে এই সব করে কিছু হবে বলে মনে হয় না। তাঁর যা হয়েছে তার নাম মৃত্যু রোগ। ভালো হবে আবার খারাপ হবে আবার একটু ভালো হবে, চলতেই থাকবে–আনটিল দ্য ফাইনাল সল্যুশন…
দীপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। কেউ এত সহজ ভঙ্গিতে মৃত্যুর কথা বললে তার ভালো লাগে না। মৃত্যু একটি ভয়াবহ ব্যাপার। সেই মৃত্যু নিয়ে এমনভাবে কথা বলা উচিত নয়।
মহসিন চলে যাবার পরপরই দীপা তৃণাকে টেলিফোন করলেন। তৃণার স্বভাব হচ্ছে টেলিফোন ধরেই হড়হড় করে একগাদা কথা বলা। অন্য কে কী বলছে তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। তুফান মেইলে নিজের সব কথা বলে শেষ করে এক সময় নিঃশ্বাস ফেলে বলবে তারপর আপা, কেমন আছ? সেই প্রশ্নের উত্তরও সে ভালোমতো না শুনেই বলবে, আপা এখন রাখি, কেমন? কারো অসুখবিসুখ নেই তো? খোদা হাফেজ।
আজও তৃণা টেলিফোন তুলেই হড়হড় করে কথা বলে যাচ্ছে, আপা আমি জানি তুমি আমার উপর খুব রাগ করেছ। গত পনেরো দিনে এক বারও তোমাদের খোঁজখবর জিই নি। যা ব্যস্ত ছিলাম বলার না। দুটা সেমিনার হয়েছে। একটা এপিলেন্সির উপর, অন্যটা সাইকেডেলিক ড্রাগ। দুটাই খুব ইন্টারেস্টিং সেমিনার। এত ইন্টারেস্টিং হবে জানলে তোমাকে জোর করে নিয়ে যেতাম। এক আমেরিকান প্রফেসর এসেছিলেন–প্রায় সত্তুরের মতো বয়স–প্রফেসর বার্ন। আমাকে কী বললেন জান? খুব গম্ভীর গলায় বললেন–মিস তৃণা, আমি কি তোমার সঙ্গে অল্প কিছুক্ষণের জন্যে হলেও প্রেম প্রেম গলায় কথা বলতে পারি? এরা কেমন রসিক, দেখলে আপা?
দীপা কোনো রকমে তাকে থামিয়ে বলল, তুই কি আমার এখানে আসতে পারবি?
অবশ্যই পারব। কখন আসব–এখন?
কাল সকালে এলেও হবে। নিশানাথ চাচার ব্যাপারে তোর সঙ্গে পরামর্শ করব।
ওঁর অসুখ কি আরো বেড়েছে?
হুঁ। কি সব আজেবাজে কথা বলে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে, জীবজন্তুর কথা বুঝতে পারে–
ব্রেইন সেলের ডিজেনারেশন হচ্ছে আর কিছু না। আমি সকাল বেলায় চলে আসব। তবে আমাকে দিয়ে তো কিছু হবে না আপা। আমি হচ্ছি ছোট ডাক্তার
হাতের কাছের ডাক্তার সব সময়ই ছোট। যে ডাক্তার অনেক দূরে, তাকেই মনে হয় অনেক বড়।
মাঝে মাঝে তুমি ফিলসফির টিচারের মতো কথা বল, আপা।
ফিলসফির টিচাররা এমন করে কথা বলে, তা তো জানতাম না।
আমি তাহলে রাখি আপা খোদা হাফেজ।–দুলাভাই ভালো আছেন তো?
হ্যাঁ, ও ভালোই আছে,–ও তোর কথা আজ বলছিল—
কি বলছিলেন?
অনেক দিন তোর সঙ্গে দেখা হয় না–তুই রাগ করেছি কিনা এই সব।
তৃণা বিস্মিত গলায় বলল, গতকালই তো দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। রোববারেও দেখা হয়েছে।
তাই নাকি! তা হলে হয়তো ভুলে গেছে।
দুলাভাইকে একটু দাও তো কথা বলি।
ও বাসায় নেই।
কখন ফিরবেন?
রাত এগারোটার দিকে ফিরতে পারে। আবার নাও ফিরতে পারে।
নাও ফিরতে পারে মানে? রাতে কোথায় থাকবেন?
তা তো জানি না। ব্যবসাট্যাবসা নিয়ে কী সব সমস্যা যাচ্ছে।
তৃণা গম্ভীর গলায় বলল, দুলাভাই যদি এগারোটার মধ্যে ফেরেন তাহলে বলবে আমাকে টেলিফোন করতে।
আচ্ছা।
কাল তোমার সঙ্গে দেখা হবে আপা। খোদা হাফেজ।
মহসিন রাত এগারোটার মধ্যে ফিরলেন না। দারোয়ানকে গেটে তালা লাগিয়ে দিতে বলে দীপা শেষবারের মতো নিশানাথ বাবুর খোঁজ নিতে গেলেন।
নিশানাথ চাদর গায়ে দিব্যি ভালেমানুষের মতো বসে আছেন। হাতে স্যুপের বাটি। চামচ দিয়ে স্যুপ তুলে মুখে দিচ্ছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব আনন্দে আছেন।
চাচা, শরীরটা কি এখন ভালো লাগছে?
হ্যাঁ মা। তবে ঘুম-ঘুম ভাব এখনো আছে। স্যুপ খেয়ে আবার শুয়ে পড়ব।
সলিড কিছু খাবেন? ভাত-মাছ? খুব ভালো পাঙ্গাশ মাছ ছিল।
না মা। দাঁত নেই তো তরল খাবার ছাড়া অন্য কিছু খেতে পারি না। গলায় আটকে যায়।
স্যুপটা কি খেতে ভালো হয়েছে?
খুবই ভালো হয়েছে। অতি উত্তম হয়েছে।
কাল তৃণা আসবে। ওর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করব কি করব না। ডাক্তার সাহেব হাসপাতালে নেবার কথা বলছিলেন।
বলুক। আমি এখানেই থাকব। বেশি দিন বাঁচব না, মা। খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহ নিজের ঘরটায় থাকি। পরিচিত জায়গায় মরার একটা আলাদা আনন্দ আছে, মা।
দীপা কিছু বললেন না। কিয়ে রইলেন। কী কুৎসিত দেখাচ্ছে মানুষটাকে, দাঁত নেই, চুললেই, সমস্ত গা ফুলে কী হয়েছে। অথচ এই মানুষের ভেতরটা যে কত সুন্দর তা তাঁর মতো ভালো কেউ জানে না।
দীপা।
জ্বি চাচা।
তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ। ঋণ নিয়ে মরতে ভালো লাগে না। তবে তোমার ঋণের জন্যে আমার খারাপ লাগছে না। দেবী অংশে তোমার জন্ম। দেবীদের কাছে ঋণী থাকা দোষের না।
কথা ঘোরাবার জন্যে দীপা বললেন, খাওয়ার পর কি আমি আপনার জন্যে এক কাপ গরম কফি আনব?
আন।
কফি এনে দীপা দেখলেন চাদর মুড়ি দিয়ে নিশানাথ বাবু ঘুমিয়ে পড়েছেন। দীপা তাঁকে জাগালেন না। অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষটির জন্যে তাঁর চোখ ভিজে উঠল।
তৃণাকে ডাক্তারের এ্যাপ্রনে সুন্দর দেখাচ্ছে
তৃণাকে ডাক্তারের এ্যাপ্রনে সুন্দর দেখাচ্ছে। সাদা রঙের গাম্ভীর্য তার চেহারাতেও পড়েছে। তাকে এখন বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে, তবে ছেলেমানুষি পুরোপুরি কাটাতে পারছে না। নিশানাথের কথাবার্তা যদিও সে বিচক্ষণ ভঙ্গি করে শুনছে, তবু বারবার হাসি আসছে। অনেক কষ্টে সে হাসি সামলাচ্ছে। ঘরে আর কেউ নেই। দীপা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। তৃণাকে বলে গেছেন নিশানাথবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে ব্যাপারটা বুঝতে। তৃণার ধারণা বোঝাবুঝির কিছুই নেই। লোকটির মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। এই বয়সে তা অস্বাভাবিকও নয়। মাথা ঠিক থাকলেই বরং অস্বাভাবিক হত।