নিশানাথ রিকশা থেকে নামবার পর ভাড়ার সঙ্গে আরো ত্রিশ টাকা দিলেন বখশিশ।
রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে তাকাল। তিনি বললেন, মীরপুরের চিড়িয়াখানাটা তোমার স্ত্রীকে দেখিও। খুশি হবে। এখন স্ত্রীর কাছে চলে যাও। জমার টাকা নিশ্চয়ই উঠে গেছে। তাই না? এই টাকাটা হল বাড়তি।
রিকশাওয়ালা ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনে লোকটা কে?
নিশানাথ নিচু গলায় বললেন, কেউ না, আমি কেউ না।
রিকশাওয়ালার বিস্ময় আরো গাঢ় হল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে অতীন্দ্রিয় কোনো রহস্য চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছে।
দীপা দু দিন ধরে
দীপা দু দিন ধরে ব্যাপারটা লক্ষ করছেন। বই নিয়ে ঘরের এক কোণে আলো বসে থাকে। পাতা ওল্টায়। এমন নিবিষ্ট তার ভাবভঙ্গি যে মনে হয় সে সত্যি সত্যি পড়তে পারছে। দীপা জানেন এটা এক ধরনের খেলা। মেয়েটা একা একা এই অদ্ভুত খেলা খেলে। তাঁর কষ্ট হয়। কিন্তু করার কী আছে?
এই মেয়েটির মধ্যে বড়ো কোনো পরিবর্তন এসেছে। রাতে এখন আর মোটই বিরক্ত করে না। একা একা ঘুমুতে চায়। মাকে বলে বাবার ঘরে গিয়ে ঘুমুতে। বলার সঙ্গে মাথাটা এমন ভাবে নিচু করে ফেলে যাতে মনে হয় বাবা-মার একসঙ্গে ঘুমানোর রহস্যের অজানা অংশটি এখন সে জানে।
দীপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন। দারোয়ান এসে খবর দিল–নিশানাথ বাবুর অবস্থা বেশি ভালো নয়, একটু পরপর বমি করছেন।
ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়েছে না?
জ্বি।
খোঁজ নাও এখনো আসছে না কেন।
দারোয়ান মুখ নিচু করে বলল, মাস্টার সাব বাঁচতো না, আম্মা।
দীপা বলেন, কীভাবে বুঝলে মারা যাচ্ছেন?
বোঝা যায় আম্মা, শইলে পানি আসছে। পিঠে চাকা ঢাকা কী যেন হইছে। মাথারও ঠিক নাই, আম্মা।
মাথার ঠিক থাকবে না কেন?
বিড়বিড় কইরা সারা দিন কী যেন কয়। নিজের মনে হাসে।
দীপার বেশ মন খারাপ হল। তিনি হাতের কাজ ফেলে নিশানাথ বাবুকে দেখতে গেলেন। দূর থেকে দেখলেন নিশানাথ বাবু ঘরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তার পাশে আলো। দূর থেকে মনে হচ্ছে তিনি আলোর সঙ্গে কথা বলছেন। এই দৃশ্যটিও অদ্ভুত। আলো অধিকাংশ সময় নিশানাথ বাবুর আশেপাশে থাকে। কেন থাকে কে জানে?
দীপা বারান্দায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই চলে গেল। দীপা বললেন, চাচা, কেমন আছেন।
নিশানাথ বললেন, বেশি ভালো না, মা। তুমি একটু বস আমার সামনে। তোমার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে।
দীপা বসলেন। কোমল গলায় বললেন, বলুন কী কথা।
শুনতে তোমার কেমন লাগবে জানি না। আমার এখন কিছু অদ্ভুত ক্ষমতা হয়েছে। আমি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি। ইচ্ছা করলেই মানুষের মাথার ভেতরও ঢুকে যেতে পারি।
দীপা মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন দারোয়ান মিথ্যা কথা বলে নি–মাথা খারাপেরই লক্ষণ।
দীপা!
জি।
শুধু যে মানুষের কথা বুঝতে পারি তাই না–পশুপাখি, জীবজন্তু সবার মনেই কী হচ্ছে বুঝতে পারি।
ও আচ্ছা।
নিম্নশ্রেণীর জীবজন্তু মানুষদের মতো গুছিয়ে কিছু ভাবে না। ওদের চিন্তাভাবনার সবটাই খাদ্য নিয়ে। অবশ্যি এদের মধ্যে অদ্ভুত কিছু ব্যাপারও আছে। এরা কী মনে করে জান। প্রত্যেকেই ভাবে তারাই জীবজগতের প্রধান। পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের জন্যে, তাদের সুখ সুবিধার জন্যে।
দীপা মৃদু গলায় বললেন, আমরা মানুষরাও তো তাই মনে করি। করি না?
হ্যাঁ করি। কারণ মানুষও তো জন্তুই। জন্তু ছাড়া সে আর কী?
হ্যাঁ, তাও ঠিক।
নিম্নশ্রেণীর পশুপাখিরা মানুষদের কী ভাবে, জান? তারা মানুষদের খুবই বোকা এক শ্রেণীর প্রাণী বলে মনে করে। ওরা আমাদের বোকামি নিয়ে সব সময় হাসাহাসি করে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। ঘরের কোণায় জাল বানিয়ে যে মাকড়সা বসে থাকে সেও মানুষের চরম মুখতা দেখে খিকখিক করে হাসে।
দীপা কিছু বললেন না। খুব সাবধানে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। নিশানাথ বললেন, তুমি বোধ হয় আমার কথা বিশ্বাস করলে না?
দীপা হা-না কিছু বললেন না। দুঃখিত চোখে তাকিয়ে রইলেন।
নিশানাথ বললেন, তোমার মনের ভেতর কী হচ্ছে আমি বলে দিই? তাহলে তুমি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবে।
দীপা বলল, বলুন।
মাথার ভেতর ঢুকতে ইচ্ছা করে না। কেন করে না জান? করে না, কারণ এটা অন্যায়। এটা ঠিক নয়। কিছু না জানিয়ে হুট করে একটা মানুষের ঘরে ঢুকে পড়ার মতো। তাই না, মা?
দীপা পুরোপুরি নিশ্চিত হল মানুষটির মস্তিষ্কবিকৃতির কিছু বাকি নেই। বেচারার সমস্ত শরীর কী কুৎসিত ভাবেই না ফুলে উঠেছে। দেরি না করে তাকে কোনো বড়ো হাসপাতালে কিংবা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া উচিত।
দীপা!
জ্বি।
আমার এই ক্ষমতা মানুষে কাজে লাগানো যায়। কীভাবে যায়, জান?
কী ভাবে?
মানুষের ভেতর মন্দ যে সব ব্যাপার আছে সেগুলি দূর করার জন্যে আমি কাজ করতে পারি।
মানুষ তো একজন দু জন নয়–লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ।
তাও ঠিক। তবে সব মন্দ মানুষকে ভালো বানানোর দরকার তো নেই। এমন সব মানুষদের ভালো করতে হবে যাদের উপর হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্য নির্ভর করে। যেমন ধর রাষ্ট্রপ্রধান, দেশের বড় বড় নেতা।
আপনি ঘুমান, চাচা। আমার মনে হয় আপনার ঘুম দরকার।
নিশানাথ বাবু দীপাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলে চললেন–যত দিন যাচ্ছে ততই অদ্ভুত সব জিনিস আমি জানতে পারছি। আমাদের এই মস্তিষ্ক অদ্ভুত একটা জিনিস। সব রকম স্মৃতি এর মধ্যে আছে। মানুষ যখন হ্যামিবা ছিল সেই স্মৃতিও আছে। আদি প্ৰাণ দীর্ঘকাল কাটাল পানিতে, সেই পানির জগতের স্মৃতিও আছে মানুষের মাথায়। এক সময় এ্যামিবার বিকাশ হল সরীসৃপ হিসেবে। হিংস্র সরীসৃপ, মানুষের আদি পিতা। সেই সরীসৃপের স্মৃতিও সঞ্চিত রইল, মস্তিষ্ক কিছুই হারায় না–।