মেয়েটি একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। বুঝতে চেষ্টাও করছে না। এই কুৎসিত লোকটি তার সব খবর জানে–এটা কী করে সম্ভব তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। ব্যাখ্যার অতীত কোনো কিছুর সামনে দাঁড়ালে আমরা যেমন ভয়ে কুঁকড়ে যাই এও সেরকম।
নিশানাথ বাবু ঘর থেকে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে নাসিমা উঠে চলে গেল। ডাক্তারের দিকে তাকাল পর্যন্ত না। অন্ধ ভয় তাকে গ্রাস করে ফেলছে। সে দ্রুত বাসায় চলে যেতে চায়। বিবাহিত বয়স্ক এই মানুষটিকে তার ভালো লাগে। ভালো লাগে বললে কম বলা হবে। ভালো লাগার চেয়েও বেশি। সে জানে, গোপনে এখানে আসা অন্যায়। খুবই অন্যায়। তবু সে নিজেকে সামলাতে পারে না। আজ এই বুড়ো লোকটির কথা তাকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। শুধু কি কথা? এই বুড়ো লোেকটি কি কথার বাইরেও কিছু করে নি? তার তো মনে হচ্ছে করেছে। কীভাবে করেছে কে জানে? আচ্ছা এই মানুষটা কি কোনো দরবেশ? কোনো বড় ধরনের পীর ফকির?
নাসিমা চলে যাবার পর ডাক্তার সাহেব খানিকক্ষণ একা একা বসে রইলেন। তার পর পরপর দুটো সিগারেট খেয়ে মাসুদকে ডাকলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, বস।
মাসুদ আশ্চর্য হয়ে তাকল। ডাক্তার সাহেবের গলা অন্য রকম লাগছে। গলার স্বরে মমতা মাখানো।
বসতে বললাম তো, বস।
মাসুদ বসল। ডাক্তার সাহেব বললেন, তুমি বয়সে আমার অনেক ছোট, এই জন্যে তুমি বলি। কিছু মনে কর না।
জ্বি না, কিছু মনে করি নি।
তোমাকে বরখাস্ত করার যে চিঠিটা দিয়েছিলাম ওটা ফেলে দাও।
জ্বি আচ্ছা।
রাগের মাথায় আমরা অনেক সময় এটা-ওটা বলি বা করি। এটা মনে। রাখা ঠিক নয়।
জ্বি স্যার।
তুমি যেমন ভুল কর, আমিও করি। হয়তো তোমার চেয়ে বেশিই করি। যেমন এই যে নাসিমা মেয়েটাকে প্রশ্রয় দেওয়া—বিরাট অন্যায়।
বাদ দেন, স্যার।
ভালো একটা মেয়ে অথচ প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে–
শুধু আপনার তো দোষ না স্যার। মেয়েটারও দোষ আছে–ও আসে কেন?
না-না, মেয়েটার কোনো দোষ নেই। বাচ্চা মেয়ে। এদের আবেগ থাকে বেশি। আবেগের বশে–
মাসুদ বলল স্যার, উঠি? সাত-আট জন রুগী এখনো আছে।
তুমি আরেকটু বস। তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।
মাসুদ কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। অনেকক্ষণ ইতস্তত করে ডাক্তার সাহেব বললেন, তুমি কত দিন ধরে আমাকে চেন?
প্রায় সাত বৎসর।
এই সাত বৎসরে তুমি নিশ্চয় আমার আচার-আচরণ আমার মানসিকতা খুব ভালো করেই জান। জান না?
জানি, স্যার।
আমার আজকের ব্যবহার কি তোমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য রকম মনে হচ্ছে না।
হচ্ছে।
এর কারণটা কি?
মাসুদ তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। ডাড়ার সাহেব বললেন, আমার কি মনে হচ্ছে জান? আমার মনে হচ্ছে বুড়ো লোকটি আমাকে কিছু একটা করেছে।
হিপনোটাইজ।
হিপনোটাইজের চেয়েও বেশি। আমার ধারণা, খুব উঁচু মাত্রার ট্যালিপ্যাথিক ক্ষমতা সে ব্যবহার করেছে। নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তবে আমার এ রকম মনে হচ্ছে। আচ্ছা, এই লোকটির মাথার ভেতর দিয়ে কী পরিমাণ রেডিয়েশন গিয়েছে।
আমি তো স্যার বলতে পারব না। টেকনিশিয়ান বলতে পারবে। জেনে আসব।
যাও, জেনে আস।
ডাক্তার সাহেব আবার একটি সিগারেট ধরালেন। তিনি সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করছেন, অথচ আজ এই অল্প সময়ের ভেতর তিনটে সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। মনে মনে ঠিক করে ফেললেন কাল-পরশুর মধ্যে একবার মেডিক্যাল কলেজ লাইব্রেরিতে যাবেন। মস্তিষ্কের উপর রেডিয়েশনের প্রভাব এই জাতীয় কোনো বই পান কি-না তা খোঁজ করবেন। এর উপর কোনো কাজ কি হয়েছে? নিউরো-সার্জনরা বলতে পারবেন। এটা তাঁদের এলাকা। হিটলারের সময় কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পের কিছু বন্দীকে নিয়ে পরীক্ষা চালান
ঠিক এক্সরে না হলেও মোটামুটি ধরনের শক্তিশালী ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ দীর্ঘ সময় ধরে মাথার ভেতর দিয়ে চালানো হয়েছিল। এই পরীক্ষার ফলাফল কখনো প্রকাশ করা হয় নি। অথচ জোর করে বন্দীদের উপর অন্য যে সব পরীক্ষা চালানো হয়েছে তার সব ফলাফলই সযত্নে রাখা আছে। মস্তিষ্কের উপর রেডিয়েশনের প্রভাবের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হল না কেন? রহস্যটা কোথায়?
ডাক্তারের কাছ থেকে বের হয়ে নিশানাথ বাবু একটা রিকশা নিলেন। রিকশায় ওঠার পরপরই তাঁর মনে পড়ল যে কারণে ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন সেটাই পুরোপুরি ভুলে গেছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অতি দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। এর কারণ কী?
এই ডাক্তারের কাছে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হল দাঁতের মাড়ির এক্সরে কপি তোলা। নিশানাথ একজন ডেন্টিস্টের কাছে গিয়েছিলেন। সব দাঁত কেন হঠাৎ করে পড়ে যাচ্ছে এটাই দেখতে চান। ডেন্টিস্ট ব্যাপার দেখে হকচকিয়ে গেল। নিশানাথকে বলল একটা এক্সরে করাতে। যদি তাতে কিছু ধরা পড়ে। সেই উদ্দেশ্যেই এবারে তিনি পলিক্লিনিকে এসেছিলেন, অথচ আসল কথাটিই ভুলে গেলেন।
রিকশা দ্রুত যাচ্ছে। এই রিকশাওয়ালা বেশ বলশালী। সে ঝড়ের বেগে রিকশা নিয়ে যাচ্ছে। নিশানাথ বললেন, আস্তে চলুন ভাই।
রিকশাওয়ালা বলল, টাইট হইয়া বহেন। চিন্তার কিছু নাই।
তিনি রিকশাওয়ালার মনে কী হচ্ছে পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। সে খুব ফুর্তিতে আছে। আনন্দে আছে। তার আনন্দের কারণটিও স্পষ্ট। আজ দেশ থেকে তার স্ত্রী এসেছে। অনেক দিন সে খোঁজখবর নিচ্ছিল না। ভয় পেয়ে তার স্ত্রী (যার নাম মনু) একা একা ঢাকা শহরে চলে এসেছে এবং ঠিকানা ধরে ঠিকই তাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে। রিকশাওয়ালা মুখে খুবই রাগ করেছে। মনুর এক-একা চলে আসাটা যে কীরকম বোকামি এবং ঢাকা শহরটা যে কী পরিমাণ খারাপ তা সে তার স্ত্রীকে বলেছে। তবে মনে মনে সে দারুণ খুশি হয়েছে। এই মুহূর্তে সে ভাবছে ঢাকা শহর পুরোটা সে তার স্ত্রীকে দেখাবে। রিকশায় বসিয়ে বিকাল থেকেই ঘুরবে। হাতে সময় নেই। জমার টাকা তুলে ফেলতে হবে।