নিশানাথ বাবু ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন আছেন?
ডাক্তার সাহেব বললেন, আমি কেমন আছি সেই তথ্যের আপনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আপনি আমার কাছে কী চান সেটা বলুন।
কিছুই চাই না।
কিছুই চান না, তাহলে এসেছেন কেন?
নিশানাথ বাবু মেয়েটির দিকে তাকালেন। এই তো সেই মেয়ে যাকে এত বার স্বপ্নে দেখেছেন। নাসিমা নাম। নিশানাথ বাবু বললেন, কেমন আছ, মা?
মেয়েটি চমকে উঠে বল, আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। ঐ দিন তুমিই তো এখানে ছিলে। ঐ যে তোমার জন্মদিন ছিল। অথচ তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তুমি একটা ট্রাকের সামনে দৌড়ে চলে গেলে। যদি ট্রাকটা না থামত?
ডাক্তার সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, পাগল না-কি এই লোক? হু আর ইউ। গেট আউট, গেট আউট।
নাসিমা কাঁপা গলায় বলল, না, উনি পাগল নন। উনি ঠিকই বলছেন। খুব ঠিক বলছেন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি কে?
আমি আপনার একজন রুগী।
আমার রুণী মানে? রুগীদের সঙ্গে আমার কোনো ব্যাপার নেই। আমি রেডিওলজিস্ট। এক্সরে প্লেট দেখে রিপোর্ট লিখে দিই। সোজাসুজি বলুন তো আপনি কে?
আমার মাথার ভেতর দিয়ে প্রচুর এক্সরে চলে গিয়েছিল। মনে নেই আপনার? তারপর থেকে দেখুন না কী হয়েছে। মাথার চুল পড়ে গেছে। দাঁত পড়ে গেছে। হাতের নখগুলিও মরে যাচ্ছে। এই দেখুন না কেমন কালচে হয়ে গেছে।
আপনি সেই রুগী?
জ্বি, আমিই সেই।
ডাক্তার সাহেব নিজের বিস্ময় গোপন করে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কি উল্টোপাল্টা কথা বলছেন? আমাদের এখানে কারো মাথার ভেতর দিয়ে বেশি এক্সরে পাস করানো হয় না। যতটুকু দরকার ততটুকুই করা হয়। আজেবাজে এলিগেশন এনে আপনার লাভ হবে না।
আপনার ভয় নেই। আমি কোনো অভিযোগ করছি না। নিশানাথ বাবু বুঝতে পারছেন ডাক্তার তাঁর কথা কিছুই বিশ্বাস করছে। না। সে অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে আছে। এই লোকটির মন অবিশ্বাস এবং সন্দেহে পরিপূর্ণ। আচ্ছা, কিছু কি করা যায় না?
এর মাথায় ঢুকে সামান্য কিছু ওলটপালট কি করে দেওয়া যায় না? তিনি যদি তুষারের মাথায় ঢুকে কিছু পরিবর্তন করতে পারেন, তিনি যদি আলোর মতো একটি মূক ও বধির মেয়েকে শেখাতে পারেন, তাহলে এই লোকটিকে কেন পারবেন না? চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। চেষ্টা করে দেখাই যাক না।
ডাক্তারের মাথার ভেতর ঢুকে নিশানাথ বাবু প্রায় দিশা হারিয়ে ফেললেন। কী অসম্ভব জটিলতা! মস্তিষ্কের কুয়োর ভেতর যত নামছেন জটিলতা ততই বাড়ছে। কুয়োর গহিন তলদেশের দিকে তিনি প্রবল টান অনুভব করছেন। যতই নিচে নামছেন আকর্ষণ ততই বাড়ছে। লোকটির চিন্তা-ভাবনার শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত গেছে। ততটা নামাও কষ্ট। বেশ কষ্ট।
একজনের মাথার ভেতর প্রবেশ করবার সঙ্গে সব পরিষ্কার বোঝা যায়। একজন মানুষের মানসিকতা কেমন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্ৰ ইটের বিশাল বিশাল। ইমারত। সেইসব ইমারতে বিচিত্র সব প্যাটার্ন। অদ্ভুত সব নকশা। একজন মানুষের মানসিকতা বদলানর মানে হচ্ছে ঐ সব নকশায় পরিবর্তন নিয়ে আসা। যার জন্য পুরো ইমারতই ভেঙে নতুন করে বানানো দরকার হয়ে পড়ে। নিশানাথ বাবু তা পারলেন। তবে তাঁর অসম্ভব কষ্ট হতে লাগল। মনে হল যেন শরীর অবশ হয়ে আসছে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছেন। এর মধ্যেও কিছু কিছু পরিবর্তনের চেষ্টা করলেন। কাজটা কঠিন, তবে পুরোপুরি অসম্ভব নয়। তার কারণ মানসিকতা পরিবর্তনের ব্যাপারটা কীভাবে করতে হয় তা তিনি জানেন। কেউ তাঁকে শিখিয়ে দেয় নি। তবু তিনি জানেন। কী করে জানেন সেও এক রহস্য।
এক সময় কাজ শেষ হল। নিশানাথ বাবু উঠে দাঁড়ালেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন, যাই, ডাক্তার সাহেব। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। সম্ভবত বাঁচব না।
ডাক্তার সাহেব চুপ করে রইলেন। মুখে কিছু বললেন না, তবে নিশানাথ বাবু পরিষ্কার বুঝতে পারলেন ডাক্তার লজ্জিত বোধ করছেন, কারণ নিশানাথ বাবুর এই সমস্যার মূলে তার এক্সরে মেশিন এবং তিনি ভালো করেই জানেন রেডিয়েশন সিকনেসের সব লক্ষণ নিশানাথ বাবুর মধ্যে প্রকট হয়েছে। তাঁর আয়ু শেষ হয়ে আসছে। কুড়ি মিলিরেমের বেশি রেডিয়েশন এক জনের শরীরের ভেতর দিয়ে চালানো যায় না অথচ এই লোকটির মাথার ভেতর দিয়ে খুব কম করে হলেও দশ হাজার রেম রেডিয়েশন গিয়েছে। হয়তো এই লোকটির থাইরয়েড গ্লা্যান্ড ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। মস্তিষ্কের নিওরোনের বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনও নিশ্চয় হয়েছে।
ডাক্তার সাহেব কেমন যেন লজ্জিত বোধ করতে লাগলেন। তাঁর মনে হতে লাগল, এই মানুষটির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। লোকটির প্রতি তাঁর খানিকটা মায়াও হতে লাগল। কেন এরকম হচ্ছে তাও বুঝতে পারলেন না।
তিনি বললেন, আমরা খুবই লজ্জিত। মানে যন্ত্রটা হঠাৎ ম্যালফাংশান করল। কোনো কারণ ছিল না হঠাৎ সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
নিশানাথ বাবু হেসে বললেন, আমার জন্যে ভালোই হয়েছে। বয়স হয়েছে, এমনিতেই তো মরে যেতাম। অদ্ভুত কিছু জিনিস জেনে গেলাম।
ডাক্তার সাহেব বললেন, কী জানলেন আমাকে কি ভালো করে গুছিয়ে বলবেন? টেলিপ্যাথিক কিছু ক্ষমতা আপনার ডেভেলপ করেছে তা বুঝতে পারছি। ক্ষমতাটা কী ধরনের এটা জানা দরকার।
অন্য একদিন জামবেন। আজ যাই। শরীরটা এত খারাপ লাগছে, বলার না।
নিশানাথ বাবু ঘর থেকে বেরুবার আগে কয়েক মুহূর্তের জন্যে নাসিমা মেয়েটির মাথার ভেতরেও গেলেন। অতি অল্প সময় কাটালেন সেখানে। সামান্য কিছু পরিবর্তন করলেন। বড় কিছু করার সময় তাঁর নেই। কষ্ট হচ্ছে, বড়োই কষ্ট হচ্ছে।