আলো : জানি।
নিশানাথ : লেখার সময় নামগুলি লিখি। সেই লেখার জন্যে আমরা কিছু চিহ্ন ব্যবহার করি। যেমন অ, আ, ই, ঈ–।
আলো : আমি এইগুলি বইয়ে দেখেছি।
নিশানাথ : এই চিহ্নগুলি সাজিয়ে সাজিয়ে আমরা মনের ভাব লিখে ফেলি। তুমি চিহ্নগুলি শিখে ফেতাহলে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে। বই পড়তে পারবে।
আলো : আমাকে চিহ্নগুলি শিখিয়ে দিন।
নিশানাথ : এক দিনে পারব না। ধীরে ধীরে শেখাব।
আলো : আমি এক দিনেই সব শিখে ফেলতে চাই।
নিশানাথ : আজ আমি আর শেখাতে পারব না। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
নিশানাথ বাবু আলোর মাথার ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। অসহ্য যন্ত্ৰণা। তিনি ছটফট করতে লাগলেন। এ রকম তীব্র যন্ত্রণা তাঁর এর আগে আর হয় নি। শুধু যে যন্ত্রণা হচ্ছে তাই নয়–মুখ থেকে লালা ঝরছে। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তিনি গোঙানির মতো শব্দ করতে লাগলেন।
দীপা লক্ষ করলেন, আলো ঘরের এক কোণে একটা বই নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে। বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। তার ভঙ্গি দেখে মনে হয় সে পড়ছে। দীপার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বেচারি আলো পড়া-পড়া খেলা খেলছে। আহা বেচারি, আহা!
রাত দশটার দিকে দারোয়ান এসে খবর দিল স্যার যেন কেমন করছে।
দীপা ছুটে গেলেন। নিশানাথ বাবু বিছানায় বসে আছেন। তাঁর চোখ রক্তবর্ণ। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে।
দীপা বললেন, চাচা আপনার কী হয়েছে?
নিশানাথ বাবু বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না, মা। কিছু বুঝতে পারছি না।
দীপা তৎক্ষণাৎ ডাক্তার আনতে পাঠালেন। তিনি মনে মনে ঠিক করে রাখলেন ডাক্তার দেখে যাবার পর নিশানাথ বাবুকে হাসপাতালে কিংবা
কোনো ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেবেন।
চাচা, আপনার অসুবিধা কী হচ্ছে তা বলুন।
আমি নিজেও বুঝতে পারছি না, মা!
মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে?
হ্যাঁ।
পানি খাবেন একটু?
না। আমার তৃষ্ণা হচ্ছে না।
গরম লাগছে কি? ফ্যান ছেড়ে দেব?
না। ঠাণ্ডা লাগছে।
তাহলে গায়ে একটা চাদর দিয়ে শুয়ে থাকুন। ডাক্তার এক্ষুণি চলে আসবে।
নিশানাথ বাবু গায়ে চাদর জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে এল।
ডাক্তার এসে দেখেন রুগী ঘুমুচ্ছে। তিনি বললেন, ঘুম ভাঙিয়ে কাজ নেই। আমি সকালে এসে দেখে যাব। ভালো ঘুম হচ্ছে যে কোনো রোগের খুব বড় ওষুধ।
ডাক্তার সাহেবের কথা বোধহয় সত্যি। নিশানাথ বাবুর ঘুম ভাঙল ভোরে। তার মাথাব্যথা নেই। শরীর ঝরঝরে। তিনি অনেকক্ষণ বাগানে হাঁটাহাঁটি করলেন।
চা খেতে খেতে মালীর সঙ্গে অনেক গল্প করলেন। সবই তাঁর ছেলেবেলার গল্প। গল্প শেষ করে নিজের ঘরে এসে চিঠি লিখলেন তাপসীকে। তাপসী তাঁর বড়ো বোনের মেয়ে, কোলকাতায় থাকে। বিএ পড়ে। এই মেয়েটিকে তিনি ছোটবেলায় খুব স্নেহ করতেন। দেশ ছেড়ে সে যখন তার মার সঙ্গে চলে যায় তখন তিনি খুব কেঁদেছিলেন।
তাপসী
মা আমার। ময়না আমার। মা গো, তুমি কেমন আছ। আমার শরীর ভালো নেই মা। কি জানি হয়েছে। বেশি দিন আর বাঁচব না। আমার কি যে হয়েছে নিজেও জানি না। খুব কষ্ট হয়। মাথার যন্ত্রণা। এই কষ্ট তবু সহ্য করা যায় কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কষ্ট আমি মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে যেতে পারি–।
এই পর্যন্ত লিখে নিশানাথ থামলেন। তাপসী এই চিঠি পড়ে কী ভাববে? নিশ্চয়ই ভাববে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তিনি আবোলতাবোল ভাবছেন।
নিশানাথ বাবু চিঠি ছিঁড়ে ফেললেন।
মাসুদ মুখ শুকনো করে
মাসুদ মুখ শুকনো করে বসে আছে।
রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।রাগের কারণ হচ্ছে দরজায় নক না করে ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে লেঙ্গয় ডাক্তার সাহেব খুব বিরক্ত হয়েছেন। অন্য সময় হলে বিরক্ত হতেন না, আজ হয়েছেন। কারণ ঐ মেয়ে ঘরে বসে আছে। মেয়েটা বড়ো যন্ত্রণা করছে। কাজের সময় যদি এভাবে বসে থাকে। তাহলে কীভাবে কাজ হয়? সব কিছুর সময়-অসময় আছে। প্রেম খুবই ভালো জিনিস। তাই বলে কাজের সময় কেন? রুগীরা বসে আছে, এক্সরে রিপোর্ট নিয়ে যাবে। ডাক্তার সাহেবের সময় হচ্ছে না।
মাসুদ ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে ইচ্ছা করেই শব্দ না করে ঢুকেছে, যাতে সে অস্বস্তিকর কোনো পরিস্থিতিতে দুজনকে দেখতে পায়, মেয়েটা যেন লজ্জায় পড়ে। লজ্জায় পড়লে আসা-যাওয়া কমাবে। আসা-যাওয়াটা যেন একটু কমায়। কোনো কিছুরই বাড়াবাড়ি ভালো নয়। প্রেমের মতো ভালো যে জিনিস তারও বাড়াবাড়ি খারাপ।
মাসুদ অবশ্যি তাদের কোনো অস্বস্তিকর অবস্থায় দেখল না। দুজনই মুখখামুখি বসে গল্প করছে। খুব সিরিয়াস ধরনের কোনো গল্প হবে, কারণ দু জনের মুখই বেশ গম্ভীর।
ডাক্তার সাহেব মাসুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী চাও?
রিপোর্টগুলি কি হয়েছে স্যার?
হ্যাঁ হয়েছে। নিয়ে যাও। শোন মাসুদ–ঘরে ঢুকবার সময় নক করে তারপর ঢুকবে। এটা হচ্ছে সাধারণ ভদ্রতা।
ডাক্তার সাহেবের কথার জবাবে কিছু না বলে চুপ করে থাকলে ঝামেলা চুকে যেত, মাসুদ তা পারল না। সে বলে ফেলল, কাজের সময় এত কিছু মনে থাকে না, স্যার। রুগী বসে আছে। কতক্ষণ বসে থাকবে বলেন, ওদের তো কাজকর্ম আছে। সারা দিন বসে থাকলে তো তাদের চলে না।
রুগী বসে থাকবার সঙ্গে দরজায় নক করার সম্পর্ক কী? রুগী বসে থাকলে কি দরজা নক করা যায় না?
মনে থাকে না, স্যার।
সাধারণ জিনিস মনে থাকে না, বাকি সব তো মনে থাকে। তোমার আচার-ব্যবহার আমার পছন্দ হচ্ছে না।
অপছন্দের কি করলাম, স্যার?