- বইয়ের নামঃ কুহক
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
রুগীদের বিশ্রামকক্ষ
ঘরের বাইরে বড় বড় করে লেখা—রুগীদের বিশ্রামকক্ষ। নীরবতা কাম্য। দশ ফুট বাই দশ ফুট বর্গাকৃতি ঘর। বেতের এবং প্লাস্টিকের চেয়ারে ঠাসাঠাসি। কাঠের একটা টেবিলে পুরনো ঘেঁড়া কিছু সিনেমা পত্রিকা। তেরো-চৌদ্দ জন রুগী বসে আছে, সবাই নিঃশব্দ, শুধু একজন গোঙানির মতো শব্দ করছে, বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
এ্যাসিস্টেন্ট জাতীয় এক লোক বিরক্ত গলায় বলল, চুপ করে থাকেন। না ভাই। কুঁ কুঁ করছেন কেন? কুঁ কুঁ করলে ব্যথা কমবে?
রুগী কাতর গলায় বলল, একটু তাড়াতাড়ি করেন।
এর চেয়ে তাড়াতাড়ি হবে না। পছন্দ হলে থাকেন। পছন্দ না হলে চলে যান।
এ্যাসিস্টেন্টের নাম মাসুদ। বয়স ত্রিশ। মুখভর্তি বসন্তের দাগ। কটকটে হলুদ রঙের একটা শাটার গায়ে। কিছুক্ষণ পরপর সে নাক ঝাড়ছে। তার মূল কাজ এক্সপ্লেটে নাম্বার বসিয়ে রুগীদের এক্সরে রুমে পাঠিয়ে দেওয়া। সে এই কাজের বাইরেও অনেক কাজ করছে। নাম লেখার সময় সব রুগীকেই খানিকক্ষণ ধমকাচ্ছে, রুগীর সঙ্গে এক্সরে রুমে ঢুকছে, এক্সরে অপারেটরকে একটা ধমক দিচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। কারণ সবাই জেনে গেছে, এই লোকটির হাতেই ক্ষমতা। এই এক্সরে ইউনিট আসলে সে-ই চালাচ্ছে। ডাক্তার এক জন আছেন, তিনি চেম্বার বন্ধ করে বসে আছেন। রুগীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। এক্সরে প্লেট দেখে একটা রিপোের্ট লিখে দেন। দায়িত্ব বলতে এইটুকুই।
আজ ডাক্তার সাহেব সেই দায়িত্বও পালন করছেন না। অল্প বয়স্ক কামিজ-পরা একটি মেয়ে ঘণ্টা দুই হল তার কাছে বসে আছে। ডাক্তার সাহেব দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। বন্ধ দরজা ভেদ করে দুবার খিলখিল হাসির শব্দ পাওয়া গেল।
মাসুদ সেই হাসির শব্দে মুখ কুঞ্চিত করে বলল, শালাব দুনিয়া! প্রেম শুরু হয়ে গেছে। কথাগুলো সে নিচু গলায় বলল না। শব্দ করেই বলল। এতে বোঝা গেল সে কারোর পরোয়া করে না। তার প্রতি রুগীদের যে প্রাথমিক বিরক্তি ছিল, তাও খানিকটা কাটল। যে তার মুনিবের প্রতি সরাসরি এমন কথা বলে সে এ্যান্টি-এ স্টাবলিশমেন্টের লোেক। সবার সহানুভূতি তার প্রতি।
নিশানাথ বাবু আট নম্বর স্লিপ হাতে বসে আছেন। একসময় তাঁর ডাক পড়ল। তিনি প্রেসক্রিপশন হাতে উঠে গেলেন।
মাসুদ কাচের দেয়ালের পাশে বছে। রেলের টিকিটের ঘুমটি ঘরের মতো ছোট্ট জানালা দি.ে তিনি প্রেক্রিপশন বাড়িয়ে দিলেন।
মাসুদ বলল, নাম বলেন।
নিশানাথ চক্রবর্তী।
হিন্দু নাকি?
নিশানাথ হা-সূচক মাথা নাড়লেন, যদিও বুঝতে পারলেন না এই প্রশ্ন করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। তাসুখের আবার হিন্দু-মুসলমান কি?
হয়েছে কী আপনার?
মাথায় যন্ত্রণা।
মাথায় যন্ত্ৰণা তো পেরাসিটামল খেয়ে শুয়ে থাকেন। এক্সরে কী জন্যে?
নিশানাথ বাবু, ইতস্তত করে বললেন, ডাক্তার এক্সরে করতে বলল, সাইনাস আছে কি-না দেখতে চান।
মাসুদ মুখ বিকৃত করে বলল, বিছু একটা হলেই এক্সরে। আরে বাবা এই যন্ত্র যখন ছিল না, তখন কি রুগীর চিকিৎসা হত না? এই সব হচ্ছে পয়সা কামাবার ফন্দি, বুঝলেন?
নিশানাথ কিছু বললেন না। এই রাগী ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। হয়তো আবার ধমক দেবে। এ সুরে করতে এসে এত বার ধমক খাবার কোনো মানে হয় না।
মাসুদ খাতায় নাম তুলতে বলল, সামান্য পেটব্যথা হলে ডাক্তাররা কী করে, জানেন? এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাম, এণ্ডোসকপি, ব্লাড, ইউরিন–শালার দুনিয়া! এইসব না করে একটা ডাব খেয়ে শুয়ে থাকলে কিন্তু পেটব্যথা কমে যায়। যান, ভেতরে যান।
নিশানাথ বাবু ভেতরে ঢুকলেন। ভয়ে ভয়ে ঢুকলেন। তাঁর ভয় করছে। কেন তাও ঠিক বুঝতে পারছেন না।
এক্সরে রুমে আলো কম। তাঁর চোখ ধাতস্থ হতে সময় লাগছে। ব্যাপারস্যাপার দেখে তিনি খানিকটা ভড়কেও গেছেন। অতি আধুনিক যন্ত্র। শরীরের যে কোনো অংশের এক্সরে করা যায়। কম্পুটারাইজড ব্যবস্থা। ছবি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিগেটিভ তৈরি হয়ে বের হয়।
মাসুদ নিশানাথ বাবুর সঙ্গে ঢুকেছে। নিশানাথ বাবু বললেন ব্যথা লাগবে নাকি?
মাসুদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, আগে কখনো এক্সরে করান নি?
ছোটবেলায় একবার করিয়েছিলাম–বুকের এক্সরে।
ব্যথা পেয়েছিলেন?
জ্বি না।
তখন ব্যথা পান নি, তাহলে এখন পাৱে কেন? এক্সরে কিছুই না। এক ধরনের রেডিয়েশন, লাইট। মাথার ভেতর দিয়ে চলে যাবে, টেরও পাবেন না। হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
কী করব?
শুয়ে পড়ুন।
কোথায় শুয়ে পড়ব?
আরে কী যন্ত্রণা! এই বজলু, এঁকে শুইয়ে দে।
বজলু এক্সরে মেশিনের অপারেটর। সে এসে নিশানাথ বাবুকে কোথায় যেন শুইয়ে দিল। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, খুব ঠাণ্ডা লাগছে, ভাই।
মাসুদ বলল, এয়ারকন্ডিশন্ড ঘর, তাই ঠাণ্ডা লাগছে। আপনি খুব যন্ত্ৰণা করছেন। চুপচাপ থাকেন।
জি আচ্ছা।
বজলু এসে সীসার পাতে তৈরি একটা জিনিস নিশানাথ বাবুর ঘাড়ের উপর রাখল। তিনি শুয়েছেন উপুড় হয়ে। কিছু দেখতে পারছেন না, তবে বুঝতে পারছেন, ঘড়ঘড় শব্দ করে ভারী একটা যন্ত্র তাঁর মাথার কাছে চলে আসছে। তিনি সেখান থেকেই বললেন, ভয় লাগছে।
মাসুদ কড়া গলায় ধমক দিল, কচি খোকা নাকি আপনি যে ভয় লাগছে? নড়াচড়া করবেন না, চুপচাপ শুয়ে থাকুন।