মতিয়ুর রহমান সাহেব বললেন, তোর খবর কী রে কুদ্দুস?
কুদ্দুস বিনয়ে মাথা নিচু করে বলল, খবর ভাল স্যার।
একটা কাজ করে দে তো—এই চিঠিটা নিয়ে যা। নাম-ঠিকানা লেখা আছে। হাতে হাতে দিয়ে আসবি।
জ্বি আচ্ছা, স্যার।
জাভেদ সাহেব ইস্টার্ন প্লাজার নয় তলায় থাকেন। ইস্টার্ন প্লাজা চিনিস তো?
জ্বি স্যার, চিনি।
খুবই জরুরি চিঠি। হাতে হাতে দিবি। উনাকে বলবি আমাকে টেলিফোন করতে। আমি অফিসেই থাকব। নে টাকাটা নে, রিকশা করে চলে যা।
মতিয়ুর রহমান সাহেব কুড়ি টাকার একটা নোট বের করে কুদ্দুসের হাতে দিলেন। কুদ্দুস টাকা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হল। রওনা হবার আগে শার্টটা পানি দিয়ে একবার ধুয়ে ফেলতে হবে। কতক্ষণের মামলা? কুদ্দুস বাথরুমের দিকে যাচ্ছে, আবার মতিয়ুর রহমান সাহেবের বেল বেজে উঠল। আবারও কুদ্দুস ছুটে গিয়ে ঢুকল। সম্পাদক সাহেবের ঘরে ঢুকলে কুদ্দুসের মাথা ঠিক থাকে না।
কুদ্দুস। জ্বি স্যার।
রিকশায় যাওয়ার দরকার নেই, দেরি হবে। তুই এক কাজ কর, আমার গাড়ি নিয়ে চলে যা। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।
জ্বি আচ্ছা, স্যার।
রিকশা ভাড়ার টাকাটা ফেরত দেবার জন্যে কুদ্দুস কুড়ি টাকার নোটটা বের করল। মতিয়ুর রহমান সাহেব বললেন, টাকা ফেরত দিতে হবে না। তুই দেরি করিস না। চলে যা।
শার্ট না ধুয়েই কুদ্দুস গাড়িতে উঠল। তার মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। শার্টের এই রঙ তো আর উঠবে না। নতুন শার্ট। মাত্র তিনবার পরা হয়েছে। গাড়িতে উঠে তার আরেকটু মন খারাপ হল—আবার একটা ভুল করা হয়েছে। পত্রিকাটা সাথে নিয়ে এলে হত। গাড়িতে যেতে যেতে কাগজ পড়ার আলাদা একটা মজা আছে। বসনিয়া-হার্জিগোভিনার গরম খবর আছে। আজকের দিনটা ভুল দিয়ে শুরু হয়েছে। আজকের তারিখটা কত যেন? ১৪ এপ্রিল ১৯৯৬, তারিখটা তার জন্যে শুভ না।
লিফটে কুদ্দুস একা। লিফটম্যান তাকে ঢুকিয়ে বোতাম টিপে দিয়ে বলেছে— আট তলায় গিয়ে থামবে। নেমে যাবেন। পারবেন না? কুদ্দুস বলেছে, পারব। তার কথা শেষ হবার আগেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। লিফট চলছে না। স্থির হয়ে আছে। একটা লালবাতি জ্বলছে আর নিভছে। মাথার উপর শার্শা শব্দে ফ্যান ঘুরছে। অদ্ভুত ফ্যান। গায়ে কোন বাতাস লাগছে না। লিফটের ভেতর বিরাট একটা আয়না লাগানো। আয়নার দিকে তাকিয়ে কুদ্দুসের মন খারাপ হয়ে গেল। শার্টের দাগ বিশ্রীভাবে দেখা যাচ্ছে। এখন লন্ড্রিতে দিয়েও লাভ হবে না। টাকা খরচ হবে অথচ দাগ উঠবে না। আচ্ছ, লিফটা চলছে না, ব্যাপারটা কী? লিফটম্যান মনে হয় শুধু দরজা বন্ধ করার বোতাম টিপেছে, ওপরে উঠার বোতাম টিপতে ভুলে গেছে। সে কি সাত লেখা বোতামটা টিপবে? কুদ্দুস। মনস্থির করতে পারছে না। এ কী বিপদে পড়া গেল! আগে জানলে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে উপরে উঠে যেত। আট তলায় ওঠা এমন কোন ব্যাপার না।
পাগল মন গানটার প্রথম লাইনটা কুদ্দুস মনে মনে কয়েকবার গাইল। ইচ্ছে করলে শব্দ করেও গাইতে পারে। লিফটে সে একা। লিফটের ভেতরে গান গাইলে কি বাইরে থেকে শোনা যায়?
হোঁস করে একটা শব্দ হয়ে লিফটের ভেতরটা পুরো অন্ধকার হয়ে গেল। ইলেকট্রিসিটি কি চলে গেল? কুদ্দুসের বুকে ধ করে একটা ধাক্কা লাগল। ঢাকা শহরে কারেন্টের কোন ঠিকঠিকানা নেই। একবার চলে গেলে কখন আসবে কে জানে। লিফটের ভেতর কতক্ষণ থাকতে হবে? লিফটম্যান যে গেছে তারও ফেরার নাম নেই। কী হচ্ছে না হচ্ছে সে খোঁজ-খবর করবে না? এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ভাল না। মতিয়ুর রহমান স্যারের হাতে পড়ত—এক পাচে। ঠিক করে দিত।
কুদ্দুস খুব সাবধানে লিফটের দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দিল। জোরে ধাক্কা দিতে সাহসে কুলুচ্ছে না। কল-কবজার কারবার কী থেকে কী হয় কে জানে? গরম লাগছে। আবার দমবন্ধও লাগছে। কুদ্দুস বেশ উঁচু গলায় ডাকল, লিফটম্যান ব্রাদার, হ্যালো! হ্যালো!
কতক্ষণ পার হয়েছে তাও বোেঝা যাচ্ছে না। কুদ্দুসের মনে হল ঘন্টাখানেকের কম না। বেশিও হতে পারে। সারাদিনে যদি কারেন্ট না আসে তাহলে কী হবে? লিফটের ভেতর থাকতে হবে? কুদ্দুস লিফটের দরজায় আরেকবার ধাক্কা দিল আর তাতেই লিফট চলতে শুরু করল। কারেন্ট ছাড়াই কি চলছে? লিফটের ভেতরটা ঘোর অন্ধকার। কারেন্ট এলে তো বাতি-ফাতি জ্বলত। কিছুই জ্বলেনি। কুদ্দুস মনে মনে বলল, চলুক, কারেন্ট ছাড়াই চলুক। চলা দিয়ে হচ্ছে কথা।
শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। কুদ্দুসের শরীর কাঁপছে। লিফট কি এত দ্রুত ওঠে? এ তো মনে হচ্ছে বাড়িঘর যুঁড়ে আসমানে উঠে যাবে। এত দ্রুত লিফট উঠছে যে কুদ্দুসের পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠছে। যে ভাবে উঠছে তাতে ১০০ তলা ছাড়িয়ে যাবার কথা। এটা মাত্র বার তলা বিল্ডিং। কুদ্দুস আসহাবে কাহাফের আটটা নাম মনে করার চেষ্টা করছে। এদের নাম পড়ে বুকে ফুঁ দিলে মহা বিপদ দূর হয়। বহু পরীক্ষিত। এরা আটজন দাকিয়ানুস বাদশাহর সময়ে পর্বতের গুহায় ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রোজ কেয়ামত পর্যন্ত এরা ঘুমন্ত থাকবে। এদের সাতজন মানুষ, একটা কুকুর। সাতজন মানুষের নাম মনে পড়ছে, কুকুরটার নাম মনে পড়ছে না।
মাকসেলাইনিয়া
মাসলিনিয়া
ইয়ামলিখা
মারনুশ
দাবারনুশ
শযনুষ
কাফাশাত্তাইউশ
কুকুরটার নাম কী?
কুকুরের নাম মনে করতে না পারলে কোন লাভ হবে না। কুকুরের নামশুদ্ধ পড়ে বুকে ফু দিতে হয়। কুদ্দুস প্ৰাণপণে কুকুরটার নাম মনে করার চেষ্টা করছে। চরম বিপদে কিছুই মনে পড়ে না।