তোমার কথা বুঝতে পারছি না–কী করতে চাও?
স্যার, একটু টয়লেটে যাওয়া দরকার।
ও আচ্ছা আচ্ছা, বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন। তুমি তো আমাদের মহা সমস্যায় ফেললে। আমাদের এখানে এরকম কোন ব্যবস্থা নেই।
বলেন কী স্যার!
আমরা দেহধারী প্ৰাণী নই। দেহধারী প্রাণীদের মতো আমাদের খাদ্যের যেমন প্রয়োজন নেই তেমনি টয়লেটেরও প্রয়োজন নেই। এখন তুমি টয়লেটে যেতে চাচ্ছ, আমাদের ধারণা কিছুক্ষণ পর তুমি বলবে খিদে পেয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কী স্যার, খিদে পেয়েছে। সকাল বেলা নাশতা করি নাই। মারাত্মক খিদে লেগেছে। চক্ষুলজ্জার জন্যে বলতে পারি নাই। সকাল থেকে এই পর্যন্ত কয়েক চুমুক চা শুধু খেয়েছি, পত্রিকাও পড়া হয় নাই— আপনাদের এখানে পত্রিকা আছে স্যার?
না, পত্রিকা নেই।
জায়গা তো তাহলে খুব সুবিধার না।
আমাদের জায়গা আমাদের মতো, তোমাদের জায়গা তোমাদের মতো।
আপনাদের তাহলে ইয়ে হয় না?
ইয়ে মানে কী?
পেসাব-পায়খানার কথা বলতেছি—বৰ্জ্য পদার্থ।
না, আমাদের এই সমস্যা নেই। তোমাকে তো একবার বলা হয়েছে। আমরা তোমাদের মতো দেহধারী না। শুধু দেহধারীদেরই খাদ্য লাগে। খাদ্যের প্রশ্ন যখন আসে তখনই চলে আসে বর্জ্য পদার্থের ব্যাপার।
তবু স্যার, আমার মনে হয় বাইরের গেস্টদের জন্য দুই-তিনটা টয়লেট বানিয়ে রাখা ভাল।
দেহধারী কোন অতিথির আমাদের এখানে আসার উপায় নেই।
আপনি তো স্যার একটা মিসটেক কথা বললেন। আমি চলে এসেছি না?
হ্যাঁ, তুমি চলে এসেছ। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কীভাবে এসেছ সেই রহস্য এখনো ভেদ করা সম্ভব হয় নি।
স্যার বিশ্বাস করেন, নিজের ইচ্ছায় আসি নাই। যে দেশে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নাই, পেসাব-পায়খানার উপায় নাই, সেই দেশে খামাখা কি জন্যে আসব বলেন? তাও যদি দেখার কিছু থাকত, একটা কথা ছিল। দেখারও কিছু নাই। স্যার, আপনাদের সমুদ্র আছে?
হ্যাঁ আছে। তবে সে সমুদ্র তোমাদের সমুদ্রের মতো না। আমরা সময়ের সমুদ্রে বাস করি। তোমাদের কাছে সময় হচ্ছে নদীর মতো বয়ে যাওয়া। আমাদের সময় নদীর মতো প্রবহমান নয়, সমুদ্রের মতো স্থির।
মনে কিছু নেবেন না স্যার, আপনার কথা বুঝতে পারি নাই।
সময় সম্পর্কিত এই ধারণা ত্রিমাত্রিক জগতের প্রাণীদের পক্ষে অনুধাবন করা খুবই কঠিন। অংক এবং পদার্থবিদ্যায় তোমার ভাল জ্ঞান থাকলে চেষ্টা করে দেখতাম।
এটা বলে স্যার আমাকে লজ্জা দিবেন না। আমি খুবই মূখ। অবশ্য স্যার মূখ হবার সুবিধাও আছে। মূখদের সবাই স্নেহ করে। বুদ্ধিমানদের কেউ স্নেহ করে না। ভয় পায়। মতিয়ুর রহমান স্যার যে আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করে তার কারণ একটাই আমি মূৰ্খ। বিরাট মূৰ্খ।
ও আচ্ছা।
উনার স্ত্রীও আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। গত ঈদে আমাকে পায়জামা আর পাঞ্জাবি দিলেন। পাঞ্জাবি সিল্কের। এই রকম সিল্ক সচরাচর পাওয়া যায় না, অতি মিহি—এক্সপোর্ট কোয়ালিটি সিল্ক। যা তৈরি হয় সবই বিদেশে চলে যায়। উনাদের কানেকশন ভাল বলে এইসব জিনিস যোগাড় করতে পারে। যাই হোক, পাঞ্জাবি সাইজে ছোট হয়ে গিয়েছিল, সেটা আর উনাকে বলি নাই, মনে কষ্ট পাবেন। শখ করে একটা জিনিস কিনেছেন।
কুদ্দুস।
জ্বি স্যার।
তোমাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে।
এই যে স্যার বললাম—মূখদের সবাই পছন্দ করে। আপনারা বেশি জ্ঞানী, কেউ আপনাদের পছন্দ করবে না। সত্যি কথা বলতে কী স্যার, আপনাদের ভয়ে আমি অস্থির। আপনাদের দিকে তাকাতেও ভয় লাগতেছে।
ভয়ের কিছু নেই আমরা তোমাকে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি।
আপনাদের পা থাকলে স্যার ভাল হত। আপনাদের পা ছুঁয়ে সালাম করতাম।
তোমার প্রতি আমাদের মমতা হয়েছে যে কারণে আমরা এমন ব্যবস্থা করে দিচ্ছি যাতে তোমার নিজের জায়গায় যখন ফিরবে তখন তোমার জীবন আনন্দময় হবে।
বললে হয়তো স্যার আপনারা বিশ্বাস করবেন না, আমি খুব আনন্দে আছি।
আনন্দে থাকলেও তোমার জীবন মোটামুটিভাবে অর্থহীন এটা বলা যায়। জীবন কাটাচ্ছ অন্যের জন্যে চা বানিয়ে।
কী করব স্যার বলেন, পড়াশোনা হয় নাই, ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা দিতে পারলাম না। ইংরেজি সেকেন্ড পেপার পরীক্ষার আগের দিন রাতে বাবাকে সাপে কাটল। চোখের সামনে ধড়ফড় করতে করতে মৃত্যু।
আমরা কী করছি মন দিয়ে শোননা, তোমাকে ফেরত পাঠাচ্ছি ইংরেজি সেকেন্ড পেপার পরীক্ষার আগের দিন রাতে। তুমি সেখান থেকে জীবন শুরু করবে। বাবাকে যাতে সাপে না কাটে সেই ব্যবস্থা করবে।
সেটা স্যার কী করে সম্ভব?
সময় আমাদের কাছে স্থির। আমরা তা পারি। তুমি যখন ফিরে যাবে তখন এখানকার স্মৃতি তোমার থাকবে না। তবে তোমার বাবাকে সাপে কাটবে এই ব্যাপারটা তোমার মনে থাকবে। এটা যাতে মনে থাকে সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। নতুন জীবন তোমার শুরু হচ্ছে। সেখানে তোমার বাবাকে সাপে কাটবে না। তোমার বুদ্ধিবৃত্তিও কিছু উন্নত করে দিচ্ছি। পড়াশোনায় তুমি অত্যন্ত মেধার পরিচয় দেবে।
অংকটা নিয়ে স্যার সমস্যা। অংকটা পারি না। খুব বেড়াছেড়া লাগে।
আর বেড়াছেড়া লাগবে না।
এখন কি স্যার আমি চলে যাচ্ছি?
কিছুক্ষণের মধ্যে যাচ্ছ।
ম্যাডামকে আমার সালাম দিয়ে দেবেন। উনার সঙ্গে দেখা হয় নাই।
ম্যাডামকে তোমার সালাম পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তোমাকে আগে একবার বলেছি আমরা দেহধারী নই। আমাদের মধ্যে নারী-পুরুষের কোন ব্যাপার নেই।