- বইয়ের নামঃ কুদ্দুসের একদিন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
কুদ্দুস চোখ খুলল
কুদ্দুস চোখ খুলল। অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগে চারপাশে ছিল গোলাপি রঙের ধোয়া, এখন বেগুনি ধোঁয়া। আগে কোন শব্দ ছিল না। এখন একটু পর পর সাপের শিসের মতো তীব্র শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শরীরের ভেতরে ঢুকে কলজে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এরচে তো আগেই ভাল ছিল। কুদ্দুস ভেবে পাচ্ছে না সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলবে কি না। চোখ বন্ধ রাখা আর খোলা তো একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে সে মারা গেছে? হার্টফেল করে লিফটের ভেতরই তার মৃত্যু হয়েছে? সে যে জগতে আছে সেটা আর কিছুই না, মৃত্যুর পরের জগৎ। এ রকম তো হয়। কিছু বোঝার আগেই কত মানুষ মারা যায়। সেও মারা গেছে, মৃত্যুর পর তাকে আবার জিন্দা করা হয়েছে। কিছুক্ষণের ভিতর মানকের-নেকের আসবে, তাকে সোয়াল-জোয়াব শুরু করবে—তোমার ধর্ম কী? তোমার নবী কে? এইসব জিজ্ঞেস করবে। এ
কী বিপদ
তুমি কে? কুদ্দুস চমকে চারদিকে তাকালো, কাউকে সে দেখতে পেল না। প্রশ্নটা সে পরিষ্কার শুনলো। তাকেই যে প্রশ্ন করা হচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে। কেমন গম্ভীর ভারি গলা। শুনলেই ভয় লাগে।
এই, তুমি কে?
কুদ্দুস কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, স্যার, আমার নাম কুদ্দুস।
তুমি এখানে কীভাবে এসেছ?
স্যার, আমি কিছুই জানি না। লিফটের ভিতরে ছিলাম। লাফ দিয়ে বের হয়েছি। বাইর হওয়া উচিত হয় নাই। আপনে স্যার এখন একটা ব্যবস্থা করেন। গরিবের একটা রিকোয়েস্ট।
আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি এখানে এলে কী করে?
স্যার আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন। কোথায় আসছি নিজেও জানি না। কীভাবে আসছি তাও জানি না। লিফটের দরজা ভালমত খোলার আগেই লাফ দিয়েছিলাম। এটা স্যার অন্যায় হয়েছে। আর কোনদিন করব না। সত্যি কথা বলতে কী—আর কোনদিন লিফটেও চড়ব না। এখন স্যার ফেরত পাঠাবার একটা ব্যবস্থা করেন। আমি খাস দিলে আল্লাহপাকের কাছে আপনার জন্যে দোয়া করব।
তোমার কোন কিছুই তো আমরা বুঝতে পারছি না। প্রথম কথা হল-মাত্রা কী করে ভাঙলে? মাত্রা ভেঙে এখানে এলে কীভাবে?
স্যার বিশ্বাস করেন, আমি কোন কিছুই ভাঙি নাই। যদি কিছু ভেঙে থাকে। আপনা আপনি ভাঙছে। তার জন্যে স্যার আমি ক্ষমা চাই। যদি বলেন, পায়ে ধরব। কোন অসুবিধা নাই।
তুমি তো বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছ। তুমি কি বুঝতে পারছ ব্যাপারটা কী ঘটেছে?
জ্বি না।
তুমি ত্রিমাত্রিক জগৎ থেকে চতুর্মাত্রিক জগতে প্রবেশ করেছ। এই কাণ্ডটা কীভাবে করেছ আমরা জানি না। আমরা জানার চেষ্টা করছি।
স্যার, ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব।
তোমার কথাবার্তাও তো আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। গোলাম হয়ে থাকব মানে কী?
কুদ্দুস ব্যাকুল গলায় বলল, স্যার, গোলাম হয়ে থাকব মানে হল স্যার আপনার সার্ভেন্ট হয়ে থাকব। আমি মুখ দেখতে পারছি না। মুখ দেখতে পারলে ভয়টা একটু কমতো।
আমরা ইচ্ছা করেই তোমাকে মুখ দেখাচ্ছি না। মুখ দেখালে ভয় আরো বেড়ে যেতে পারে।
স্যার, যে ভয় লিফটের ভিতর পেয়েছি, এরপর আর কোন কিছুতেই কোন। ভয় পাব না। রয়েল বেঙ্গলের খাঁচার ভেতর ঢুকে রয়েল বেঙ্গলকে চুমু খেয়ে আসব। তার লেজ দিয়ে কান চুলকাব, তাতেও স্যার ভয় লাগবে না।
তোমার নাম যেন কী বললে-কুদ্দুস?
জ্বি স্যার, কুদ্দুস।
একটা জিনিস একটু বোঝার চেষ্টা করো–তুমি হচ্ছ ত্ৰি-মাত্রিক জগতের মানুষ। তোমাদের জগতের প্রাণীদের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এই তিনটি মাত্রা আছে। এই দেখে তোমরা অভ্যস্ত। আমরা চার মাত্রার প্রাণী। চার মাত্রার প্রাণী সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই।
স্যার, আপনি আমার মতো বাংলা ভাষায় কথা বলতেছেন, এইটা শুনেই মনে আনন্দ পাচ্ছি। আপনার চেহারা যদি খারাপও হয়, কোন অসুবিধা নাই, চেহারার উপর তো স্যার আমাদের হাত নাই। এটা হল বিধির বিধান।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি আমাকে দেখ।
কুদ্দুসের শরীরে হালকা একটা কাঁপুনি লাগল। হঠাৎ এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া লাগলে যে রকম লাগে, সে রকম। তারপরই মনে হতে লাগলো তার চারপাশে যত বেগুনি রঙ আছে সব তার চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আবার চোখের ভেতর থেকে কিছু কিছু রঙ বের হয়ে আসছে। এ কী নতুন মুসিবত হল।
আচমকা রঙের আসা-যাওয়া বন্ধ হল। কুদ্স তার চোখের সামনে কী একটা যেন দেখল। মানুষের মতোই মুখ তবে স্বচ্ছ কাচের তৈরি। একটা মুখের ভেতর আরেকটা, সেই মুখের ভেতর আরেকটা—এই রকম চলেই গিয়েছে। মুখটার চোখ দুটাও কাচের। সেই চোখের যে কোন একটার দিকে তাকালে তার ভেতরে আর একটা চোখ দেখা যায়, সেই চোখের ভেতর আবার আরেকটা…ঘটনা এই শেষ হলে হত, ঘটনা এইখানে শেষ না। কুদ্দুসের কখনো মনে হচ্ছে ভয়ংকর সে এই মানুষটার ভিতরে আছে, আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে ভয়ংকর এই মানুষটা তার ভেতরে বসে আছে। এই কুৎসিত জিনিসটাকে মানুষ বলার কোন কারণ নেই, মানুষ ছাড়া কুদ্দুস তাকে আর কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
জ্বি না, স্যার। যদি কিছু মনে না করেন—একটু পেসাব করব, পেসাবের বেগ হয়েছে।
কী করবে?
প্রস্রাব করব। আপনাদের বাথরুমটা কোন্ দিকে।