গত দশ দিন ধরে ইরিনাকে একটি করে ভয়ের গল্প পড়তে হচ্ছে। ভয়ংকর সব গল্প। ভূত-প্রেতের গল্প, খুন-খারাবির গল্প। মানসিক রোগীর গল্প। পৃথিবী ংস হয়ে যাওয়ার গল্প। গল্পগুলো প্রাচীন পৃথিবীর মানুষদের লেখা। কেন তারা এসব ভয়াবহ গল্প লিখেছে কে জানে। ইরিনা খেতে খেতে বলল, আজ আমি কোনো গল্প পড়ব না। সহজ গলায় বললেও তার স্বরে ধাতব কাঠিন্য ছিল। এনারোকিক রোবট বলল, আজকের গল্পটি ভয়ের গল্প নয়। আজ তুমি পড়বে হাসির গল্প।
হাসির গল্প?
হ্যাঁ। পৃথিবীতে যে কয়টি সেরা হাসির গল্প আছে, এটি তার একটি। গল্প বললে ভুল হবে, হাসির উপন্যাসের একটি ক্ষুদ্র অংশ।
হাসির গল্প পড়তে ইচ্ছা করছে না।
তোমাকে এটি পড়তে একটি বিশেষ কারণে অনুরোধ করছি। কারণটি হচ্ছে, পৃথিবীর মানুষেরা এটাকে একটি হাসির গল্প মনে করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই গল্প পড়ে প্রাণ খুলে হাসে, কিন্তু আমাদের ধারণা এটা একটা ভয়াবহ গল্প। গল্প পড়ে মানুষদের ভয় পাওয়া উচিত। তারা তা পায় না, তারা হাসে। কেন হাসে এটা আমরা বুঝতে পারি না। তাহলে কি ভয় এবং হাসি- এরা খুব কাছাকাছি। আমরা এই জিনিসটি বুঝতে চাই। তুমি কি খানিকটা কৌতূহল বোধ করছ না?
না, করছি না।
তুমি মিথ্যা কথা বললে। তুমি যথেষ্ট পরিমাণেই কৌতূহল বোধ করছি। মানুষ যখন কৌতূহল বোধ করে, তখন তার নিও ফ্রিকোয়েন্সি সত্ত্বরের মতো বেড়ে যায়। তোমার বেড়েছে। দয়া করে বইটি নাও এবং পড়।
ইরিনা বইটি হাতে নিল। প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই দাগ দেয়া অংশ পড়তে শুরু করল। গোলকধাঁধা নিয়ে গল্প। কয়েকটি মানুষ গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায়। বেরুবার পথ খুঁজে পায় না। এটাই হচ্ছে বিষয়বস্তু। মজার গল্প। পড়তে পড়তে ইরিনা হেসে কুটিকুটি। বইটির নাম এক নৌকায় তিন জন।
গল্প
হ্যারিস জানতে চাইল আমি কখনো হ্যাম্পটন কোটের সেই বিখ্যাত গোলকধাঁধায় গিয়েছি। কিনা। সে বলল, অন্যদের পথ দেখিয়ে দেবার জন্যে এক বার সে গিয়েছিল। গোলকধাঁধার ম্যাপি পড়ে সে বুঝতে পারলা, পয়সা খরচ করে গোলকধাঁধা দেখতে যাওয়া নিতান্ত বোকামি। খুবই সাধারণ।কেন যে মানুষ পয়সা খরচ করে এটা দেখতে আসে, কে জানে। হ্যারিসের এক চাচাতো ভাইয়েরও তাই ধারণা। সে বলল, এসেছ যখন দেখে যাও। এমন কোনো ধাঁধা নয়। যে কোনো বোকা লোকও ভেতরে গিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে বের হয়ে আসতে পারে। জিনিসটা এতই সোজা যে, একে গোলকধাঁধা বলাই অন্যায়। ভেতরে ঢোকার আগে শুধু খেয়াল রাখতে হবে, যখনই বাকি আসবে, তখনি যেতে হবে ডান দিকের রাস্তায়। চল যাই তোমাকে ব্যাপারটা দেখিয়েই আনি। সবার সঙ্গে গল্প করতে পারবে যে হ্যাম্পটন কোটের গোলক ধাঁধায় ঢুকছে।
ভেতরে ঢোকার পরই কয়েকজন লোকের সঙ্গে তাদের দেখা হয়। লোকগুলো ক্লান্ত ও খানিকটা ভীত। তারা বলল, গত এক ঘণ্টা ধরে আমরা শুধু ঘুরপাক খাচ্ছি। আমাদের যথেষ্ট হয়েছে। এখন বেরুতে পারলে বাঁচি। হ্যারিস বলল, আপনারা আমার পেছনে পেছনে আসতে পারেন। আমি খানিকক্ষণ দেখব, তারপর বেরিয়ে যাব।
লোকগুলো অসম্ভব খুশি হল, বারবার ধন্যবাদ দিতে লাগল। তারা হ্যারিসের পেছনে পেছনে হাটতে লাগল। নানান ধরনের লোকজনের সঙ্গে তাদের দেখা হল, গোলকধাঁধার বিভিন্ন অংশে আটকা পড়েছে, বেরুবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। এদের কেউ বেরুবার আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের ধারণা হয়েছিল, জীবনে আর লোকালয়ে ফিরে যাওয়া হবে না। হ্যারিসকে দেখে তারা সাহস ফিরে পেল। আনন্দের সীমা রইল না। প্রায় কুড়ি জনের মতো লোক তাকে অনুসরণ করছে। এদের মধ্যে আছেন কাঁদো কাঁদো মুখে বাচ্চা-কোলে এক মহিলা। তিনি বললেন যে – তিনি ভোর বেলায় ঢুকেছিলেন, আর বেরুতে পারছিলেন না। যে দিকেই যান আবার আগের জায়গায় ফিরে আসেন।
হ্যারিস খুব নিয়মমাফিক প্রতিটি বাঁকে ডান দিকে যেতে লাগল। দশ মিনিটে বাঁক শেষ হবার কথা, কিন্তু ফুরোচ্ছে না। প্রায় দুমাইলের মতো হাঁটা হয়ে গেল।
একটা জায়গায় এসে হ্যারিসের কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হল। মনে হল এই জায়গায় কিছুক্ষণ আগেই একবার এসেছে। এর মানেটা কি? হ্যারিসের চাচাতো ভাই জোর গলায় বলল, সাত মিনিট আগেও একবার এই জায়গায় এসেছি। ঔ তো রুটির টুকরোটা দেখা যাচ্ছে। হারিস বলল, হতেই পারে। না। বাচ্চা কোলে মহিলাটি বললেন, আপনাদের সঙ্গে দেখা হবার আগে এই জায়গাতেই আমি বসেছিলাম। রুটির টুকরোটি আমিই ফেলেছি। ভদ্রমহিলা রাগী দৃষ্টিতে হ্যারিসের দিকে তাকালেন এবং বললেন, আপনি একটি চালাবাজ। গোলকধাঁধা থেকে বেরুবার কৌশল আপনার জানা নেই। হ্যারিস পকেট থেকে ম্যাপ বের করল, এবং বেরুবার পথ কি রকম, তা খুব সহজ ভাষায় সবাইকে বুঝিয়ে দিল। চলুন এক কাজ করা যাক। যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম, সেখানে যাওয়া যাক।
হ্যারিসের কথায় তেমন কোনো উৎসাহ সৃষ্টি হল না। তবুও সবাই বিরক্ত মুখে হ্যারিসের পেছনে পেছনে উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। দশ মিনিট না যেতেই দেখা গেল তার ঠিক আগের জায়গাতেই আছে। ঐ তো রুটির টুকরোটি পড়ে আছে।
হ্যারিস প্ৰথমে ভাবল যে সে এমন ভান করবে যাতে সবাই মনে করে এটাই সে চাচ্ছিল। দলের লোকদের দিকে তাকিয়ে সাহসে কুলালো না। সবাইকে অসম্ভব ক্ষিপ্ত মনে হচ্ছে। হ্যারিসের মনে হল দলপতি হিসেবে তার আগের জনপ্রিয়তা এখন আর নেই।