- বইয়ের নামঃ ইরিনা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
লোকটির মুখ লম্বাটে
লোকটির মুখ লম্বাটে।
চোখ দুটি তক্ষকের চোখের মতো। কোটির থেকে অনেকখানি বেরিয়ে আছে। অত্যন্ত রোগা শরীর। সরু সরু হাত। হাতের আঙুলগুলো অস্বাভাবিক লম্বা। কাঁধে ঝুলছে নীলরঙা চকচকে ব্যাগ। তার দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে একটি বিনীত ভঙ্গি আছে। নিশ্চয়ই কিছু-একটা গছাতে এসেছে।
দুপুরের দিকে এ রকম উটকো লোকজন আসে। এরা কলিং বেল টিপে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে হাত কচলায়। লাজুক গলায় বলে, আমি নিতান্তই একজন দরিদ্র ব্যক্তি, কাটা কাপড়ের টুকরো বিক্রি করি। আপনি কি অনুগ্রহ করে কিছু কিনবেন? কিনলে আমার খুব উপকার হয়।
এই লোক নিশ্চয়ই সে রকম কিছু বলবে। ইরিনা তাকে সে সুযোগ দিল না। লোকটি মুখ খুলবার আগেই সে বলল, আমাদের কিছু লাগবে না। আপনি যান।
লোকটি কিছুই বলল না চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করতে লাগল। ইরিনা কড়া গলায় বলল, বলেছি তো আমাদের কিছু লাগবে না।
আমি কিছু বিক্রি করতে আসি নি।
আপনি কে? কাকে চান আপনি?
আমি কে? তা কি তুমি বুঝতে পারছি না?
ইরিনা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল লোকটির দিকে। লোকটির দাঁড়িয়ে থাকার যে ভঙ্গিটিকে একটু আগেই বিনীত ভঙ্গি মনে হচ্ছিল, এখন সে-রকম মনে হচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে লোকটি ভয়ঙ্কর উদ্ধত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে।
আপনার কি দরকার বলুন?
বাইরে দাঁড়িয়ে কি আর সবকিছু বলা যায়?
বাবা-মা কেউ ঘরে নেই, আপনাকে আমি ভেতরে আসতে বলব না।
লোকটি মেয়েদের রুমালের মত ছোট্ট ফুল আঁকা একটি রুমাল বের করে কপাল মুছল। ইরিনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আপনি কোনো খবর না দিয়ে এসেছেন।
লোকটি বলল, খবর না দিয়ে অনেকেই আসে। জরা আসে, মৃত্যু আসে এবং মাঝে মাঝে গ্যালাকটিক ইন্টেলিজেন্সের লোকজন।
তাহলে আপনি কি-?
লোকটি হাসল। নিঃশব্দ হাসি নয়- বেশ শব্দ করে হাসি। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, হাসির শব্দ অত্যন্ত সুরেলা। শুনতে ভালো লাগে। ইরিনা বলল, আসুন, ভেতরে আসুন।
শুভ দুপুর ইরিনা।
আপনি আমার নাম জানেন?
গ্যালাকটিক ইন্টেলিজেন্সের লোকজন যখন কারোর বাড়ি যায়, তখন বাড়ির লোকজনের নাম জেনেই যায়। সেটাই স্বাভাবিক, তাই না?
ইরিনা কথা বলল না। সে একদৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটি বলল, তুমি কি আমার কার্ড দেখতে চাও? স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমার পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়ার অধিকার তোমার আছে।
আমি কিছুই দেখতে চাই না। আপনি কেন এসেছেন? আমার কাছ থেকে কী জানতে চান?
লোকটি কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, আমি কিছুই জানতে bारे না।
তাহলে এসেছেন কি জন্যে?
তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে।
তার মানে? আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন?
ইরিনা, তুমি কি জান না ইন্টেলিজেন্সের লোকজনদের কোনো প্রশ্ন করা যায় না? বিধি নং চ ২১১/২, তুমি কি এই বিধি জান না? তোমাকে স্কুলে শেখান হয় নি?
হয়েছে।
তাহলে তুমি হয়তো চ ২১১/৩ বিধিটিও জািন।
হ্যাঁ, জানি।
বল তো বিধিটি কি?
ইরিনা যন্ত্রের মতো বলল, আপনি যদি আমাকে কোথাও যেতে বলেন, তাহলে যেতে হবে।
যদি যেতে অস্বীকার কর, তাহলে কি হবে বল তো?
প্ৰথম শ্রেণীর অপরাধ করা হবে।
এই অপরাধের শাস্তি কি জান?
জানি। কিন্তু আমি যাব না। আমার বাবা-মা না আসা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না।
লোকটি ছোটো ছোটো পা পেলে ঘরে মধ্যেই হাঁটছিল। হাঁটা বন্ধ করে চেয়ারে বসল। খুব আরামের একটা নিঃশ্বাস ফেলল। যেন এই বাড়ি-ঘর তার দীর্ঘদিনের চেনা। সে যেন নিতান্ত পরিচিত কেউ। অনেক দিন পর বেড়াতে এসেছে।
ইরিনা আবার বলল, বাবা-মা বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। বাবা-মা না ফেরা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকব।
এই কথাগুলো তুমি পর পর তিনবার বললে। একই কথা বারবার বললে কথা জোরাল হয় না।
লোকটি সিগারেট ধরাল। ছাই ফেলবার জন্যে নিজেই উঠে গিয়ে একটা এ্যাশট্রে আনল। ইরিনার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ কী যেন দেখল, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে খুব সহজ গলায় বলল, তোমার বাবা-মা আর এ বাড়িতে ফিরে আসবে না।
ইরিনা স্তম্ভিত হয়ে গেল। কী বলছে এই লোকটি! সে প্ৰায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি বুঝতে পারছি না, আপনি কি বলতে চান?
ঠিক এই মুহুর্তে তোমার বাবা-মা দুজনেই আছেন খাদ্য দপ্তরে। বেলা তিনটে পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবেন। তারপর তাদের পাঠান হবে প্রথম নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখান থেকে তাদের ঠিক পাঁচটায় নেয়া হবে সেন্ট্রাল কমিউনে। আরো শুনতে চাও?
না।
তুমি বোধ হয় আমার কথা বিশ্বাস করছ না?
না। ইন্টেলিজেন্সের লোকজন কখনো সত্যি কথা বলে না।
এটা তুমি ভুল বললে ইরিনা। শুধু মিথ্যা বললে মিথ্যা ধরা পড়ে যায়। মিথ্যা বলতে হয়। সত্যের সঙ্গে মিশিয়ে। আমরা এক হাজার সত্যি কথার সঙ্গে একটা মিথ্যে কথা ঢুকিয়ে দিই। কারো সাধ্য নেই সেই মিথ্যা ধরে। হা হা হা।
লোকটি সুরেলা গলায় হেসে উঠল। এমন একজন কু-দৰ্শন লোক এত চমৎকার করে হাসে কী করে!
ইরিনা, তুমি কি আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াবে? সেই সঙ্গে কিছু খাবার। আশা করি ঘরে কিছু খাবার আছে।
খাবার নেই। কপি খাওয়াতে পারি।