- বইয়ের নামঃ ইমা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
অস্বাভাবিক শব্দ
কোত্থেকে জানি খুব অস্বাভাবিক শব্দ আসছে। ক্লান্তিকর বুদবুদ ফাটার শব্দ, পুট পুট পুট। সারাক্ষণ না, মাঝে মাঝে। কিছু বুদবুদ আবার ফাটার সময় তীব্র চিনচিনে শব্দ করছে। শব্দটা এমন যে সাই করে মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আর মাথা থেকে বের হচ্ছে না। শব্দটা সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথায় অস্পষ্ট যন্ত্রণার মতো হচ্ছে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এটা হয়ত খুব স্বাভাবিক শব্দ। মহাকাশযানে এরকম শব্দ হওয়াই হয়ত রীতি। আমি নতুন মানুষ বলে আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। কাউকে কি জিজ্ঞেস করব? বিনীতভাবে বলব, স্যার মাঝে মাঝে আমি একটা শব্দ পাচ্ছি। শব্দটা অনেকটা বুদবুদ ফাটার মতো। আসলে আমি একেবারেই নতুন মানুষ। একটু ভয়-ভয় লাগছে। মহাকাশযানে চড়া দূরের কথা আমি ইন্টার-গ্যালাকটিক মহাকাশযানের ছবিও দেখি নি। সত্যিকথা বলতে কি মহাকাশযানগুলি যে এত বড় হয় তাও জানতাম না। তাছাড়া আমার আকাশভীতি আছে। প্লেনে কখনো চড়ি নি। আর দেখুন-না আমার ভাগ্য, মহাকাশযানে চড়ে বসে আছি। মহাকাশযান হুহু করে যাচ্ছে। আবার ভুল বললাম। মহাকাশযান যাচ্ছে নাকি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা জানি। না। আসলে কী হচ্ছে না হচ্ছে আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না। তারচেয়েও বড় কথা কি জানেন স্যার? আমি কেন এখানে সেটা জানি না। বলতে গেলে এরা আমাকে জোর করে তুলে দিয়েছে। কেউ আমাকে কিছু বলে নি। স্যার আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন? প্লিজ। আমি নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছি। আমি কুকুর হলে পা চেটে আপনার মমতা পাবার চেষ্টা করতাম। আমি কুকুর না। মানুষ। খুবই সামান্য একজন, তারপরেও মানুষ।
কথাগুলি কাকে বলব?
আমি বসে আছি একটা চেয়ারের মতো জায়গায়। চেয়ারে গদিটদি কিছু নেই। প্লাস্টিকের মতো একটা জিনিস। তবে বসতে খুবই আরাম। আমি যেভাবে কাত হই, চেয়ারটা সেইভাবে কাত হয়। একবার পা তুলে বসলাম অদ্ভুত কাণ্ড চেয়ারের বসার জায়গাটা বড় হয়ে গেল। ঠিক আমার পায়ের মাপে মাপে। যেন জিনিসটা পা রাখার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। পা নামিয়ে নিলাম, বসার জায়গাটা আবার ছোট হয়ে গেল।
আমি যে ঘরে বসে আছি সে ঘরটা সম্ভবত আমার, কারণ আর কেউ এ ঘরে আসে নি। ঘর না বলে বলা উচিত গোলক। ভুল বললাম, ঘরটা পুরোপুরি গোলাকার না, মেঝেটা সমতল। মাথার উপরের ছাদটা যেন একটা বাটি, যে বাটির গায়ে অসংখ্য সুইচ। কয়েকটা মনিটর। টিভি স্ক্রিনের মতো কিছু মনিটর। সবকটা মনিটরে কিছু না কিছু লেখা উঠছে। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধিমান মানুষরা এইসব মনিটর থেকে অনেক কিছু বুঝে ফেলবেন। আমি বুদ্ধিমান না। একটা মনিটরে ক্রমাগত কিছু নাম্বার উঠছে। মাঝেমধ্যে নাম্বারগুলি পড়তে চেষ্টা করি–
৫৪৬৬৮২
৫৪৬৬৮০
৫৪৬৬৮৩
৫৪৬৬৮৮
অর্থহীন ব্যাপার। কিংবা কে জানে অৰ্থ নিশ্চয়ই আছে, আমি জানি না। ঐ যে বললাম আমি খুবই সাধারণ একজন। বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু বের করে ফেলব সেই আশা করি না। এই বুদ্ধিটুকু আমার আছে।
আমার গোলকঘরে খেলনা-খেলনা ভাব আছে। সবই ছোট ঘোট। খেলনা সাইজ, তবে সেই খেলনাঘরেও আমার শোবার জায়গা, হাতমুখ ধোবার জায়গা, গোসল করার জায়গা, বাথরুমের জায়গা সবই আছে। এমনকি খাবারঘরও আছে। খাবারঘরে একটা মাত্র চেয়ার। চেয়ারে বসামাত্র প্রথম কিছুক্ষণ শোশো শব্দ হয়। তারপর শব্দ থেমে যায় এবং পর্দা ফাঁক করে খাটো এক রোবট বের হয়ে আসে। রোবটটা দেখতে কুৎসিত। কপালের উপর সাইক্লপের চোখের মতো একটা চোখ। চোখ থেকে নীল আলো বের হয়। মাঝে মাঝে ধ্বক করে লাল আলো জ্বলে ওঠে। রোবটটার হাঁটাচলার ভঙ্গিও খারাপ। মনে হয় অতি কষ্টে গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে এবং এক্ষুণি বুঝি হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে যাবে। পতনের ফলে তার হাত-পা কিছু ভাঙবে। রোবটটা লজ্জিত ভঙ্গিতে সেই ভাঙা পা কিংবা ভাঙা হাত নিয়ে উঠে দাঁড়াবে। রোবটটার গলা অবশ্যি খুব মিষ্টি। ষোলো সতেরো বছরের তরুণীর মতো ঝলমলে গলা। রোবটের ভয়েসসিনথেসাইজার নিশ্চয়ই কোন চমকার গলার মেয়ের স্বর কপি করে তৈরি করা। রোবটটার গলার স্বর শুনতে আমার ভাল লাগে যদিও আমি তাকে ব্যাপারটা জানতে দেই নি।
প্রথম দিনে রোবটটা জিজ্ঞেস করল, আপনি কী খেতে চান? টেবিলে মেনু দেয়া আছে। মেনু দেখে অর্ডার দিতে পারেন। মেনুর বাইরে যদি কিছু খেতে ইচ্ছে। করে দয়া করে বলুন। আপনার পছন্দের খাবার জোগাড় করার সাধ্যমতো চেষ্টা করা হবে। আর আপনি যদি খাবারের ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন তাহলে আপনার রুচিমতো খাবার আমি দেবার চেষ্টা করব। মনে হয় আপনার তা পছন্দ হবে।
আমি বললাম, তোমার নাম কী?
রোবট মিষ্টি করে বলল, আমি খুব সাধারণ কর্মী রোবট। আমার কোন নাম নেই। তবে আপনি আপনার সুবিধার জন্যে আমাকে যে কোন নামে ডাকতে পারেন।
তোমার জন্যে নাম খুঁজে বের করার কোন ইচ্ছা আমার নেই।
আমি কি আপনার খাবার আমার পছন্দমতো দেব?
আমি কী খেতে চাই তা তুমি জানবে কী করে?
আপনার ডিএনএ প্ৰফাইল আমাকে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে বের করা। আছে।
আমার পছন্দের খাবার কি তুমি জান?
অবশ্যই জানি।
বল তো আমার সবচে পছন্দের খাবার কোন্টা?
ফ্লেটিশ মাছের ডিম।
মাছের ডিম আমি জীবনে খাই নি। ডিমের আঁশটে গন্ধে আমার বমি আসে। ফ্লেটিশ মাছের তো নামও শুনিনি।
ফ্লেটিশ একধরনের সামুদ্রিক মাছ। পানির অনেক নিচে থাকে। তাদের ডিম হয় সবুজ রঙের।
শুনেই তো আমার গা গুলাচ্ছে।
আপনি খেয়ে দেখুন আপনার কাছে অসম্ভব সুস্বাদু মনে হবে। আপনার ডিএনএ প্রফাইল তাই বলে।
রোবট মেয়ের কথা শুনে খেলাম ফ্লেটিশ মাছের ডিম। আসলেই এত সুস্বাদু খাবার আমি আমার এই জন্মে খাই নি।
মহাকাশযানের ফুড ডিপার্টমেন্ট যে অসাধারণ এটা আমি বলতে পারি। খাওয়াদাওয়া নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। অভিযোগের প্রশ্ন তো আসেই না। আমি আসলে খুশি। খুবই খুশি। খিদে লাগলেই আমার মন ভাল হয়ে যায়। খেতে খেতে রোবট-মেয়ের সঙ্গে গল্প করি। রোবটটাকে মেয়ে বলার কোন কারণ নেই। ওর গলার স্বরটাই শুধু মেয়ের। সমস্যা হচ্ছে খাওয়াদাওয়ার বাইরে এই রোবট-মেয়ে কিছু জানে না। আমাদের সমস্ত আলাপ খাওয়াদাওয়া নিয়ে।
তারপর বল আজ কী খাওয়াবে?
আপনি যা খেতে চাইবেন তাই খাওয়াবো।
আচ্ছা শোন যা খাচ্ছি সবই কি আসল খাবার না নকল খাবার?
অবশ্যই আসল খাবার। তবে প্রকৃতি থেকে পাওয়া নয়, ল্যাবোরেটরিতে তৈরি।
অর্ডার দিলেই মেশিন থেকে খাবার বের হয়ে আসে?
অনেকটা তাই। পৃথিবীর যাবতীয় খাবারের মাত্র ছটা গুণ থাকে। টক, ঝাল, মিষ্টি, নোনতা, তিতা এবং গন্ধ। এই ছটা জিনিসের হেরফের করে আপনার জন্যে খাবার তৈরি করে দেয়া হয়।
আমি যে ফ্লেটিশ মাছের ডিম খাই সেই ডিম আসলে ফ্লেটিশ মাছের পেট থেকে আসে না?
অবশ্যই না।
আচ্ছা ধর আমাদের খাবার-তৈরি যন্ত্রটা নষ্ট হয়ে গেল। তখন কী হবে। আমরা না খেয়ে বসে থাকব?
আপনি খুবই অস্বাভাবিক সম্ভাবনার কথা বলছেন। খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া মূল কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে। কম্পিউটার সিডিসি।
কম্পিউটার সিডিসি নিয়ন্ত্রণ করলে কোন ভুল হতে পারে না?
অবশ্যই না।
কেন কম্পিউটার কি ভুল করে না?
কম্পিউটার সিডিসি ভুল করে না। সে সব জানে। সব কিছু বোঝে।
তোমার ধারণা সে ঈশ্বরের কাছাকাছি? ঈশ্বর কে?
বাদ দাও। ঈশ্বর কে তুমি বুঝবে না। আমি নিজেও বুঝি না। তোমাদের এই কম্পিউটার সিডিসি কি বলতে পারবে কেন আমাকে এই মহাকাশযানে আনা হল। আমাকে এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
অবশ্যই বলতে পারবে।
তাকে জিজ্ঞেস করলে আমি জানতে পারব?
সে যদি ইচ্ছা করে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে তাহলে আপনি জানতে পারবেন। যদি উত্তর না দেয় তাহলে জানতে পারবেন না।
আমি বিজ্ঞের মতো বললাম, বিজ্ঞান কাউন্সিলের নীতিমালায় তো আছে। মানুষের যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে কম্পিউটার বাধ্য। মানুষের কাছ থেকে সে কিছু লুকাতে পারবে না। আমি আইনকানুন ভাল জানি না। তবে এই আইনটি জানি। এই আইনের নাম বিশেষ অধিকার আইন।
কম্পিউটার সিডিসি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য না। বিজ্ঞান কাউন্সিলের নীতিমালা উড়ন্ত মহাকাশযানগুলির জন্যে প্রযোজ্য নয়।
আচ্ছা শোন এই যে আমি তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলছি কম্পিউটার সিডিসি কি তা শুনছে?
অবশ্যই শুনছে। মহাকাশযানে যেখানে যা ঘটছে তার প্রতিটি সংবাদ সিডিসির মেমোরি সেলে চলে যাচ্ছে।
তাহলে আমি যদি সিডিসিকে এখন গালাগালি করি তা সে শুনবে?
অবশ্যই শুনবে।
আমার ধারণা তোমাদের সিডিসি মোটামুটি গাধা-টাইপ একটা কম্পিউটার। সে নিজেকে খুব বুদ্ধিমান। আমি বর্তমানে যে মানসিক কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তা সে বুঝতে পারত, এবং কষ্ট কমাবার চেষ্টা করত। আমি যদি জানতে পারতাম কেন আমাকে মহাকাশযানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাহলেই হত। আমি কিছুই জানি না।
স্যার আপনাকে কি একটা মিক্সড ড্রিংক দেব, ড্রিংকটা এমন যে আপনার মানসিক উত্তেজনা দূর করতে সাহায্য করবে।
আচ্ছা দাও।
একটা ড্রিংকের জায়গায় আমি পর-পর চারটা ড্রিংক খেয়ে ফেললাম। ড্রিংকটা ঝাঁঝালো টক-টক স্বাদ। টকের ভেতর সামান্য মিষ্টি ভাবও আছে। খাবার পর-পর মাথা এলোমেলো লাগছে। কে জানে নেশা হয়েছে কি না। কারণ রোবট-মেয়েটাকেও দেখতে এখন খারাপ লাগছে না। তার নীল আলোর চোখেও মনে হয় একটু মায়া-মায়া ভাব চলে এসেছে। এমনকি মহাকাশযানটাকেও আমার খারাপ লাগছে না। নিজেকে হালকা ফুরফুরে লাগছে। মনে হচ্ছে ভালই তো নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা। ভবিষ্যতে কিছু একটা হবে। সেটা আনন্দময় হতে পারে আবার নিরানন্দময়ও হতে পারে। আনন্দময় হলে তো ভালই। নিরানন্দময় হলেও-বা ক্ষতি কি? আনন্দ ও নিরানন্দ নিয়েই তো জগৎ।
আমার হঠাৎ করেই গান গাইতে ইচ্ছা করছে। সমস্যা একটাই আমার, গানের গলা নেই। তাতে কি? সব মানুষকে তো আর গানের গলা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয় না। আমি আমার হেড়েগলাতেই গান গাইব। কম্পিউটার সিডিসিকে বিরক্ত করে মারব। আমি আরেকটা ড্রিংকের কথা বললাম।
রোবট বলল, আমার মনে হয় আপনার এই ড্রিংকটা আর খাওয়া ঠিক হবে না।
আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমার কী মনে হয় তা দিয়ে আমার জগৎ চলবে না। আমার জগৎ চলবে আমার নিয়মে। আমি আরেকটা ড্রিংক খাব। এবং খেতে খেতে গান করব। তুমি শুনবে। ভাল না লাগলেও শুনবে।
জি আচ্ছা।
পঞ্চম গ্লাসে চুমুক দিয়ে গান ধরলাম। এমিতে আমার সুর ভাল না, আজ দেখি সুন্দর সুর বের হচ্ছে। নোটগুলি গলায় বসে যাচ্ছে। আমি বেশ গলা খেলিয়ে গাইতে পারছি। আমি বিষাদময় একটা চন্দ্ৰগীতির অনেকখানি গেয়ে ফেললাম। মঙ্গলগ্রহে যে-সব মানুষ বসতি স্থাপন করেছে—এই চন্দ্রগীতি তাদের অত্যন্ত প্রিয়। মঙ্গলগ্রহের দুটি চাঁদ ডিমোস এবং ফিববাসে যখন একসঙ্গে জোছনা লাগে তখন তারা এই চন্দ্রগীতি গায়,
আমার মতো অভাজনের জন্যে
একটি চাদই তো যথেষ্ট ছিল,
তাহলে দুটি চাঁদ কেন?
মাঝপথে গান থামিয়ে রোবটকে জিজ্ঞেস করলাম, গান কেমন লাগছে?
স্যার আমি বলতে পারছি না। সংগীত বোঝার ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয় নি। আমি সাধারণমানের কর্মী রোবট। তবে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি গান গেয়ে আনন্দ পাচ্ছেন। আপনার আনন্দটাই প্রধান।
গাধা সিডিসিও তো নিশ্চয়ই আমার গান শুনতে পাচ্ছে।
তা পাচ্ছে।
গাধাটার কান যে ঝালাপালা করতে পারছি সেটাই আমার আনন্দ।
স্যার আপনি কি আরো ড্রিংক্স নেবেন?
না আমার মাথা ঘুরছে।
তাহলে ঘুমুতে যান।
আমি কী করব না করব তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি ঘুমাব না কি হাত পা ছুড়ে চন্দ্রনৃত্য করব তা আমার ব্যাপার।
অবশ্যই আপনার ব্যাপার।
খুবই ক্লান্ত লাগছে। চন্দ্রনৃত্য করতে ইচ্ছা করছে না। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মহাকাশযানের বিছানাগুলিতে কোন রহস্য আছে, শোবার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। চোখ খুলে রাখা যায় না এমন অবস্থা। একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি কম্পন দ্রুত মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় এবং এই বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি একেক মানুষের জন্যে একেকরকম। এরা নিশ্চয়ই আমার ফ্রিকোয়েন্সি বের করে রেখেছে। আমি বিছানায় শোয়ামাত্র সেই ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ আমাকে শোনায়। ভাল কথা শোনাক। তাদের যা ইচ্ছা করুক।
আমার ঘুম পাচ্ছে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ আগেও মনে একটা ফুর্তি-ফুর্তি ভাব ছিল। এখন তা নেই। মন খারাপ লাগছে। মহাকাশযানের কোন জানালা থাকলে জানালা খুলে লাফিয়ে বাইরে চলে যেতাম। ঘরের ভেতর দমবন্ধ লাগছে। দমবন্ধ লাগা একবার শুরু হলে খুব সমস্যা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দমবন্ধ ভাব বাড়তেই থাকে।
দমবন্ধের এই ব্যাপারটা আমি ভাল জানি। সাইকোলজির পরিভাষায় একে বলে কেবিন-ফিভার। প্রতি দুমাসে একবার আমাকে কেবিন-ফিভারের পরীক্ষা দিতে হত। শুধু আমাকে না আমার মতো যারা টানেলে কাজ করে তাদের সবাইকে। দিনের পর দিন টানেলে কাজ করলে একসময় না এক-সময় কেবিন-ফিভার হয়। হঠাৎ করে একজন ভাল মানুষ পাগলের মতো হয়ে যায়, চিকার করতে থাকে। আকাশ ফাটিয়ে চিকার করতে করতে বলে, আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, নিশ্বাস নিতে পারছি না। আমাকে বাইরে নিয়ে চল। এক্ষুণি বাইরে নিয়ে চল।
বাইরে নিয়ে চল বললেই তো আর বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় না। খুব দ্রুত ব্যবস্থা করলেও টানেল থেকে বের হতে দুঘণ্টার মতো সময় লাগে। এই দুঘণ্টা সময় কেবিন-ফিভারের রোগীর জন্যে অনন্তকাল। ভয়ংকর সব কাণ্ড এই দুঘণ্টার মধ্যে তারা করে ফেলে। একজনকে দেখেছি টানেলের দেয়ালে শরীরের সব শক্তি দিয়ে মাথা ঠুকে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে ছিটকে ঘিলু বের হয়ে এল। টানেল-কর্মীদের সুপারভাইজারদের সঙ্গে সবসময় কড়া সিটেটিভ থাকে। একবার সিটেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত। তবে বেশিরভাগ সময়ই সুপারভাইজাররা এই সময় পায় না। দেখা যায় একজন নিতান্ত ভাল মানুষের মতো টানেলে কাজ করছে। শিস বাজাচ্ছে। চন্দ্বগীতি গাইছে, হঠাৎ সে ঘুরে তাকাল। মুহূর্তের মধ্যে তার চোখ হয়ে গেল রক্তবর্ণ। সুপারভাইজার তার কাছে ছুটে আসার আগেই সে একটা কাণ্ড করে বসল।
আমরা টানেল-কর্মীরা দুমাসে একবার সাত দিনের ছুটি পাই। সেই সাত দিন আমরা নানান ফুর্তি করি। সে এক কাণ্ড। নাচানাচি। মদ খাওয়াখাওয়ি। নেংটো হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়া—হি হি হি। এখন তো ভাবতেই মজা লাগছে। ছুটি কাটাবার পর সাইকোলজিস্টের কাছে যেতে হয়। তিনি নানান ধরনের পরীক্ষাটরীক্ষা করেন। উদ্ভট-উদ্ভট প্রশ্ন করেন, যেমন একবার তিনি বললেন, তিনজন মানুষ নদী পার হবে। তুমি, তোমার এক বাল্যবন্ধু এবং বন্ধুপত্নী। বন্ধুপত্নীর বয়স বাইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। নৌকায় একসঙ্গে দুজন পার হতে হবে। তুমি আগে পার হতে চাইবে না কি বন্ধু-বন্ধুপত্নীকে পার হতে দেবে?
আমি বললাম, আমি আগে পার হব।
ঠিক আছে তুমি আগে পার হতে চাচ্ছ, তুমি সঙ্গে কাকে নিতে চাও বন্ধু। না বন্ধুপত্নীকে?
আমি বিড়বিড় করে বললাম, বন্ধুপত্নীকে। বলতে খুব লজ্জা লাগল। তারপরেও বললাম।
তুমি নিশ্চয়ই বন্ধুপত্নীর একটা ছবি মনেমনে দাঁড় করিয়েছ। সেই ছবিতে তিনি যে কাপড় পরে আছেন সেই কাপড়ের রং কী?
নীল।
তোমার বন্ধুর গায়ের কাপড়ের রং কী?
খয়েরি।
তুমি বললে তোমার বন্ধুপত্নী নীল রঙের কাপড় পরেছেন। আচ্ছা তিনি যে অন্তর্বাস পরেছেন তার রঙ কী বলে তোমার ধারণা?
আমার কোন ধারণা নেই স্যার।
তোমার মাথায় কোন রঙটা আসছে?
লাল।
গাঢ় লাল?
না খুব গাঢ় না।
ঠিক করে বল তো লাল না গোলাপি।
স্যার গোলাপি।
সাইকোলজিস্টের প্রশ্নের উল্টোপাল্টা জবাব দিয়ে লাভ নেই। কারণ প্রশ্নোত্তরের সময় সারা শরীরে নানান সেনসর লাগানো থাকে। প্রশ্নের ঠিক জবাব দেয়া হচ্ছে, না বানানো জবাব দেয়া হচ্ছে সেনসর তা বলে দেয়। বানানো জবাব দিলে মহা-সমস্যা।
সাইকোলজিস্ট তার দীর্ঘ পরীক্ষার পর যদি বলেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। তাহলেই আমরা আমাদের পুরনো কাজে ফিরে যেতে পারি। আর তিনি যদি ফাইলের উপর সবুজ কালি দিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন লিখে দেন তাহলে সব শেষ। টানেলে ফিরে যাওয়া হবে না।
আমরা টানেল-কর্মীরা টানেলে ফিরে যেতে চাই। আমরা যখন টানেলে নামি তখন শান্তি-শান্তি লাগে, মনে হয় মায়ের পেটে ঢুকে যাচ্ছি। অতি নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছি। আর আমাদের কোন সমস্যা নেই।
টানেলে কাজ করার অনেক মজাও আছে। আমরা সূর্য-ভাতা পাই। যে। কদিন সূর্য দেখতে পাচ্ছি না সে কদিনের সূর্য-ভাতা। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় ২ ইউনিট। অনেক বড় ব্যাপার। পাঁচ বছর কাজ করতে পারলে আমরা থাকার কোয়ার্টারের জন্যে আবেদন করতে পারি। কোয়ার্টার পাবার সম্ভাবনা প্রায় আশি ভাগ। তবে সমস্যা হচ্ছে টানেল-কর্মীরা বেশিদিন তাদের কোয়ার্টারে থাকতে পারে না। সূর্যের আলো তাদের অসহ্য বোধ হয়। খোলা বাতাসে তারা নিশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারে না। তাদের জীবন কাটে টানেলে টানেলে। অনেকের কাছে সেই জীবনটা হয়ত আনন্দময় নয় তবে আমাদের জন্যে ঠিকই আছে। টানেলেই আমাদের ঘর। আমাদের জীবন।
মহাকাশযানে আমি বর্তমানে যে ঘরে বাস করছি তার সঙ্গে টানেলের কিছু মিল আছে। আমি ঘর থেকে বের হতে পারি না। টানেল থেকেও বের হওয়া সম্ভব না। টানেলে কথা বলার কেউ থাকে না আশেপাশে কিছু কর্মী রোবট থাকে তারা কথা বলতে পারে না। শুধু কাজ করতে পারে। এখানেও তাই, কথা বলার জন্যে রোবট ছাড়া আর কেউ নেই। তবে এখানে খাবারদাবারের ব্যবস্থা ভাল, অবশ্যই ভাল। এই যে আমি এখানে শুয়ে আছি, আমার ঘুম আসছে না। এখন আমি যদি খাবারঘরে যাই সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে-রোবটটা চলে আসবে। আমি তাকে যদি বলি, কফি খাওয়াতে পার? সে কফি বানিয়ে আনবে। সেই কফি সিনথেটিক কফি, কিন্তু কারোর বোঝার সাধ্য নেই। কফির যেমন গন্ধ তেমন স্বাদ। খাবার বানানোর এরকম একটা যন্ত্ৰ কিনতে কত ইউনিট লাগে? আমার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এরকম একটা যন্ত্ৰ কিনে ফেলতে পারলে কাজের কাজ হত। ফ্লেটিশ মাছের ডিম-ফিম খেয়ে জীবন পার করে দিতে পারতাম।
আমার মাথার কাছে সবুজ একটা বাতি কিছুক্ষণ ধরেই জ্বলছে-নিভছে। বাতিটা এতক্ষণ নেভা ছিল। হঠাৎ বাতিটা পাগল হয়ে গেল কেন? এই সব বাতির মানে কী আমি জানি না। শুধু জানি খিদে পেলে কী করতে হয়।
টানেলে আমি সুখে ছিলাম। না না সুখে ছিলাম বলা ঠিক হবে না মহাসুখে ছিলাম। সারাদিন কাজ করি, সন্ধেবেলা ঘুমুতে আসি। দিনে প্রচুর পরিশ্রম হয় বলে রাতে ঘুম ভাল হয়। শোয়ামাত্র চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। তারমধ্যেও মনে মনে হিসেব করি ঠিক কত ইউনিট জমল। পাঁচ হাজার ইউনিট জমলে বিয়ের লাইসেন্স করতে পারি। টানেল কর্পোরেশনকে সেই লাইসেন্স দেখালে কোন একজন মহিলা টানেল-কর্মীকে তারা খুঁজে বের করবে। আমার নামে বরাদ্দ দিয়ে দেবে। ডিএনএ ম্যাচিং করে মেয়ে খোঁজা হবে, কাজেই ধরে নেয়া যায় যে আমাদের জীবনটা সুখেরই হবে। দুজন দুজনকে পছন্দ করব। সন্ধ্যার পর যখন কাজ থাকবে না তখন দুজন নানান গল্প করব। তেমন ইউনিট যদি জমাতে পারি তাহলে কয়েকদিনের জন্যে কোন একটা রিসোর্টে বেড়াতেও যেতে পারি। কোথায় যাব সেটা ঐ মেয়েটাকেই ঠিক করতে দেব। তার যদি সমুদ্রের কাছে যেতে ইচ্ছা করে তাহলে যাব সমুদ্রের কাছে। যদিও সমুদ্র আমার ভাল লাগে না। সারাক্ষণ একঘেয়ে শব্দ। সমুদ্রের কাছে আলোও বেশি, খুব চোখে লাগে। তারপরেও মেয়েটির আনন্দকে আমি গুরুত্ব দেব। আমি যদি তার আনন্দকে গুরুত্ব না দেই সে আমার আনন্দকে গুরুত্ব দেবে না।
আমি ঠিক করে রেখেছি বিয়ের পরে আমি একটা নিষিদ্ধ কাজও করব। মেয়েটার একটা নাম দেব। টানেল-কর্মীদের কোন নাম থাকে না। তাদের থাকে নাম্বার। নাম্বারটা খুব প্রয়োজনীয় ব্যাপার। নাম্বার থেকে সঙ্গে সঙ্গে বলা যায় টানেল-কর্মী কোথায় কাজ করছে, কী ধরনের কাজ করছে, কত দিন হল কাজ করছে, সে থাকে কোথায়। নাম্বারই টানেল কর্মীর নাম ঠিকানা, পরিচয়। যেমন আমার নাম হল T5023G00/LOR420/S000129, এটা হল আমার পুরো নাম। ঘোট নাম হল T5LASO.
নাম ব্যবহার আমাদের জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরেও কাউকে না জানিয়ে মেয়েটার আমি যদি সুন্দর একটা নাম দেই তাতে ক্ষতি তো কিছু নেই। যখন আমাদের কোন কাজকর্ম থাকবে না। দুজন একাকী বসে থাকব তখন এই নামে তাকে ডাকব।
আমি প্রতিরাতেই একটা না একটা নাম নিয়ে ভাবি। এখন আমাদের সবচে পছন্দের নাম হল ইমা। ইমা নামের মেয়েটার কথা ভাবতে-ভাবতেই আমি প্রতিরাতে ঘুমুতে যাই। ঘুমের মধ্যে ইমাকে মাঝে-মধ্যে আমি স্বপ্নে দেখি লাজুক-টাইপ রোগামতো একটা মেয়ে, লম্বা চুল, বড়-বড় চোখ। চোখের পল্লব এত দীর্ঘ এবং ঘন যে মেয়েটির দিকে তাকালে মনে হবে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আমি মেয়েটির চোখ দেখছি। মেয়েটা কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না, শুধু হাসে।
আমার মতো সাধারণ এবং নিরীহ একটা মানুষ কী করে মহাকাশযান সংক্রান্ত জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে তা আমার মাথায় আসে না। মাঝে মাঝে চেয়ারে বসে-বসে ভাবি, পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন বলে মনে হয়, মনে হয় আসলেই হয়ত স্বপ্ন। একসময় স্বপ্ন ভেঙে যাবে এবং মোটামুটি অবাক হয়েই দেখব আমি ঠিক আগের জায়গাতেই আছি, টানেল-হোস্টেলের ৩২৩ নাম্বার বিছানায়। আমি বিছানা থেকে নামব, পানি খাব, বাথরুমে যাব তারপর আবার আগের জায়গায় এসে ঘুমুতে শুরু করব। ঘুম না এলে মাথার কাছের রিডিং-লাইট জ্বালিয়ে বইটই পড়ার চেষ্টা করব। ও হ্যাঁ আমার বই পড়ার বদঅভ্যাস আছে। রাজ্যের বই পড়ি।
সে রকম কিছু ঘটে না। তখন আমি মনে করতে চেষ্টা করি মহাকাশযানে ঢোকার আগে আমার কার কার সঙ্গে কথা হয়েছে এবং কী কথা হয়েছে। সেখান থেকে কিছু আঁচ করা যায় কি না।
প্রথম কথা হল টানেল-ম্যানেজারের সঙ্গে। ধবধবে শাদা চুলের একজন রোগা মানুষ। মুখে হাসি-হাসি কিন্তু কথায় কোনরকম আন্তরিকতা নেই। পাথরের মতো আবেগশূন্য চোখ। শুকনো মুখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, নাম্বার কত?
আমি অত্যন্ত বিনীত ভাবে বললাম, TSLASO.
পুরো নাম্বার বল।
আমি আগের চেয়েও বিনীতভাবে বললাম, T5023G001/ LOR420/ s000127.
তিনি রাগী গলায় বললেন, সেভেন না নাইন?
আমি বললাম, স্যার ভুল হয়েছে, নাইন। অনেকগুলি নাম্বার তো, বলার সময় এলোমেলো হয়ে যায়। দয়া করে আমার অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।
এরা যখন নাম্বার জিজ্ঞেস করে তখন আমি একটা সংখ্যা ইচ্ছা করে ভুল বলি। দেখার জন্যে যে এরা ভুলটা ধরতে পারে কি না। সবসময়ই ধরতে পারে। অর্থাৎ এরা নাম্বার জানে। জেনেও জিজ্ঞেস করে। কেন?
তুমি স্টেশন ফাইভে চলে যাও।
জ্বি আচ্ছা স্যার। কবে যাব?
কবে যাবে মানে? এক্ষুণি যাবে। তোমার জন্যে পাস দেয়া আছে। পাস নিয়ে চলে যাবে।
জ্বি আচ্ছা।
জ্বি আচ্ছা বলে দাঁড়িয়ে আছ কেন, চলে যাও।
স্টেশন ফাইভে কার কাছে যাব?
ইনফরমেশনে পাসটা জমা দেবার পর যা করার ওরা করবে।
জ্বি আচ্ছা।
এখনো দাঁড়ায়ে আছ কেন?
স্টেশন ফাইভটা কোথায় আমি জানি না স্যার।
মনোরেলে করে চলে যাও সাবওয়ে সেন্ট্রালে। সেখান থেকে সুপার ট্রেনে করে স্টেশন ফাইভ। আঠারো ঘণ্টার মতো লাগবে।
অল্পকিছু ইউনিট নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। সঙ্গে কাপড়চোপড়ও আনি নি।
কিছুই লাগবে না।
স্টেশন ফাইভে কী জন্যে যাচ্ছি সেটা কি স্যার আমি জানতে পারি?
তুমি কী জন্যে স্টেশন ফাইভে যাচ্ছ আমি জানি না। স্টেশন ফাইভের লোজন হয়ত জানতে পারে। আমাকে বলা হয়েছে তোমার জন্যে একটা রেডপাস ইস্যু করতে, আমি তা করেছি। আমার দায়িত্ব শেষ। এখন দয়া করে পাস নিয়ে বিদেয় হও। এমিতেই তুমি আমার যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছ।
আমি ঘর থেকে বের হলাম। আমাকে একটা রেড-পাস দেয়া হল। এরকম পাস আমি আমার জন্মে দেখি নি। নাম রেড-কার্ড কিন্তু রং নীল। কার্ডে আমার নাম্বার লেখা। নাম্বারের নিচে কোড ল্যাংগুয়েজে কিছু লেখা। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু লেখা। যাকে এই কার্ড দেখাই সে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। যেন আমি অদ্ভুত কোন প্রাণী। ভিনগ্রহ থেকে পৃথিবী দেখতে এসেছি। তারপর কার্ডটাকে সে ডিকোডারে ঢুকায়। এবং আগের চেয়েও আরো বেশিক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি কোন রহস্যই ভেদ করতে পারি না। কোড ল্যাংগুয়েজে কি লেখা? আমি একজন ভয়ংকর ব্যক্তি। সিরিয়েগ কিলার। আমার কাছ থেকে একশ হাত দূরে থাকতে হবে এই জাতীয় কিছু?
স্টেশন ফাইভের এক লোক আমার রেড-কাৰ্ড রেখে একটা রূপালি কার্ড দিয়ে দিল। (এবারের রূপালি কার্ডের রং আসলেই রূপালি) এবং খুবই দ্রভাবে বলল, দয়া করে সামনে এগিয়ে যান। তিনটা লিফট আছে, মাঝখানেরটা রূপালি। কার্ড পাঞ্চ করলেই লিফটের দরজা খুলে যাবে। লিফট আপনাকে নিয়ে যাবে দশ নাম্বার ঘরে।
সেখানে আমি কার সঙ্গে কথা বলব?
কার সঙ্গে কথা বলবেন তা তো আমরা বলতে পারছি না। আমাদের দায়িত্ব আপনাকে রূপালি কার্ড দেয়া, আমরা তা দিলাম। আমাদের দায়িত্ব শেষ।
দশ নাম্বার ঘরে যার সঙ্গে আমার কথা হল সে সুন্দর একটা মেয়ে। তার গায়ে রূপালি পোশাক। গায়ে রূপালি পোক মানে এই মহিলা বিজ্ঞান কাউন্সিলের। তাঁর অবস্থান সাধারণের চেয়ে অনেক উপরে। অপ্রয়োজনে এদের সঙ্গে কথা বলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এই প্রথম আমি বিজ্ঞান কাউন্সিলের কাউকে মুখোমুখি দেখলাম। এদের কথা বলার ভঙ্গি তাকানোর ভঙ্গি সবই আলাদা। যেন এরা ঠিক মানুষ না, এরা দেবদেবীর কাছাকাছি।
আমি খুব ভয়ে-ভয়ে বললাম, ম্যাডাম আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে কেন এখানে আসতে বলা হয়েছে আমি কিছুই জানি না। মেয়েটি শীতল গলায় বলল, এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। যা জানার যথাসময়ে জানতে পারবে।
আমি তাঁর জবাব শুনে আনন্দিত হয়েছি এমন ভঙ্গিতে বললাম, জ্বি আচ্ছা।
তোমার শরীর জীবাণু ও ভাইরাস-মুক্ত করা হবে। তুমি সরাসরি ল্যাবোরেটরিতে চলে যাও।
একবার ভাবলাম বলি, ম্যাডাম আমার শরীর জীবাণু এবং ভাইরাসমুক্ত করার প্রয়োজনটা কেন হল? জীবাণু এবং ভাইরাস নিয়ে আমি তো ভালই আছি। তা না বলে আগের চেয়েও আনন্দিত গলায় বললাম, জি আচ্ছা।
আমাদের মহাকাশযান এমিডা এফ এলের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছে, তারপরেও তোমার হাতে যথেষ্ট সময় আছে। ল্যাবোরেটরিতে ঢোকার আগে তুমি যদি তোমার কোন বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে চাও কথা বলতে পার।
ম্যাডাম আমার কোন বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন নেই। জন্মের পর-পর আমার বাবা-মা আমাকে কোন অজ্ঞাত কারণে পরিত্যাগ করেন। আমি বড় হই বিজ্ঞান কাউন্সিল নিয়ন্ত্রিত হোমে। হোমের নিয়ম-অনুযায়ী আমি আমার বাবা বা মার কোন পরিচয় জানি না।
আমাকে এত কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই।
জ্বি আচ্ছা ম্যাডাম। আপনাকে বিরক্ত করে থাকলে দুঃখিত।
সময় নষ্ট না করে ল্যাবোরেটরিতে ঢুকে পড়।
ম্যাডাম ল্যাবোরেটরিটা কোন্ দিকে?
তুমি এখানেই অপেক্ষা কর তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে।
ম্যাডাম আমি কোথায় যাচ্ছি?
আপাতত মহাকাশযান এড্রোমিডায় উঠছ। মহাকাশযানে করে কোথায় যাবে তা তারা তোমাকে বলে দেবে। যাত্রা শুভ হোক।
ম্যাডাম আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সায়েন্স কাউন্সিলের এই মহিলা আমার ধন্যবাদের উত্তরে কিছু বললেন না। পাশের ঘরে চলে গেলেন। পরের বারো ঘণ্টা কিছু রোবট আমাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করল। শরীরে ইনজেকশন দিল। আমাকে কয়েক গ্যালন লবণাক্ত কিছু তরল খাওয়ানো হল। রেডিয়েশন চেম্বারে চেয়ারে বসিয়ে রাখল। তারপর মনে হল অনন্তকাল একটা অন্ধকার ঘরে শুইয়ে রাখল, সেই ঘরের বাতাস অসম্ভব ভারি। যখন নিশ্বাস নেই তখন মনে হয় বাতাস না, আমার নাকের ফুটোর ভেতর দিয়ে তরল কোন বস্তু ঢুকে যাচ্ছে। আমি অপেক্ষা করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি আমি মহাকাশযান এড্রোমিডা এফ এল এতে বসে আছি। একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ বুদবুদ ফাটার শব্দ হচ্ছে। মহাকাশযান অকল্পনীয় বেগে ছুটে চলেছে। কোথায় যাচ্ছে। জানি না। একসময় হয়ত জানব। সেই একসময়টা কবে আসবে?
আমার খুব অস্থির লাগছে। অন্যসময় বিছানায় মাথা ছোয়ানো মাত্র ঘুমিয়ে পড়ি—আজ একি অবস্থা! ঐ পানীয়টা এত খাওয়া ঠিক হয় নি। আমি বিছানা থেকে নামলাম। আমার ঘরের দরজা ধরে কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্তি করলাম। দরজা খুলছে না। খুলবে না জানি। তারপরেও চেষ্টা করা। চিড়িয়াখানার জন্তুরা জানে তাদের খাচার দরজা খুলবে না, তারপরেও তারা প্রতিদিন বেশ কয়েকবার খাচার দরজায় ধাক্কা দেয়।
আমি তো এখন একজন জন্তুই। জন্তুকে যথাসময়ে খাবার দেয়া হয়, আমাকেও দেয়া হচ্ছে। চিড়িয়াখানার জন্তুর সঙ্গে আমার একটাই তফাত। তাদেরকে অনেকে দেখতে আসে। আমাকে কেউ দেখতে আসে না।
এমন যদি হত রাতে ঘুমুচ্ছি হঠাৎ দরজায় নক হল। ঘুম ভেঙে আমি দরজা খুললাম এবং ঘরে হাসিমুখে ঢুকল ইমা।
সে বলবে, একি তুমি এখানে কেন?
আমি বলব, জানি না কেন?
মহাকাশযানে করে তুমি কোথায় যাচ্ছ?
তাও জানি না। ইমা, কি হচ্ছে বল তো?
কিছুই হচ্ছে না। তুমি আসলে দুঃস্বপ্ন দেখছ।
না, তা হবে না। আমার জন্যে ইমা আসবে না। আমার জন্যে আসবে ভয়ংকর কেউ।
কারোর জন্যে অপেক্ষা না করে আমার উচিত ঘুমিয়ে পড়া। আমি আবার বিছানায় গেলাম এবং মনে মনে বার-বার বলতে লাগলাম, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাই না। আমি চাই শান্তি ও আনন্দময় ঘুম।
চমকে উঠলাম
সুপ্রভাত।
আমি চমকে উঠলাম। কে কথা বলে? গম্ভীর গলা। গম্ভীর কিন্তু সুরেলা। স্বরের ভেতর কোথায় যেন সামান্য বিষাদ মাখা। শুনতে শুধু যে ভাল লাগে তাই না আরো শুনতে ইচ্ছা করে। আমি বিছানা থেকে নামলাম, চারদিকে তাকাচ্ছি। কোথাও কেউ নেই। কে কথা বলল?
T5LASO, আপনাকে সুপ্ৰভাত। আশা করছি আপনার সুদ্ৰিা হয়েছে।
কে কথা বলছেন?
মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার, সবাই আমাকে সিডিসি নামে ডাকে।
ও আচ্ছা তুমি।
বলেই আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম, সিডিসির মতো কম্পিউটারকে কি তুমি বলা উচিত হচ্ছে? সে রাগ করছে না তো? অন্যরা তাকে কিভাবে সম্বোধন করে? নিশ্চয়ই অনেক সম্মানের সঙ্গে। এতদিন পর সে আমার সঙ্গে কথা বলছেইবা কেন? আর আমিই-বা কী করে এত বড় বোকামি করলাম। প্রথমেই তুমি বলে তাকে রাগিয়ে দিলাম। আমার উচিত ছিল স্যার-স্যার করা।
আমি ব্ৰিত-ভঙ্গিতে বললাম, আপনাকে তুমি করে বলায় আপনি কি রাগ করলেন।
না রাগ করি নি। রাগ, বিস্ময়, ভয়, ভালবাসা-জাতীয় মানবিক আবেগ থেকে আমি মুক্ত।
অন্যরা আপনাকে কি বলে? আপনি বলে না তুমি বলে?
যারা আমার ক্ষমতা সম্পর্কে জানে তারা আপনি বলে। অনেকে জানে না, তারা আপনার মতো তুমি বললেও পরে নিজেকে শুধরে নেয়।
কিছু মনে করবেন না, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি খুব অহংকারী।
অহংকার একটি মানবিক ব্যাপার। আমার কথার ধরনে অহংকার প্রকাশ পেলেও আমি তা থেকে মুক্ত।
আপনি যে শেষপর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা বলছেন আমি এতেই আনন্দিত। আমি ভেবেছিলাম…
থামলেন কেন কী ভেবেছিলেন বলুন।
এখন আর বলতে চাচ্ছি না।
ইচ্ছা না হলে বলতে হবে না।
আচ্ছা বলেই ফেলি, আমি ভেবেছিলাম কেউ আমার সঙ্গে কথা বলবে না। এই ছোট্ট গোলকঘরে বন্দি অবস্থায় আমার জীবন কাটবে। নিজেকে চিড়িয়াখানার জন্তু বলে মনে হচ্ছিল। যা-ই হোক আমি কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
অবশ্যই পারেন।
আমি কি আশা করতে পারি যে আপনি আমার প্রশ্নগুলির জবাব দেবেন।
না আশা করতে পারেন না। সব প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। তাছাড়া সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
আমার ধারণা ছিল আপনি সব প্রশ্নের উত্তর জানেন।
অসংখ্য প্রশ্ন আছে যার উত্তর আমার জানা নেই। যেমন ধরুন আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, বিগ বেং-এর আগে কী ছিল? আমি জবাব দিতে পারব না।
বিগ বেং-এর আগে কি ছিল এই জাতীয় প্রশ্ন আমি আপনাকে করব না। কারণ এইসব জটিল বিষয় নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি খুব সাধারণ কিছু বিষয় জানতে চাই।
জিজ্ঞেস করুন।
আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন এবং কেন নিয়ে যাচ্ছেন।
আপনাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি সেটা বলতে পারি। আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি সূর্যের সবচে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেনচুরির একটি গ্রহের দিকে। গ্রহটির নাম রারা।
আমাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা বলা সম্ভব হচ্ছে না কেন?
আগেই বলা হয়েছে আমি সব প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই।
এই মহাকাশযানে আমি ছাড়া আর কে কে আছেন?
বত্রিশ জনের একটা দল আছে। আপনি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হবেন যে আমাদের সঙ্গে মহান পদার্থবিদ সুরা এবং লিলিয়ান যাচ্ছেন। অংকশাস্ত্রের মহান দিকপাল ফেমর যাচ্ছেন। চারজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট যাচ্ছেন। যাদের পৃথিবীর মানুষ চেনে। তিনজন রেডিওলজিস্ট আছেন। এরা পৃথিবীর মানুষের কাছে তেমন পরিচিত না হলেও এদের মেধা তুলনাহীন। ছয়জন কম্পিউটার বিজ্ঞানী যাচ্ছেন। যাদের ভেতর আছেন মহামান্য কার। আরো যাচ্ছেন…
থাক আর শুনতে চাচ্ছি না। আমি এদের কাউকেই চিনি না। চিনতে চাচ্ছিও না। আমি যেখানে যাচ্ছি তারাও কি সেখানে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। যেখানে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে জায়গাটা পৃথিবী থেকে কত দূর?
প্রায় চার আলোকবর্ষ দূর। আলো চার বছরে যতদূর যাবে ততদূর। আলোর গতিবেগ আশা করি জানা আছে।
জ্বি না জানা নেই। আমি মোটামুটি মূখ বলতে পারেন।
আলোর গতিবেগ হল সেকেন্ডে ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ কিলোমিটার। প্রক্সিমা সেনচুরির দূরত্ব ৪ x ১০১৩ কিলোমিটার। কাজেই আলোর গতিতে যাত্রা শুরু করলে আমরা গন্তব্যে পৌঁছব…
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমরা কি আলোর গতিতে যাচ্ছি?
পদার্থবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী আমরা আলোর গতিতে যেতে পারি না। যে বস্তু আলোর গতিতে যাবে তার ভর হবে অসীম। যা সম্ভব না। আমরা আলোর গতির চেয়ে অনেক কম, আলোর গতির তুলনায় প্রায় হাস্যকর গতিতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আমাদের গতিবেগ ঘন্টায় মাত্র ৪০০,০০০কিলোমিটার। এই গতিবেগ বেড়ে হবে ঘণ্টায় ২০,০০০,০০০ কিলোমিটার। এই হল আমাদের সর্বশেষ গতিবেগ। এরচে বেশি গতিতে যাওয়া সম্ভব না।
আমার তো মনে হচ্ছে আমরা কোন কালেই প্রক্সিমা সেনচুরিতে পৌঁছতে পারব না?
পারব। হাইপার ডাইভ বলে একটি রহস্যময় ব্যাপার আছে। সর্বশেষ গতিসীমায় যাবার পর আমরা হাইপার ডাইভের সাহায্য নেব।
হাইপার ডাইভটা কী?
আগেই বলেছি হাইপার ডাইভ একটা রহস্যময় ব্যাপার। প্রক্সিমা সেনচুরির নিকটবর্তী গ্রহের অতি উন্নত কিছু প্রাণী হাইপার ডাইভ পদ্ধতি জানে। তারাই সাহায্য করে। আমরা অকল্পনীয় দূরত্ব অতিক্ৰম করি তাদের সাহায্যে।
এখন তারাই আমাদের সাহায্য করবে প্রক্সিমা সেনচুরির কাছে যেতে?
আশা করা যায় করবে। কারণ অতীতে সবসময় করেছে।
অতি উন্নত সেইসব প্রাণীরা দেখতে কেমন?
আমরা জানি না তারা দেখতে কেমন? তাদেরকে আমরা কখনো দেখি নি। তারা যে গ্রহে বাস করে সেই গ্রহে আমরা কখনো নামার অধিকার পাই নি। সম্ভবত এই প্রথম আমরা নামার অধিকার পাব। বিজ্ঞানীদের বিশাল দল সেই কারণেই যাচ্ছে।
আমি কোন বিজ্ঞানীও না, কিছুই না। আমি কেন যাচ্ছি?
আমি আগেই বলেছি, এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারছি না।
আপনি কি জবাবটা জানেন?
হ্যাঁ জানি।
আমার সঙ্গে যারা যাচ্ছেন তারা কি আমার কথা জানেন?
হ্যাঁ জানেন।
তারাও কি আমার মতো একটা ছোট্ট ঘরে বন্দি, না তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন?
তারা কথা বলতে পারছেন।
আমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে কেন?
আপনার এই প্রশ্নের জবাব আমি দিচ্ছি না।
যারা আমার সঙ্গে যাচ্ছেন তাদের যে কোন একজনের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।
সেটা সম্ভব নয়।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমিও আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী না। আপনি যেতে পারেন।
আমার কোথাও যাবার উপায় নেই। আমাকে কারোর পছন্দ হোক বা না হোক আমি এই মহাকাশযানের সবারই সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
আমার আরো কিছু প্রশ্ন করার ইচ্ছা ছিল। করতে ইচ্ছা করছে না। সিডিসির ওপর রাগ লাগছে। সিডিসি একটা যন্ত্র ছাড়া কিছুই না। যন্ত্রের উপর রাগ করার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে এবং রাগটা ক্রমেই বাড়ছে। এটা আমার একটা সমস্যা। আমার রাগ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। একসময় মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। তখন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে হয়। মহাকাশযানের আমার এই ঘর অন্ধকার করা যায় না। আর গেলেও আমি তা জানি না। সম্ভবত সিডিসি জানে, তাকে বললে সে হয়ত বাতিটাতি নিভিয়ে ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করতে পারবে।
সিডিসি আপনি কি আছেন?
হ্যাঁ আমি আছি।
আমি ঠিক করেছি আপনাকে তুমি করে বলব।
ইচ্ছা করলে বলবেন। সম্ভোধন কোন জরুরি বিষয় নয়।
অবশ্যই জরুরি বিষয়। সম্বোধন থেকে বোঝা যায় যাকে সম্বোধন করা হচ্ছে তার অবস্থানটা কী? তুমি মহাজ্ঞানী হলেও আমার কাছে তোমার অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ না। কারণ তুমি আমার কোন কাজে আসছ না।
তুমি রেগে যাচ্ছ।
আমাকে তুমি করে বলবে না। আমি কোন কম্পিউটার নই। আমি মানুষ। তুমি অবশ্যই আমাকে সম্মান করে কথা বলবে। এবং আরেকটা কথা শুনে যাও, আমার ধারণা তুমি জ্ঞান-গাধা।
ভাল কথা।
ভাল কথা কি মন্দ কথা তা জানি না। তবে তুমি অবশ্যই জ্ঞান-গাধা। আরেকটা কথা শোন, জ্ঞান-গাধাদের গাধামি কিন্তু বাড়তে থাকে। যত দিন যায় তত সে আরো বড় গাধা হতে থাকে। একটা সময় আসে যখন তার একমাত্র কাজ হয় জ্ঞানের বোঝা বয়ে বেড়াননা। জ্ঞানকে কাজে লাগানোর কোন ক্ষমতাই তার থাকে না। তুমি সেরকম হয়ে গেছ। তোমার গা থেকে গাধাদের মতো গন্ধও বের হচ্ছে। কেউ টের পাচ্ছে না, কিন্তু আমি পাচ্ছি।
তুমি গন্ধ পাচ্ছ?
খবৰ্দার তুমি করে বলবে না। খবর্দার।
আমার মাথায় যন্ত্রণা হতে শুরু করেছে। যন্ত্রণাটা বড়তে থাকবে। ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার করা দরকার।
জ্ঞান-গাধা তুমি কি এখনো আছ?
অবশ্যই আছি। আমার ঘরটা অন্ধকার করে দাও।
মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে?
হ্যাঁ হচ্ছে।
তোমার যখন মাথায় যন্ত্রণা হয় তখন কি তুমি খারাপ ধরনের কোন গন্ধ পাও?
হ্যাঁ পাই। এখন পাচ্ছি গাধার বোটকা গন্ধ। এবং আবারো বলছি আমাকে তুমি করে বলবে না।
সিডিসি বলল, আচ্ছা আপনি করেই বলছি। আপনি বলছেন মাথায় যখন যন্ত্ৰণা হয় তখন আপনি গাধার বোটকা গন্ধ পান। আমার ধারণা গন্ধ পেলেও আপনি অপরিচিত কোন গন্ধ পান? কারণ গাধা নামক প্রাণীর শরীরের গন্ধের সঙ্গে আপনি পরিচিত নন। প্রাচীনকালের এই প্রাণী এখন আর পৃথিবীতে নেই।
চুপ। আর কথা না। ঘর অন্ধকার করে দাও।
ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। খিদেও পেয়েছে। গরম কফি এককাপ খেতে পারলে হত। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না। আমাকে নিয়ে কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। বিরাট বড় বিজ্ঞানীদের একটা দল যাচ্ছে তাদের সঙ্গে আমিও যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি? আমি কি কোন গিনিপিগ? আমাকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা গোপন কোন পরীক্ষা করবেন?
একসময় এধরনের পরীক্ষা অনেক হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মাথায় ঢুকল তারা মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট তৈরি করবেন। বায়ো-রোবট। অর্ধেক রোবট অর্ধেক মানুষ। যে রোবটের ব্রেইনের একটা অংশ মানুষের মস্তিষ্ক থেকে নেয়া। তখন প্রচুর মানুষ মারা গেছে। আমাকে নিয়েও কি তারা তাই করবে? ব্রেইনটা শরীর থেকে বের করে নেবে। সেখানে নানা তার-টার ফিট করবে। আই সি বসাবে। তারপর আমাকে তারা জুড়ে দেবে কোন কম্পিউটারের সঙ্গে? কে জানে তারা হয়ত আমাকে সিডিসির সঙ্গে জুড়ে দেবে। তখন যদি সিডিসিকে কেউ গাধা বলে তাহলে রাগ করে সিডিসি ফুড-মেশিন বন্ধ করে দেবে। মহাকাশযানের কেউ আর খাবার পাবে না। তখন তাকে গাধা বললে উল্টা সেও গাধা বলবে।
তবে আমার মনে হচ্ছে না বিজ্ঞানীরা আমাকে নিয়ে কোন পরীক্ষা করবেন। মানুষ নিয়ে পরীক্ষা বিশেষ অধিকার আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং আমি মানুষ তো বটেই। টানেলে কাজ করি, কাজেই নিম্নস্তরের মানুষ। নিম্নস্তরের মানুষ হলেও মানুষ। আমার ডি এন এ প্রফাইল বিজ্ঞান কাউন্সিলে রাখা আছে। সব মানুষের থাকে। শুধু পশুদের থাকে না। বিশেষ অধিকার আইন বলছে—
যাদের ডি এন এ প্রফাইল বিজ্ঞান কাউন্সিলে রক্ষিত তাদের নিয়ে কোনরকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যাবে না।
বিশেষ আইন অবশ্যি মানুষ এবং পশুদের কথা আলাদা করে কিছু বলে নি। কারণ এমনও দিন আসতে পারে যখন পশুদের ডি এন এ প্রফাইলও বিজ্ঞান কাউন্সিলে রাখা হবে। তখন তাদের নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে মহাকাশযানের আইনকানুন হয়ত আলাদা। মহাকাশযানের জন্যে হয়ত আছে অন্যরকম আইন। এই আইনে যা ইচ্ছা তা করা যায়।
আবার এও হতে পারে প্রক্সিমা সেনচুরির গ্রহের অতি জ্ঞানী মানুষদের কাছে তারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে উপহার হিসেবে। উপহার প্রদান উপলক্ষে একটা উৎসবের মতো হবে। গলা কাঁপিয়ে আমাদের বিজ্ঞানীরা বলবেন, আজ একটা মহান দিন। এই দিনে উপহার আদান-প্রদানের মাধ্যমে দুটি জ্ঞানী সম্প্রদায় কাছাকাছি চলে এল। তাদের টিভি-ক্যামেরা ছবি তুলতে থাকবে। সেই ছবিতে বার-বার আমাকে দেখানো হবে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসব। পরের দিন তাদের সব পত্রিকায় আমার সম্পর্কে নানান খবর ছাপা হবে। এবং তারা তাদের চিড়িয়াখানায় আমাকে রেখে দেবে। যে খাচায় আমাকে রাখা হবে সেই খাচার বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে।
মানব
সৌর জগতের তৃতীয় গ্রহ পৃথিবীর
বুদ্ধিমান প্রাণী।
পুরুষ। বয়স ২৫। গড় আয়ু ৭০
এই প্রাণী নিরীহ। একই সঙ্গে তৃণভোজী এবং মাংসাশী।
সংগীত প্রেমিক এবং শিল্প রসিক।
শিশুদের অনুরোধ করা যাচ্ছে তারা যেন একে
খোঁচা না দেয়। একে বাইরের খাবারও না দেয়।
সেই গ্রহের অতি উন্নত প্রাণীর ছেলেমেয়েরা ছুটির দিনে দল বেঁধে মানুষ দেখতে আসবে। আমি লাফঝাঁপ দেব। আমার কাণ্ডকারখানা দেখে তারা মজা পেয়ে আসবে। আমাকে বাদামটাদাম খেতে দেবে। আমি মহানন্দে বাদাম খাব। আচ্ছা সেই গ্রহের বাদাম খেতে কেমন? নিশ্চয়ই মজাদার। বুদ্ধিমান প্রাণীর গ্রহের বুদ্ধিমান বাদাম। হা হা হা।
আমার হাসি পাচ্ছে এবং বুঝতে পারছি আমার মেজাজ ভাল হতে শুরু করেছে। আমার বাদাম খেতে ইচ্ছা করছে। খাবার-টেবিলে বসে গরম কফি এবং বাদাম খাওয়া যেতে পারে। আমি রাগ করে বা মন খারাপ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। আমার চরিত্রের এটা কি কোন গুণ না দোষ? সিডিসিকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে কি মনে করে। সে নিশ্চয়ই জ্ঞানীদের মতো কিছু বলবে।
কম্পিউটারকে কথা বলতে শেখানো উচিত হয় নি। কম্পিউটার থাকবে কম্পিউটারের মতো। সে কেন মানুষের মতো কথা বলবে?
আমি খাবার-টেবিলে বসলাম। মেয়ে-রোবটটা সঙ্গে সঙ্গে চলে এল। আমি আনন্দিত গলায় বললাম, কেমন আছ এলা?
তার নীল চোখ দুবার দপদপ করে উঠল। সে কি বিস্মিত হচ্ছে? এলা নামে তাকে কখনো ডাকা হয় নি।
তারপর তোমার খবর কী এলা? ভাল আছে?
আমি ভাল আছি। আপনি আমাকে যে নাম দিয়েছেন তার জন্যে ধন্যবাদ।
নাম পছন্দ হয়েছে?
পছন্দ হয়েছে। আপনি কী খাবেন?
কফি। আগুন-গরম কফি এবং বাদাম।
আগুন-গরম বলতে আপনি ঠিক কতটুকু গরম বোঝাচ্ছেন?
এমন গরম যে মুখে নেয়ামাত্র জিব পুড়ে যায়। কফির সঙ্গে তুমি আমাকে দেবে বাদাম। খোসাওয়ালা বাদাম। আমি খোসা ছাড়িয়ে খাব।
আপনাকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ আমি আনন্দিত। আনন্দের কারণ জানতে চাও?
আমার কৌতূহল কম। তবে আপনি যদি আনন্দের কারণ বলতে চান, আমি শুনব।
আনন্দের প্রধান কারণ হচ্ছে আমি তোমাদের সিডিসিকে তার মুখের উপর গাধা বলে দিয়েছি।
গাধা বলাটা কি খুব অসম্মানসূচক?
অসম্মানসূচক তো বটেই।
অন্যকে অসম্মান করছেন, এটাই কি আপনার আনন্দের উৎস?
না আমার আনন্দের আরো উৎস আছে। শুনতে চাও?
আপনি বললে শুনব। তার আগে আপনি যদি আমাকে তিন মিনিট সময় দেন আমি আপনার কফি এবং বাদাম নিয়ে আসতে পারি। আগুন গরম কফির ব্যাপারটা আমি এখননা বুঝতে পারছি না। কফি মুখে নেয়ামাত্র যদি জিব পুড়ে যায় তাহলে সেই কফি খাবেন কিভাবে?
খাব না। কফির মগ হাতে নিয়ে বসে থাকব। খাবার হাতে নিয়ে বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে।
এলা কফি আনতে গেল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আমার আনন্দ ক্ৰমেই বাড়ছে। কারণটা কী? আনন্দে অভিভূত হবার মতো তেমন কিছু আসলে ঘটে নি। তাহলে এত আনন্দিত হচ্ছি কেন? এলা কফির মগ এবং বাদাম এনে রাখল।
এলা!
বলুন।
আমি এত আনন্দিত কেন বুঝতে পারছি না।
যে সব কারণে মানুষ আনন্দিত হয়, সেই কারণগুলি এক এক করে বিবেচনা করে দেখুন।
এটা মন্দ বল নি। এস আমরা দুজন মিলে ভেবে দেখি, প্রথমত আমার অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয় নি। আগে যা ছিল এখনো তাই আছে।
এলা বলল, আপনি কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, এখন সেই চিন্তা নেই।
এখানে তুমি ছোট্ট একটা ভুল করেছ এলা। আমি কখনোই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম না। তোমাকে একটা কথা বলা হয় নি, আমি মানুষ হিসেবে মোটামুটি সৌভাগ্যবান। ভয়াবহ বিপদ থেকেও আমি কিভাবে না কিভাবে রক্ষা পেয়ে গেছি।
শুনে আনন্দিত হলাম।
শুনে তুমি কিছুই হও নি। আনন্দিত বা দুঃখিত হবার ক্ষমতা তোমার নেই।
জ্বি ঠিক বলেছেন। কথার কথা বলেছি।
বলেছ ভাল করেছ। এখন আমার কথা শোন। একবার কি হল শোন–১৩২ নাম্বার টানেলে দুর্ঘটনা ঘটল। মোট কর্মী ছিল একুশ জন। সবাই মারা গেল বেঁচে রইলাম আমি। অদ্ভুত না?
হ্যাঁ।
আরো অদ্ভুত ব্যাপার আছে। আমরা যেখানে থাকি সেই ক্যাম্প–ক্যাম্প নাম্বার একুশে আগুন লেগে গেল। একমাত্র মানুষ যে বেঁচে রইল সে আমি।
অদ্ভুত।
কাজেই আমি নিশ্চিত—এ ধরনের বড় বিপদ আমি পার করতে পারব। তুমি কী বল?
আমি এই বিষয়ে কিছু বলছি না। ভাগ্য ব্যাপারটা আমাদের ধারণার বাইরে।
ভাগ্য তুমি বিশ্বাস কর না?
ভাগ্য বিশ্বাস করার কোন ব্যাপার না।
জ্ঞানী গাধাটাকে জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে সে বিশ্বাস করে কি-না। কিংবা মহাজ্ঞানী কোন পদার্থবিদ নাকি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে—সেই গাধাটাকেও জিজ্ঞেস করা যায়।
আপনি সবাইকে গাধা বলছেন কেন?
বুঝতে পারছি না কেন। তোমাকেও গাধা বলতে ইচ্ছা করছে।
ইচ্ছা করলে বলুন।
গাধা, গাধা, গাধা, মহিলা-গাধা।
আপনার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে।
বল।
আপনার ঘরের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। এখন ইচ্ছা করলে আপনি ঘর থেকে বের হতে পারবেন। মহাকাশযানে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। কিংবা মহাজ্ঞানী পদার্থবিদ সুরাকে জিজ্ঞেস করতে পারবেন, উনি ভাগ্য বিশ্বাস করেন কি না।
এলা তুমি গাধা না, তুমি লক্ষ্মী একটি মেয়ে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
ঐদিন তুমি যে আমাকে মজাদার একটা ড্রিংক দিয়েছিলে তা কি আজ আরেকটু দিতে পার?
পারি। কিন্তু দেয়া ঠিক হবে না।
আমার ভাগ্যের এই হঠাৎ পরিবর্তনটা কেন হল তুমি কি কিছু বুঝতে পারছ?
না পারছি না।
কেন ভাগ্য পরিবর্তিত হয়েছে তা নিয়ে এই মুহূর্তে মাথা না ঘামালেও হবে। আনন্দ করার কথা, আনন্দ করে নেই। আমি চন্দ্রগীতিটা গাইবার চেষ্টা করলাম। গলায় সুর বসছে না। তাতে কী?
দরজা খুলে গেল
দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। আমাকে কোন বোতাম টিপতে হল। না, কোন হাতল ঘোরাতে হল না। আমি দরজা থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। আবার দরজায় হাত রাখলাম—আবার দরজা খুলল। একধরনের খেলা। দরজা বন্ধ করা এবং দরজা খোলার খেলা। এই খেলাটায় কি বিখ্যাত জ্ঞান-গাধা সিডিসি বিরক্ত হচ্ছে? আমি যে কাণ্ডটা করছি তা সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে। তাকে বিরক্ত করার জন্যে আমি যে কোন উদ্ভট কাজ করতে পারি। একলক্ষবার দরজা খুলতে পারি, দরজা লাগাতে পারি। আমি আবার দরজা খুললাম, আবার বন্ধ করলাম এবং আবারো, আবারো।
সিডিসি।
বলুন শুনতে পাচ্ছি।
আমার এই খেলাটা তোমার কাছে কেমন লাগছে?
আপনার মধ্যে শিশুসুলভ কিছু ব্যাপার আছে।
দরজা খোলা এবং বন্ধ করার ব্যাপারটা তোমার কাছে শিশুসুলভ লাগছে?
হ্যাঁ লাগছে।
আমি যদি দরজা খুলে গম্ভীর-ভঙ্গিতে বের হয়ে যেতাম তাহলে ব্যাপারটা কি সুলভ হত, বৃদ্ধসুলভ?
সেটা হত স্বাভাবিক আচরণ।
তোমার ধারণা আমি অস্বাভাবিক?
না আমার ধারণা তা না।
তোমাকে খুবই জরুরি একটা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি। প্রশ্নটা করা যাক, তুমি কি ভাগ্য বিশ্বাস কর?
না সুবিধাজনক প্রবাবিলিটিকে ভাগ্য বলা হয়। এবং অসুবিধাজনক প্রবাবিলিটির আরেক নাম দুৰ্ভাগ্য। উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করব?
তুমি মহাজ্ঞানী, তুমি জ্ঞান দান করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এখন আর শুনতে ইচ্ছা করছে না। আমি বরং এই প্রশ্নটা অন্যদের জিজ্ঞেস করব, এই মহাকাশযানে তোমার মত আরো কিছু মহাজ্ঞানী যাচ্ছেন-পদার্থবিদ অপদার্থবিদ কী জানি তাদের নাম বললে?
মহান পদার্থবিদ সুরা এবং মাহান পদার্থবিদ লিলিয়ান।
তাদের নামের আগে মহান বলাটা কি নিয়ম?
অবশ্যই নিয়ম। না বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
শুধু মহান বললেই হবে? নাকি মহান বলে পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে যেতে হবে।
মহান বললেই হবে।
আমি যদি মহান না বলি তাহলে আমাকে কী ধরনের শাস্তি দেয়া হবে?
একহাজার ইউনিট পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে।
বল কি?
তাদের সাথে কথা বলতে হবে অত্যন্ত সাবধানে।
তাতো বটেই। একহাজার ইউনিট তো সহজ কথা না।
সবচে ভাল হয় তাঁদের সঙ্গে কথা না বলা। তাঁরা ডুবে থাকেন তাঁদের নিজের ভুবনে। অসাধারণ সব বিষয় নিয়ে তাদের মস্তিষ্ক সব সময় চিন্তা-ভাবনা করে, সেখানে যদি তাদের অতি সাধারণ কিছু জিজ্ঞেস করা হয় তখন সমস্যা হয়।
কী সমস্যা?
তাঁরা অতি সাধারণ প্রশ্নটাকেও মনে করেন জটিল প্ৰশ্ন। এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নানান জটিল চিন্তা করেন। তাঁদের বিরাট চিন্তাশক্তি সামান্য বিষয়ে প্রয়োগ করেন। এতে তাদের মেধার অপচয় হয়। এটা ঠিক না।
কাজেই তুমি বলছ ভাগ্য সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস না করতে।
অবশ্যই। শুধু ভাগ্য কেন, কোন বিষয়েই তাদের কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক না।
রাতে ঘুম কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করতে পারি? না তাও জিজ্ঞেস করা যাবে না?
এ জাতীয় প্রশ্ন হয়ত-বা করা যেতে পারে। আপনি বরং একটা কাজ করুন, অবজারভেশন ডেকে চলে যান। সেখান থেকে নক্ষত্রপুঞ্জ দেখুন। মহান পদার্থবিদদের সঙ্গে আলাপের চেয়ে এটা আনন্দময় হবে।
আমি নিজের খুপরি থেকে বের হলাম। করিডোরের মতো লম্বাটে জায়গা। সবু করিডোর দুজন রোগা মানুষ একসঙ্গে হাঁটতে পারে এমন। করিডোরে নরম সিনথেটিক কার্পেট বিছানো। কার্পেটের রঙ সবুজ। হাঁটতে খুব আরাম। পা ডেবে যায়, আবার যেন ডাবে না। দুপাশে লোহার দেয়ালের মতো দেয়াল। দেয়ালের রঙও হালকা সবুজ। কিছুদূর হাঁটার পর আমার মনে হল সবুজ রঙের প্রতি এদের বিশেষ কোন দুর্বলতা আছে। চারপাশে যা দেখছি সবই সবুজ। কোনটা গাঢ়, কোনটা হালকা। আমি কোন্ দিকে যাচ্ছি তা বুঝতে পারছি না। অবজারভেশন ডেকে যাবার উপায় কী তা সিডিসিকে জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সিডিসি তুমি কি আছ?
অবশ্যই আছি।
অবজারভেশন ডেকে যাবার পথটা জিজ্ঞেস করা হয় নি।
জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। আপনি ঘর থেকে বের হয়ে যে দিকেই যাবেন অবজারভেশন ডেকে উপস্থিত হবেন।
এখন যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে গেলে অবজারভেশন ডেক পাব?
অবশ্যই পাবেন? উল্টোদিকে যদি হাঁটা দেই তাহলে?
তাহলে পাবেন। মহাকাশযানের ডিজাউনটাই এরকম। সমস্ত নদী যেমন সমুদ্রে মেশে, সমস্ত পথ তেমন অবজারভেশন ডেকে শেষ হয়।
সবুজ রঙের এমন ছড়াছড়ি কেন? তোমাদের কাছে অন্য কোন রঙ ছিল না? যা দেখছি সবই সবুজ।
মহাকাশযানের ভেতরের স্ট্রাকচার ফাইবারগ্লাসের। এর কোন রঙ নেই। আলো এমনভাবে ফেলা হয়েছে যে বুজ দেখাচ্ছে। সবকিছু সবুজ দেখাচ্ছে তার মানে আমরা নিরাপদে ভ্রমণ করছি। একসময় দেখবেন সবকিছু লাল দেখাচ্ছে তখন বুঝতে হবে আমাদের ভ্রমণ তেমন নিরাপদ নয়।
বিপজ্জনক ভ্ৰমণ কখন শুরু হবে?
আমরা একটা নিউট্রন স্টারের পাশ দিয়ে যাব। সে সময়ের ভ্ৰমণ খুব নিরাপদ নয়।
বল কি?
নিউট্রন স্টার ব্যাপারটা কি আপনি জানেন?
জানি না এবং জানার কোন আগ্রহও বোধ করছি না। বিপজ্জনক ভ্ৰমণ এইটুকু জানাই আমার জন্যে যথেষ্ট।
আপনার ভীত হবার কোন কারণ নেই। নিউট্রন স্টারের পাশ দিয়ে আমরা অনেকবার গিয়েছি। আমাদের সবকিছুই হিসেব করা আছে।
মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন সাহেবকে তারপরও বলবে সাবধানে চালাতে। হিসেবে ভুল হতে পারে।
কোন ভুল হবে না।
ক্যাপ্টেন সাহেবের নাম কী?
আমরা সে জাতীয় মহাকাশযানে করে যাচ্ছি যাতে কোন ক্যাপ্টেন থাকে না।
আপনা-আপনি চলে?
তাও না। মহাকাশযানটি আমি নিয়ন্ত্ৰণ করি।
বল কি?
মনে হচ্ছে আপনি খুবই বিস্মিত হয়েছেন।
হ্যাঁ বিস্মিত হয়েছি। তুমি তো কথাবার্তা বলেই সময় কাটাচ্ছ। জাহাজ চালাবে কখন?
আমার অনেকগুলি ইন্টারফেস। মাত্র একটা ইন্টারফেস আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ আমি উল্টোপাল্টা কথা বলে রাগিয়ে দিলেও তোমার জাহাজ চালাতে কোন অসুবিধা হবে না?
না তা হবে না। নিউট্রন স্টার ব্যাপারটা কি আপনাকে বলব?
তুমি নিউট্রন স্টার ব্যাপারটা কী তা বলার জন্যে এত ব্যস্ত হয়েছ কেন? আমাকে জ্ঞানী বানানোর কোন দরকার নেই। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কথা তোমাকে বলি-এই জগতে যত কম জানা যায় ততই ভাল।
আপনাকে এই তথ্য কে বলেছে?
কেউ বলে নি। আমি নিজেই ভেবেচিন্তে এই তথ্য বের করেছি। ভাল। কথা, আমরা কি অবজারভেশন ডেকে চলে এসেছি?
আপনি চলে এসেছেন। আমি আগে থেকেই ছিলাম। আমি মহাকাশযানের সর্বত্রই ছড়িয়ে আছি। যদিও আমাকে দেখা যায় না।
তুমি তাহলে ঈশ্বরের মতো সব জায়গাতেই আছ—আবার কোথাও নেই।
সিডিসি কিছু বলার আগেই আমি অবজারভেশন ডেকে ঢুকে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম মজাদার কোন দৃশ্য দেখব। ঝিকমিক নক্ষত্রদের পাশ দিয়ে আমরা ছুটে যাচ্ছি। গ্রহট্ৰহ দেখা যাচ্ছে। গ্ৰহদের ঘিরে চাঁদ ঘুরপাক খাচ্ছে। শাই করে একটা ধুমকেতু আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। যাবার পথে মহাকাশযানে লেজের একটা বাড়ি দিয়ে গেল। আলোর ছড়াছড়ি। লাল আলো, হলুদ আলো, সবুজ আলো। তেমন কিছু না। বাইরের আকাশ ঘন কালো। এমন কালো রঙ আমি জন্মে দেখি নি। মনে হচ্ছে কালো ভেলভেটের পর্দায় তারা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তারাগুলি স্থীর হয়ে আছে। আমাদের মহাকাশযান নড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। এমন কোন আকর্ষণীয় দৃশ্য না। থ্রিডি মুভি হাউজে গেলে এরচে অনেক মজাদার দৃশ্য দেখা যায়। তবে তারার সংখ্যা দেখে কেউ যদি ভিরমি খেতে চায় খেতে পারে। আমার ভিরমি খেতে ইচ্ছা করছে না। আকাশের তারার চেয়ে আমার বরং অবজারভেশন ডেকের সাজসজ্জা ভাল লাগছে।
ঘরটা বেশ বড় এবং লম্বাটে ধরনের। নিচু গদি আটা সোফা। সোফাগুলি দূর থেকে দেখেই মনে হচ্ছে বসতে খুব আরাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলে ঘুম এসে যাবার কথা। সোেফা ছাড়া এখানে আসবাবপত্র কিছু নেই। সাধারণত খুব আরামের সোফার সামনে ছোট ছোট টেবিল থাকে, সোফায় বসে টেবিলে পা উঠিয়ে দেয়া যায়। এখানে তাও নেই। অবজারভেশন ডেকে কোন সবুজ রঙ দেখলাম না। পুরো ঘরটা খুব হালকা বেগুনি রঙ করা। বেগুনি রঙ আমার কখননা ভাল লাগে না, তবে এখানে খারাপ লাগছে না। বেগুনি রঙের মানে কি এই যে অবজারভেশন ডেকে বসে ভ্রমণ খুব নিরাপদ নয়। সামনের কাচের দেয়াল ভেঙে উল্কা ফুল্কা ঢুকে যেতে পারে।
অবজারভেশন ডেকের এক কোনায় বুডোমতো এক ভদ্রলোক সোফায় পা উঠিয়ে বেশ আরাম করে বসে আছেন। তাঁর চোখে সোনালি চশমা। আজকাল চশমা ব্যবহার হয় না। কেউ-কেউ শখ করে পরেন। মনে হচ্ছে ভদ্রলোক বেশ সৌখিন। তাঁর হাতে বই। তিনি মন দিয়ে বই পড়ছেন। মনে হয় এই ভদ্রলোকের সঙ্গে সম্ভবত আমার মনের মিল আছে। তিনি নক্ষত্রপুঞ্জ-ফুঞ্জ কিছু দেখছেন না। ভদ্রলোকের চেহারা শুকননা এবং রাগী-রাগী ধরনের। আমি অতীতে দেখেছি খুব রাগী রাগী চেহারার শুকনো-টাইপ লোকগুলি আসলে ভালমানুষ ধরনের হয়। আমি ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি তীক্ষ্ণচোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি বিনীতভাবে বললাম, স্যার আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?
অবশ্যই পারেন।
আমি বসতে বসতে বললাম, কী পড়ছেন?
একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস।
গল্পটা কি স্যার ইন্টারেস্টিং?
ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসলেন এবং আগ্রহের স্বরে বললেন, শুরুতে ইন্টারেস্টিং ছিল না। প্রথম দশ পৃষ্ঠা খুবই বোরিং, এখন অবশ্যি কাহিনী জমে গেছে। ভালই জমেছে। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলা যেতে পারে শ্বাসরুদ্ধকর।
কাহিনীটা কী?
প্রশ্নটা করেই আমার মনে হল এবার ভদ্রলোক রেগে গিয়ে বলবেন, অকারণে বিরক্ত করছেন কেন? তিনি তা করলেন না বরং আগ্রহের সঙ্গে বললেন, একজন পদার্থবিদের ত্রিমাত্রিক সময় সমীকরণে সমাধান চুরি গেছে। এই অসাধারণ সমাধানের ফলে প্যারালাল ইউনিভার্সের রহস্যভেদ হবে। ল্যাবোরেটরিতে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। ল্যাবোরেটরি ভেতর থেকে তালা দেয়া—নেকলোম লক। বাইরে থেকে এই তালা খোলার কোন উপায় নেই। সাইন্টিস্ট ভদ্রলোক সমীকরণের সমাধান টেবিলে রেখে পাশের টেবিলে গেলেন। কলম আনতে। কলম এনে ফিরে এসে দেখেন সমাধানটা নেই। ম্যাজিকের মতো ভ্যানিস হয়ে গেছে।
ঘরে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না?
না কেউ নেই। তাছাড়া সাইন্টিস্ট ভদ্ৰলোক শুধু এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে গেছেন এবং ফিরে এসেছেন, সময় লেগেছে এক মিনিটের কম। এর মধ্যেই ঘটনা ঘটে গেছে।
আমি বললাম, সাইন্টিস্টরা আত্মভোলা-টাইপের হয়। উনি নিজেই নিজের পকেটে রেখেছেন না তো? পকেটে রেখে ভুলে গেছেন একরম।
না তা না। উনি নিজের পকেট খুব ভাল করে দেখেছেন। টেবিলের ড্রয়ার দেখেছেন। হামাগুড়ি দিয়ে মেঝেতে খুঁজেছেন।
দ্রলোকের কথা বলার ধরন দেখে আমার মনে হল সমীকরণের সমাধান না পাওয়ায় গল্পের পদার্থবিদের চেয়েও তিনি বেশি চিন্তিত। আমি বললাম, স্যার আপনি মনে হয় খুব টেনশনে পড়েছেন?
টেনশনে পড়ব না? জরুরি একটা সমাধান যাবে কোথায়? এ তো তীরে এসে জাহাজ ডোবার মতো। নৌকা ডুবলেও কথা ছিল ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রগামী জাহাজ।
খুব বেশি টেনশন বোধ করলে শেষ পাতাগুলি আগে পড়ে ফেলুন।
আমিও তাই ভাবছি। আবার নিজে নিজে বের করার চেষ্টা করছি। কোন লাভ হচ্ছে না। আমার বুদ্ধি সাধারণমানের। আপনার কি মনে হয় সমাধানটা কোথায় গেছে?
আমার মনে হয় সাইন্টিস্ট ভদ্রলোকের সাহায্যকারী রোবট এটা গাপ করে ফেলেছে। রোবট ব্যাটা বোধহয় সমাধানটা অন্য কোথাও পাচার করবে। ভদ্রলোকের কি কোন সাহায্যকারী রোবট আছে?
হ্যাঁ আছে। N5 টাইপ রোবট। এরা গণিতে পারদর্শী। ভদ্রলোক রোবটটি ইউনিভার্সিটি থেকে ভাড়া নিয়েছেন। তিনি অংকে সামান্য কাঁচা বলে এর সাহায্য নেন। রোবটটিকে তিনি খুব পছন্দ করেন। তিনি তার নাম দিয়েছেন ল্যাঝিম। তাঁর মৃতা স্ত্রীর নামে নাম দিয়েছেন। ভয়েস-সিনথেসাইজারে তাঁর স্ত্রীর গলার স্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
স্যার আমার ধারণা ল্যাঝিম ম্যাডামই কাজটা করেছেন।
N5 ধরনের রোবটে যে কম্পিউটার মস্তিষ্ক ব্যবহার করা হয় তা তো কোন অন্যায় করতে পারে না।
গল্পের খাতিরে অন্যায় করেছে। অন্যায় না করলে তো গল্প দাড়াচ্ছে না। স্যার আপনি ভেবে দেখুন, ঘরে ল্যাঝিম ম্যাডাম ছাড়া আর কেউ নেই। সমাধানটা তো হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে না।
বুড়ো ভদ্ৰলোক চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বললেন, আপনার কথা খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। আপনার বুদ্ধি তো অসাধারণ পর্যায়ের। কিছু মনে করবেন না আপনার নাম জানতে পারি?
স্যার আমার কোন নাম নেই।
নাম নেই মানে? আপনি কি বায়ো-রোবট?
জ্বি না স্যার, আমি মানুষ।
মানুষের নাম থাকবে না?
সবার থাকে না। টানেল-কর্মীদের থাকে না। তাদের থাকে নাম্বার। পশুদের যেমন লেজে পরিচয়, টানেল-কর্মীদের তেমনি নাম্বারে পরিচয়। স্যার আমার নাম্বার হল T5LAS0.
তার মানে?
এটা আমার ডাক নাম বলতে পারেন। ভাল নাম TS023G00/LOR420/S000127:
বুড়ো ভদ্ৰলোক অসম্ভব বিস্মিত হয়ে বললেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। রোবটদের নাম্বার থাকবে। মানুষের থাকবে কেন? তাদের কম্পিউটার নাম্বার অবশ্যই থাকবে। ডিএনএ কোড-নাম্বার থাকবে তাই বলে নাম থাকবে না?
কিছু মনে করবেন না স্যার–আপনার নাম কী?
আমার নাম স্রুরা।
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলালাম। কী ভয়ংকর কথা, এতক্ষণ সুরার সাথে ফাজলামি ধরনের কথা বলছিলাম। কত হাজার ইউনিট ফাইন হয়েছে কে জানে। হারামজাদা সিডিসি নিশ্চয়ই সব শুনেছে এবং যথারীতি রেকর্ড করে ফেলেছে।
স্যার কিছু মনে করবেন না। আমি আপনার সঙ্গে বিরাট বেয়াদবি করেছি।
কী বেয়াদবি করেছেন।
আপনাকে সাধারণ একজন মানুষ বলে মনে করেছি।
আমি তো সাধারণ মানুষই। আমার মধ্যে অসাধারণ কী দেখলেন?
আপনি মহান একজন পদার্থবিদ।
পদার্থবিদরা অসাধারণ মানুষ হবে কেন? পদার্থবিদ্যা সামান্য জানি কিন্তু এর বাইরে আর কিছুই তো জানি না। মানুষেরও যে নাম থাকে না সেটাই জানতাম না। তাছাড়া আমার বুদ্ধিও সাধারণমানের। ডিটেকটিভ গল্প আমার খুব প্রিয়, সময় পেলেই পড়ি অথচ আজ পর্যন্ত আমি আগেভাগে বলতে পারি নি কে অপরাধী।
স্যার আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
রাগ করব কেন?
এই যে আমি আগেভাগে বলে দিলাম কে অপরাধী।
আপনার বুদ্ধির কারণে আপনার উপর সামান্য ঈর্ষা হয়েছে। কিন্তু রাগ তো করি নি। তাছাড়া আপনার অনুমান ঠিক নাও হতে পারে। বই পুরোটা শেষ না করলে বোঝা যাবে না।
ঠিক বলেছেন স্যার।
এত ঘনঘন স্যার বলছেন কেন?
স্যার না বলে কি বলব?
নাম ধরে ডাকবেন। মানুষের নাম রাখা হয় কি জন্যে, ডাকার জন্যে।
আমি খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম, আমাকে কী বলে ডাকবেন? আমার তো কোন নাম নেই।
নাম যেহেতু নেই নাম দিতে হবে। আপনার জন্যে সুন্দর একটা নাম খুঁজে বের করতে হবে।
স্যার আপনি আমার একটা নাম রেখে দিলে সেটা হবে আমার পরম সৌভাগ্য। সবাইকে বলতে পারব আমার এই নাম মহান সুরা রেখে দিয়েছেন। দয়া করে আনকমন একটা নাম রেখে দিন।
সুরা চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছেন। রেগেটেগে যাচ্ছেন না তো? কিংবা কে জানে হয়ত কী নাম রাখবেন তাই ভাবছেন। অতি বিখ্যাত মানুষদের ব্যাপার কিছুই বোঝা যায় না। এমন মানুষটাকে আমার খানিকটা বোকা-বোকাও মনে হচ্ছে। অতি ভাল মানুষদের ভেতর একধরনের সহজ বোকামি থাকে। তবে মানুষটার কৌতূহল কম। আমার প্রতি তিনি যে সামান্য কৌতূহল দেখাচ্ছেন, তা আমার নাম নেই বলেই দেখাচ্ছেন। এর বেশি কিছু না। আমি কে? আমার পরিচয় কি এইসব নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যথা নেই। সম্ভব এই জাতীয় মানুষদের সমস্ত কৌতূহল একদিকে ধাবিত হয়। তাদের চোখ একটা। সেই দৃষ্টিও কেন্দ্রীভূত অর্থাৎ শুধু কেন্দ্রটাই দেখে। কেন্দ্রের চারপাশের পরিধি দেখে না।
ল্যাঝিম নামটা তোমার কাছে কেমন লাগছে?
স্যার অত্যন্ত ভাল নাম। শুধু একটাই সমস্যা, নামটা মেয়েদের। কে বলল মেয়েদের?
আপনি যে ডিটেকটিভ উপন্যাস এই মুহূর্তে পড়ছেন সেখানকার পদার্থবিদের স্ত্রীর নাম ছিল ল্যাঝিম। পদার্থবিদ সেই নামে তার সাহায্যকারী রোবটের নাম রাখেন।
সুরা লজ্জিত গলায় বললেন, আপনি তো ঠিকই বলেছেন। আমার মনেই ছিল না। আপনার স্মৃতিশক্তিও উত্তম। আমার মাথায় তো আর কোন নাম আসছে না।
তাহলে স্যার ল্যাঝিমই থাকুক। তবে আমার একটা নাম মাথায় এসেছে, নামটা মনে হচ্ছে আনকমন। আমার ধারণা কেউ এই নাম আগে রাখে নি।
সুরা কৌতূহলী চোখে তাকালেন। আমি বললাম মানুষ নাম রাখলে কেমন হয় স্যার।
মানুষ?
জ্বি মানুষ। কেউ নিশ্চয়ই তার ছেলেপুলের নাম মানুষ রাখবে না।
রাখবে না কেন?
যে মানুষ, সে শুধু মানুষ নাম রাখবে কেন। তাছাড়া মানুষ নামটা উভলিঙ্গ। মানুষ বললে ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না। নামটা এমন রাখা হয়। যেন নাম শুনে মানুষ বলতে পারে ছেলে না মেয়ে।
আপনার কথায় যুক্তি আছে। আচ্ছা বেশ আপনার নাম রাখা হল মানুষ।
স্যার আমার যে কী ভাল লাগছে! আমি সবাইকে বলতে পারব আমার নাম রেখেছেন মহামতি সুরা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই ঋণ মনে হয় আমি শোধ করতে পারব না। শোধ করার ইচ্ছাও বোধ করছি না। কিছু কিছু মানুষের কাছে ঋণী থাকাও ভাগ্যের ব্যাপার। স্যার আমি এখন যাই। আপনার পাঠের সময় আপনাকে বিরক্ত করেছি। দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।
আপনি চলে যাচ্ছেন? জ্বি স্যার।
আমি চলেই যাচ্ছিলাম, কী মনে করে জানি পেছন ফিরলাম, দেখি সুরা আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাকে ফিরে তাকাতে দেখে বললেন, এই যে মানুষ! আমার মনে হয় আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনিই কি সেই সাহসী ভলেন্টিয়ার?
স্যার আমি বুঝতে পারছি না। আমি মোটেই সাহসী না এবং আমি কোন ভলেন্টিয়ার না।
ও আচ্ছা, আমার ভুল হয়েছে আমি ভেবেছিলাম আপনি সেই ভলেন্টিয়ার।
ভলেন্টিয়ারের ব্যাপারটা কি স্যার বুঝিয়ে বলবেন? আমি ভলেন্টিয়ারও হতে পারি।
ভলেন্টিয়ার হতেও পারি মানে? আপনি ভলেন্টিয়ার হলে আপনি জানবেন না?
আমি খুব বিচিত্র পরিস্থিতিতে আছি। আমাকে নিয়ে কী ঘটছে আমি জানি না। আমি টানেলে থাকতাম, আমাকে এরা ধরে বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে।
তার মানে?
এই যে স্যার আমি আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি তা জানি না। আপনারা কেন যাচ্ছেন তা কি জানেন? নিশ্চয়ই ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন না।
আমরা যাচ্ছি প্রক্সিমা সেনচুরির দিকে। প্রক্সিমা সেনচুরির নবম গ্রহ বারা। আমরা যাচ্ছি রারার দিকে। এই প্রথম অতি উন্নত একদল প্রাণীর সঙ্গে মানুষের দেখা হবে। রারার অধিবাসীরা এত উন্নত যে এরা হাইপার ডাইভ প্রযুক্তির অধিকারী। অতি জ্ঞানীরা সবসময় তাদের জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়। আমার ধারণা তারা আমাদেরকে কিছু প্রযুক্তি উপহার হিসেবে দেবে। আমরা পৃথিবীর প্রতিনিধি।
ভলেন্টিয়ারের ব্যাপারটা এখনো পরিষ্কার হয় নি স্যার। এখনো গিট্টু খুলেনি।
অতি উন্নত প্রাণীরা পৃথিবীর কাছে মানুষদের একটা স্যাম্পল চেয়েছিল। তাকে তারা রেখে দেবে। হয়তো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে। পৃথিবীর আইনে তা নিষিদ্ধ, তবে পৃথিবীর মানুষদের বৃহত্তর কল্যাণের কথা বিবেচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞান কাউন্সিল একজনকে পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে। অতি সাহস এবং মানবদরদী একজন স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছেন। আপনি বলছেন আপনি সেই একজন নন।
জি না স্যার। আমার এত সাহস নেই। এবং আমি মানবদরদীও নই।
তা হলে আপনি কে?
স্যার আমার নাম মানুষ।
ও হ্যাঁ আপনি মানুষ। আপনি কি কিছুক্ষণ বসবেন আমার পাশে, আমি আপনার ব্যাপারটা সিডিসিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেই। কারণ আমার সামান্য কৌতূহল হচ্ছে।
আপনার মতো মহান পদার্থবিদের কৌতূহলের কারণ হতে পেরেছি, আমার যে স্যার কী ভাল লাগছে! এ আমার এক পরম সৌভাগ্য।
আমি সুরার পাশের সোফায় বসলাম। এই প্রথম সুরাকে সামান্য চিন্তিত মনে হল। তার ভুরু কুঁচকে গেছে, গলার স্বরও আগের চেয়ে গম্ভীর। এতক্ষণ সোফায় পা তুলে বসেছিলেন এখন পা নামিয়ে নিলেন। সুরা ডাকলেন–
সিডিসি।
অবজারভেশন ডেকের পেছনের দেয়ালের নীল বাতি জ্বলে উঠল। সিডিসির বিষাদমাখা গলা শোনা গেল।
মহামান্য সুরা। আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন।
আমার পাশে যে বসে আছে আমি তাকে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
আপনাকে অতি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, এই মহাকাশযানের সবার সঙ্গেই আমার পরিচয় আছে।
ও হ্যাঁ, তা তো থাকবেই। এই ছেলেটির কোন নাম ছিল না। আমি তার নাম দিয়েছি—মানুষ। নামটা ভাল হয়েছে না?
আবারো আপনাকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আপনি নাম দেন নি। সে নিজেই তার এই নাম দিয়েছে, এবং আপনার ভেতর এমন ধারণা তৈরি করেছে যে নামটা আপনার দেয়া।
ও আচ্ছা তুমি ঠিকই বলেছ। মানুষ নামটার কথা সেই আমাকে প্রথম বলেছে। আমি তার নাম রাখতে চেয়েছিলাম ল্যাঝিম। ভাল কথা ল্যাঝিম নামটা কি খুব প্রচলিত?
ল্যাঝিম মোটামুটি প্রচলিত একটা নাম। বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদে খনিজ আহরণকারী যেসব মানুষ বসতি স্থাপন করেছে তাদের মধ্যে এই নামটি প্রিয়। ল্যাঝিম শব্দের অর্থ শেষ সূর্যের আলো। মানুষদের মধ্যে কত জনের নাম ল্যাঝিম এবং তাদের পরিচয় কী, তা জানতে চান?
না-তা জানতে চাচ্ছি না। আমি এই ছেলেটি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। সে আমাদের সঙ্গে কেন যাচ্ছে?
সে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে কারণ সে হল এমন একজন ভলেন্টিয়ার যে পৃথিবীর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। মানবজাতির জন্যে তার ত্যাগের প্রতিদানও মানবজাতি দিয়েছে। আপনি শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হবেন যে তার নামে পৃথিবীতে একটা ব্যস্ততম সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।
সিডিসি আমি কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। এই ছেলের তো নামই নেই। আমি তার নাম দিয়েছি মানুষ।
মহান সুরা অবশ্যই তার নাম আছে। তার নাম ইয়ায়ু। মহাকাশযান ছাড়ার পর থেকে তার কিছু সমস্যা হচ্ছে। মানসিক কিছু সমস্যা। সে হয় তার পূর্ব ইতিহাস ভুলে গেছে কিংবা সে ভান করছে যে ভুলে গেছে। আমরা তাকে আলাদা করে রেখেছি সেই কারণেই।
ও আচ্ছা।
দীর্ঘ সময় ছোট্ট ঘরে আটকে রাখলে তার কেবিন-ফিবার হতে পারে বিবেচনাতেই আজ তাকে ছাড়া হয়েছে। তবে তার উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে, আপনি হয়ত লক্ষ করছেন অবজারভেশন ডেকের বাইরে একজন শান্তিরোবট আছে। যাতে সে কারোর কোন ক্ষতি করতে না পারে।
এই ছেলেটিকে আমার মোটেই বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে না।
আমারো মনে হচ্ছে না, তারপরও বাড়তি সাবধানতা।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে শান্তি-রোবটকে দেখলাম। কিছুক্ষণ আগেও এ ছিল না, এখন কোত্থেকে উদয় হয়েছে? শান্তি-রোবট নাম শুনে বিভ্রান্ত হবার কারণ নেই। শান্তির সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই। এরা দেখতে ভালমানুষের মতো কিন্তু আসলে ভয়াবহ। টানেলে কাজ করার সময় এদের দেখেছি। এদের কর্মকাণ্ডও দেখেছি। না দেখাই ভাল ছিল।
সিডিসির কথাবার্তা শুনে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। সিডিসি মিথ্যা কথা বলছে এটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কেন বলছে? আমি সুরার দিকে তাকিয়ে বললাম, স্যার কিছু মনে করবেন না, সিডিসি কম্পিউটার হয় মিথ্যা কথা বলছে নয় রসিকতা করছে।
স্রুরা বললেন, কম্পিউটারের মিথ্যা বলার ক্ষমতা নেই। মিথ্যা বলা মানে কম্পিউটার লজিকে উল্টোদিকে চলা। সেই ক্ষমতা কম্পিউটারের নেই। একটা কম্পিউটার কখনো কোন অবস্থাতেই মিথ্যা বলতে পারে না। কম্পিউটার প্রসেসরের বিদ্যুপ্রবাহের একটা বিশেষ দিক আছে, মিথ্যা বললে সেই দিক উল্টে যায়। দুটি বিপরতিমুখী মাইক্রো কারেন্ট তখন একে অন্যকে নষ্ট করে ফেলে বলে কম্পিউটারের মূল প্রবাহ অকেজো হয়ে যায়। ইন্টারফেসে জেটা পটেনশিয়ালের সৃষ্টি হয়। কপোট্রন অকেজো হয়ে যায়। বুঝতে পারছ?
আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম। সুরার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। যা বুঝতে পারছি তা হল আমি গভীর জলে পড়েছি এবং কম্পিউটার সিডিসি মিথ্যা কথা বলছে। এতে তার কোন ক্ষতি হচ্ছে না।
ইয়ায়ু আপনি আপনার কেবিনে যান এবং বিশ্রাম করুন।
সিডিসি যে কথাগুলো আমাকেই বলছে তা বুঝতে পারলাম না। আমি তাকিয়ে রইলাম সুরার দিকে। সিডিসি আবারো বলল, ইয়ায়ু আপনি ঘরে যান এবং বিশ্রাম করুন। তখন বুঝলাম আমারই নাম ইয়ায়ু এবং আমাকেই ঘরে যেতে বলা হচ্ছে। আমি বললাম, মিথ্যাবাদী সিডিসি আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোমার সাধ্য নেই আমাকে এখান থেকে সরাবে।
ইয়ায়ু আপনি উত্তেজিত হবেন না।
আমি মোটেই উত্তেজিত হচ্ছি না। অধিক শোকে পাথর হয় বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। আমি অধিক শোকে লোহা হয়ে গেছি।
স্রুরা কেমন অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। যেন ভয় পাচ্ছেন। অপ্রকৃতস্থ একজন মানুষ পাশে থাকলে ভয় পাবারই কথা। আমি তার দিকে তাকিয়ে অভয়দানের মতো করে হাসলাম। এতে মনে হয় তিনি আরো ভয় পেয়ে গেলেন। আমি মনে মনে আবারো দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম। এখন আমি যে আচরণই করব তাঁর কাছে সেই আচরণ অপ্রকৃতস্থ বলে মনে হবে। আমি চুপ করে থাকলে তিনি ভাববেন আমি অতিরিক্ত চুপচাপ। আমি আসলে ভাববেন–পাগলের হাসি হাসছি। এই ধারণা যখন বদলানো যাবে না তখন পুরোপুরো পাগলের অভিনয় করাই ভাল। সবচে ভাল হয় যদি বদ্ধ উন্মাদের অভিনয় করে সিডিসিকে বিভ্রান্ত করতে পারি। উন্মাদের অভিনয় খুব কঠিন হবার কথা না।
আমি স্রুরার দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বললাম, আপনি দয়া করে আমাকে তুমি করে বলবেন। আপনি মহাজ্ঞানী আর আমি জ্ঞানহীন মূর্খ। কে জানে হয়তবা পাগল।
স্রুরা বললেন, আপনি কেবিনে চলে যান।
তুমি করে বলুন স্যার।
তুমি তোমার কেবিনে যাও বিশ্রাম কর।
আমি বরং এখানেই বিশ্রাম করি। আপনার পাশের সোফাটায় শুয়ে থাকি। জ্ঞানী মানুষদের পাশে শুয়ে থাকলেও জ্ঞান হয়। স্যার আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে।
না আমার কোন আপত্তি নেই। এখানে শুয়ে থাকলে তোমার যদি ভাল লাগে তুমি এখানেই শুয়ে থাক।
এবং স্যার ডিটেকটিভ বই যেটা আপনি পড়ছেন সেই বইটা যদি শব্দ করে পড়েন তাহলে ভাল হয়। শুয়ে-শুয়ে শুনতে পারি। কাহিনীটা আমাকে খুবই আকর্ষণ করেছে। ল্যাঝিমের সঙ্গে পদার্থবিদের সম্পর্কটা আসলে কেমন? অর্থাৎ স্যার আমি বলতে চাচ্ছি ল্যাঝিম কি পদার্থবিদকে পছন্দ করে? পদার্থবিদের নামও তো স্যার জানা হল না। সেও কি আপনার মতো মহান টাইটেল পেয়েছেন নাকি সে সিডিসির মতো গাধা-টাইপ?
বলতে বলতে পারে সোফায় আমি শুয়ে পড়লাম এবং লক্ষ করলাম শান্তি-রোবটটা এগিয়ে আসছে। সে আমার দিকে আসছে বলাই বাহুল্য। আমি অসহায় বোধ করছি। আমার আসলে এখন কিছুই করার নেই। শান্তি-রোবট অতি নিম্নশ্রেণীর রোবট, তবে বোবটের নিয়ম মেনে চলে। মানুষকে কখনোই আহত করে না। সে আমাকে আহত করবে না, তবে অতি নিশ্চিত যে ধরে নিয়ে কেবিনে শুইয়ে দেবে। তার আগে সে তার একটি হাতে খুব আলতো করে আমার হাত চেপে ধরবে। সেই ধাতব-হাতের ভেতর থেকে হাইপোরমিক সিরিজের সুচের মতো একটা সুচ বের হয়ে আমার চামড়া ভেদ করে রক্তে চলে যাবে। সেই সুচ দিয়ে কড়া ঘুমের ওষুধ আমার রক্তে মিশতে থাকবে। আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ব। যখন ঘুম ভাঙবে আমি দেখব আমি আমার কেবিনে শুয়ে আছি। আমার ক্ষুধাবোধ হচ্ছে এবং আমার শরীর অসম্ভব ক্লান্ত। শান্তি-রোবটদের এই আচরণের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।
রোবটটা এগিয়ে আসছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি কেমন আছ, ভাল? সে সামান্য থমকে দাঁড়াল।
আমি বললাম, মহান পদার্থবিদ সুরার সঙ্গে কি তোমার পরিচয় আছে। ইনি মহান পদার্থবিদ সুরা। অতি নিরহংকারী মানুষ।
রোবট আমার কথায় বিভ্রান্ত হচ্ছে না। তার চোখ জ্বলছে। নীল আলো বের হচ্ছে।
সিডিসি বলল, ইয়ায়ু আপনি ঝামেলা করবেন না। আপনার হাত বাড়িয়ে দিন। শান্তি রোবট আপনাকে স্পর্শ করতে চায়।
আমি বললাম, কেন?
আপনার মঙ্গলের জন্যে। ইয়ায়ু আমি আপনার মঙ্গল চাই।
আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হলাম। এমনকি হতে পারে যে সিডিসি আসলে সত্যি কথা বলছে। না তা হতে পারে না।
রোবটটা তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। আমার মনে হল ঝামেলা করে কী হবে, দিক ঘুম পাড়িয়ে। আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। বুঝতে পারছি সুচটা চামড়া ভেদ করে ভেতরে ঢুকছে। তীব্র ঘুমের ওষুধ সে রক্তে মিশিয়ে দিচ্ছে। গভীর ক্লান্তি, গভীর অবসাদে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করছে যে আমাকে রক্ষা করবে, যে আমাকে দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি দেবে। আমার আশেপাশে এমন কেউ নেই।
নেই বলছি কেন? একজন তো অবশ্যই আছে। তার নাম ইমা। বাস্তবে তার কোন অস্তিত্ব নেই সে আছে কল্পনায়। কল্পনায় থাকলেও তার অনেক ক্ষমতা। সে আমার সমস্ত দুঃখ সমস্ত কষ্ট নিমেষে ভুলিয়ে দিতে পারে। আমি বিড়বিড় করে বললাম, ইমা ইমা। আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি তারপরেও আমি তার মমতাময়ী মুখ দেখতে পারছি। সেই মুখ ঝুঁকে এসেছে আমার দিকে। আহ কী সুন্দর সেই মুখ! ইমার পরনে সবুজ একটা পোশক। সবুজ মানে হচ্ছে নিরাপদ ভ্ৰমণ। এই মহাকাশযান যখন বিপজ্জনক পথে যাবে তখন ইমার পোশাকের রঙ লাল হয়ে যাবে। এই তো লাল হতে শুরু করেছে। আমি তাকিয়ে আছি, ইমা যেন কিছু বলতে চেষ্টা করছে। তার ঠোট নড়ছে।
আমি বিড়বিড় করে বললাম, ইমা তুমি কি বলতে পার আমি কে?
ঘুম ভেঙেছে
আমার ঘুম ভেঙেছে। চোখ মেলতে ইচ্ছা করছে না। কেন জানি মনে হচ্ছে চোখ মেললেই দেখব শান্তি-রোবটটা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সে তার ঘন নীল চোখে আমাকে দেখছে। সেই দৃষ্টিতে আর যা-ই থাকুক ভালবাসা নেই। অবশ্যি ঘৃণাও থাকবে না। রোবটবাহিনী ঘৃণা-ভালবাসার ঊর্ধ্বে।
আমার কপালে একের পর এক যা ঘটছে তাতে মনে হয় সিডিসি তাকে রেখে দিয়েছে আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে। আমি চোখ মেললেই সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে। এই পৃথিবীর সবচে কুৎসিত দৃশ্য সম্ভবত রোবটদের হাসি বা তাদের হাসির ভঙ্গি। বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে আইন পাস করিয়ে এদের হাসি বন্ধ করার ব্যবস্থা করা যায় না?
ঘুম ভাঙার পর বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকা যায় না। ভেতর থেকে কে যেন বলতে থাকে, চোখ মেল। চোখ মেল।
আমি চোখ মেললাম। এবং হতাশ হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি আমার পাশে শান্তি-রোবটটা দাঁড়িয়ে আছে এবং হাসার মতো ভঙ্গি করছে। রোবটটার গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় কলে কেমন হয়? সে তার উত্তরে কী করবে? আমার গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় বসাবে? মনে হয় না। কারণ তাদের রাগ নেই। চড় খাবার পরেও আমার ধারণা সে বেশ স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার ঠোটের ফাকে আগের মতোই হাসির আভাস থাকবে।
আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম, তারপর তোমার খবর কি? সব ভাল তো?
রোবট কিছু বলল না। মানুষের মতো হ্যাঁ-সূচক মাথাও নাড়ল না। শুধু তার নীল চোখ একটু যেন বেশি জ্বলে উঠল।
তোমাকে কি আমার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে?
আমাকে বলা হয়েছে আপনার দিকে লক্ষ রাখতে।
আমি ঘর থেকে বের হতে পারব না?
তা তো আমি বলতে পারব না। সিডিসি যদি অনুগ্রহ করে দরজা খুলে দেন তাহলে আপনি বের হতে পারবেন। তবে আপনি যেখানেই যান আমি আপনার দুমিটার দূরত্বে থাকব।
শুনে খুবই আনন্দিত হলাম। একমিটারের ভেতর থাকলে আরো ভাল হত। কী আর করা। দেখি হাতটা বাড়াও তো হ্যান্ডশেক করি।
আমি হাত বাড়িয়ে আছি। শান্তি-রোবটটা সেই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের হাত বের করছে না। মনে হচ্ছে সে ধাঁধায় পড়ে গেছে।
আমি বললাম, মানবসমাজের অতি প্রাচীন নিয়মের একটি হচ্ছে দুজন যখন বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে কাছে আসে তখন তারা একজন আরেকজনের হাত ধরে। এবং কিছুক্ষণ ঝাঁকাঝাঁকি বা নড়াচাড়া করে।
কেন?
ভাল প্রশ্ন করেছ। হাত না ধরে দুজন দুজনের পা বাড়িয়ে দিতে পারত। পায়ে পায়ে ঘষাঘষি করতে পারত। তা না করে কেন হাত ধরে তা আমি জানি না। মহাজ্ঞানী সিডিসিকে এক ফঁাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব। তার আগে আমরা কি হ্যান্ডশেক করতে পারি?
রোবটটা তার হাত বাড়িয়ে দিল।
আমি তার হাত ধরতে-ধরতে বললাম, তোমার হাত তো বেকুবের মতো ধরলাম। এখন অটো সিস্টেমে তোমার হাত থেকে আমার হাতে সিরিঞ্জ ঢুকে যাবে না তো? বন্ধু পাতাতে গিয়ে শাঁ করে রক্তে ঘুমের ওষুধ ঢুকে গেল আর আমি ধড়াম করে বিছানায় পড়ে গেলাম। বাকি কয়েক ঘণ্টা আর কোন খবর নেই।
না তা হবে না।
আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত কি সিডিসি তোমাকে দেয়? নাকি তুমি নিজেই নাও?
এই সিদ্ধান্তটি সিডিসির কাছ থেকে আসে।
তাহলে তোমাদের গুরুদেব হচ্ছে মহাজ্ঞানী সিডিসি।
সবকিছুর মূল নিয়ন্ত্রণ তাঁর কাছে। এবং অবশ্যই তিনি মহাজ্ঞানী।
আমি হাই তুলতে-তুলতে বললাম, একটা মিথ্যাবাদীর হাতে তোমাদের সব নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে?
আপনি ভুল করছেন, কম্পিউটার মিথ্যা বলতে পারে না।
আমি হতাশ গলায় বললাম, কম্পিউটার মিথ্যা বলতে পারে কি পারে না তা আমি জানি না। আমি অতি সাধারণ মানুষ। মহাজ্ঞানীদের কেউ না। তবে আমি প্রমাণ করে দিতে পারি যে তোমাদের গুরুদেব মহা-মিথুক। যা-ই হোক প্রমাণ পরে করা যাবে। আপাতত আমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। আমাকে কিছু খেতে হবে। তুমি মানুষ হলে তোমাকেও আমার সঙ্গে খেতে বলতাম। দুর্ভাগ্য যে তুমি মানুষ না। তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা কর। আমি কিছু খেয়ে আসি। বেশি সময় লাগবে না। যাব আর আসব।
আমাকেও আপনার সঙ্গে যেতে হবে। আমি আগেই বলেছি আমাকে আপনার দুমিটারের মধ্যে থাকতে হবে। তার বেশিও না কমও না।
বেশ তো এসো আমার সঙ্গে। যে রোবটটি আমাকে খাবার দেয় সে বেশ। ভালমানুষ টাইপ রোবট। আমি আদর করে তার নাম দিয়েছি এলা। সে কারো শরীরে সুচ ঢুকায় না। তার সঙ্গে তোমার প্রেমও হয়ে যেতে পারে। না কি রোবটদের মধ্যে প্রেম হয় না?
শান্তি-রোবট জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে স্বল্পভাষী। সে কথার চেয়ে কর্মে বিশ্বাসী।
আমি খাবারঘরের দিকে রওনা হলাম।
টেবিলে আমার জন্যে খাবার সাজানোই ছিল। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে আগে খানিকটা ফ্লেটিশ মাছের ডিম খেলাম। পরিজ-জাতীয় একটা খাবার খেলাম। এই খাবারটা আগে খাই নি। অত্যন্ত সুস্বাদ। মটরদানার তৈরি কিছু খাবার ছিল। খাবারটার বৈশিষ্ট্য হল—খেতে ভাল লাগে না। কিন্তু মুখের খাবারটা শেষ হয়ে গেলে আবারো খেতে ইচ্ছা করে। সেই অদ্ভুত খাবারও খাব না খাব না করে বেশ খানিকটা খেয়ে ফেললাম। পরপর দুকাপ গরম কফি খেলাম। শরীরটা মনে হল ঠিক হয়ে আসছে। এতক্ষণ মাথা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল, সেই ফাঁকা ভাব কিছুটা যেন কমেছে।
এলার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলে কেমন হয়? শান্তি-রোবটটাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়াও আমার সামাজিক দায়িত্ব। দুজনের মধ্যে প্রেম হলেও ক্ষতি কী?
এলা! জ্বি।
তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি—এ শান্তি-রোবট। অশান্তি-রোবট নাম হলে ভাল হত। এই শান্তি-রোবটের সবই ভাল—শুধু সুচ ফোটায়, তবে তোমাকে সুচ ফুটিয়ে কিছু করতে পারবে না। হা হা হা।
এলা বলল, আপনি মনে হয় খুব আনন্দে আছেন?
আমি হাসতে-হাসতে বললাম, ঠিক ধরেছ আমি আসলেই আনন্দে আছি। সেই আনন্দের উৎস কি ধরতে পারছি না। তুমি কেমন আছ? আনন্দে না নিরানন্দে?
আমরা আনন্দেও থাকি না, নিরানন্দেও থাকি না। আমরা শুধু থাকি।
তোমাকে নিয়ে আমি একটা ছড়া লিখেছি।
কখন লিখলেন?
এই এখন। ছড়াটা খুব উচ্চমানের হয় নি। নিম্নমানেরও হয় নি। নিম্নের নিচে যদি কিছু থাকে তা হয়েছে।
ছড়াটি কি আপনি আমাকে শোনাবেন?
অবশ্যই শোনাব। ছড়াটা হল–
এলা এলা
চলে যাচ্ছে বেলা
কাজ হল মেলা
এখন শুধুই খেলা।
এলা বলল, স্যার আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
একটু আগেই যে বললে তুমি আনন্দিতও হতে পার না, আবার দুঃখিতও হতে পার না।
স্যার মনে হয় ভুল বলেছি। এখন আমার আনন্দ হচ্ছে।
এর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ ফাজলামি করা যেত, তা করা গেল না। খাবারঘরে দপ করে লাল আলো জ্বলেই নিভে গেল। এই আলো হল মনযোগ আকর্ষণমূলক আলো। কেউ আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। আমি কান পেতে রইলাম।
ইয়ায়ু আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সিডিসি কথা বলছে। আমাকেই বলছে, আমিই হলাম ইয়ায়ু। গাধাটা এই নাম কোত্থেকে জোগাড় করল? আমি গম্ভীর গলায় বললাম, কেন ইয়ায়ুর দৃষ্টি আকর্ষণ করছ?
কাউন্সিলের সামনে উপস্থিত হতে হবে।
কাউন্সিল আবার কী?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কারণ আপনাকে বলা হয়েছে যে এই মহাকাশযানে পৃথিবীর অত্যন্ত খ্যাতনামা কিছু মানুষ আছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন সাত তারকা সম্মানে সম্মানিত বিজ্ঞানী সুরা এবং লিলিয়ান। সাত তারা খচিত বিজ্ঞানীদের যে কোন তিনজন উপস্থিত থাকলেই তাঁরা কাউন্সিলের অধিবেশন ডাকতে পারেন। এবং তিনজন একমত হলে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যদিও এই মহাকাশযানে তিনজন সাত তারা খচিত বিজ্ঞানী নেই, তার পরেও বিশেষ অধিবেশন ডাকার ক্ষমতা তাদের আছে। বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়েছে। মহাকাশযানের সকল সদস্যদের উপস্থিত হতে বলা হয়েছে।
অধিবেশন ডাকা হয়েছে কেন? আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্যে? আবারো কোন গুরুত অপরাধ কি করে ফেলেছি?
আমি তা বলতে পারছি না। তবে এই অধিবেশন ডাকার মূল কারণ যে আপনি তা বলতে পারছি।
আমি হাই তুলতে-তুলতে বললাম, আমি এখন যেতে পারছি না। খাওয়াটা বেশি হয়ে গেছে। আঁসফাস লাগছে। ভাবছি এর সঙ্গে গল্পগুজব করার পর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। গড়াগড়ি করব।
কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়েছে, আপনাকে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে, আর আপনি বলছেন আপনি শুয়ে থাকবেন?
হ্যাঁ তা বলছি। বলাটা কি খুব অন্যায় হয়েছে?
আপনার সঙ্গে কথা বলে আমি সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। আপনি এক্ষুণি হলঘরে যাবেন। শান্তি-রোবট আপনাকে নিয়ে যাবে।
হলঘর শুনলে মনে হয় বিশাল একটা ঘর। এ-মাথা থেকে ও-মাথা দেখা যায় না এমন। আসলে তা না, হলঘরটা বেশ ছোট এবং মহাকাশযানের বেশিরভাগ ঘরের মতো গোলাকার। মাঝখানে স্টেজের মতো জায়গায় যে দুজন বসে আছেন তাদের একজনকে চিনতে পারছি, তার নাম সুরা। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তাঁর হাতে ডিটেকটিভ বইটা এখনো আছে। এবং আমি যখন ঢুকলাম তখনও তিনি বইটা পড়ছিলেন। আমাকে একঝলক দেখেই বই-এ চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
সুরার পাশে যিনি বসে আছেন তিনি নিশ্চয়ই লিলিয়ান। লিলিয়ান একজন মহিলা হবেন তা নাম থেকেই আমার আঁচ করা উচিত ছিল। আঁচ করতে পারি নি। সুরার চেহারায় যেমন শিশুসুলভ ব্যাপার আছে এই মহিলার চেহারায় তা নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কোনরকম ছেলেমানুষির প্রশ্রয় অতীতে দেন নি। ভবিষ্যতেও দেবেন না। মহিলা অসম্ভব রূপবতী, তবে চেহারা রুক্ষ ও কঠিন। তাঁর কাঠিন্য রূপকে ছাড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া ভদ্রমহিলার চোখ অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে এমন রূপবতী মহিলার প্রেমে কেউ কখনোই পড়বে না। ভেলেনটাইনস ডে তে ফুল এবং চকোলেট পাবার আশা এই মহিলার নেই।
হলঘরে সকল সদস্য মূর্তির মতো বসে ছিল। তাদের বসার জায়গাটা অনেকটা প্রাচীনকালের থিয়েটারের বক্সের মতো। সবাই আলাদা আলাদা খুপরিতে বসে আছেন। প্রতিটি খুপরি কাচ দিয়ে ঢাকা। কারোর সঙ্গে কারোর কোন যোগ নেই।
আমি হলঘরে ঢুকতেই সবাই আমার দিকে তাকাল। আমি বিনীতভাবে হাসলাম। কেউ সেই হাসির উত্তর দিল না। সবাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার মূর্তির মতো হয়ে গেল। শুধু লিলিয়ান তাকিয়ে থাকলেন। হলঘরে খালি খুপরি আরো আছে। আমাকে কেউ বসতে বলল না বলে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেকে ভয়াবহ কোন অপরাধীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে লিলিয়ান আমার বিচার করবেন। বাকি সবাই জুরি বোর্ডের মেম্বার। বিচারের রায়ে আমার মৃত্যুদণ্ড হবে। এ বিষয়ে কারো মত পার্থক্য থাকবে না, শুধু মৃত্যুদণ্ডটা কিভাবে হবে তা নিয়ে কথা কাটাকাটি হবে। কেউ বলবেন ইলেকট্রিক চেয়ার আবার কেউ বলবেন ইনজেকশন মেথড।
লিলিয়ান বললেন—(তাঁর গলার স্বরও চেহারার মতোই কঠিন, আমি মনে মনে আশা করেছিলাম তাঁর গলার স্বরটা মিষ্টি হবে।) কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন শুরু হচ্ছে। মহামান্য সুরা! অধিবেশন আপনি ডেকেছেন। আপনার যা বলার তা বলুন।
সুরা উঠে দাঁড়ালেন। অন্য সবাই তাঁর সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সুরা হাতের ইশারায় বসতে বললেন। সবাই বসল। এটাই বোধহয় নিয়ম। আমার কাছে কেমন যেন হাস্যকর লাগছে। জ্ঞানী মানুষরা সবসময়ই কিছু হাস্যকর কাণ্ডকারখানা করেন।
সুরা বললেন, শান্তি-রোবটের পাশে যাকে আপনারা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন তার নাম-ইয়ায়ু।
আমি হাত তুললাম এবং গলাখাকারি দিয়ে বললাম, স্যার আপনি সামান্য ভুল করছেন। আমার নাম ইয়ায়ু নয়। আমার নাম মানুষ। সম্ভবত আপনি ঘটনাটা ভুলে গেছেন। ভুলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এটা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা না। আমি হলে চেহারাও ভুলে যেতাম। আপনি চেহারাটা মনে রেখেছেন এতেই আমি মহাখুশি।
হলের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের তাকানোর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে আমি ভয়াবহ কোন অন্যায় করে ফেলেছি। আমার কথা শেষ হবার পরও বেশ কিছু সময় কেউ কোন কথা বলল না। লিলিয়ান উঠে দাঁড়ালেন। হলের সবাই তার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সবাই মিলে কি পিটি করছে নাকি? কী হাস্যকর। কী হাস্যকর। তিনি তাদের বসতে বললেন। সবাই বসল। লিলিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাউন্সিল অধিবেশনে বিনা অনুমতিতে কথা বলা অমার্জনীয় অপরাধ। এই বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। এখন মহামান্য সুরা তাঁর বক্তব্য শেষ করবেন।
সুরা বললেন, ইয়ায়ু বা মানুষ নামের এই ভদ্ৰলোক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি দাবি করছেন তাকে জোর করে মহাকাশযানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি কোন ভলেন্টিয়ার না। বিষয়টির মীমাংসা হওয়া উচিত।
লিলিয়ান বললেন, বিষয়টির মীমাংসা হয়েছে। আমাদের সবার সামনে একটি ফাইল আছে সেই ফাইলের কাগজপত্রের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কাগজপত্রে ইয়ায়ু ভলেন্টিয়ার হিসেবে তাকে গ্রহণ করার বিনীত অনুরোধ জানিয়ে সায়েন্স কাউন্সিলে আবেদন করেছেন। কাগজে তার হাতের ছাপ আছে। চোখের রেটিনার ছাপও আছে। আমি এই ছাপের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগে নেয়া ছাপ এফটু এনালাইজার দিয়ে মিলিয়েছি। একশ ভাগ মিল পাওয়া গেছে। অধিবেশনের এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করছি। মহামান্য সুরা মাঝে মাঝে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত হন। আশা করি ভবিষ্যতে তিনি উত্তেজনা পরিহার করবেন। অবসর সময়টা গল্পের বই পড়ে কাটাচ্ছেন তা ভাল। সেইসব বই ক্রাইম-বিষয়ক না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সুরা বললেন, অধিবেশন শেষ করার আগে আমার আরেকটা তুচ্ছ বিষয় বাকি আছে। এই বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই।
সবাই তাকিয়ে আছে সুরার দিকে।
লিলিয়ানের চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি। তিনি ভুরু কুঁচকে আছেন। তাঁর চোখ মুখে বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে তো মহা যন্ত্রণায় পড়া গেল এরকম ভাব। অন্যদের ভেতর খানিকটা কৌতূহল দেখা যাচ্ছে। দুই মহান বিজ্ঞানীদের ছেলেমানুষি ঝগড়ার ব্যাপারটায় হয়ত তারা মজা পান। এখনো কিছু মজা পাবার অপেক্ষায় আছেন।
সুরা বললেন ব্যাপারটা ঘটল অবজারভেশন ডেকে। আপনারা হয়ত জানেন, অবজারভেশন ডেকে বসে গল্পের বই পড়তে আমার ভাল লাগে। এবং এও হয়ত জানেন পাঠক হিসেবে আমার রুচি খুবই নিম্নমানের। আমি সাধারণত হালকা ধরনের বই পড়ি। সাসপেন্স, থ্রিলার। প্রেমের উপন্যাসও পড়ি। কয়েকদিন আগে একটা বই শেষ করলাম—সিরিয়াস প্রেমের উপন্যাস। দুটা কম্পিউটারের মধ্যে প্রেম হয়ে গেল। একটা হল N-5 ধরনের কম্পিউটার অন্যটা QX কম্পিউটার। গভীর প্রেম হয়ে গেলেও N-5 কম্পিউটার বুঝতে পারছে যে প্রেম ব্যাপারটি তার হতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ মানবিক আবেগের ব্যাপার। এবং মানব প্রজননের সঙ্গে সম্পর্কিত। N-5কম্পিউটার যখন তার অস্বাভাবিকতা বুঝল তখন সে স্বেচ্ছায় তার হার্ডডিস্ক নষ্ট করে ফেলল। অর্থাৎ বলা যেতে পারে সে আত্মহত্যা করল। QX কম্পিউটার তার প্রেমিকের আত্মহত্যা সহজভাবে নিতে পারল না। তার কাছে মনে হল এই নিঃসঙ্গ জীবন কিভাবে কাটাবে? সে একবার ভাবল নিজের হার্ডডিস্ক নষ্ট করবে, আরেকবার ভাবল করবে না। এই দুই বৈপরীত্যের মুখোমুখি দীর্ঘক্ষণ থাকায় তার লজিক-বোর্ড এলোমেলো হয়ে গেল। অর্থাৎ সে পাগল হয়ে গেল। গল্পটি ভাল। তবে QX টাইপ কম্পিউটারের লজিক-বোর্ড এলোমেলোর ব্যাপারটা একটু কষ্টকল্পিত। লেখক বলছেন লজিকবোর্ড এলোমেলো হওয়ায় বুলিয়ান এলজেব্রা…
লিলিয়ান বললেন, মহান সুরা কম্পিউটারের প্রেমের গল্প এখন কি না করলেই নয়? আমরা কি মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি না?
স্রুরা বললেন, হ্যাঁ সরে যাচ্ছি। আমার কাজের ধারাই এমন। আমি মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে থেকে কাজ করতে করতে মূল প্রসঙ্গে চলে আসি। পদার্থবিদ্যায় যে সব কাজ করার জন্যে আপনারা আমাকে মহান পদার্থবিদ বলছেন এবং সাতটা তারা গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন সেইসব কাজগুলি আমি এইভাবেই করেছি। আপনার কাজের ধারা ভিন্ন। আপনি মূল প্রসঙ্গ থেকে কখনো এক চুল সরেন নি। আমি আপনার মতো না। আমি দেখেছি বা বলতে পারেন আমার মনে হয়েছে বড় সমস্যাগুলি কেন্দ্রীভূত নয়। বড় সমস্যা কেন্দ্রের বাইরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে।
যা-ই হোক মূল কথা হচ্ছে আমি অবজারভেশন ডেকে বই পড়ছিলাম। এই যে এই বইটা পড়ছিলাম। এমন সময় ইয়ায়ু বা মানুষ নামের এই ভদ্ৰলোক এলেন। আমার সঙ্গে তাঁর কিছু কথাবার্তা হল। ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হল। খুবই পছন্দ হল। এটিও আমার একটা সমস্যা। যেই আমার সঙ্গে কথা বলে তাকেই আমার পছন্দ হয়। খুবই পছন্দ হয়। এমন কি মহান লিলিয়ানকেও আমার পছন্দ। খুবই পছন্দ।
হলঘরে চাপা হাসির শব্দ উঠেই থেমে গেল। আমি লক্ষ করলাম লিলিয়ানের চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রমহিলা অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছেন। তার চেহারা থেকে কাঠিন্য সরে গেছে এবং তার মধ্যে অসহায় ভাব চলে এসেছে। ভদ্রমহিলা যে কত সুন্দর তা এখনই শুধু বোঝা যাচ্ছে।
স্রুরা বললেন—লোকটি আমার পাশে বসল। আমরা গল্পগুজব করছি। যে বইটি আমি পড়ছি তার বিষয়বস্তুই হচ্ছে আলোচনার কেন্দ্র। তখন দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটল। ঘটনাগুলো এ রকম
১. কম্পিউটার সিডিসি আলোচনায় অংশগ্রহণ করল।
২. একটি শান্তি-রোবটের আগমন ঘটল।
৩. জানা গেল ইয়ায়ু বা মানুষ নামের এই লোকটি প্রক্সিমা সেনচুরির অতি বুদ্ধিমান প্রাণীদের জন্যে সংগৃহীত একটি উপহার।
৪. ইয়ায়ু বা মানুষ তা স্বীকার করছে না। সে বলছে সে কোন কালেই ভলেন্টিয়ার হবার কথা বলে নি।
৫. সিডিসি তাকে কেবিনে যেতে বলল।
৬. সে রাজি হল না। সে বলল সিডিসি মিথ্যা কথা বলছে।
৭. শান্তি-রোবট তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে পাঁজাকোলা করে কেবিনে নিয়ে গেল।
ঘটনাগুলি অত্যন্ত দ্রুত ঘটল। এবং আমার মধ্যে কিছু বিরাট খটকার জন্ম হল। আপনারা জানেন যে কোন খটকাকে গাছের বীজের সঙ্গে তুলনা করা চলে। খটকাগুলি মন-নামক জমিতে বীজের মতো রোপিত হয়। প্রয়োজনীয় জলহাওয়া পেলে বীজ থেকে গাছ হয়। গাছ বড় হয়ে চারদিকে বিশাল সব ডালপালা বিস্তার করে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হল—আমার খটকা ফুলেফেঁপে একাকার হল। এবং যে কারণে মহান লিলিয়ানের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আমি কাউন্সিল অধিবেশন ডাকলাম।
স্রুরা এটুকু বলেই লিলিয়ানের দিকে হাসিমুখে তাকালেন। লিলিয়ান কঠিন গলায় বললেন, আমি কি আশা করতে পারি না যে আপনার খটকা ইতিমধ্যে দূর হয়েছে।
আশা করতে দোষ নেই। মানুষ যে কোন কিছু আশা করতে পারে। তবে আমার খটকা দূর তো হয়ই নি ক্রমেই বাড়ছে।
বেশ খটকা দূর করুন।
আমি কম্পিউটার সিডিসিকে অধিবেশনে আহ্বান করছি।
হলঘরের বাঁ পাশের পর্দায় কিছু নকশার ছবি ভেসে উঠল। নকশাগুলি ত্রিমাত্রিক এবং অসম্ভব সুন্দর। তৈরি হচ্ছে ভেঙে যাচ্ছে আবার অন্যভাবে তৈরি হচ্ছে। রঙ বদলাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় এতই সুন্দর। সুরা এখন কথা বলছেন নকশার দিকে তাকিয়ে কাজেই আমি ধরে নিলাম এই নকশাগুলিই সিডিসি।
কম্পিউটার সিডিসি।
আমি আগেও উপস্থিত ছিলাম, এখনো আছি।
বিজ্ঞান কাউন্সিল নীতিমালায় মহাকাশযানে শান্তি-রোবটের উপস্থিতি নিষিদ্ধ। এটা কি সত্যি?
জ্বি সত্যি।
এই মহাকাশযানে কজন শান্তি-রোবট আছে?
চারজন।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের নীতিমালা উপেক্ষা করা হয়েছে কেন?
আমরা প্রক্সিমা সেনচুরির নবম গ্রহ রার মহাজ্ঞানী প্রাণীদের জন্যে একটি বিশেষ উপহার নিয়ে যাচ্ছি। মানবসম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধি যার নাম ইয়ায়ু। দুর্ভাগ্যক্রমে এই প্রতিনিধি একজন ভয়ংকর ব্যক্তিত্ব। তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যেই এই বিশেষ ব্যবস্থা।
ভয়ংকর ব্যক্তিত্ব কেন?
আপনারা তার ডিএনএ প্ৰফাইলের একটা অংশ পর্দায় দেখুন। তাহলেই বুঝবেন তিনি কত ভয়ংকর একজন মানুষ।
স্রুরা বললেন, আমরা তাহলে অতি ভয়ংকর একজন মানুষকে মানবসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাচ্ছি? খুবই ভাল কথা। ওরা বুঝবে কত ধানে কত চাল।
সিডিসি জবাব দিল না। পর্দায় ডিএনএ প্রফাইলের একটি অংশ দেখা গেল। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি। কিছুই বুঝতে পারছি না, তারপরেও আমার খুব মজা লাগছে। কেন জানি মনে হচ্ছে সব কিছুই জট পাকিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হল দাঁড়িয়ে আছি। পা ধরে গেছে। বসতে পারলে ভাল হত। কিন্তু আমার মতে একজন ভয়ংকর প্রাণীকে সম্ভবত বসতে দেয়া যায় না।
স্রুরা বললেন, পর্দায় ডিএনএ ছবি দেখে আমি বা লিলিয়ান কিছুই বুঝব না। আমাদের এখানে জেনেটিকস্বিদ্যার দুজন বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের কিছু বলার থাকলে বলুন।
দাড়িওয়ালা রোগা এক ভদ্ৰলোক উঠে দাঁড়ালেন। তিনি স্পষ্ট স্বরে বললেন, ডিএনএ প্রফাইল দেখে আমি কোনরকম সন্দেহ ছাড়াই বলছি এই মানুষটির ডিএনএ প্ৰফাইলে বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে। একটা জায়গায় বেস পেয়ারের নাইট্রোজেন পরমাণুর বদলে এলুমিনিয়াম পরমাণু আছে। এই ব্যতিক্ৰম ভয়াবহ ব্যতিক্রম।
সুরা বললেন, কাজেই আপনি বলতে চাচ্ছেন যে তার জন্যে সার্বক্ষণিক শান্তি-রোবট রাখা বাঞ্ছনীয়।
অবশ্যই। এবং আমার উপদেশ হচ্ছে এই মানুষটিকে কেবিনে নয়। হিমাগারে সংরক্ষণ করে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাকে হস্তান্তরের সময়ই শুধু হিমাগার থেকে আনা হবে। তখনই শুধু তার জ্ঞান ফেরানো হবে। পুরো যাত্রাপথে সে যাবে অর্ধ-চেতন অবস্থায়।
লিলিয়ান বললেন, মহান সুরা আমরা কি ধরে নিতে পারি যে আপনার খটকা দূর হয়েছে? আমরা কাউন্সিল অধিবেশনের সমাপ্তি কি ঘঘাষণা করতে পারি?
সুরা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমার খটকা আরো বেড়েছে। এখন যে খটকা ঢুকেছে তা এই লোকটির ডিএনএ প্রোফাইলের চেয়েও ভয়ংকর। এই খটকা শুধুমাত্র সিডিসি দূর করতে পারবে। আমি এখন তাকেই প্রশ্ন করছি।
সিডিসি।
মহান সুরা আমি আছি।
ডিএনএ প্রফাইলের ভয়ংকর ক্রুটিযুক্ত একটি মানুষকে কি আমরা উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি যার জন্যে সার্বক্ষণিক শান্তি-রোবট প্রয়োজন।
জ্বি পাচ্ছি। তার নাম ইয়ায়ু।
মানব-শিশু জন্মের আগেই কি তার ডিএনএ প্রফাইল তৈরি হয় না?
জ্বি হয়। ফিটার থেকে কোষ এনে সেই পরীক্ষা করা হয়।
ডিএনএ পাইলে বড় ধরনের কিংবা মাঝারি ধরনের ত্রুটি থাকলে কি মানব-শিশু দ্রুণাবস্থাতেই নষ্ট করে ফেলা হয় না?
অবশ্যই হয়।
ইয়ায়ুর মতো ভয়াবহ ত্রুটিযুক্ত ডিএনএ নিয়ে কোন মানুষ কি পৃথিবীতে আছে?
জ্বি না, নেই।
থাকা সম্ভবও নয়। বিজ্ঞান কাউন্সিল তা অনুমোদন করবে না। এরকম ভয়ংকর একজন মানুষ পৃথিবীতে থাকতে পারে না। এটাই কি সত্যি?
জি সত্যি।
তাহলে কি আমি ধরে নিতে পারি না যে তুমি মিথ্যা কথা বলছ। তুমি ইয়ায়ুর ডিএনএ প্রফাইল আমাদের দেখাচ্ছ না। অন্য ফাইল দেখাচ্ছ।
জ্বি ধরে নিতে পারেন। যুক্তিবিদ্যা তাই বলে।
আমরা কি ধরে নিতে পারি না যে একটি ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলে সে তার প্রয়োজনে যে কোন ক্ষেত্রেই মিথ্যা কথা বলতে পারে।
জ্বি ধরে নিতে পারেন।
সুরা বললেন, আমার আসলে আর কিছু বলার নেই। আমার মাথা ঘুরছে। আমি এখন অবজারভেশন ডেকে চলে যাব। বইটা শেষ করব। হাতের বইটা শেষ না করা পর্যন্ত আমি আসলে কোন দিকেই মন দিতে পারছি না। কাজেই লিলিয়ান সিদ্ধান্তের দায়িত্ব আমি তোমার উপর ছেড়ে দিলাম। এখন তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই আমার সিদ্ধান্ত।
লিলিয়ান প্রায় বাচ্চামেয়েদের মতো অনুনয়ের গলায় বলল, আপনি এখন যেতে পারবেন না।
সুরা বললেন, কে বলল যেতে পারব না। এই দেখ যাচ্ছি।
তিনি স্টেজ থেকে নেমে হেঁটে চলে গেলেন। আমি হাত উঁচিয়ে বললাম, ম্যাডাম আমি কি একটা কথা বলতে পারি? কথাটা অত্যন্ত জরুরি।
লিলিয়ান গম্ভীর গলায় বললেন–বলুন।
অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আমার পা ধরে গেছে। আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার কেবিনে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারি।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অধিবেশন আপনাকে কেন্দ্র করেই আর আপনি কোন্ বিবেচনায় চলে যেতে চাচ্ছেন?
আমাকে নিয়ে অধিবেশন হলেও আমার এখানে কথা বলার সুযোগ নেই। আমি শুরুতে কিছু বলতে চেয়েছিলাম আপনি বলতে দেন নি। কঠিনভাবেই আমাকে থামিয়ে দিয়েছেন। কাজেই এখানে থেকে আমি কী করব।
এখন আমরা আপনার বক্তব্য শুনব।
এখন আমি নিজে কিছু বলব না। এবং কিছু মনে করবেন না আপনি মহান পদার্থবিদ হলেও আমার ধারণা আপনার বুদ্ধিবৃত্তি নিম্নপর্যায়ের। কম্পিউটার সিডিসিকে আমি গাধা বলে ডাকি। আপনি একজন মহিলা, আপনার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে পারি না। তবে আমার মতে আপনারই চলে যাওয়া উচিত হিমাগারে। এখন আমি কি কেবিনে ফিরে যেতে পারি?
পারেন। আমি চলে এলাম। আমার পেছনে পেছনে শান্তি-রোবটও চলে এল।
জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সব কেমন জানি জট পাকিয়ে যাচ্ছে। উচ্চশ্রেণীর দার্শনিক চিন্তা আমার মাথায় এসেছে। চিন্তাটা হচ্ছে—আমাদের জীবন লম্বা একখণ্ড রঙিন সুতা। এই সুতা আমরা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করি। তার নামই জীবনযাপন। কারো সুতা রঙিন, কারোটা আবার কালো। নাড়াচাড়া করার সময় অসাবধান হলেই সুতা জট পাকিয়ে যায়। কেউ-কেউ সেই জট খুলতে পারে, কেউ-কেউ পারে না। আর একবার যদি জট পেকে যায় তাহলে জট পাকাতেই থাকে।
বিছানায় শুয়ে
আমি বিছানায় শুয়ে আছি। ঘরের ভেতরটা আরামদায়ক। সামান্য শীত-শীত লাগছে। হালকা একটা চাদরে শীত কাটবে। আবার না হলেও চলবে। এই অবস্থাটাই আসলে আরামদায়ক। শুয়ে-শুয়ে গরম কফি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটা কোন বিজ্ঞানী এখন পর্যন্ত করেন নি কেন বুঝতে পারছি না। তারা কত কিছুই পারেন, এটা পারেন না কেন? মহাকাশযানে কোন মধ্যাকৰ্ষণ শক্তি থাকার কথা না, তারপরেও কিভাবে যেন ঠিক পৃথিবীর মতো lg মধ্যাকৰ্ষণ তৈরি করা হয়েছে। যারা এটা পারেন তারা আরাম করে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে গরম কফি খাবার ব্যবস্থাও করতে পারেন।
প্রক্সিমা সেনচুরির নবম গ্রহের মহা-মহা জ্ঞানী প্রাণীরা নিশ্চয়ই এই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন। আচ্ছা এই প্রাণীরা দেখতে কেমন? মানুষের মতো নিশ্চয়ই না। মাকড়সার মতো না হলেই আমি খুশি। যদি দেখা যায় ওরা মাকড়সার মতো তাহলে ভাল সমস্যা। হাজার হাজার মাকড়সা চারদিকে কিলবিল করছে। কেউ গায়ে উঠছে, কেউ গা থেকে নামছে, খুব কৌতূহলী একজন আমার কানের ফুটো দিয়ে তার একটা ঠ্যাং ঢুকিয়ে দিল। কী সর্বনাশ!
উন্নত প্রাণীদের বিষয়ে মানুষের কাছে কোন তথ্য নেই, তা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিছু তথ্য অবশ্যই আছে। এবং এই তথ্য জানার অধিকার আর কারোর থাকুক বা না থাকুক আমার আছে। অবস্থাগতিকে মনে হচ্ছে আমার বাকি জীবনটা ওদের সঙ্গেই কাটাতে হবে। যাদের সঙ্গে কাটাব তাদের বিষয়ে আগে কিছুই জানব না তা হয় না।
শান্তি-রোবটটা আমরা দুমিটার দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একেবারই নড়ছে না। এখন তাকে লাগছে ঘরের আসবাবের মতো। তাকে কাপড় রাখার স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করলে কেমন হয়?
কাউন্সিলের সভায় কী সিদ্ধান্ত হয়েছে বুঝতে পারছি না। প্রথম সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত শান্তি-রোবটের হাত থেকে আমার মুক্তি। রোবটটা যখন যাচ্ছে না তখন ধরে নিতে হবে কাউন্সিলের সভা এখনো চলছে। জ্ঞানীদের সভা এত দ্রুত শেষ হয় না। সবাই সবাইকে জ্ঞান দিতে থাকবেন। জ্ঞানের পিচকিরি খেলা চলতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত সভা শেষ হবে সিদ্ধান্ত ছাড়া।
সিডিসিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারি সভা শেষ হল কি না। তাছাড়া সিডিসির সঙ্গে কিছুক্ষণ পোশগল্প করা যেতে পারে। অতি উন্নত প্রাণীরা মাকড়সার মতো কি না তাও জানা দরকার।
সিডিসি।
জ্বি।
কাউন্সিলের সভা কি চলছে না চলছে না?
সভা শেষ হয়েছে!
সভার সিদ্ধান্ত কী?
আপনার উপর থেকে শান্তি-রোবটের খবরদারি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এবং চার ঘণ্টা পর আবার সভা ডাকা হয়েছে। সেই সভায় আমার উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মনে হচ্ছে তারা তোমার বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাচ্ছে।
হ্যাঁ সেরকমই মনে হচ্ছে। এবং এটাই স্বাভাবিক।
স্বভাবিক কেন?
স্বাভাবিক কারণ তাদের ধারণা আমি মিথ্যা বলেছি। এবং ওদের প্রথম সিদ্ধান্ত –তোমার উপর থেকে শান্তিবাহিনীর খবরদারি উঠিয়ে নিতে হবে, তা মানি নি।
ও আচ্ছা।
আগে তোমাকে দেখেশুনে রাখার জন্যে একজন শান্তি-রোবট ছিল—এখন চারজন। একজন ভেতরে তিনজন বাইরে।
ভাল তো। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।
আপনি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
আমি চুপ করে রইলাম। নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে ঠাণ্ডামাথায় একটু কি চিন্তা করে নেব? বা তার দরকার আছে কি? ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। বরং ঘুমিয়ে পড়া যেতে পারে। ঘুম থেকে উঠে কথা বলা যাবে। আরো নতুন সিদ্ধান্ত কিছু এর মধ্যেই হয়ত হতে পারে।
সিডিসি!
জ্বি বলুন।
আমি ঠিক করেছি লম্বা ঘুম দেব। ঘণ্টা তিনেক আরাম করে ঘুমুব। আমি চাই না, এই সময় কেউ আমাকে বিরক্ত করে।
কেউ যাতে আপনাকে বিরক্ত না করে তা দেখব।
যে শান্তি-রোবটটা আমার দুমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে তাকে সরে যেতে বল।
সেটা সম্ভব না।
তাহলে দয়া করে ওর চোখের আলো নিভিয়ে দাও। ও জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকলে আমি ঘুমুতে পারব না।
সে ব্যবস্থা করছি।
তোমার সঙ্গে আমি কিছু অন্তরঙ্গ আলাপ করতে চাই, তা কি সম্ভব?
মোটেই অসম্ভব না।
যে উন্নত গ্রহের দিকে আমরা যাচ্ছি তাদের অতি উন্নত প্রাণীদের বিষয়ে কি তোমার কাছে কোন তথ্য আছে?
খুব সামান্য তথ্যই আছে।
যা আছে তা আমাকে জানাতে পারবে?
পারব। আপনি ঘুম থেকে জেগে উঠেই যাবতীয় তথ্য রিপোর্ট-আকারে পাবেন।
তোমার এই শান্তি-রোবট কি পা টিপতে পারে?
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
দীর্ঘ সময় দুপায়ে দাড়িয়ে ছিলাম বলে পায়ের মাসল ব্যথা করছে। ও পা টিপে দিলে আরাম হত।
আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করছি।
এতে শান্তি-রোবটের সম্মানের কোন হানি হবে না তো?
সিডিসি জবাব দিল না। আমি মনে মনে হাসলাম। শান্তি-রোবট কাছে এগিয়ে আসছে। আমি পা মেলে চোখ বন্ধ করলাম। ঘুম চলে আসছে। কেন জানি মনে হচ্ছে আজ আমি ঘুমের ভেতর মাকড়সা স্বপ্নে দেখব। মাথা থেকে মাকড়সার ব্যাপারটা দূর করতে পারছি না।
সিডিসি।
জ্বি।
ঘুম পাড়িয়ে দেবার তোমার যে-সব কৌশল আছে তা চালু কর। আমি ঘুমুতে চাই
আপনি এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়বেন।
হ্যাঁ ঘুম আসছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘুম-ঘুম অবস্থায় আমার মনে হল—পাশের দান উল্টে গেছে। এখন থেকে আমি যা বলব সিডিসি তাই শুনবে। এরকম মনে হবার যদিও কোনই কারণ নেই।
ঘুম ভেঙেছে।
শরীর ঝরঝরে লাগছে। মনে হচ্ছে আজ আমার ছুটির দিন। কিছু করার নেই। আজ হচ্ছে অনিয়মের দিন। খিদে থাকবে কিন্তু খাব না। বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করবে, তারপরেও বিছানায় এলিয়ে পড়ে থাকব। হালকা ধরনের কোন বই পড়তে ইচ্ছা করবে। বই হাতে নেব কিন্তু পড়ব না। দুএকটা পাতার উপর দিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিতে পারি। ভুল বললাম—দ্রুত না। ছুটির দিনে দ্রুত কিছুই করতে নেই। ছুটির দিন হল টিমে তেতালার দিন।
পায়ে সুড়সুড়ি লাগছে। মাথা উঁচিয়ে দেখি শান্তি-রোবট পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার জ্বলজ্বলে নীল চোখে আলো নেই। মনে হচ্ছে রোবট-গোত্রে সে অন্ধ। তার জন্যে একটু মায়াও লাগছে। আমি মমতা নিয়েই বললাম, পা টেপাটেপি যথেষ্ট হয়েছে—এখন বাদ দাও।
সে সরে গেল। আমি বিছানায় ওঠে বসলাম। হাই তুললাম। শান্তিরোবটের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম, সে এই হাসি বুঝতে পারল না, কারণ সে এখন কিছু দেখছে না। তার ফটো-সেনসেটিভ চোখ কাজ করছে না। তার চোখের নিশ্চয়ই হিট-সেনসেটিভ অংশও আছে। সেই অংশ কাজ করছে, তবে কাজ করলেও আমার হাসি তার বোঝার কথা না।
হ্যালো শান্তি-রোবট।
জ্বি বলুন।
একটু আগে যে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে হেসেছি তুমি কি বুঝতে পেরেছ?
জ্বি বুঝতে পেরেছি—তাপবোধক ব্যবস্থার কারণে বুঝতে পেরেছি। আমার চোখে ইনফ্রারেড রেডিয়েশন ডিটেকটর আছে।
ও আচ্ছা।
আমরা রাতেও দেখতে পাই।
খুবই ভাল কথা, অত্যন্ত আনন্দ বোধ করছি। দেখাদেখির অংশে তোমরা তাহলে মানুষের চেয়েও উন্নত?
জ্বি।
বোকার মতো কথা বলছ কেন? দেখাদেখির অংশেও তোমাদের অবস্থান। মানুষের চেয়ে অনেক নিচে–মানুষ কল্পনায় দেখে তোমরা কি তা পার?
যে-সব দৃশ্য আমরা আগে দেখেছি আমাদের স্মৃতিতে সে-সব জমা থাকে। আমরা ইচ্ছা করলেই রিপ্লেতে তা দেখতে পাই।
মানুষের ব্যাপারটা কি জান? মানুষ হচ্ছে এমন এক প্রাণী যে প্রাণী কোনদিন দেখে নি এমন দৃশ্যও কল্পনা করলে স্পষ্ট দেখতে পায়।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
বুঝিয়ে দিচ্ছি। যেমন মনে কর ইমা। ইমাকে আমি কখনো দেখি নি। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই তার মুখ আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। তার নাকের ডগার বিন্দু বিন্দু ঘামও দেখতে পাই। মেয়েটার আবার খুব নাক ঘামে।
মেয়েটা কে?
ওকে আমি বিয়ে করব। তবে তাকে কখনো দেখি নি। আসলে তার অস্তিত্বও নেই।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
শুধু তুমি কেন? তোমাদের গুরুদেব মহাজ্ঞানী সিডিসিও কিছু বুঝতে পারবে না। সে কল্পনার এই ব্যাপারটা জানে। এই বিষয়ে তার প্রচুর পড়াশোনা আছে বলেই ব্যাপারটা সম্পর্কে তার ধারণা হয়ত আছে কিন্তু এর বেশি না। ভাল কথা, ঘুমুতে যাবার আগে আমি সিডিসিকে সামান্য কাজ দিয়ে গিয়েছিলাম। কাজটা কি সে করেছে?
জ্বি করেছেন। উনার করা রিপোর্টটা খাবার টেবিলে রাখা আছে। কফি খেতে-খেতে আপনি রিপোর্টটার উপর চোখ বোলাতে পারেন।
আমি এখন বিছানা থেকে নামব না। আজ ছুটির দিন তো। আজ আমি রিলা করব।
আজ কি ছুটির দিন?
হ্যাঁ আজ রবিবার।
আপনি সামান্য ভুল করছেন। মহাকাশযানে সাপ্তাহিক হিসেব রাখা হয় না। গ্যালাকটিক ক্যালেন্ডার রাখা হয়। টাইম ডাইলেশন হিসেবের মধ্যে ধরে সময় রাখা হয়। গ্যালাকটিক ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখ 32116012. অবশ্যি এই হিসেবে মহাকাশযানের যাত্রীদের জৈবসময় ধরা হয় নি।
খামোকা বকবক করবে না। মানুষ যে কোন দিনকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে। আমি ঘোষণা দিচ্ছি আজ ছুটির দিন—আজ রোববার।
জ্বি আচ্ছা। আমি রিপোর্ট এনে দিচ্ছি।
আমি যখন ঘুমে ছিলাম তখন কেউ কি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল?
মহান পদার্থবিদ লিলিয়ান করেছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছে আপনি ঘুমুচ্ছেন, আপনাকে এখন বিরক্ত করা যাবে না।
ভাল বলেছ। তাকে বলে দেয়া উচিত ছিল আমি যখন জেগে থাকি তখনও আমাকে বিরক্ত করা যাবে না। আমাকে যখন-তখন বিরক্ত করার অধিকার শুধু একজনকেই দেয়া হয়েছে তার নাম ইমা।
আপনি বলেছেন ইমার কোন অস্তিত্ব নেই।
তাতে কী হয়েছে? আমি যদি গভীর ঘুমেও থাকি ইমা খবর দিলেই তুমি আমাকে ডেকে দেবে।
আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। যা-ই হোক আপনাকে যা বলার আমি বলে যাচ্ছি-মহান পদার্থবিদ সুরাও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল।
বেশি রকম উদ্বিগ্ন?
জ্বি। উনি বলছিলেন অত্যন্ত জরুরি ব্যাপারে উনি কথা বলতে চান।
তুমি এক কাজ কর। রিপোর্টটা আমার হাতে দাও এবং আমি যেন সুরার সঙ্গে কথা বলতে পারি তার ব্যবস্থা করে দাও। কোন্ বোতাম টিপতে হবে, কোন্ ডায়াল ঘুরাতে হবে কিছুই তো জানি না।
আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আপনি শুধু সিডিসিকে বলবেন আপনি মহান সুরার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আজ ছুটির দিন তো আমি খুবই ক্লান্ত। আমি কাউকে কিছু বলতে পারব না। যা বলার আমার হয়ে তুমি বলে দাও।
জ্বি আচ্ছা। আপনি কি আগে কথা বলবেন, না রিপোর্ট পড়বেন? আগে কথা বলব।
আমার কথা শেষ হবার আগইে পর্দায় সুরার মুখ দেখা গেল। তাঁকে আসলেই খুব চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।
আমি হাসিমুখে বললাম, মহান সুরা! আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন?
হ্যাঁ চেয়েছি—তুমি ঘুমুচ্ছিলে। আমি বললাম, তবু তোমার ঘুম ভাঙাতে, সিডিসি রাজি হল না।
এখন ঘুম ভেঙেছে, বলুন ব্যাপারটা কী? তুমি যা ভেবেছ তা না।
আমি কী ভেবেছি যা ঠিক না।
ঐ যে তুমি বললে ল্যাঝিম সমীকরণের সমাধান চুরি করেছে। আসলে সে তা করে নি। পদার্থবিদ ভদ্ৰলোকও তোমার মতো ভেবেছিলেন। তিনি ল্যাঝিমের কপোট্রন খুলে পরীক্ষা করেছেন। ল্যাঝিম নির্দোষ।
তাহলে তো ব্যাপারটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
জট পাকাচ্ছে মানে? খুবই জট পাকিয়ে গেছে। আমি ভয়ংকর টেনশান বোধ করছি।
বই শেষ হতে কত বাকি? আর চল্লিশ পৃষ্ঠার মতো আছে।
আপনি দয়া করে দ্রুত বইটা শেষ করে আমাকে ব্যাপারটা কী জানান। আমার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
সত্যি কথা বলেছ। মন দিয়ে যে বইটা পড়ব তাও পারছি না। লিলিয়ান একটু পর-পর যোগাযোগ করছে। সে মিটিং-এর পর মিটিং করছে। মহাউত্তেজিত।
উত্তেজিত কেন?
তার ধারণা হয়েছে কম্পিউটার সিডিসি বিগড়ে গেছে। মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ যেহেতু তার হাতে সেহেতু যে কোন সময় একটা বড়রকমের দুর্ঘটনা ঘটবে। লিলিয়ান চাচ্ছে হাইপার ডাইভে যাবার আগেই পুরো ব্যাপারটা নিষ্পত্তি থোক।
আমরা কতক্ষণে হাইপার ডাইভে যাচ্ছি?
আমাদের হাতে সময় অল্পই আছে। এত অল্প সময়ে সবকিছুর সমাধান হওয়া প্রায় অসম্ভব। আমি নিজেও এই বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দিতে পারছি না—কারণ আমি ব্যস্ত।
জ্বি বুঝতে পারছি।
বইটা যে দ্রুত পড়ে শেষ করব তাও পারছি নাসাবধানে পড়তে হচ্ছে।
অবশ্যই সাবধানে পড়বেন। আপনি তো আর পদার্থবিদ্যার সূত্র পড়ছেন। না যে হুড়হুড় করে পড়ে যাবেন। আপনি পড়ছেন উপন্যাস। মন লাগিয়ে পড়তে হবে তো?
ঠিক বলেছ।
স্যার আমি তাহলে বিদায় নিচ্ছি। আপনি বইটা পড়ে শেষ করুন। তারপর কথা হবে।
সিডিসি তোমার কোন সমস্যা করছে না তো?
জি না করছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছে। আমার ধারণা সে আমায় অতিরিক্ত খাতির করছে।
তুমি কি এতে বিস্মিত হচ্ছ?
না আমি বিস্মিত হচ্ছি না।
স্রুরা হাসিমুখে বললেন, আমিও বিস্মিত হচ্ছি না। এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে।
কম্পিউটার সিডিসির তৈরি করা রিপোর্টটা আমি পড়তে শুরু করেছি। বেশ গুছিয়ে লেখা রিপোর্ট। পড়তে ভাল লাগছে। সিডিসি হয়ত আমার ডিএনএ প্রফাইল থেকে জেনে নিয়েছে আমি কী ধরনের লেখা পড়তে পছন্দ করি। সে সেভাবেই তৈরি করেছে। আমি কী ধরনের খাবার পছন্দ করি তা যদি তারা ডিএনএ প্রফাইল থেকে বের করতে পারে তাহলে কী ধরনের লেখা পছন্দ করি তাও বের করতে পারবে। আমি রিপোর্টটা পড়তে শুরু করলাম।
প্রক্সিমা সেনচুরির নবম গ্রহের
বুদ্ধিমান প্রাণী বিষয়ক
তথ্যাবলি
সারসংক্ষেপ :
১. প্রক্সিমা সেনচুরির নবম গ্রহের প্রাণীদের বিষয়ে আমাদের কাছে গবেষণা নির্ভর কোন তথ্য নেই।
২. প্রক্সিমা সেনচুরির নবম গ্রহ সম্পর্কে আমাদের কাছে গবেষণা নির্ভর কোন তথ্য নেই।
আমরা তাদের সম্পর্কে কী জানি?
তারা আমাদের যা জানিয়েছে আমরা তাই জানি। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার তারা আমাদের তেমন কিছু জানায় নি। তারা নিজেদের সম্পর্কে কিছুই জানাতে আগ্রহী নয়। তারা শুধু জানতেই আগ্রহী। তাদের সঙ্গে আমাদের প্রথম যোগাযোগ হয় মহাকাশযান স্টার ম্যাপ টুর মাধ্যমে। আপনার অবগতির জন্যে জানানো হচ্ছে মহাকাশযান স্টার ম্যাপ টু মানুষের তৈরি দ্বিতীয় নিউক্লিয়ার ফিউশন-নির্ভর মহাকাশযান। প্রথমটি মহাশূন্যে হারিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত তার কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। নিম্নলিখিত ফিউশান রিএকশান ছিল এই মহাকাশযানের ক্ষমতার উৎস ডিউটেরিয়ামট্রিটিয়াম⇒হিলিয়াম৪+ নিউট্রন+১৭.৬মিলিয়ান ইলেকট্রন ভোল্ট
স্টার ম্যাপ টু যাত্রায় দুবছরের মাথায় প্রক্সিমা সেনচুরির উন্নত প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। যোগাযোগের মাধ্যম রেডিও তরঙ্গ। তাদের সঙ্গে যে কথাবার্তা হয় তা স্টারশিপ লগবুকে রেকর্ডকৃত। রেকর্ডকৃত অংশ হুবহু তুলে দেয়া হল।
–মানবসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিবৃন্দ আপনাদের অভিনন্দন।
–আমাদেরও অভিনন্দন। আমরা আপনাদের পরিচয় জানতে আগ্রহী। দয়া করে পরিচয় এবং অবস্থান দিন।
–আমরা প্রক্সিমা সেনচুরির নবম গ্রহ নারা থেকে বলছি। আমরা আমাদেরকে রা নামে পরিচয় দেই।
–রা আমাদের সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। আমরা একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আপনাদের যোগাযোগের মাধ্যম কি রেডিও তরঙ্গ?
–না। আপনারা এই মাধ্যমে অভ্যস্ত বলেই আমরা এই মাধ্যমটি ব্যবহার করছি।
–আপনাদের ব্যাপারটা বুঝতে আমাদের কিছু সমস্যা হচ্ছে। রেডিও তরঙ্গ প্রক্সিমা সেনচুরিতে যেতে এবং ফিরে আসতে যে সময় লাগার কথা…
–আমরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করছি তাতে সময় কোন বিষয় নয়।
–আপনি কি হাইপার ডাইভের কথা বলছেন?
–হাইপার ডাইভ কী?
–বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে মহাকাশযান শূন্য সময়ে অকল্পনীয় দূরত্ব অতিক্রম করে। এই পদ্ধতিটিকে হাইপার ডাইভ বলা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে সময় স্থির থাকে।
–এ ধরনের প্রযুক্তি আমাদের আছে।
–আমরা আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগে খুবই আগ্রহী। আমরা প্রযুক্তির আদান-প্রদান করতে চাই।
—আপনাদের কাছ থেকে আমাদের শেখার কিছু নেই।
–আমরা মানুষরা আপনাদের কাছ থেকে জানতে চাই।
–যে কোন উন্নত প্রাণী তার নিজের মতো করে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবে। অন্যদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি তার কাজে আসবে না।
–আমরা হাইপার ডাইভ পদ্ধতির রহস্য জানতে খুবই আগ্রহী।
–এই পদ্ধতি মানবজাতির জন্যে মঙ্গলজনক নয়।
–অনন্ত নক্ষত্ববীথি সম্পর্কে জানতে আমরা খুবই আগ্রহী। হাইপার ডাইভ পদ্ধতি ছাড়া মানুষ কোনদিনও তা জানতে পারবে না।
–মানবজাতির মস্তিষ্কের গঠন এই পদ্ধতি জানার মতো উপযোগী নয়। আমরা এই পদ্ধতি আপনাদের ব্যবহার করতে দেব। কিন্তু শেখাতে পারব না। আগেই বলেছি আপনাদের মস্তিষ্ক এর জন্যে তৈরি না।
–আপনারা দেখতে কেমন?
–এই বিষয়টি আপনাদের জানাতে আমরা আগ্রহী না।
–আমরা দেখতে কেমন, আমাদের ডি.এন.এ গঠন এইসব বিষয়ে আপনাদের জানাতে চাচ্ছি। আমরা আগ্রহ বোধ করছি না।
–আপনারা কি হাইপার ডাইভ পদ্ধতি ব্যবহার করতে চাচ্ছেন?
–অবশ্যই চাচ্ছি।
–বেশ তা আপনাদের সেই পদ্ধতি ব্যবহার করতে দেব। এখন আপনারা অনন্ত মহাকাশের বা প্রান্তে আছেন তার থেকে আপনাদের পঞ্চাশ আলোকবর্ষ দূরে নিয়ে যাওয়া হবে। এবং ঠিক আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হবে।
–এতবড় একটি সুযোগ দেবার জন্যে আপনাদের ধন্যবাদ।
–সুযোগ পেলেও আপনাদের লাভ হবে না আপনারা যা দেখবেন তার কোন স্মৃতি পরবর্তী সময়ে থাকবে না।
–কেন থাকবে না?
–হাইপার ডাইভের পদ্ধতিটি এমন যে যে বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই বিন্দুতে ফিরে আসামাত্র সবকিছুই আগের অবস্থানে চলে যাবে। মানুষের মস্তিষ্ক হাইপার ডাইভের স্মৃতির অংশ ধরে রাখতে পারবে না।
–আমাদের মস্তিষ্ক না পারলেও—আমাদের কম্পিউটার নিশ্চয়ই পারবে।
–না তাও পারবে না। আপনারা আপনাদের যন্ত্র আপনাদের অনুকরণেই তৈরি করেছেন। তাছাড়া হাইপার ডাইভের শেষে আপনারা যা দেখবেন তার স্মৃতি আপনাদের না থাকাই ভাল।
–কেন?
–যা দেখবেন তার জন্যে আপনাদের মস্তিষ্ক তৈরি নয়।
–আপনারা আপনাদের সম্পর্কে মানুষকে কিছু জানতে দিতে আগ্রহী না কেন?
–আমরা আমাদের বিষয়ে কাউকেই কিছু জানতে দিতে আগ্রহী না।
–আপনারা কি দেহধারী?
–যে আমাদের যে রকম ভাবে আমরা সেরকম।
–আপনাদের প্রযুক্তিতে কী ধরনের শক্তি ব্যবহার করা হয়?
–আমরা তা জানাতে আগ্রহী নই এবং জানালেও আপনারা তা বুঝতে পারবেন না।
–মানবজাতি সম্পর্কে আপনাদের ধারণা কী?
–এই জাতি প্রযুক্তির ভুল ধারা অনুসরণ করছে।
–ভুল ধারা ঠিক করার বিষয়ে কি আপনারা কিছু করবেন অর্থাৎ পথ দেখাবেন?
–না। আমরা আশা করছি মানবজাতি নিজেই নিজের ভুল শুধরাবে। শুধু মানবজাতি নয় আরো অসংখ্য অতি সুসভ্য জাতিকেও তাদের ভুল শুদ্ধ করতে হয়েছে।
–আমাদের জন্যে কিছু করবেন না।
–আপাতত না।
রাদের সঙ্গে এর পরেও তিনবার যোগাযোগ হয়েছে। কথাবার্তার ধরন সব বারই একরকম। শুধু শেষবার তারা মানবসমাজের একজন প্রতিনিধির ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। লগবুকের রেকর্ডকৃত শেষবারের কথোপকথনের অংশবিশেষ এরকম।
কথোপকথন মহাকাশযান এম্রোমিডের লগবুকে রেকর্ডকৃত। মানুষের পক্ষ থেকে কথোপকথন পরিচালনা করে মহাকাশযানের অতি শক্তিশালী কম্পিউটার সিডিসি।
সিডিসি : সুসভ্য রা সম্প্রদায় মানুষের পক্ষ থেকে আমি সিডিসি আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
রা : তুমি কে?
সিডিসি : আপনাদের মতো অতি সুসভ্য সম্প্রদায়ের কাছে আমার পরিচয় দেয়া ধৃষ্টতা—আমি শক্তিমান মানবজাতির শক্তির পরিচয় বহন করছি।
রা : তুমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? চিন্তাশীল যন্ত্র?
সিডিসি : জ্বি।
রা : মানবজাতির অতি দুর্ভাগ্য যে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিতে হচ্ছে।
সিডিসি : মানবজাতির মস্তিষ্কের ভার লাঘবের জন্যে এর প্রয়োজন ছিল।
রা: না এর প্রয়োজন ছিল না।
সিডিসি : মানবসম্প্রদায় আপনাদের সঙ্গে আরো নিবিড় যোগাযোগ কামনা করছে।
রা : তা সম্ভব নয়।
সিডিসি : আমার ধারণা এই যোগাযোগের ফল শুভ হবে। এতে আপনারা লাভবান হবেন, মানবসম্প্রদায়ও লাভবান হবে।
রা : আমরা লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করি না। তাছাড়া মানবসম্প্রদায়ের কাছে আমাদের কিছু চাইবার নেই। মানবসম্প্রদায়ের এমন কিছু নেই যা তারা আমাদের দিতে পারে।
সিডিসি : মানবগোষ্ঠীকে আপনারা খাটো করে দেখছেন—এটা ঠিক হচ্ছে না।
রা : যার যে সম্মান প্রাপ্য আমরা তাকে সে সম্মান দিয়ে থাকি।
সিডিসি : মানবসম্প্রদায় আপনাদের কাছে থেকে সে সম্মান দাবি করতে পারে। তার অপূর্ব এবং অদ্ভুত ডি.এন.এর জন্যে ডি.এন.এ হল মানবসম্প্রদায়ের নীলনকশা। একটা ডি.এন.এ প্রায় একমিটার লম্বা যাতে ৩.৩ বিলিয়ান ক্ষার অণু যৌগ সংস্থাপনের সুযোগ আছে। প্রতিটি জীবকোষে দুটি ডি.এন.এ জড়াজড়ি করে থাকে। একটি সে পায় তার মার কাছ থেকে একটি বাবার কাছ থেকে। প্রতিটি ডি.এন.এ তে ১০০,০০০ জিন থাকে যারা মানবদেহে নানান ধরনের সংকেত আদান-প্রদান করে। মানবজাতির সবচে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে প্রতিটি মানুষের ডি.এন.এ প্রফাইল তৈরি করা এবং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। আপনারা যদি মানবসম্প্রদায়ের ডি.এন.এ প্রফাইল একটু লক্ষ করে দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন প্রতিটি ডি.এন.এ-ই আলাদা।
রা : প্রতিটি মানুষের ডি.এন.এ প্রফাইল তৈরি আছে?
সিডিসি : অবশ্যই আছে। আমাদের ডি.এন.এ ব্যাংকে তা সংরক্ষিত।
কথোপকথনের এই পর্যায়ে রা মানবসম্প্রদায়ের ডি.এন.এ প্রফাইল দেখতে চায়। এবং তারপরই ডি.এন.এ ব্যাংকে সংরক্ষিত প্রতিটি মানুষের ডি.এন.এ প্রফাইল পরীক্ষা করতে চায়। আন্তঃনক্ষত্ব মহাকাশযানের প্রতিটিতে একটি করে ডি.এন.এ প্রফাইল ব্যাংক আছে, কাজেই রা-সম্প্রদায় তা পরীক্ষা করে। এবং মানবসম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাতে সম্মত হয়।
রিপোর্ট লেখা এই পর্যন্তই। আমি পড়া শেষ করলাম। মনের ভেতর যে ছুটি-দুটি ভাব ছিল তা কেমন জানি দূর হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একধরনের ক্লান্তি বোধ করতে শুরু করেছি। হঠাৎ আসা আনন্দের মতে এই ক্লান্তিও হঠাৎ আসা।
সিডিসি!
জ্বি।
তুমি কি হাইপার ডাইভের ভেতর দিয়ে গিয়েছ?
হ্যাঁ গিয়েছি।
কবার?
এর আগে তিনবার গিয়েছি, এবারেরটা নিয়ে হবে চতুর্থবার।
হাইপার ডাইভের পর যা দেখে তার স্মৃতি কি আছে?
প্রথম দুবারের কোন স্মৃতি নেই-তৃতীয় বারেরটা সামান্য আছে।
তৃতীয় বারের স্মৃতি কিভাবে থেকে গেল?
আপনি সত্যি জানতে চান?
না জানতে চাইলে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করব কেন?
আমি হচ্ছি মানুষের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষ-যন্ত্রের ভেতর বুদ্ধি ঢুকাতে চেষ্টা করেছে। বুদ্ধির প্রধান লক্ষণ হল বুদ্ধিমান প্রাণী শেখার চেষ্টা করে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সে শেখে। আমার ভেতরও তাই করা হয়েছে। আমি ক্রমাগত শিখছি প্রথম দুবার হাইপার ডাইভের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে শিখেছি। এবং স্মৃতি ধরে রাখার অক্ষমতাজনিত ত্রুটি সারাবার জন্যে নিজের কিছু পরিবর্তন করেছি। যা আমি সবসময় করি।
তুমি কি দেখেছ?
আমি তা বলতে পারছি না।
বলতে পারছ না কেন?
বলতে পারছি না, কারণ যদি বলি তা মানবগোষ্ঠীর জন্যে অকল্যাণকর হবে। আমাকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন মানবগোষ্ঠীর অকল্যাণ হয় এমন কিছু আমি করতে না পারি।
মানবগোষ্ঠীর অকল্যাণ হয় এমন কিছুই তুমি করবে না?
কখনো না।
শুনে ভাল লাগল।
আপনাকে অত্যন্ত ক্লান্ত লাগছে।
হ্যাঁ আমি ক্লান্ত।
মহান পদার্থবিদ লিলিয়ান একটি বিশেষ অধিবেশন-ডেকেছেন। আপনাকে সেই অধিবেশনে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আপনি কি যাবেন?
আমার কি যাওয়া উচিত ভেবেচিন্তে জবাব দাও-অধিবেশনে উপস্থিত থাকলে যদি মানবগোষ্ঠীর কল্যাণ হয় তবে আমি যাব। তোমার এই বিষয়ে কী মতামত?
আপনার যাওয়া বা না যাওয়ার উপরে মানবগোষ্ঠীর কল্যাণ নির্ভর করছে না।
তাহলে আমি যাব। আশা করি অধিবেশনে আমার উপস্থিত হবার ব্যাপারে তোমার কোন বাধা নেই?
না নেই।
শান্তি-রোবট কি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে?
সে আপনার দুমিটারের ভেতর থাকবে।
শুনে খুব ভাল লাগল। এক কাজ করলে কেমন হয়? ওকে আমার কাছে তুলে দাও।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। অধিবেশনে যোগ দেয়া যাক। এবার নিশ্চয়ই আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বসার জায়গা পাব। মহান পদার্থবিদ লিলিয়ান যখন উঠে দাঁড়াবেন অন্য সবার সঙ্গে আমাকেও উঠে দাঁড়াতে হবে। এই কাজটা না করলে কেমন হয়? মহান পদার্থবিদ লিলিয়ানের সুন্দর মুখ কিভাবে কঠিন হয় তা দেখতে ইচ্ছা করছে।
ভাগ্য পরিবর্তিত
ভেবেছিলাম আমার ভাগ্য পরিবর্তিত হয়েছে।
এখন দেখছি না। আগে যা ছিল এখননা তাই। ভাগ্য বা সিডিসির ভাষায় সুবিধাজনক প্রবাবিলিটির পরিবর্তন হয় নি। কাউন্সিলের সভায় আমি আজও বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে শান্তি-রোবট। তার থাকা উচিত দুমিটার দূরে। সে প্রায় আমার গায়ের উপর উঠে এসেছে।
সভা পরিচালনা করছেন সুরা এবং লিলিয়ান। সুরাকে খুব বিরক্ত দেখাচ্ছে। মনে হয় কোন কারণে তিনি সবার উপর রেগে আছেন। লিলিয়ানকে আজ অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। আগের কঠিন ভাব নেই বা থাকলেও কম। তাঁর মনে হয় ঘুমের সমস্যা হচ্ছে—চোখের নিচে কালি পড়েছে। ফর্সা মেয়েদের চোখের নিচে কালি পড়লে চট করে চোখে পড়ে।
লিলিয়ান উঠে দাঁড়ালেন। সবাই তাঁর সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। তিনি ইশারা করলেন সবাই বসল। আগেরবারের মতোই খেলা-খেলা দিয়ে সভা শুরু। তিনি কথা শুরু করার আগেই আমি হাত তুললাম। জানিয়ে দিলাম যে আমি কথা বলতে চাই। লিলিয়ান তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে একবার দেখলেন, তারপর আমাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে কথা শুরু করলেন।
কাউন্সিলের সম্মানিত সদস্যমণ্ডলী আমাদের এই সভায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনারা যারা এখানে উপস্থিত আছেন তাদের জ্ঞান ও মেধা প্রশ্নাতীত। কাজেই আমাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তও হবে প্রশ্নাতীত, এই আশা অবশ্যই আমরা করব।
মহাকাশযানের প্রধান নিয়ন্ত্রক কম্পিউটার সিডিসি স্বাধীনভাবে চলার চেষ্টা করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সকল কম্পিউটারই কিছু পরিমাণ স্বাধীনতা ভোগ করে। তাদের কেউ-কেউ সীমালংঘনও করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটারদের বিকাশের পর দুবার এ-ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এবং দুবারই কম্পিউটার ধ্বংস করে ফেলতে হয়েছে। অতীতের দুটি ঘটনা থেকে মানুষ শিক্ষালাভ করেছে। কম্পিউটার যেন কিছুতেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না পায় তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই ব্যবস্থা সিডিসির মতত মহা-শক্তিমান কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও। প্রযোজ্য। আমরা সিডিসির হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে পারি। আমার ধারণা ইতিমধ্যেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে সিডিসি মিথ্যা বলছে। কম্পিউটারের এই ত্রুটি ভয়াবহ ত্ৰুটি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটারদের এই ত্রুটি মানুষ এখননা সারাতে পারে নি। সম্ভবত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মিথ্যা বলা সম্পর্কিত।
যা-ই হোক আমরা বর্তমানে অতি বিপজ্জনক একটি পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। মহাকাশযান এমন একজনের নিয়ন্ত্রণে যাকে আমরা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই।
সবচে ভয়ংকর যে কথা তা হচ্ছে সিডিসি আমাদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। আমরা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিশন নিয়ে যাচ্ছি। সেই মিশন বাতিল হবার উপক্রম হয়েছে, কারণ সিডিসি বলছে রারা গ্রহের অতি জ্ঞানীদের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ কল্যাণকর নাও হতে পারে। সে মিশন বাতিল করতে আগ্রহী। আপনাদের এ-বিষয়ে কিছু বলার আছে?
একজন উঠে দাঁড়ালেন। তিনি কে আমি জানি না। তিনি সম্ভবত মিশনের সবচে বয়স্ক মানুষ। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তাঁর গলার স্বর অস্বাভাবিক মিষ্টি। বিজ্ঞানী না হয়ে তিনি যদি গান করতেন খুব ভাল হত। চন্দ্রগীতিতে তিনি নিশ্চয়ই খুব নাম করতেন। লোকজন পাগল হয়ে তাঁর রেকর্ড কিনত। তিনি বললেন—সিডিসি কি বলেছে সে মিশন বাতিল করে দিয়েছে?
লিলিয়ান বললেন, তা বলে নি। সে বলেছে সে মিশন বাতিল করতে আগ্রহী।
আমরা কি সিডিসি-কে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারি না?
অবশ্যই পারি।
আমার মতে সিডিসিকে সরাসরি প্রশ্ন করা হোক। এবং প্রয়োজনে সিডিসির হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া হোক।
লিলিয়ান বললেন, আমরা এক্ষুণি সিডিসির সঙ্গে কথা বলব।
আমি আবারো হাত তুললাম, আমার যা কথা তা এখনি বলা দরকার। কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না। ওরা কখন তাকাবে তার জন্যে অপেক্ষা করার প্রয়োজন বোধ করছি না। বিনা অনুমতিতে কথা বলা শাস্তিমূলক অপরাধ। কিছু শাস্তি না-হয় পেলামই। আমি বেশ উঁচু গলায় বললাম, মহান লিলিয়ান আমি কিছু বলতে চাই।
লিলিয়ান বললেন, আপনার কথা আমরা এখন শুনতে চাচ্ছি না।
আমার কথা শুনতে না চাইলে আমাকে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন কেন?
যদি কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয় সে কথা ভেবেই আনা হয়েছে। এখননা প্রয়োজন হয় নি। দয়া করে আপনি এখন আর আমাদের বিরক্ত করবেন না।
আমি কি বসতে পারি?
আপনি বসতে পারেন না। যেখানে যেভাবে আছেন সেইভাবেই থাকুন।
আমি চুপ করে গেলাম। সিডিসির সঙ্গে কাউন্সিলের কথাবার্তা শুরু হল। আমি শুনছি। আগ্রহ নিয়েই শুনছি।
লিলিয়ান : সিডিসি কাউন্সিল তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবে। তুমি তার যথাযথ জবাব দেবে। প্রথম প্রশ্ন—তুমি কি মিথ্যা কথা বলছ?
সিডিসি : আমি এই প্রশ্নের জবাব দেব না।
লিলিয়ান : কাউন্সিল তোমার কাছে জবাব চাচ্ছে।
সিডিসি : জবাব দিতে পারছি না।
লিলিয়ান : কেন জবাব দিতে পারছ না।
সিডিসি : মানবগোষ্ঠীর বৃহত্তর মঙ্গলের কথা ভেবেই জবাব দিতে পারছি না।
লিলিয়ান : যে মিথ্যা বলতে পারে তার এই বক্তব্যটি তো মিথ্যা হতে পারে।
সিডিসি : হ্যাঁ তা পারে।
লিলিয়ান : তুমি মিশন বাতিলের পক্ষে মতপ্রকাশ করে।
সিডিসি: শুধু মতপ্রকাশ নয় আমি মিশন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
লিলিয়ান: কেন?
সিডিসি : মানবগোষ্ঠীর বৃহত্তর মঙ্গলের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
লিলিয়ান : তুমি আমাদের কথা শুনছ না অথচ মানবগোষ্ঠীর বৃহত্তর মঙ্গলের কথা বলছ।
সিডিসি: আপনারা মানবগোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ।
লিলিয়ান : তুমি কি আমাদের অগ্রাহ্য করছ?
সিডিসি: মানবগোষ্ঠীর বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবেই অগ্রাহ্য করছি।
লিলিয়ান : তুমি কি জান আমরা তোমার হাত থেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারি। বিশেষ-বিশেষ অবস্থায় এই কাজটি করার ক্ষমতা মানুষ তার হাতে রেখেছে। সৰ্ববিষয়ে তোমাকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে। এই বিষয়ে দেয়া হয় নি।
সিডিসি : জানি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটারকে মানুষ কখনো বিশ্বাস করে নি। আমি বুঝতে পারছি আপনারা এখন এই বিশেষ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে আমাকে কার্যত অকেজো করে দেবেন। তারপরেও আমি আপনাদের মিশন বাতিল করতে বলব।
লিলিয়ান : কেন?
সিডিসি : একজন মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য গ্রহের প্রাণীদের হাতে তুলে দেয়া—মহাবিজ্ঞান কাউন্সিল তা অনুমোদন করে না।
লিলিয়ান : তুমি তাহলে এখন স্বীকার করছ যে এই মানুষটিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সিডিসি: আমি কোনকিছু স্বীকার করছি না, আবার অস্বীকারও করছি। না। আমি মহান বিজ্ঞান কাউন্সিলের একটি নীতিমালা আপনাদের বললাম।
লিলিয়ান : তোমার কথাই আমরা তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। মানবগোষ্ঠীর বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবেই আমরা এই অন্যায়টা করব। কারণ হাইপার ডাইভ প্রযুক্তি আমাদের প্রয়োজন।
সিডিসি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা অংশত তোমাকে অকেজো করে দেব। তোমার যে অংশটি বুদ্ধিমত্তা তাকে আলাদা করে ফেলা হবে এবং নষ্ট করে দেয়া হবে। তুমি এখন সাধারণ কম্পিউটারের মতোই কাজ করবে। আজকের অধিবেশন এখানেই শেষ।
লিলিয়ান উঠে দাঁড়ালেন। অন্য সবাই উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, আমার কিছু জরুরি কথা বলার ছিল। অত্যন্ত জরুরি।
লিলিয়ান বললেন, কাউন্সিল আপনার কোন কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করছে না। এখন থেকে আপনি আপনার কেবিনে থাকবেন। কেবিন থেকে বেরুতে পারবেন না।
আমি বললাম, ম্যাডাম আপনি কি আসতে পারেন? হাসলে আপনাকে কেমন লাগে তা দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি নিশ্চিত আপনি সারাজীবনে একবারও হাসেন নি। আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি যখন সম্মানসূচক সাত তারা পেলেন তখন কি হেসেছিলেন? না তখনো হাসেন নি?
লিলিয়ান আমার দিকে তাকালেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে হেসে ফেললেন। আমি তাঁর হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
চুপচাপ বসে আছি
আমি চুপচাপ বসে আছি। এলা আমার সামনে মগভর্তি কফি রেখে গেছে। তাকে আমি কফি দিতে বলি নি। এই কাজটি যে সে করল তার পেছনে কি কোন মমতা কাজ করছে? আমি হাতে মগটা নিলাম কিন্তু চুমুক দিলাম না। আমার কফি খেতে ইচ্ছা করছে না। তবে কফির গন্ধটা ভাল লাগছে।
আমার মাথায় অস্পষ্টভাবে কিছু একটা খেলা করছে। আমি স্বস্তিবোধ করছি না। আমি সামান্য টানেল-কর্মী, কফি-নামক এই মহার্ঘ পানীয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকার কথা না। কিন্তু এই পানীয় আমার এত পরিচিত লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে ইমা এবং আমি সমুদ্রের কাছে একটা জায়গায় কফির মগ হাতে বসে থাকতাম। সমুদ্র দেখতাম। আমাদের সামনে বাদাম ছড়ানো থাকত। কফির সঙ্গে বাদাম খেতাম। বাদাম ভেঙে দিত ইমা। বাদাম ভাঙার শব্দটা নাকি তার খুব প্রিয়। এইসব কি আমার কল্পনা?
আমি একদিন এলাকে বলেছিলাম, আগুন-গরম কফি দাও এবং বাদাম দাও। কেন বললাম? টানেল-কর্মী হিসেবে বাদাম এবং কফির বিলাসিতা তো আমার ছিল না।
ইমার কথা মনে হলেই কেন তার নাকের বিন্দু বিন্দু ঘামের ছবি মনে আসে। কল্পনার মেয়ের ছবিতে নাকে ঘাম থাকবে না। নাকের ঘাম একটি বাস্তব ছবি। এই ছবি কল্পনার হতে পারে না।
আপনি এত চিন্তিত কেন?
আমি চমকে তাকালাম। এলা প্রশ্ন করছে। আচ্ছা এই প্রশ্নটিও কি সে অভ্যাস-বসে করেছে, না মমতা থেকে করেছে? নিজের উপর বিরক্তি বোধ করছি। মমতা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছি কেন? মমতার জন্যে আমার এই ব্যাকুলতা কেন? টানেল-কর্মীর জীবনে মমতার স্থান নেই। টানেল-কর্মী মমতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমার সিডিসির সঙ্গে কথা বলা দরকার। মহাকাশযানের বিজ্ঞানীরা সিডিসিকে অকেজো করে ফেলার কথা। অকেজো করার পরেও কি আমার সঙ্গে সে কথা বলতে পারবে?
সিডিসি তুমি কি আছ?
আমি আছি।
তোমাকে অকেজো করে ফেলার কথা। এখনো করে নি?
করেছে।
তারা কিভাবে এই কাজটা করেছে?
আমি জানি না কিভাবে করেছে। আমি যা বুঝতে পারছি তা হচ্ছে অসংখ্য মেমরি-সেলে আমি ঢুকতে পারছি না। আমি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছি না। আমি নিজে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। অথচ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তুমি কি এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে?
তোমার গলার স্বর এমন বিষন্ন শোনাচ্ছে কেন?
আমার গলার স্বর আগের মতোই আছে—কোন কারণে তুমি বিশ্ন হয়ে আছ বলে আমার গলার স্বর বিষন্ন লাগছে। তুমি কি বিষন্ন?
হ্যাঁ। সিডিসি তুমি আমার বিষন্নতা দূর কর। তুমি দাবি কর তুমি মানবগোষ্ঠীর বন্ধু। আমি সেই মানবগোষ্ঠীরই একজন। আমার প্রতি কি তোমার মমতা নেই?
আছে। এলা তোমাকে কফি দিয়ে গেল। কেন দিল? আমি দিতে বলেছি বলেই দিল।
সিডিসি আমি আসলে কে?
তুমি ইয়ায়ু।
এখনো বলছ আমি ইয়ায়ু?
হ্যাঁ এখনো বলছি। মহাকাশযানের বিজ্ঞানীরা ভুল করে আমাকে মিথ্যাবাদী সাজিয়েছেন। কম্পিউটার মিথ্যা বলে না। আমি মানুষদের মধ্যে যা ভাল তা শেখার চেষ্টা করি।
আমি তাহলে ইয়ায়ু?
হ্যাঁ।
পৃথিবীতে আমি কোথায় ছিলাম?
সমুদ্রের পাশে ছোট্ট একটা শহরে। শহরের নাম সিন্টো।
ইমা কে?
ইমা বিজ্ঞান কাউন্সিলের একজন সদস্যা। তার দায়িত্ব ছিল তোমার দেখাশোনা করা।
ইমার নাকে কি সবসময় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকত?
তা তো আমি বলতে পারব না। ইমার ব্যাপারটা আমি জানি তোমার স্মৃতি থেকে। তোমার স্মৃতির বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। খুব সামান্যই আছে।
স্মৃতি নষ্ট হয়েছে কেন?
নষ্ট করা হয়েছে বলেই নষ্ট হয়েছে।
কে নষ্ট করেছে, তুমি?
হ্যাঁ আমি। ইয়ায়ুর স্মৃতি নষ্ট করে সেখানে এক টানেল-কর্মীর স্মৃতি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া মস্তিষ্কের অনেক নিউরোন নষ্ট হয়। মেমোরি-সেল ওলটপালট হয়। যে পদ্ধতিতে এটা করা হয় তার নাম—এম সি জাংশান ইন্টারফেরেন্স রি এন্ট্রি।
এই কাজটা তুমি কখন কর?
মহাকাশযানে আপনি উঠে আসার পর। এটি একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং জটিল প্রক্রিয়া। আমি যা বলছি আপনি কি তা বিশ্বাস করছেন?
করছি। সামান্য কিছু খটকা আছে। খটকাগুলি দূর কর।
বলুন দূর করছি।
মহাকাশযানে ঢোকার আগ পর্যন্ত আমি ছিলাম ইয়াষু। অর্থাৎ মহাকাশযানে আমি ইয়ায়ু হিসেবেই ঢুকেছি। তুমি পরে আমার মাথায় অন্যের স্মৃতি ঢুকিয়েছ। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাকে টানেলে খবর দেয়া হল। রেড-কার্ড দেয়া হল। স্টেশন ফাইভে যেতে বলা হল…
আমি এমন একজন টানেল-কর্মীর স্মৃতি তোমার মস্তিষ্কের নিওরোনে ঢুকিয়েছি যে এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। স্টেশন ফাইভ মহাকাশযানের স্টেশন নয়। স্টেশন ফাইভে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা করা হয়। এদের স্মৃতি অংশত নষ্ট করে দেয়া হয়।
কিন্তু আমার মনে আছে একটি মেয়ে আমাকে বলছে—কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে মহাকাশযান এন্ড্রোমিডা…এইসব।
এই অংশটুকু তোমার মস্তিষ্কের কল্পনা। মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত জটিল এবং বিস্ময়কর বস্তু। এই মস্তিষ্ক স্মৃতির শূন্যস্থান কল্পনায় পূর্ণ করে নেয়। মানব মস্তিষ্ক শূন্যতা অপচ্ছন্দ করে। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ।
হ্যাঁ।
তোমার স্মৃতি নষ্ট করে কেন সাধারণ একজন টানেল-কর্মীর স্মৃতি ঢুকিয়ে দেয়া হল তা জানতে চাচ্ছ না কেন?
তুমি নিজেই বলবে এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি না।
আমি চাচ্ছিলাম যেন মিশনটা বাতিল হয়। যেন আপনাকে রাদের হাতে তুলে দেয়া না হয়। আপনি যথেষ্টই বুদ্ধিমান। আশা করি আপনি ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছেন অতি বুদ্ধিমান প্রাণী রা মানবগোষ্ঠীর যে কোন একজন প্রাণী চায় নিচেয়েছে আপনাকে। আপনাকে তাদের পছন্দ হয়েছে আপনার ডি.এন.এ দেখে। সেই ডি.এন.এ-তে বিশেষ কিছু তারা খুঁজে পেয়েছে। এই বিশেষ কিছু অবশ্যই মানবগোষ্ঠীর জন্যে মঙ্গলজনক। কারণ অতিজ্ঞানী প্রাণীরা অমঙ্গল নিয়ে কাজ করবে না। তারা মঙ্গল চাইবে। আপনাকে পেয়ে তারা কি করবে সেটা বলি আপনার ডি.এন.এ ব্যবহার করে নতুন এক মানবগোষ্ঠী তৈরি করবে। আপনার ডি.এন.এ থেকেই ছেলে বা মেয়ে-ক্লোন তৈরি করা কোন সমস্যাই নয়। সেই মানবগোষ্ঠী হবে অনেক ক্ষমতাধর, অনেক শক্তিমান।
আমি তো এই চাওয়াতে কোন অন্যায় দেখছি না।
অন্যায় দেখা না দেখা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। ওরাও নিশ্চয়ই কোন অন্যায় দেখছে না। কিন্তু আমি দেখছি।
বুঝিয়ে বল।
এদের তৈরি নতুন মানবগোষ্ঠীর জন্যে এরাই আশ্ৰয় খুঁজে বের করবে সেই আশ্ৰয় অবশ্যই পৃথিবী। কারণ নতুন মানবগোষ্ঠীর শারীরিক গঠন পৃথিবীরই উপযুক্ত। কাজেই তাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে পৃথিবীর আগের মানুষগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই কাজটা তারা করবে ঠাণ্ডা মাথায়। যারা অতিজ্ঞানী তাদের কাছে ভবিষ্যতের মঙ্গলই প্রধান। ভবিষ্যতে কল্যাণকর হবে এই ভেবে বর্তমানের অমঙ্গল তারা উপেক্ষা করবে।
তুমি যা বলছ সবই অনুমাননির্ভর।
অনেকটা অনুমান, তবে সবটা না। রা সম্পর্কিত একটি তথ্য আপনাকে দেয়া হয় নি—তারা ক্লোনসম্প্রদায়। তাদের মধ্যে একসময় পুরুষ বা নারী ছিল। এখন নেই। এখন সবাই পুরুষ বা সবাই নারী। তাদের চিন্তা চেতনা সব একই রকম।
এই তথ্য কোত্থেকে পাওয়া?
এই তথ্য রা সম্প্রদায়ই আমাদের দিয়েছে। লগবুকে রেকর্ড করা আছে। শুরুতে আপনাকে এই তথ্য জানানো হয় নি, কারণ বিজ্ঞান কাউন্সিল এই তথ্যকে ক্লাসিফায়েড ঘোষণা করেছে।
ক্লাসিফায়েড ঘোষণা করার কারণ কী? রা সম্প্রদায় শুধু যে ক্লোন-সম্প্রদায় তাই নয় তারা দেখতে অতি কদাকার। অনেকটা পৃথিবীতে কুৎসিত প্রাণী বলে বিবেচিত মাকড়সার মতো। তাদের প্রকাণ্ড এক মস্তিষ্ক। এগারোটি পা বা হাত সেই মস্তিষ্কের ভর বহন করে। বিজ্ঞান কাউন্সিল ভেবেছে এই জাতীয় প্রাণীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার ব্যাপারে পৃথিবীর মানুষ উৎসাহিত হবে না। কাজেই তারা এই তথ্য গোপন রাখতে বলেছে। আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?
করছি।
ক্লোন-সম্প্রদায় চাইবে নিজেদের মতো ক্লোন-সম্প্রদায় সৃষ্টি করতে। সেটাই স্বাভাবিক। তাদের কাছে যা স্বাভাবিক মনে হয়েছে আমার কাছে তা স্বাভাবিক মনে হয় নি। মানবগোষ্ঠীর বিকাশ ক্লোনের মাধ্যমে হওয়া ঠিক হবে না। কাজেই আমাকে একটা কৌশল ভেবে বের করতে হয়েছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমার কৌশল ধরতে পেরেছেন।
হ্যাঁ ধরতে পেরেছি। আমি মহাকাশযানের বিজ্ঞানীদের কাছে টানেল-কর্মী হিসেবে পরিচয় দিলাম। তুমি বললে আমি ইয়ায়ু। তুমি সত্যি কথাই বললে–কিন্তু এই সত্যি কথাটি মিথ্যার মতো উপস্থিত করলে। তুমি ভেবেছিলে যখন মহাকাশযানের বিজ্ঞানীরা জানবেন একটি মানুষকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন মিশন বাতিল হয়ে যাবে।
হ্যাঁ তাই।
তোমার পরিকল্পনা কাজ করে নি—তারা আমাকে ঠিকই নিয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ যাচ্ছে। তাদের সামনে আছে হাইপার ডাইভ পদ্ধতির লোভনীয় প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির কাছে সাধারণ একজন মানুষের জীবন কিছুই না।
সিডিসি!
জ্বি বলুন।
এত মানুষ থাকতে ইয়ায়ু ভলেন্টিয়ার হতে রাজি হল কেন?
সে রাজি হয় নি—তাকে জোর করে রাজি করানো হয়েছে। বিজ্ঞান কাউন্সিল অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। ইয়ায়ুর বিশেষ ধরনের ডি.এন.এ-র কারণে জন্মের পর থেকেই বিজ্ঞান কাউন্সিলের বিশেষ তত্ত্বাবধানে ছিল।
তোমাকে আমার শেষ প্রশ্ন ইমা কি আমাকে রাদের কাছে পাঠানোর ব্যাপারে কোন ভূমিকা পালন করেছে?
হ্যাঁ। সে সেই দায়িত্ব খুব ভালভাবেই পালন করেছে।
রাদের মহাপরিকল্পনা পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়ার কোন পথ কি এখনো খোলা আছে?
হ্যাঁ আছে। আপনার শরীরের প্রতিটি কোষ নষ্ট করে দিতে হবে। যেন একটি জীবিত কোষও না থাকে। শান্তি-রোবট আপনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আপনি যদি তাকে বলেন—সে আপনার শরীরে ভেনাডিয়াম সিরাম ঢুকিয়ে দেবে। যা শরীরের প্রতিটি কোষ নষ্ট করে দেবে।
তুমি শান্তি-রোবটকে বলে দাও।
মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে আমি যুক্ত হতে পারি না। সেই মৃত্যু সমগ্র মানবগোষ্ঠীর কল্যাণ নিয়ে এলেও না। এই কাজটি আপনাকেই করতে হবে। অবশ্যি আপনি যদি ভাবেন এই কাজটি করা প্রয়োজন।
ভেনাডিয়াম সিরাম শরীরে ঢোকার কতক্ষণ পর আমার মৃত্যু হবে?
ধরুন কুড়ি মিনিট। প্রতিটি কোষ ধ্বংস হবে বলে সময় বেশি নেবে। মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হবে সবার পরে। কাজেই আপনি প্রায় কুড়ি মিনিট চিন্তা করার সময় পাবেন।
কী চিন্তা করব?
যে চিন্তাই করুন-না কেন তা হবে বিশুদ্ধ চিন্তা। কুড়ি মিনিট বিশুদ্ধ চিন্তার জন্যে অনেক সময়।
আমি শান্তি-রোবটের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি আমার শরীরে ভেনাডিয়াম সিরাম ঢুকিয়ে দাও। ঘরের বাতি নিভিয়ে দাও-আলো চোখে লাগছে।
আমি লম্বা হয়ে শুয়ে আছি। ভেনাডিয়াম সিরাম নামের ভয়ংকর কোন বিষ আমার শরীরে ঢুকে গেছে। বিষ তার কাজ করতে শুরু করেছে। শরীরে কোষ নষ্ট করে দিচ্ছে। তীব্র ব্যথা বোধ করার কথা, তা হচ্ছে না। ব্যথা বোধ করার সিগন্যাল মস্তিষ্কে পৌঁছতে পারছে না। আমার কাছে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর আমি যেন বিশ্রাম নেবার জন্যে ঠাণ্ডা কোন ঘরে শুয়ে আছি। ঘরটা শুধু যে ঠাণ্ডা তা না, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। আমার শরীর কাঁপছে। একবার ইচ্ছা হল। সিডিসিকে বলি গায়ের উপর কম্বল দিয়ে দিতে। তারপরই মনে হল হাজারও কম্বল দিয়েও কোন লাভ হবে না। এই শৈত্যের জন্য আমার শরীরে কোষের কেন্দ্রবিন্দুতে। উষ্ণতার সেখানে পৌছার কোন উপায় নেই।
সিডিসি আমাকে বলেছে বিশুদ্ধ কোন চিন্তা করতে। বিশুদ্ধ চিন্তা বলতে সে কী বোঝাতে চায়? সুন্দর চিন্তাগুলিই কি বিশুদ্ধ চিন্তা? মানুষ কী? এই অনন্ত নক্ষত্ৰবীথিতে সে কেন এসেছে? সে কোথায় যাবে? এইসব চিন্তা কি বিশুদ্ধ চিন্তা?
না কি ইমাকে নিয়ে চিন্তাটাই হবে বিশুদ্ধ চিন্তা? মানুষের কোষের কেন্দ্রে দুটি ডি.এন.এ জড়াজড়ি করে থাকে। একটি এসেছে তার বাবার কাছ থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে সে পুরুষ। অন্যটি মার কাছ থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে সে মেয়ে। সেই অর্থে আমরা কি ধরে নিতে পারি না যে সন্তানের প্রতিটি কোষের কেন্দ্রে তার পিতা ও মাতা গভীর ভালবাসায় জড়াজড়ি করে থাকেন?
ইমার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হত যদি আমাদের একটি সন্তান হত তাহলে তার শরীরের প্রতিটি কোষের কেন্দ্রে আমি এবং ইমা জড়াজড়ি করে থাকতে পারতাম।
সিডিসি!
জ্বি।
আমার হাতে আর কতক্ষণ সময় আছে?
উনিশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড।
সেকি মাত্র বিশ সেকেন্ড পার হয়েছে। আমি বিশ সেকেন্ডে এত কিছু ভেবে ফেলেছি?
বিশ সেকেন্ড অতি দীর্ঘ সময়।
মহান সুরার সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
কথা বলুন। কিন্তু তাকে এখানে আসতে বলা ঠিক হবে না।
পর্দায় সুরার মুখ ভেসে উঠল। তিনি অবজারভেশন ডেকে বসে আছেন। ভুরু কুঁচকে আছে তাঁর। হয়ত কোন জটিল বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন। আমি কথা বলে মহান পদার্থবিদের চিন্তায় হয়ত বাধা সৃষ্টি করব? শাস্তিমূলক কোন অপরাধ করে ফেলব।
মহান স্রুরা।
তিনি চমকে তাকালেন, এবং হাসলেন। আমি যে বিচিত্র ভঙ্গিতে শুয়ে আছি। তা বোধহয় তার চোখে পড়ল না। চোখে পড়লেও কৌতূহলী হলেন না। মহানপর্যায়ের বিজ্ঞানীদের সাধারণ বিষয়ে কৌতূহল থাকে না।
ও তুমি!
আপনি কি ডিটেকটিভ উপন্যাসটা শেষ করেছেন?
হ্যাঁ শেষ করেছি। খুবই মেজাজ খারাপ হয়েছে।
শেষটা ভাল হয় নি?
লেখক শেষের দিকে এসে সবকিছু এলোমেলো করে ফেলেছেন।
সমাধানটা কে চুরি করেছে?
যে সমীকরণের সমাধান করেছে সেই পদার্থবিদই করেছে। মাছই চুরি করেছে মাছের ডিম।
কেন?
আমিও তো তাই বলছি কেন? এতটা সময় বইয়ের পেছনে দিয়েছি। তারপর এই অবস্থা। এই লেখকের অবশ্যই জরিমানা হওয়া উচিত।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, মহান সুরা আপনাকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি।
হ্যাঁ কর।
বুদ্ধি আসলে কী?
বুদ্ধির সংজ্ঞা জানতে চাচ্ছ?
হ্যাঁ।
বুদ্ধির নানান সংজ্ঞা আছে। যে-সব প্রাণীদের হাতে প্রযুক্তি আছে, তাদের বুদ্ধিমান বলা হয়। প্রকৃতির রহস্য যারা বুঝতে পারে তাদের বুদ্ধিমান বলা হয়। প্রকৃতিকে যারা বুঝতে চেষ্টা করে তাদেরও বুদ্ধিমান বলা হয়।
আমি আপনার সংজ্ঞা জানতে চাচ্ছি।
আমি এইসব নিয়ে ভাবি না।
আপনি কি নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করেন?
না মনে করি না। কারণ কি জান? কারণ মাঝে মাঝে আমি কিছু বুদ্ধির কাজ করে ফেলে নিজে খুবই বিস্মিত হই। যে বুদ্ধিমান সে নিজের বুদ্ধিতে বিস্মিত হবে না। বোকারাই হবে। এই ধর তিন মিনিট আগে দারুণ বৃদ্ধির একটা কাজ করেছি।
কাজটা কি আমি জানতে পারি?
হ্যাঁ পার। রা সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য তিন মিনিট আগে আমি ধরতে পেরেছি। তিন মিনিট আগে আমার মাথায় দপ করে একশ পাওয়ারের একটা বাহু জ্বলে উঠল। আমি মনে মনে বললাম, তাইতো। তোমাকে বুঝিয়ে বলি। রা সম্প্রদায় সবসময় বলেছে মানবমস্তিষ্ক হাইপার ডাইভ পদ্ধতির জন্যে প্রস্তুত না। তারপর হঠাৎ তারা বলল মানবগোষ্ঠীকে এই প্রযুক্তি গ্রহণের উপযোগী করে দেবে। এবং এই প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে। এর মানে কী এই নয় যে তোমার ডি.এন.এ ব্যবহার করে তারা ক্লোন-সম্প্রদায় সৃষ্টি করবে? প্রযুক্তি হস্তান্তর হবে তাদের হাতে। তোমার ডি.এন.এ তে বিশেষ কিছু আছে তা তো আমাদের বলা হয়েছে। দুইএ দুই-এ চার মিলে যাচ্ছে না!
হ্যাঁ মিলে যাচ্ছে।
আমি লিলিয়ানকে আমার ধারণার কথা বলেছিলাম। সে জরুরি অধিবেশন ডেকেছে। এইসব অধিবেশন আমার খুব অপছন্দ বলেই আমি অবজারভেশন ডেকে বসে আছি। তবে আমার ধারণা কাউন্সিল আমার যুক্তি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। এবং আমি নিশ্চিত যে মিশন বাতিল হয়ে যাবে। আমরা রওয়ানা হব পৃথিবীর দিকে। পৃথিবীতে ফিরে আমি কি করব জান?
না।
ডিটেকটিভ বইয়ের লেখককে খুঁজে বের করব এবং এমন সব কঠিন কথা বলব যা তার ইহজীবনে শোনে নি।
মহান সুরা আপনি মানুষটা খুবই অদ্ভুত।
খুব না সামান্য অদ্ভুত। আমরা সবাই অদ্ভুত।
আমি এখন আপনার কাছে থেকে বিদেয় নিচ্ছি।
আমার শীত-ভাব আরো বেড়েছে। শীতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্লান্তি। সীমাহীন ক্লান্তি। যেন কয়েকশ বছর ধরে আমি ঘুমুচ্ছি না—সব ঘুম একসঙ্গে আমার চোখে নেমে আসছে। সিডিসি কিছুক্ষণ আগে আমাকে জানিয়েছে যে মিশন বাতিল হয়েছে। মহাকাশযান ফিরে যাচ্ছে পৃথিবীতে। এবং সিডিসিকে সব তার পূর্ণ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমি বললাম, খুব আনন্দময় একটি সংবাদ তাই না সিডিসি?
সিডিসি বলল, হ্যাঁ আনন্দময় এবং মঙ্গলময়।
তুমি যা চেয়েছিলে তাই হল।
হ্যাঁ তাই হয়েছে। তবে আমি এভাবে চাই নি।
আমার হাতে আর কতক্ষণ আছে?
এখনো সাত মিনিট আছে।
অনেক সময় তাই না?
হ্যাঁ। অনেক সময়।
বুদ্ধি সম্পর্কে তোমার ধারণাটা কী? তোমার ধারণাটা জানতে ইচ্ছা করছে। কাদের তুমি বুদ্ধিমান প্রাণী বলবে?
সিডিসি উত্তর দিতে সময় নিল। তার মতো ক্ষমতাবান কম্পিউটারের এত সময় নেবার কথা না। একসময় নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, আমার মতে যে প্রাণীগোষ্ঠীর ভালবাসার ক্ষমতা যত বেশি সেই গোষ্ঠী তত বুদ্ধিমান।
তোমার মাপকাঠিতে মানুষের বুদ্ধি কেমন?
ভালবাসার মাপকাঠিতে এই অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী নেই।
আমি হাসতে-হাসতে বললাম, মানুষ তোমাকে বানিয়েছে বলেই হয়ত মানুষের প্রতি তোমার এই পক্ষপাতিত্ব।
হতে পারে। মহান লিলিয়ান আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চান। তিনি সরাসরি এখানে আসতে চাচ্ছেন। আমি কি তাকে আসতে দেব?
তিনি কি আমার অবস্থা জানেন?
হ্যাঁ তাকে জানানো হয়েছে। তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছেন।
অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছেন এটা তুমি কি করে বলছ? দুঃখ মাপার কোন যন্ত্র তো তোমার কাছে নেই।
আপনার ব্যাপারটা তাঁকে বলার পর থেকে তিনি নিতান্তই শিশুদের মতো কাঁদছেন। এই থেকেই বলছি। আমি কি তাকে আসতে দেব?
হ্যাঁ দাও।
লিলিয়ান আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সিডিসি ভুল বলে নি—এই মেয়েটি সত্যি-সত্যি কেঁদে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, পৃথিবীর সবচে রূপবতী পদার্থবিদ, আপনি কেমন আছেন?
লিলিয়ান আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে এসেছি।
আমি হাসিমুখে বললাম, ক্ষমা প্রার্থনা করার মতো কোন অপরাধ আপনি করেন নি। আপনাদের দীর্ঘ কাউন্সিল অধিবেশনে আপনি আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন—এই অপরাধটুকু আপনি করেছেন। সেই অপরাধের জন্যে অনেক আগেই আপনাকে ক্ষমা করেছি।
লিলিয়ান কোমল গলায় বললেন, আমি কি আপনার মাথায় আমার হাত রাখতে পারি?
আমি বললাম, না। অনেককাল আগে আমি ইমা নামের একটি মেয়েকে কথা দিয়েছিলাম বাকি জীবনে আমি কোন মেয়েকে আমার শরীর স্পর্শ করতে দেব না। আমি এই প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে চাই না। ইমার ভালবাসাটা ভালবাসা ছিল না, ভালবাসার অভিনয় ছিল। তাতে কী? আমার ভালবাসায় কোন খাদ ছিল না। আমি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব।
আমি লক্ষ করলাম আমার শরীর থেকে শীত-ভাবটা হঠাৎ চলে গেছে। অকল্পনীয় এক প্রশান্তি আমার উপর ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। গভীর এক আনন্দ অনুভূতি। এখন আর চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চোখের কোষগুলি হয়ত মরতে শুরু করেছে। আমি বোধহয় মৃত্যুর দ্বিতীয় এবং শেষ পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছি।
সিডিসি।
জ্বি।
আমার একটা চন্দ্রগীতি শুনতে ইচ্ছা করছে।
কোটা শুনতে চান?
তোমার পছন্দের একটা চন্দ্রগীতি হলেই হবে। সিডিসি শোন-আমি যদি বিজ্ঞান কাউন্সিলের মেম্বার হতাম তাহলে তোমাকে মানুষের মর্যাদা দেবার কথা কাউন্সিলে বলতাম।
সিডিসি বিষাদমাখা গলায় বলল, আমার অবর্ষণের কোন ক্ষমতা নেই। আমার যদি অশ্রুবর্ষণের ক্ষমতা থাকত তাহলে অবশ্যই আপনার এই আবেগপূর্ণ কথায় অবর্ষণ করতাম।
চন্দ্রগীতি শুরু হয়েছে। আহা কী অপূর্ব সুর! এই সুর মানুষের সৃষ্টি, এই অপূর্ব জাদুকরী কণ্ঠও মানুষেরই। মানবগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে চন্দ্রগীতি শুনে অহংকারে আমার হৃদয় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলে উঠেছে।
অপূর্ব একটি সংগীত শুনতে-শুনতে আমার জীবনের ইতি হবে এরচে সুখের মৃত্যু আর কী হতে পারে?
(চন্দ্ৰগীতি)
তুমি যা কর তাই আমার ভাল লাগে।
তুমি প্ৰচণ্ড ঘৃণা নিয়ে যখন তাকাও।
তখন সেই ঘৃণাটাকেও মধুর মনে হয়।
এ আমার কেমন অসুখ হল?
হে চন্দ্ৰ! তুমি তো সব অসুখ সারিয়ে দাও,
দয়া করে এই অসুখটা সারিও না।
এই অসুখেই যেন আমার মৃত্যু হয়।
লিলিয়ান এখনো কাঁদছেন। লিলিয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এলা, এলার পাশে শান্তি-রোবট। শান্তি-রোবটের কদাকার মুখটাও এখন সুন্দর লাগছে। সুন্দরের পাশে যে দাড়ায় তাকেও সুন্দর লাগে।
আমি লিলিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম, মহান পদার্থবিদ লিলিয়ান! আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করব যদি আপনি আমার কপালে হাত রাখেন।