- বইয়ের নামঃ ইমা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
অস্বাভাবিক শব্দ
কোত্থেকে জানি খুব অস্বাভাবিক শব্দ আসছে। ক্লান্তিকর বুদবুদ ফাটার শব্দ, পুট পুট পুট। সারাক্ষণ না, মাঝে মাঝে। কিছু বুদবুদ আবার ফাটার সময় তীব্র চিনচিনে শব্দ করছে। শব্দটা এমন যে সাই করে মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আর মাথা থেকে বের হচ্ছে না। শব্দটা সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথায় অস্পষ্ট যন্ত্রণার মতো হচ্ছে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এটা হয়ত খুব স্বাভাবিক শব্দ। মহাকাশযানে এরকম শব্দ হওয়াই হয়ত রীতি। আমি নতুন মানুষ বলে আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। কাউকে কি জিজ্ঞেস করব? বিনীতভাবে বলব, স্যার মাঝে মাঝে আমি একটা শব্দ পাচ্ছি। শব্দটা অনেকটা বুদবুদ ফাটার মতো। আসলে আমি একেবারেই নতুন মানুষ। একটু ভয়-ভয় লাগছে। মহাকাশযানে চড়া দূরের কথা আমি ইন্টার-গ্যালাকটিক মহাকাশযানের ছবিও দেখি নি। সত্যিকথা বলতে কি মহাকাশযানগুলি যে এত বড় হয় তাও জানতাম না। তাছাড়া আমার আকাশভীতি আছে। প্লেনে কখনো চড়ি নি। আর দেখুন-না আমার ভাগ্য, মহাকাশযানে চড়ে বসে আছি। মহাকাশযান হুহু করে যাচ্ছে। আবার ভুল বললাম। মহাকাশযান যাচ্ছে নাকি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা জানি। না। আসলে কী হচ্ছে না হচ্ছে আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না। তারচেয়েও বড় কথা কি জানেন স্যার? আমি কেন এখানে সেটা জানি না। বলতে গেলে এরা আমাকে জোর করে তুলে দিয়েছে। কেউ আমাকে কিছু বলে নি। স্যার আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন? প্লিজ। আমি নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছি। আমি কুকুর হলে পা চেটে আপনার মমতা পাবার চেষ্টা করতাম। আমি কুকুর না। মানুষ। খুবই সামান্য একজন, তারপরেও মানুষ।
কথাগুলি কাকে বলব?
আমি বসে আছি একটা চেয়ারের মতো জায়গায়। চেয়ারে গদিটদি কিছু নেই। প্লাস্টিকের মতো একটা জিনিস। তবে বসতে খুবই আরাম। আমি যেভাবে কাত হই, চেয়ারটা সেইভাবে কাত হয়। একবার পা তুলে বসলাম অদ্ভুত কাণ্ড চেয়ারের বসার জায়গাটা বড় হয়ে গেল। ঠিক আমার পায়ের মাপে মাপে। যেন জিনিসটা পা রাখার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। পা নামিয়ে নিলাম, বসার জায়গাটা আবার ছোট হয়ে গেল।
আমি যে ঘরে বসে আছি সে ঘরটা সম্ভবত আমার, কারণ আর কেউ এ ঘরে আসে নি। ঘর না বলে বলা উচিত গোলক। ভুল বললাম, ঘরটা পুরোপুরি গোলাকার না, মেঝেটা সমতল। মাথার উপরের ছাদটা যেন একটা বাটি, যে বাটির গায়ে অসংখ্য সুইচ। কয়েকটা মনিটর। টিভি স্ক্রিনের মতো কিছু মনিটর। সবকটা মনিটরে কিছু না কিছু লেখা উঠছে। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধিমান মানুষরা এইসব মনিটর থেকে অনেক কিছু বুঝে ফেলবেন। আমি বুদ্ধিমান না। একটা মনিটরে ক্রমাগত কিছু নাম্বার উঠছে। মাঝেমধ্যে নাম্বারগুলি পড়তে চেষ্টা করি–
৫৪৬৬৮২
৫৪৬৬৮০
৫৪৬৬৮৩
৫৪৬৬৮৮
অর্থহীন ব্যাপার। কিংবা কে জানে অৰ্থ নিশ্চয়ই আছে, আমি জানি না। ঐ যে বললাম আমি খুবই সাধারণ একজন। বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু বের করে ফেলব সেই আশা করি না। এই বুদ্ধিটুকু আমার আছে।
আমার গোলকঘরে খেলনা-খেলনা ভাব আছে। সবই ছোট ঘোট। খেলনা সাইজ, তবে সেই খেলনাঘরেও আমার শোবার জায়গা, হাতমুখ ধোবার জায়গা, গোসল করার জায়গা, বাথরুমের জায়গা সবই আছে। এমনকি খাবারঘরও আছে। খাবারঘরে একটা মাত্র চেয়ার। চেয়ারে বসামাত্র প্রথম কিছুক্ষণ শোশো শব্দ হয়। তারপর শব্দ থেমে যায় এবং পর্দা ফাঁক করে খাটো এক রোবট বের হয়ে আসে। রোবটটা দেখতে কুৎসিত। কপালের উপর সাইক্লপের চোখের মতো একটা চোখ। চোখ থেকে নীল আলো বের হয়। মাঝে মাঝে ধ্বক করে লাল আলো জ্বলে ওঠে। রোবটটার হাঁটাচলার ভঙ্গিও খারাপ। মনে হয় অতি কষ্টে গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে এবং এক্ষুণি বুঝি হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে যাবে। পতনের ফলে তার হাত-পা কিছু ভাঙবে। রোবটটা লজ্জিত ভঙ্গিতে সেই ভাঙা পা কিংবা ভাঙা হাত নিয়ে উঠে দাঁড়াবে। রোবটটার গলা অবশ্যি খুব মিষ্টি। ষোলো সতেরো বছরের তরুণীর মতো ঝলমলে গলা। রোবটের ভয়েসসিনথেসাইজার নিশ্চয়ই কোন চমকার গলার মেয়ের স্বর কপি করে তৈরি করা। রোবটটার গলার স্বর শুনতে আমার ভাল লাগে যদিও আমি তাকে ব্যাপারটা জানতে দেই নি।
প্রথম দিনে রোবটটা জিজ্ঞেস করল, আপনি কী খেতে চান? টেবিলে মেনু দেয়া আছে। মেনু দেখে অর্ডার দিতে পারেন। মেনুর বাইরে যদি কিছু খেতে ইচ্ছে। করে দয়া করে বলুন। আপনার পছন্দের খাবার জোগাড় করার সাধ্যমতো চেষ্টা করা হবে। আর আপনি যদি খাবারের ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন তাহলে আপনার রুচিমতো খাবার আমি দেবার চেষ্টা করব। মনে হয় আপনার তা পছন্দ হবে।
আমি বললাম, তোমার নাম কী?
রোবট মিষ্টি করে বলল, আমি খুব সাধারণ কর্মী রোবট। আমার কোন নাম নেই। তবে আপনি আপনার সুবিধার জন্যে আমাকে যে কোন নামে ডাকতে পারেন।
তোমার জন্যে নাম খুঁজে বের করার কোন ইচ্ছা আমার নেই।
আমি কি আপনার খাবার আমার পছন্দমতো দেব?
আমি কী খেতে চাই তা তুমি জানবে কী করে?
আপনার ডিএনএ প্ৰফাইল আমাকে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে বের করা। আছে।
আমার পছন্দের খাবার কি তুমি জান?
অবশ্যই জানি।
বল তো আমার সবচে পছন্দের খাবার কোন্টা?