তবে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, পৃথিবীর অত্যন্ত সফল একটা প্রাণী যারা দোর্দণ্ড প্রতাপে সারা পৃথিবীতে রাজত্ব করত তারা বিস্ময়করভাবে আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগে পুরাপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কীভাবে এটা ঘটেছে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক চিন্তাভাবনা করে একটি ব্যাখ্যা বের করেছেন। সেটি এ রকম :
আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগে কোনো একদিন যখন পৃথিবীর বুকে বিশাল ডাইনোসরেরা গাছের মাথা থেকে পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষ ইঁদুরের মতো ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী জঙ্গলের ফাঁক-ফোকড়ে ছোটাছুটি করছে তখন হঠাৎ আকাশ থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার বড় একটি গ্রহকণা পৃথিবীর বুকে ছুটে এসেছিল। সেই বিশাল গ্রহকণার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় একশ হাজার কিলোমিটার থেকে বেশি। সেই বিশাল গ্রহকণার গতিবেগ এত বেশি ছিল যে, বলা যেতে পারে বায়ুমণ্ডলে একটা ফুটো তৈরি করে মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপ এলাকায় এসে আঘাত করেছিল। সেই ভয়ংকর গতিবেগ ছিল অপ্রতিরোধ্য। সেটা সমুদ্রের তলদেশে আঘাত করেও কঠিন পাথর ভেঙে কযেক কিলোমিটার ঢুকে গেল। এই ভয়ংকর আঘাতে যে বিস্ফোরণ হলো সেটি পৃথিবীর সকল নিউক্লিয়ার বোমা থেকেও দশ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। সমুদ্রের তলদেশে যে গর্তের জন্ম হয়েছিল তার ব্যস ছিল 150 কিলোমিটার। বিস্ফোরণের পাথর ধুলাবালি বায়ুমণ্ডলের সেই গর্তের ভিতর দিয়ে উপরে উঠে গেল এবং কিছু বোঝার আগে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। সমুদ্রে ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসের জন্ম হলো, সেটা সমুদ্র মহাসমুদ্র দিয়ে পৃথিবীর উপকূলে আছড়ে পড়ল। বিস্ফোরণের ধুলাবালি পাথর ধীরে ধীরে পৃথিবীতে পড়তে শুরু করে এবং দেখতে দেখতে সারা পৃথিবী কালো ধুলাবালিতে ঢেকে গেল। বায়ুমণ্ডলে যে ধুলাবালি ছড়িয়ে পড়েছে সেটা সূর্যের আলোকে ঢেকে দিল। সারা পৃথিবী তখন অন্ধকারে ডুবে গেল। মাসের পর মাস পৃথিবীতে ঘন অন্ধকার, তাপমাত্রা দেখতে-দেখতে নিচে নেমে এলো, সারা পৃথিবীতে তখন এক হিমশীতল পরিবেশ। বিস্ফোরণের সময় প্রচণ্ড তাপে যে নাইট্রোজেন অক্সিজেনের সাথে সংযুক্ত হয়েছে পানির সাথে মিশে সেটি ভয়ংকর এসিডের জন্ম দিলো, পুরো একটা মহাদেশ সেই এসিডের বৃষ্টিতে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল। বিস্ফোরণের প্রবল ধাক্কায় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ফাটলের জন্ম হয়ে শত শত আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত করতে শুরু করে। অন্ধকার, এসিড-বৃষ্টি, শীত এবং অগ্ন্যুৎপাত–সব মিলিয়ে পৃথিবীতে যে নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হলো সেটি সব ডাইনোসরকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিল। শুধু যে ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হলো তা নয়–সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনার ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর সকল জীবিত প্রাণী গাছপালা সবকিছুর দুই-তৃতীয়াংশ পৃথিবীর বুক থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল।
এই ঘটনাটি কী শুধু বিজ্ঞানীদের অনুমান নাকি তার পিছনে যুক্তি আছে সেটি পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। পৃথিবীর বুকে খোদাই করে পাথরের যে স্তরটি পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগে জমা হয়েছিল সেখানে ইরিডিয়াম নামে একটা ধাতু দেখা গেছে। এই ধাতু পৃথিবীর উপরে থাকার কথা নয়, মহাকাশ থেকে কোনো একটি গ্রহকণা পৃথিবীতে ভয়ংকর গতিবেগে আঘাত করলেই তার বিস্ফোরণে সারা পৃথিবীতে যে ধূলিকণা ছড়িয়ে পড়বে সেখানে এটি থাকবে। শুধু তাই নয় মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে সমুদ্রের নিচে গ্রহকণার সংঘাতে তৈরি প্রায় দেড়শ কিলোমিটার ব্যাসের গর্তটিকে খুঁজে পাওয়া গেছে। পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগের গাছপালার যে ফসিল পাওয়া গেছে সেগুলো থেকেও প্রমাণ পাওয়া গেছে হঠাৎ করে সারা পৃথিবী হঠাৎ করে ভয়াবহভাবে শীতল হয়ে গিয়েছিল! বিজ্ঞানীরা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগে সত্যি সত্যি এই পৃথিবীর বুকে মহাকাশ থেকে মৃত্যুদূতের মতো একটি গ্রহকণা নেমে এসেছিল।
যদি আমরা বিজ্ঞানীদের এই তত্ত্ব মেনে নিই, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবে পরের প্রশ্নটি এসে যায়। আবার কি পৃথিবীর বুকে এ-রকম সাক্ষাৎ-মৃত্যু নেমে আসতে পারে? উত্তর হচ্ছে হাঁ পারে। সত্যি কথা বলতে কি ইতোমধ্যেই এ-রকম আরো ঘটনা ঘটে গেছে। আজ থেকে মাত্র পনেরো থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে প্রায় পঁচিশ মিটার বড় একটা উল্কা এসে যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা অঙ্গরাজ্যকে আঘাত করেছিল। তার চিহ্ন হিসেবে সেখানে প্রায় দেড় কিলোমিটার ব্যাস এবং দুইশ মিটার গভীর গর্তের চিহ্নটি এখনো সেখানে রয়ে গেছে। অতি সাম্প্রতিক ঘটনাটি ঘটেছে 1908 সালের 30 জুন সাইবেরিয়ার তুঙ্গুসকাতে। সেদিন ভোররাতে আকাশের বুক চিরে একটা উল্কা পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছিল। তার ভয়ংকর বিস্ফোরণে প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার একটা পুরো বনাঞ্চলের সব গাছ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন প্রায় একশ মিটার বড় একটি উল্কা মাটির কাছাকাছি পৌঁছে ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। এই বিস্ফোরণে বায়ুমণ্ডলে যে ধুলোবালি জমা হয়েছিল সারা পৃথিবীর মানুষ সেটা দেখেছে। সৌভাগ্যক্রমে সাইবেরিয়াতে কোনো মানুষজন থাকে না, তাই কোনো মানুষের জীবন নষ্ট হয় নি। কিন্তু ঘটনাটি যদি কোনো লোকালয়ে হতো তাহলে কী হতো সেটা চিন্তা করে মানুষ এখনো আতঙ্কে শিউরে ওঠে।