- বইয়ের নামঃ কাবিল কোহকাফী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. পূর্বকথা
কাবিল কোহকাফী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১. পূর্বকথা
ছাগলের ঘাস খাওয়া অঙ্কটা শেষ করে টুশি বানরের বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার অঙ্কটা শুরু করল। অঙ্ক করে বানরটিকে নিয়ে যখন ঠিক বাঁশের মাঝামাঝি পৌঁছাল তখন তার নানা দরজা খুলে ঘরে মাথা ঢুকিয়ে বললেন, “এই টুশি!”
টুশি মাথা না তুলে বলল, “উ?”
নানা গলা উঁচিয়ে বললেন, “উ আবার কীরকম উত্তর? ডাকছি কথা কানে যায় না?”
টুশি মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমাকে ডিস্টার্ব করো না নানা। একটা বানরকে তেল-মাখানো বাঁশ দিয়ে উপরে ওঠাচ্ছি। হঠাৎ করে ছেড়ে দিলে বানর আছাড় খেয়ে নিচে পড়বে। মহা কেলেঙ্কারি হবে তখন।”
নানা বললেন, “রাখ দেখি তোর বাঁদর! আয় এখন আমার সাথে।”
“তুমি বড় ডিস্টার্ব করো নানা, দেখছ না হোমওয়ার্ক করছি।”
“বাদরের বাদরামি আবার হোমওয়ার্ক হল কবে থেকে? আয় আমার সাথে।”
টুশি অঙ্কখাতা বন্ধ করে বলল, “কোথায়?”
নানা চোখেমুখে একটা রহস্যের ভান করে বললেন, “বড় সিন্দুকটা খুলব।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ, সত্যি। তালাটাতে সকাল থেকে কেরোসিন তেল দিয়ে রেখেছি, এতক্ষণে মনে হয় একটু নরম হয়েছে। একশ বছরের জং কি সোজা কথা নাকি!”
টুশি এবারে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার বয়স বারো, দেখে অবশ্যি আরও কম মনে হয়। তার জীবনের বারো বছরের গত নয় বছর সে তার নানার সাথে কাটিয়েছে। প্রথম তিন বছর সে তার বাবা-মায়ের সাথেই ছিল, একটা গাড়ি-অ্যাক্সিডেন্টে একসাথে দুজনেই মারা যাবার পর নানা তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। টুশির অবশ্যি কিছুই মনে নেই–জ্ঞান হবার পর থেকে দেখছে একটা বিশাল বাড়িতে সে আর তার নানা।
বাড়ি দেখাশোনার জন্যে অবশ্যি ইদরিস মিয়া নামে একজন পাহারাদার আছে–সে এত দুবলা যে টুশি পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিতে পারবে। কিন্তু ইদরিস মিয়ার গলার জোর সাংঘাতিক, যে-কোনো সময়ে সে চিৎকার করে মানুষের কানের পরদা ফাটিয়ে ফেলতে পারে, সেইজন্যে মনে হয় তাকে কেউ ঘটায় না। এ ছাড়াও বাসায় আছে জমিলার মাসে ইদরিস মিয়ার একেবারে উলটো, পেটে বোমা মারলেও তার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয় না। জমিলার মায়ের হাতে অবশ্যি জাদু আছে–সে যদি কেরোসিন তেল দিয়ে মাছ ভাজা করে তা হলেও মনে হয় সেই মাছ ভাজার স্বাদ হবে অমৃতের মতো। টুশি তার নানা আর এই দুজনকে নিয়ে এই বিশাল বাড়িতে বড় হয়েছে। মানুষ একা একা বড় হলে মনে হয় একটু আজব হয়ে যায়, টুশিও হয়েছে যদিও সে নিজে সেটা জানে না। স্কুলের বন্ধু বান্ধবেরা তাকে নিয়ে মাঝে মাঝে হাসাহাসি করে–টুশি অবশ্যি সেগুলো একেবারেই পাত্তা দেয় না–আজব হয়ে যাবার মনে হয় এটা আরেকটা লক্ষণ অন্যেরা কী ভাবছে সেটাকে কোনো পাত্তা না দেওয়া।
বড় সিন্দুক খোলার উত্তেজনায় টুশি তার নানার হাত ধরে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে ছুটে যাচ্ছিল, নানা তখন তাকে থামালেন, বললেন, “আস্তে, পাগলি মেয়ে আস্তে। আমি কি আর তোর মতো দৌড়াতে পারি?”
“কেন পার না?”
“আমার কি সেই বয়স আছে?”
নানার কথা শুনে টুশি ঘুরে তার দিকে তাকাল, নানা নিশ্চয়ই বুড়ো মানুষ, কিন্তু তাকে কখনওই টুশির বুড়ো মনে হয় নি। নানা যখনই নিজেকে বুড়ো বলে দাবি করেন তখনই টুশি আপত্তি করে, এবারেও করল, বলল, “তোমার আর এমন কী বয়স হয়েছে? তোমার যত বয়স রোনাল্ড রিগান সেই বয়সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিল।”
নানা মাথা নাড়লেন, বললেন, “আমেরিকাতে সব সম্ভব। ঐ দেশে সব পাগল। বুড়োকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেয়, স্কুল-পালানো পোলাপান হয় বিলিওনিয়ার!”
দোতালার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নানা মাঝখানে দাঁড়িয়ে বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, “বুঝলি টুশি”।
“কী?”
“আমি বলছিলাম কি–”
কিন্তু নানা কিছু না বলে খুব নির্মমভাবে দাড়ি চুলকাতে লাগলেন। নানা যখনই কোনো সমস্যায় পড়ে যান তখন এভাবে দাড়ি চুলকাতে থাকেন। টুশিকে নিয়ে একবার কান্তজীর মন্দির দেখতে গিয়েছিলেন, ট্রেনে উঠে আবিষ্কার করলেন মানিব্যাগ-টিকিট সবকিছু বাসায় ফেলে এসেছেন, তখন ঠিক এইভাবে ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাতে শুরু করলেন। টুশি খানিকক্ষণ নানার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “নানা, তোমার দাড়িতে উকুন হয়েছে নাকি?”
নানা দাড়ি চুলকানো বন্ধ করে বললেন, “কেন, উকুন কেন হবে? দাড়িতে কখনও উকুন হয় না জানিস না?”
“তা হলে এভাবে দাড়ি চুলকাচ্ছ কেন?”
“কে বলছে দাড়ি চুলকাচ্ছি?” বলে নানা অন্যমনস্কভাবে আবার দাড়ি চুলকাতে শুরু করলেন।
টুশি নানার হাত ধরে বলল, “কী হয়েছে তোমার?”
নানা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “না, মানে মাঝে মাঝে তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়।”
টুশি ভুরু কুচকে বলল, “আমার কী নিয়ে চিন্তা হয়?”
“এই যে–এই যে–মানে এই-যে–” নানা আবার দাড়ি চুলকাতে লাগলেন।
টুশি অধৈর্য হয়ে নানার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, “কী যে? পরিষ্কার করে বলো।”
নানা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি মরে গেলে তোর কী হবে?”
টুশি চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি মরে যাবে কেন?”
নানা হা হা করে হেসে বললেন, “মানুষ বুড়ো হয়ে যে মারা যায় তুই জানিস না?”
“তুমি কি বুড়ো হয়েছ নাকি?”
নানা হাত তুলে বললেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি বুড়ো হই নাই। কিন্তু কম বয়সী মানুষ মারা যায় না? তোর বাবা-মা মারা যায় নাই?”
“সেটা তো অ্যাকসিডেন্ট।”
“আমার কখনও অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে না?”
টুশি এবারে সোজাসুজি উত্তর দিতে পারল না, বলল, “চেষ্টা করো যেন অ্যাকসিডেন্ট না হয়। সাবধানে থাকো।”
নানা সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠতে উঠতে আবার ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাতে লাগলেন। টুশি চোখের কোনা দিয়ে নানাকে লক্ষ করে বলল, “কী বলতে চাইছ বলে ফেলো।”
নানা একটু অবাক হয়ে বললেন, “আমি কিছু বলতে চাই তুই কেমন করে জানিস?”
“যখন তুমি কিছু বলতে চাও কিন্তু ঠিক জান না কীভাবে বলবে তখন তুমি এইভাবে ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাও।”
নানা দাড়ি চুলকানো বন্ধ করে বললেন, “তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।”
নানা খানিকক্ষণ টুশির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তুই ঠিকই ধরেছিস। কয়দিন থেকেই তোক একটা কথা বলব ভাবছি।”
“কী কথা?”
নানা দোতালার বারান্দা দিয়ে হেঁটে সিন্দুকের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে চাবি দিয়ে তালা খুলতে খুলতে বললেন, “তুই স্বীকার করিস আর না-ই করিস–আমি আসলে বুড়ো হয়েছি, যে-কোনো দিন মরে যাব, তখন তোর কী হবে?”
টুশি ভয়ে ভয়ে নানার দিকে তাকাল, বলল, “কী হবে?”
“তা ছাড়া তোর মতো এরকম হাট্টা-কাট্টা-টাটকা-মাটকা একটা মেয়ে আমর মতো বুড়ো মানুষের সাথে থাকবে সেটাও ঠিক না। একেবারেই ঠিক না–”
টুশি চোখ পাকিয়ে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, নানা সুযোগ দিলেন না, বললেন, “আসলে তোর যেটা দরকার সেটা হচ্ছে একটা ফ্যামিলি। যেখানে বাবা মা আছে, ভাই-বোন আছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে। সত্যিকারের একটা ফ্যামিলি।”
“ফ্যামিলি?”
“হ্যাঁ।”
“ফ্যামিলি কি ভাড়া পাওয়া যায়? তুমি কি ভাড়া করবে?”
নানা আবার হা হা করে হাসলেন, বললেন, “না পাগলি মেয়ে, ফ্যামিলি ভাড়া পাওয়া যায় না। কিন্তু খুঁজে বের করা যায়।” একটু থেমে বললেন, “আমি খুঁজে বের করেছি।”
টুশি একেবারে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, চিৎকার করে বলল, “কী বললে তুমি? কী বললে?”
সিন্দুকের ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে নানা বললেন, “বলেছি যে তোর জন্যে একটা ফ্যামিলি ঠিক করেছি। সত্যিকারের ফ্যামিলি। একটা বাবা-মা আর ছোট একটা ভাই। তুই তাদের সাথে থাকবি।”
টুশি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, খানিকক্ষণ বিস্ফারিত চোখে নানার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বাঘের মতো গর্জন করে বলল, “তুমি আমার জন্যে একটা ফ্যামিলি ঠিক করেছ? আমি কী তোমার এত ঝামেলা করছি যে আমাকে বিদায় করে দিতে হবে?”
নানা অপ্রস্তুত হয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “আহা হা–রাগ করিস না, পাগলি মেয়ে। আমি কী তোকে বিদায় করে দিতে চাইছি? তুই ছাড়া আমার কে আছে! কিন্তু আমি যদি মরে যাই”।
টুশি হুংকার দিয়ে বলল, “তুমি মরবে না।”
নানা হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে আমি মরব না।”
“অন্য একটা ফ্যামিলি আমাকে নেবে কেন? কালো কুচ্ছিৎ একটা মেয়ে আমি–আমাকে দেখলে মানুষ দৌড়ে পালায়”
নানা টুশির ঘাড় ধরে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বাজে কথা বলবি না, ঘাড় ভেঙে ফেলব।”
“কখন বাজে কথা বললাম? আমার চেহারা যে কালো কুচ্ছিৎ তুমি জান না?” নানা টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ছি টুশি ছি! এইভাবে কথা বলে না।
তোর গায়ের রংটা হয়তো ফরসা না কিন্তু তুই কালো কুচ্ছিৎ হবি কেন? আমার কাছে তুই হচ্ছিস পৃথিবীর সবচেয়ে রূপসী মেয়ে–”
“আমাকে দেখে দেখে তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে তাই এই কথা বলছ। সেদিন কী হয়েছে জান?”
“জানি না।” নানা ভয়ে ভয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”
“স্কুল থেকে আসার সময় একটা রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম যাবে কি না, সে রাজি হল না। সায়মা এসে জিজ্ঞেস করতেই রাজি হয়ে গেল। কেন রাজি হল জান? কারণ আমার চেহারা খারাপ, সায়মার চেহারা ভালো।”
“ধুর বোকা মেয়ে!” নানা হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “পাগলি মেয়ে। কী বলতে কী বলিস! যত্তো সব–”
টুশি মুখ শক্ত করে বলল, “যাদের চেহারা ভালো না তাদের মনে অনেক কষ্ট থাকে, বুঝেছ? আমার চেহারা যদি খুব সুন্দর হত তোমার সেই ভাড়া-করা ফ্যামিলি আমাকে দেখে বলত, আহা, টুশি কী ভালো মেয়ে! এই ভালো মেয়েটাকে আদর করে যত্ন করে নিজের মেয়ের মতো করে রাখব। এখন আমাকে দেখে কী বলবে জান?”
নানা জানতে চাচ্ছিলেন না, কিন্তু টুশি তাকে সুযোগ দিল না, মেঘের মতো গর্জন করে বলল, “এখন আমাকে দেখে বলবে, এই মেয়েটা দেখতে এত খারাপ, এর স্বভাবও নিশ্চয়ই খারাপ। পাজি এই মেয়েটাকে আচ্ছামতো শিক্ষা দিতে হবে। টাইট করে ছেড়ে দিতে হবে।”
নানা একধরনের আতঙ্ক নিয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে রইলেন, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বললেন, “এইজন্যে বলছিলাম তোর থাকা দরকার একটা সত্যিকার ফ্যামিলির সাথে। যেখানে সত্যিকারের বাবা আছে, মা আছে, ছোট ভাই আছে। আমার মতো বুড়ো মানুষের সাথে থেকে তোর কী ক্ষতি হয়েছে দেখেছিস?”
“কী ক্ষতি হয়েছে?”
“তুই কথা বলিস বুড়ো মানুষের মতো। তুই চিন্তা করিস বুড়ো মানুষের মতো। কয়দিন পরে তোর চেহারাও হয়ে যাবে বুড়ো মানুষের মতো–”
টুশি এবারে হি হি করে হেসে বলল, “কী মজা হবে তখন, তাই না?”
নানা একটু রেগে বললেন, “ঠাট্টা করবি না। সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি তার মাঝে ফাজলেমি করবি না।”
“কখন আবার আমি ঠাট্টা করলাম?” টুশি ঘরের মাঝামাঝি রাখা বিশাল কালো সিন্দুকের কাছে গিয়ে বলল, “এখন এটা খোলো।”
নানা বিশাল লম্বা একটা চাবি বের করে বললেন, “একশ বছর যে-তালা খোলা হয় নাই সেটা কি এত সহজে খোলা যাবে? দেখা যাক চেষ্টা করে।”
“খুলতে না পারলে তালা ভেঙে ফেলব।”
নানা বিশাল তালাটা দেখিয়ে বললেন, “এটা ভাঙা কি সোজা কথা? বোমা মেরেও এই তালা ভাঙা যাবে না!”
টুশি কালো সিন্দুকটার উপরে কৌতূহল নিয়ে একবার হাত বুলিয়ে দেখে, শক্ত কাঠের সিন্দুক, কাঠের মাঝে বিচিত্র একধরনের নকশা, এরকম একটা সিন্দুক তৈরি করতে কত দিন লেগেছে কে জানে! টুশি নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, “ভিতরে কী আছে নানা?”
“আমি কী করে বলল?”
“তুমি কখনও খুলে দেখনি?”
“নাহ্!”
“কেন? তোমার দেখার ইচ্ছা হয় নাই?”
“নাহ্! আমার বাবা যখন ছোট ছিল তখন আমার দাদা এই সিন্দুকটা শেষবার খুলে বন্ধ করে রেখেছে। বলা হয়েছে আর যেন খোলা না হয়। আর খোলাও হয় নাই।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “খুললে কী হবে?”
“আগের যুগের মানুষের অনেক রকম কুসংস্কার থাকে তো সে রকম একটা কুসংস্কার আর কি! ভিতরে নাকি অভিশাপ দেয়া জিনিস আছে।”
“আচ্ছা নানা, আমরা যদি খুলে দেখি ভিতরে একটা নরকঙ্কাল তা হলে কী করব?”
নানা মাথা চুলকে বললেন, “পুলিশকে খবর দিতে হবে মনে হয়।”
“আর যদি দেখি কলসি কলসি সোনা?”
“তা হলেও মনে হয় পুলিশকে খবর দিতে হবে!”
টুশি উত্তেজনায় বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তাড়াতাড়ি খোলো।”
নানা তালায় বড় চাবিটা ঢুকিয়ে খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর যখন খুলতে না পেরে হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন তখন হঠাৎ ঘঠাং করে তালাটা খুলে গেল। টুশি উত্তেজনায় নিশ্বাস নিতে পারে না। নানা তালাটা খুলে সিন্দুকটার ডালা টেনে উপরে তোলেন, কাঁচ ক্যাচ করে একটা শব্দ হল এবং সিন্দুকের ভেতর থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ বের হয়ে এল। ডালাটা পুরোপুরি খুলে টুশি আর নানা একসাথে ভিতরে উঁকি দেয় এবং একেবারে হতবাক হয়ে যায়। ভিতরে কিছু নেই।
টুশি অবাক হয়ে একবার সিন্দুকের ভিতরে আরেকবার তার নানার দিকে তাকাল, বলল, “ভিতরে দেখি কিছু নাই!”
নানা মাথা চুলকালেন, বললেন, “তা-ই তো দেখছি!”
“তোমার দাদা আমাদের এপ্রিল ফুল করেছে।”
“সেরকমই তো মনে হচ্ছে।”
টুশি আবার ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল, “দাঁড়াও। একেবারে খালি নয়। ঐ দেখো, কী যেন একটা আছে!”
নানা আবার উঁকি দিলেন, সত্যিই এক কোনায় ছোট কী-একটা আছে, আলো পড়ে চকচক করছে। নানা উবু হয়ে ধরার চেষ্টা করে নাগাল পেলেন না–তখন টুশি ঝুঁকে পড়ে জিনিসটা তুলে আনল।
“কী এটা?”
টুশি জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা ছোট বোতল।”
“বোতল?” নানা হাত বাড়িয়ে বললেন, “দেখি।”
টুশি বোতলটা নানার হাতে দিল, নানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে টুশির হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, “আশ্চর্য! এত বড় একটা সিন্দুকে এইটুকুন একটা বোতল? এটাকে বোতল না বলে বলা উচিত শিশি।”
টুশি ভালো করে ছোট বোতলটা দেখল। বেশ ভারী, মনে হয় পাথরের তৈরি, কালচে রং–ভিতরে কিছু আছে কি না বোঝা যায় না। মুখটা খুব ভালো করে বন্ধ করা আছে। মনে হয় কেউ ঝালাই করে লাগিয়েছে। বোতলটা দেখতেও বেশ অদ্ভুত, পারফিউমের যেমন আজব ধরনের শিশি থাকে অনেকটা সেরকম। টুশি হাতে নিয়ে কয়েকবার ঝাঁকিয়ে বলল, “ভিতরে কী আছে নানা?”
নানা ততক্ষণে পুরো ব্যাপারটাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। সিন্দুকের ডালাটা বন্ধ করতে করতে বললেন, “এইটুকুন বোতলে কী আর হাতি-ঘোড়া থাকবে?”
“খুলে দেখি?”
“দ্যাখ।”
টুশি তখন ছিপিটা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু খুব শক্ত করে লাগানো, খোলা খুব সহজ হল না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। নানা বললেন, “ইদরিসকে দিস, খুলে দেবে।”
টুশি বলল, “আমি যদি না পারি ইদরিস ভাইও পারবে না। ইদরিস ভাইয়ের গায়ে কোনো জোর আছে নাকি?”
“তা ঠিক।” নানা হেসে বললেন, “তা হলে জমিলার মা’কে দিস, ঠিক খুলে দেবে।”
নানা আবার সিন্দুকে তালাটা লাগিয়ে বললেন, “কী কাণ্ড! একশ বছরের একটা রসিকতা।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “নানা, এমন কি হতে পারে যে এই সিন্দুকের ভিতরে একটা ভূত আটকে ছিল এখন সেটা বের হয়ে গেছে! আমরা ঘুমালেই কটাশ করে আমাদের ঘাড় মটকে দেবে?”
“ঘাড় মটকাতেই যদি পারে তা হলে ঘুমানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেন?” নানা বললেন, “জেগে থাকলেও ঘাড় মটকাতে পারবে।”
টুশি নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, “আসুক না আমার ঘাড় মটকাতে, আমি উলটো ভূতের ঘাড় মটকে ছেড়ে দেব না!”
নানা টুশির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা তুই পারবি।”
“আচ্ছা নানা ভূতটা তো ভালো ভূতও হতে পারে। খুব সুইট একটা ভূত। মায়া-মায়া চেহারা। হতে পারে না?”
“তুই যখন বলছিস হতেও তো পারে। আমি তো আর ভূতের এক্সপার্ট না। তুই হচ্ছিস ভূতের এক্সপার্ট।”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, যদি খুব সুইট একটা ভূত এসে বলে, তুমি কী চাও? তা হলে আমি কী বলব জান?”
নানা বললেন, “না, জানি না। কী বলবি?”
“বলব, আমার চেহারাটা সুন্দর করে দাও। এমন সুন্দর করে দাও যেন যে-ই দেখে সে-ই ট্যারা হয়ে যায়।”
নানা টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তোর চেহারা এমনিতেই খুব সুন্দর আছে”
“ছাই আছে, কচু আছে।” টুশি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ভূত যদি তোমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে তুমি কী চাও, তা হলে তুমি কী বলবে নানা?”
“আমি? আমি বলব আমার নাতনির যে গরম মেজাজ সেটাকে ঠাণ্ডা করে দাও–যেন সে দিনরাত ক্যাট ক্যাট ক্যাট ক্যাট না করে!”
টুশি নানাকে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলো না, আমার মেজাজ মোটেও গরম না–আমি মোটেও দিনরাত ক্যাট ক্যাট করি না। ঠিক করে বলো তুমি কী চাইবে। প্লিজ।”
নানা দাড়ি চুলকালেন তারপর মাথা চুলকালেন তারপর বললেন, “আমি বলব, আমার নাতনি টুশি যেন খুব ভালো একটা ফ্যামিলিতে বড় হতে পারে–যে ফ্যামিলি তাকে একেবারে নিজের বাচ্চার মতো করে দেখে। আমি তা-ই চাইব।”
টুশি তার নানার দিকে তাকাল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, নানা। সেটা হবে না। আমি কোনো ফ্যামিলির সাথে থাকব না। আমি থাকব তোমার সাথে। তার মানে কী জান?”
“কী?”
“আমি যতদিন বড় না হচ্ছি তুমি মারা যেতে পারবে না।”
“মারা যেতে পারব না?”
“না।”
নানা হাসি গোপন করে বললেন, “এটা কি তোর আদেশ।”
“হ্যাঁ আমার আদেশ।”
.
টুশির এরকম কঠিন একটা আদেশ দিয়েও অবশ্যি লাভ হল না। তার নানা এক বছরের মাথায় মারা গেলেন, টুশিকে যেতে হল তার নানার ঠিক করে রাখা পরিবারটির সাথে। যেদিন এই বড় বাড়িটি ছেড়ে যাচ্ছিল সেদিন জানালায় মাথা রেখে খুব কাঁদল টুশি। তারপর চোখ মুছে তার ছোট ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হয়ে এল। ঘর থেকে বের হবার সময় কী মনে করে টেবিল থেকে ছোট বিচিত্র আকারের কালচে রঙের বোতলটা নিয়ে নিল টুশি।
আমাদের কাহিনী শুরু হল সেই থেকে।
০২. নূতন পরিবার
টুশি যে-পরিবারটির সাথে থাকতে গেল তারা কীভাবে কীভাবে জানি টুশির আত্মীয় হয়। নানা ধরনের হিসাব করে সঠিক সম্পর্কটা বের করে ফেলা যায়, কিন্তু টুশি এত ঝামেলার মাঝে গেল না, ভদ্রলোককে ডাকল চাচা এবং তার স্ত্রীকে ডাকল চাচি। টুশির এই নূতন চাচা-চাচি যে খুব আগ্রহ নিয়ে টুশিকে নিজেদের কাছে এনে রেখেছেন সেটা ঠিক নয়। টুশির সাথে দুজনেই মোটামুটি একধরনের ভদ্রতা বজায় রেখেছেন, কিন্তু এর মাঝে কোনো আন্তরিকতা নেই–টুশি খুব সহজে সেটা ধরে ফেলল। টুশির যেন টাকাপয়সা নিয়ে সমস্যা না হয় সেজন্যে মারা যাবার আগে নানা একটা ট্রাস্ট খুলে ব্যবস্থা করে গেছেন–এরকম একটা ব্যবস্থা করা না হলে এই পরিবারটি তাকে বাসায় এনে রাখতে রাজি হত কি না সেটা নিয়ে টুশির মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়।
টুশির নূতন চাচার নাম ইমতিয়াজ আহমেদ, মানুষটি মোটাসোটা গোলগাল, নাকের নিচে সিরাজদ্দৌলার মতো সরু গোঁফ। মোটাসোটা মানুষ সাধারণত হাসি খুশ হয়, কিন্তু ইমতিয়াজ আহমেদ গোমড়ামুখী মানুষ। কথা বলেন কম, হাসেন আরও কম। তাঁর স্ত্রী শায়লা আহমেদ মোটামুটি সুন্দরী মহিলা, হালকা পাতলা এবং একধরনের ধারালো চেহারা। ঠোঁট দুটো সরু বলে তাঁকে কেমন জানি অহংকারী দেখায়। তাঁদের একটামাত্র ছেলে, তার বয়স সাত এবং সে ক্লাস টুতে পড়ে। ছেলেটা মায়ের মতো ছিপছিপে, বড় বড় কৌতূহলী চোখ। প্রথম দিন চাচা-চাচি টুশিকে তাদের ছেলের ঘরে পরিচয় করিয়ে দিতে এনে বললেন, “তপু, এই যে তোমার নূতন আপু—“
তপু কোনো কথা না বলে কেমন জানি ভয়-পাওয়া চোখে একবার টুশির দিকে, একবার তার আব্ব আরেকবার তার আম্মুর দিকে তাকাল। ছেলেটার ভয় ভাঙানোর জন্যে টুশি একটু হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। তখন তার আম্মু কঠিন একধরনের গলায় বললেন, “এই আপু তোমার ঘরে থাকবে। তুমি তোমার এই আপুকে বিরক্ত করবে না। ঠিক আছে?”
ছেলেটা সাথে সাথে মাথা নাড়ল, টুশি অবাক হয়ে বুঝতে পারল এই ছোট বাচ্চাটা তার বাবা-মাকে ভয় পায়। কী আশ্চর্য! টুশির যদি নিজের বাবা-মা থাকত তা হলে সে তাদের নিয়ে কী যে কাণ্ড করত সেটা কাউকে বোঝাতেও পারবে না। আর এই ছোট ছেলেটার নিজের বাবা-মা অথচ তাদেরকে ভয় পায়–কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
টুশিকে তপুর ঘরে রেখে বাবা-মা বের হয়ে যাবার সাথে সাথে টুশি ছেলেটার সাথে ভাব করার চেষ্টা করল। বলল, “আমাকে তোমার ঘরে থাকতে দেবে?”
ছেলেটা মাথা নাড়ল।
“আমাকে তোমার ভয় করবে না তো?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে জানাল যে ভয় করবে না।
“আমার নাম তুমি জান?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে জানাল সে জানে না এবং নামটা জানার জন্যে সে চোখেমুখে একটু কৌতূহল দেখাল।
“আমার নাম হচ্ছে টুশি। কেন আমার নাম টুশি তুমি জান?”
ছেলেটা আবার মাথা নেড়ে জানাল যে সে জানে না।
টুশি কবিতার ছন্দ করে বলল,
“আমি একজনকে মেরেছিলাম ঘুসি–
সেই জন্যে আমার নাম টুশি!”
এই প্রথমবার ছেলেটার মুখে হালকা একটু হাসি দেখা গেল। টুশি এবারে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল “তোমার নাম কেন তপু জান?”
ছেলেটি মাথা নেড়ে জানাল সে জানে না কিন্তু কেন সেটা জানার আগ্রহ তার চোখে মুখে ফুটে উঠল। টুশি আবার কবিতার মতো ছন্দ করে বলল,
“তোমার বিশাল বপু–
সেই জন্যে তোমার নাম তপু।”
ছেলেটা ফিক করে একটু হেসে ফেলল, তারপর প্রথমবার মুখ খুলল, জিজ্ঞেস করল, “ব-ব-বপু মানে কী?”
ছেলেটা একটা কথাও না বলে কেন শুধু মাথা নেড়ে নেড়ে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল টুশি এবারে সেটা বুঝতে পারে। কথা বলার সময় তার নিশ্চয়ই একটু তোতলামো এসে যায় এবং সেটা নিয়ে লজ্জা পায়। টুশির খুব মায়া হল ছেলেটার জন্যে তাই ভান করল সে তোতলামোটুকু লক্ষই করেনি। বলল, “বপু মানে জানিস না? বপু মানে হচ্ছে শরীর।”
“আ-আ-আমার শরীর কি বিশাল?”
টুশি চোখ কপালে তুলে বলল, “ওমা! তোর শরীর যে বিশাল জানিস না? এই দ্যাখ তোর কত বড় ভুড়ি-তুই যখন হাঁটিস তখন তোর ভুঁড়ি থলথল করে। তোর হাত হচ্ছে থাম্বার মতো মোটা। তোর গালের পাশে চর্বি জমে আছে, তোর মুখ এত মোটা যে তোর চোখ দুটো দেখাই যায় না ছোট ছোট ইঁদুরের মতো কুকুতে চোখ”
তপু টুশির মুখে নিজের বর্ণনা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল, তারপর বলল, “তু-তুমি একটা জোকার।”
“উঁহু।” টুশি মাথা নাড়ল, “ছেলেরা হয় জোকার। মেয়েরা হয় জোকারনি।”
তপু আবার হি হি করে হাসতে থাকে। তপুর হাসির শব্দ শুনে তার আম্মু ঘরে উঁকি দিলেন এবং সাথে সাথে তপু হাসি বন্ধ করে ফেলল, এই বাসায় হাসাহাসি করা মনে হয় নিষেধ। আম্মু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
তপু কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু হঠাৎ করে তার তোতলামোটা অনেক বেড়ে গেল, সে কথা শুরুই করতে পারল না, আম্মু মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “হোম-ওয়ার্ক করেছিস?”
তপু মাথা নেড়ে জানাল হোমওয়ার্ক করেনি। আম্মু কঠিন মুখে বললেন, “হোম-ওয়ার্ক না করে ইডিয়টের মতো হাসছিস যে বড়? হোম-ওয়ার্ক শেষ কর।”
তপু সাথে সাথে যন্ত্রের মতো উঠে গিয়ে টেবিল থেকে খাতা বই টানাটানি করতে থাকে। পুরো ব্যাপারটার মাঝে টুশি বাইরের একজন মানুষ হিসেবে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
.
তপুর ব্যাপারটা নিয়ে টুশির যে সন্দেহটা ছিল রাত্রে খাবার টেবিলে তার আব্ব আম্মু বাকিটা খোলাসা করে দিলেন। এই বাসায় কোনো কাজের মানুষ নেই, সব কাজ নিজেদের করতে হয় তাই রান্নার পরিশ্রম বাঁচানোর জন্যে সপ্তাহে একদিন রান্না। করে সেগুলো ফ্রিজ করে রাখা হয়–তারপর সারা সপ্তাহ সেগুলো বের করে গরম করে খাওয়া হয়। তপুর আম্মু রান্নাবান্না জানেন না–খাবার বিস্বাদ, তার উপর বাসি খাবার গরম করে খেতে গিয়ে টুশির নাড়ি উলটে আসে। খেতে খেতে টুশির মনে হয় একবেলা জমিলার মায়ের রান্না খাওয়ার জন্যে সে অর্ধেক পৃথিবী দান করে দেবে। টুশি কোনোমতে বিস্বাদ খাবার খাচ্ছে এবং তখন তপুর আম্মু সবজি নামের অত্যন্ত বিদঘুঁটে একটা জিনিস তপুর প্লেটে ধ্যাবড়া করে ছড়িয়ে দিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “ভেজিটবল খা বেশি করে। তোর নিশ্চয়ই ভাইটামিন ডেফিসিয়েন্সি হচ্ছে।”
বেচারা তপু মুখ কালো করে সেই বিস্বাদ জিনিস গেলার চেষ্টা করতে থাকে। তপুর আম্মু টুশির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি এতক্ষণে নিশ্চয়ই তপুর প্রবলেমটা টের পেয়েছ?”
টুশি বুঝতে না পেরে বলল, “কী প্রবলেম?”
“স্পিচ ডিজওর্ডার।”
“স্পিচ কী?”
“ডিজওর্ডার।”
টুশি ভয়ে ভয়ে বলল, “কী হয় এটা হলে?”
তপুর আব্ব হাত নেড়ে বললেন, “তপুর তোতলামোর কথা বলছে।”
“ও!” টুশি নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “তা-ই বলেন! আমি ভাবলাম, কী না কী!”
তপুর আম্মা কঠিন মুখে বললেন, “এটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার। একজন মানুষ কীভাবে কথা বলে সেটা হচ্ছে সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট। সে যদি কথাই না বলতে পারে”
তপুর সামনে এভাবে কথা বলাটা টুশির একেবারেই পছন্দ হল না, বাধা দিয়ে বলল, “কে বলছে পারে না! তপু কী সুন্দর কথা বলে”
চাচি মাথা নাড়লেন, “বেশির ভাগ সময়েই পারে না। আমার কথা বিশ্বাস না করলে এখনই পরীক্ষা করো।” চাচি কঠিন মুখে তপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তপু বল দেখি পৃথিবীর এক ভাগ স্থল তিন ভাগ জল–”।
তপু একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। খুব করুণ চোখে তার মায়ের দিকে তাকাল, কিন্তু চাচির মন এতটুকু নরম হল না, হুংকার দিয়ে বললেন, “বল। পৃথিবীর এক ভাগ স্থল তিন ভাগ জল।”
চাচা প্লেটে বিস্বাদ ভাতের সাথে বিস্বাদ ডাল মাখাতে মাখাতে বললেন, “থাক ছেড়ে দাও এখন।”
“কেন ছেড়ে দেব? তোমার লাই পেয়ে পেয়েই তপুর এই দশা। ডাক্তার বলেছে প্র্যাকটিস করতে–এই পাজি ছেলে প্র্যাকটিস করে?”
চাচা কোনো কথা না বলে খেতে লাগলেন। এই বাসায় শুধুমাত্র চাচাই মনে হয় চাচির রান্না করা এই বিস্বাদ খাবারগুলো শখ করে খান! চাচি আবার চোখ গরম করে তপুর দিকে তাকালেন, হুংকার দিয়ে বললেন, “বল, পাজি ছেলে।”
তপুর চোখে পানি এসে গেল, তার মাঝে সে কথা বলার চেষ্টা করল, “পি পি-পি-পৃ–”
“স্পষ্ট করে বল হতভাগা ছেলে।”
তপু ভাঙা গলায় বলল, “থু-থ-থি”
তপুর কষ্ট দেখে টুশির চোখেই পানি এসে যাচ্ছিল কিন্তু চাচির মন একটুও নরম হল না। তপু অনেক কষ্ট করে পৃথিবীর এক ভাগ পর্যন্ত বলে স্থল’ শব্দটিতে আটকে গেল, কিছুতেই সেটা বলতে পারল না। চাচি হিংস্র চোখে তপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং এক সময়ে মুখ ঘুরিয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে যুদ্ধ জয় করার ভঙ্গি করে বললেন, “দেখেছ?”
টুশি কী বলবে বুঝতে পারল না, সে তপুর দিকে তাকাতে পারছিল না; দুর্বলভাবে বলল, “বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“আর কত বড় হবে? সে কি চার বছরের খোকা? তার বয়স সাত। স্পিচ থেরাপিস্টরা কতরকম এক্সারসাইজ দিয়েছে, সকাল-বিকাল প্র্যাকটিস করার কথা, এই পাজি ছেলে কিছু করে? প্রবলেমটা কার? তার না আমার?”
টুশি বলল, “আপনি কিছু চিন্তা করবেন না চাচি। এখন তো আমি আছি, আমি তপুর সব এক্সারসাইজগুলি করিয়ে দেব।”
এই প্রথমবার চাচি একটু নরম হলেন, বললেন, “থ্যাংক ইউ। একটা অসুস্থ পঙ্গু ছেলে থাকা যে কী কষ্ট সেটা মা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।” চাচি ফোঁৎ করে একটা নিশ্বাস নিয়ে গলায় কান্না-কান্না ভাব নিয়ে এলেন এবং এই পুরো নাটকের মাঝে চাচা বিস্বাদ কড়কড়ে ভাতের সাথে আঠালো সবজি আর ফ্যাকাশে দানা দানা ডাল মিশিয়ে কোঁৎ কোঁৎ করে খেতে লাগলেন। মনে হয় তাঁর চারপাশে কী হয় তিনি তার কিছু দেখেন না শোনেন না বা বোঝেন না।
.
রাত্রিবেলা যখন টুশি আর তপু তাদের ঘরে একা তখন টুশি তপুকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “তোর আম্মু যে এক্সারসাইজের কথা বলেছে সেগুলো কী?”
তপু মুখ কালো করে বলল, “মা-মা-মারবেলের মতো বল মু-মু-মুখে রেখে ক-ক-কথা বলতে হয়।”
টুশি মুখ কুঁচকে বলল, “ছি! খবরদার ওগুলো করবি না। যতসব পাগলামি!”
“আ-আ-আম্মু যে বকে।”
“আমি তোকে ঠিক করে দেব।”
তপু অবাক হয়ে বলল, “ঠি-ঠিক করে দেবে?”
“হ্যাঁ। আমাকে কী দিবি বল?”
“স-স-সবগুলো কমিক দিয়ে দেব।”
“ধুর তোর ঐ কমিক কে পড়ে!”
তপু চিন্তিত মুখে বলল, “তা-তা-তা-হলে আমার লে-লে-লেজার গান।”
“আমি মেয়েমানুষ তোর লেজার গান দিয়ে কী করব? ক্যাশ টাকা দিবি কি না বল!”
“টা-টা-টাকা?” তপু খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। “ক-ক-কত টাকা?”
“লাখখানেক।”
“লা-লা-লা “
টুশি এবারে হি হি করে হেসে ফেলল, বলল, “তোকে টাকা দিতে হবে না, আমি এমনিতেই ঠিক করে দেব। শুধু”
“শুধু কী?”
“শুধু সবসময় আমার পক্ষে থাকবি। তুই আর আমি সবসময় একদিকে। ঠিক আছে?”
তপু একগাল হেসে বলল, “ঠি-ঠিক আছে।”
“ছোট থাকা খুব সমস্যা। বড় মানুষেরা খুব জ্বালাতন করে। এইজন্যে যারা ছোট তাদের সবসময় একসাথে থাকতে হয়। এখন থেকে তুই থাকবি আমার পক্ষে–আমি থাকব তোর পক্ষে।”
তপুর মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে কাছে এগিয়ে এসে বলল, “আ আ-আমাকে তুমি কে-কে-কেমন করে ঠিক করবে?”
“সেটা সিক্রেট। এখন বলা যাবে না।”
“ক-ক-কখন বলবে?”
“সময় হলেই বলব।”
এরকম সময় চাচি ঘরে মাথা ঢুকিয়ে বললেন–”এত রাতে এত কথা কিসের, ঘুমিয়ে পড় দুজনেই।”
“জি চাচি ঘুমাচ্ছি।” টুশি তাড়াতাড়ি উঠে ঘুমানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সুটকেস খুলে ঘুমের কাপড় বের করার সময় প্রথমে তার প্রিয় বইগুলো দেখতে পেল। সেগুলো যত্ন করে বের করে টেবিলে রাখাতেই তার সেই বিচিত্র বোতলটা চোখে পড়ল। টুশি সাবধানে বোতলটা বের করে টেবিলে রাখতেই তপু জিজ্ঞেস করল, “এ-এটা কী?”
টুশি মুখ গম্ভীর করে বলল, “কেউ জানে না এই বোতলের ভিতরে কী আছে।”
“খু-খুলে দ্যাখো না কেন?”
“কেমন করে খুলব? দেখিস না কীভাবে সিলগালা করে রেখেছে।”
“কে রেখেছে?”
“কেউ জানে না।” টুশি রহস্যময় গলায় বলল, “একটা বিশাল কালো সিন্দুকের মাঝে এটা লুকিয়ে রেখেছিল একশ বছর।”
“স-স-সত্যি?”
“আমি কি তোর সাথে মিথ্যা কথা বলব?”
তপু খুব কৌতূহল নিয়ে বোতলটা দেখল, টুশি বলল, “আমার কী মনে হয় জানিস?”
“কী?”
“এই বোতলটার মাঝে আনন্দ আর স্ফুর্তি ঠেসে বন্ধ করা আছে। এটা খুলতেই চারিদিকে আনন্দ হতে থাকবে।”
তপু চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“আমার তা-ই মনে হয়। তা না হলে কেন মানুষ একটা বোতল একশ বছর এইভাবে ছিপি দিয়ে বন্ধ করে আটকে রাখবে?”
তপু বোতলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, “বো-বো-বোতলটা খুলে দেখি!”
টুশি মাথা নাড়ল। বলল, “খুলব। যেদিন তোর আর আমার দুজনেরই কিছু নিয়ে মন খারাপ থাকবে সেদিন বোতলটা খুলব, সাথে সাথে দেখবি আমাদের মন ভালো হয়ে যাবে।”
তপু মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল। টুশি একটা নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তপু, তোর কি মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়?”
“আ-আ-আম্মু যখন বকে তখন মন খারাপ হয়।”
টুশি গম্ভীর গলায় বলল, “বকলে তো মন খারাপ হবেই। মন খারাপ করার জন্যেই তো বকে। কেউ কি মন ভালো করার জন্যে বকে? এমনি মন খারাপ হয়?”
“নাহ, হয় না।”
টুশি কোনো কথা বলল না, শুধু ছোট একটা নিশ্বাস ফেলল।
.
রাত্রিবেলা দুজনেই যখন শুয়েছে তখন টুশি তার বিছানা থেকে বলল, “তপু, ঘুমিয়ে গেছিস?”
“না।”
“তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি? সত্যি করে বলবি।”
“আচ্ছা।”
“আমাকে যখন প্রথম দেখেছিস তখন আমার চেহারাটা দেখে তোর কী মনে হয়েছিল? সত্যি সত্যি বলবি।”
তপু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ম-ম-মনে হয়েছিল, তোমার চেহারাটা বেশি ভা-ভালো না। এখন কিন্তু ভা-ভালোই মনে হচ্ছে।”
“ও।”
তপু জিজ্ঞেস করল, “কে-কেন আপু?”
টুশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, এমনি।”
০৩. একলা রাত
মাস তিনেক পরের কথা। টুশি আর তপু তাদের পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। তপুর আব্ব আর আম্মু বাসায় নেই, বিকেলবেলা তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেছেন। বের হওয়ার সময়ে দুজনেই নিচু গলায় ফিসফিস করে চিন্তিত মুখে কথা বলছিলেন– কী নিয়ে এরকম চিন্তা সেটা তাদের বলে যান নি। তাদেরকে বলে যাবেন টুশি আর তপু সেরকম আশাও অবশ্যি করে নি। তাদেরকে এই বাসায় মানুষ বলেই বিবেচনা করা হয় না–টুশি বাইরের মানুষ, তাকে মানুষ বলে বিবেচনা না করলে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু তপুকেও যেন হিসেবের মাঝেই নেয়া হয় না। চাচা-চাচির কথাবার্তা কাজকর্ম দেখে মনে হয় তপু যেন একটা জীবাণু, পারলে ফিনাইল দিয়ে ধুয়ে তাকে যেন নর্দমায় ফেলে দেয়া হবে! বেচারা তপুর দোষটা কোথায় সেটা টুশি এখনও বুঝতে পারে নি, তার কথাবার্তায় একটু তোতলামো আছে কিন্তু সেটা তো আর কারও অপরাধ হতে পারে না। এমনিতে তপুর মতো মিষ্টি স্বভাবের ছেলে পাওয়া কঠিন, এই বাসায় যদি তপু না থাকত তা হলে টুশি বহু আগে পালিয়ে জমিলার মায়ের কাছে চলে যেত।
পড়ার টেবিলে কয়েকটা যোগ অঙ্ক করে তপু বলল, “টু-টু-টুশি আপু, খি খিদে পেয়েছে।”
টুশি মাথা চুলকাল, তার নিজেরও খিদে পেয়েছে। চাচা-চাচি যাবার সময় কিছু বলে যান নি, তাই তারা ধরেই নিয়েছে যে বেশি রাত হবার আগে চলে আসবেন। কিন্তু মোটামুটি রাত হয়ে আসছে তারা এখনও আসছেন না–রাতের খাবারের কী হবে টুশি বুঝতে পারছে না। টুশি জিজ্ঞেস করল, “বেশি খিদে পেয়েছে?”
তপু মাথা নাড়ল। টুশি বলল, “আয় দেখি ফ্রিজে কী আছে।” ফ্রিজ খুলে দেখা গেল সেখানে কিছু নেই একটা বাটিতে শুকনো কয়েকটা চিমসে হয়ে থাকা পটলভাজি–সেটা দিয়ে তো আর রাতের খাবার হতে পারে না। ফ্রিজে কোনো খাবার নাই দেখে তপুর খিদে মনে হয় এক লাফে আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
টুশি বলল, “তুই কোনো চিন্তা করিস না। চাচা-চাচি আসতে দেরি করলে আমি রান্না করে ফেলব।”
তপু চোখ বড় বড় করে বলল, “তু-তু-তুমি রান্না করতে পার?”
“পারি না আবার!” টুশি তপুকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে একটু বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলল, “আমি সবকিছু রাঁধতে পারি। ভাত ডাল ডিমভাজি খিচুড়ি।” কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে বলল, “জমিলার মা আমাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়েছে।”
“স-স-সত্যি?”
“সত্যি নয়তো মিথ্যা? দেখাব রান্না করে?”
আব্ব আম্মু না এলেও তপুকে না খেয়ে থাকতে হবে না জেনে তপু খানিকটা ভরসা পেল, সে জ্বলজ্বলে চোখে টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “তু-তু-তুমি কী রান্না করবে?”
“সেটা নির্ভর করে বাসায় কী আছে তার উপর। যেমন মনে কর বাসায় আছে শুধু চাল ডাল আর ডিম। তা হলে মনে কর”
টুশি কথা শেষ করার আগেই টেলিফোন বাজল, টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “এটা নিশ্চয়ই চাচা নাহয় চাচি।” সে দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরল, “হ্যালো।”
“হ্যালো। কে টুশি?”
তপুর আম্মুর গলার স্বর, টুশি বলল, “জি চাচি, আমি।”
“আমরা একটা ঝামেলায় আটকে গেছি। এমনও হতে পারে যে আজ রাতে আমরা নাও আসতে পারি।”
“নাও আসতে পারেন?”
“হ্যাঁ। তোমরা খেয়ে ঘুমিয়ে যেয়ো। দরজা বন্ধ করে রেখো।”
“ঠিক আছে চাচি।”
“ভয় পাবে না তো?”
টুশির হঠাৎ করে ভয় ভয় লাগতে থাকে কিন্তু সেটা তো আর বলা যায় না, তাই চি-চি করে বলল, “না চাচি ভয় পাব না।”
“কিছুতেই দরজা খুলবে না।”
“ঠিক আছে চাচি, দরজা খুলব না।”
“আজ যদি খুব বেশি রাত হয়ে যায় তা হলে কাল সকালে আসব। কাল তো তোমাদের স্কুল নাই?”
“না চাচি।”
“গুড।”
তারা আজ রাতে কী খাবে সেটা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই অন্য পাশ থেকে চাচি টেলিফোনটা রেখে দিলেন। টুশি টেলিফোন রেখে তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচা-চাচি আজ রাত্রে নাও আসতে পারেন।”
“না-না-না-নাও আসতে পা-পা-পারেন?” হঠাৎ করে তপুর তোতলামি বেড়ে গেল। টুশি সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? ভয় পাবার কী আছে?”
“রাত্রে যদি ভূ-ভূ-ভূত আসে?”
ভূতের কথা শুনে টুশির পেট ভয়ে মোচড় দিয়ে উঠল, কিন্তু সে মুখে সেটা বুঝতে দিল না। সাহসের ভাব দেখিয়ে বলল, “ধুর! ভূত আবার কিছু আছে নাকি। আয়াতুল কুরসি বললে ভূত ধারেকাছে আসে না।”
“তু-তু-তুমি আয়াতুল কুরসি জান?”
“একেবারে মুখস্থ, কণ্ঠস্থ ঠোঁটস্থ। পড়ে তোকেও একটা ফুঁ দিয়ে দেব।”
টুশির কথা শুনে তপু একটু সাহস পেল। টুশি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “তা ছাড়া ঢাকা শহরে যত গাড়ি, লাইট শব্দ আর ধোঁয়া–এখানে ভূত কেন ভূতের বাবাও আসবে না!”
তপু ভয়ে ভয়ে বলল, “কে-কেন টুশি আপু?”
“জিন ভূতেরা লাইট ধোয়া শব্দ এইসব খুব ভয় পায়।”
“ও।”
টুশি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “আয় আমরা রান্না করে ফেলি।”
তপুর চোখেমুখে খানিকটা উৎসাহ ফুটে উঠল, বলল, কী-কী মজা হবে, তা তা-তাই না টুশি আপু?”
টুশি এ ব্যাপারে খুব নিশ্চিত ছিল না কিন্তু সেটা তপুকে বুঝতে দিল না। বলল, “হ্যাঁ অনেক মজা হবে!”
খাবারের মেনুকে খুব সহজ করার চেষ্টা করা হল, খিছুড়ি এবং ডিমভাজা। চাল এবং ডাল মেপে ডেকচিতে ঢালা হল। কীভাবে রান্না করতে হয় সেটা নিয়ে টুশির ভাসাভাসা একটা ধারণা ছিল, কিন্তু কতটুকু রান্না করতে হয় সেটা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। রান্না করার আগে যে জিনিসটা থাকে অল্প একটু, রান্না করার পর সেটা ফুলে ফেঁপে এত বিশাল আকার নিয়ে নেয় যে সেটা টুশি কল্পনাও করে নি। তাই প্রায় ঘণ্টাখানেক পর যখন রান্না শেষ হয়েছে তখন টুশি এবং তপু। আবিষ্কার করল যেটুকু রান্না হয়েছে সেটা তারা চোখ বুজে সপ্তাহখানেক খেতে পারবে। তপু ভয়ে ভয়ে বলল, “এ-এ-এতগুলো কে খাবে?”
টুশি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি তো আরও কম রাঁধতে চেয়েছিলাম, তুই না বললি বেশি করে রাধার জন্যে। তোর নাকি অনেক খিদে পেয়েছে। এখন বেশি করে খা।”
কাজেই দুজনেই বেশি করে খেল। খিদে বেশি পেয়েছিল বলেই কি না জানা নেই দুজনের কাছেই নিজেদের রান্নাকে মনে হল প্রায় অমৃত। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে দুজনে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–রান্না করা ব্যাপারটি সহজ হতে পারে কিন্তু রান্নার প্রস্তুতির অংশটা সহজ না। সারা রান্নাঘরে চাল, ডাল, বাটি, চামুচ, পেঁয়াজ, পেঁয়াজের খোসা, ডিম, ডিমের ছিলকে, কাঁচামরিচ, শুকনো মরিচ তেল লবণ বাসন পাতিল ছড়ানো–হঠাৎ দেখলে মনে হয় এখানে একটা টর্নেডো হয়ে গেছে। টুশি রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচি আসার আগে এটা পরিষ্কার করতে হবে। না হলে চাচি খুব রাগ করবে।”
তপু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠি-ঠি-ঠিক বলেছ।”
“আয় আগে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিই। রান্না করে খেতে খুব পরিশ্রম হয়েছে।”
টুশি যে-কথাই বলে তপু কোনোরকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই সেটা মেনে নেয় কাজেই এবারেও সেটা মেনে নিল, কাজেই দুজনেই বিশ্রাম নেবার জন্যে নিজেদের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
টুশি ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচা-চাচি কোথায় গেছে জানিস তপু?”
“আ-আ-আমার মনে হয় নানি-বাড়ি।”
“তোর নানি-বাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
“তা হলে সেটা নিয়ে এত ফিসফিস কেন?”
“জা-জা-জানি না। টা-টা-টাকা পয়সার ব্যাপার আছে মনে হয়।”
টুশি কোনো কথা বলল না, তপু পর্যন্ত বুঝে গেছে টাকাপয়সার ব্যাপার থাকলে তার আব্ব আম্মু খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টুশি আরও একটা কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ করে তপু উঠে বসে টুশির টেবিল থেকে বিচিত্র আকারের বোতলটা হাতে নিয়ে বলল, “টু-টুশি আপু চলো এই বো-বো বোতলটা খুলি।”
“খুলবি?”
“হ্যাঁ। মনে নেই তুমি বলেছিলে এ-এটা খুললে খুব আ-আনন্দ হবে। চ-চলো খুলি।”
টুশি উঠে বলল, “চল।”
প্রথমে দুজনে হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু ছিপিটা অসম্ভব শক্তভাবে লাগানো। তখন তপু খুঁজে খুঁজে তার আব্দুর টুল-বক্সটা নিয়ে আসে। সেখান থেকে একটা প্লায়ার্স বের করে দুজনে খোলার চেষ্টা করে খুব একটা সুবিধে করতে পারল না। ছিপিটা মনে হয় ঝালাই করে লাগানো, তাই শেষ পর্যন্ত হ্যাঁক-স বের করে ঝালাইয়ের অংশটা কেটে ফেলল, তখন শেষ পর্যন্ত ছিপিটা খুলে এল। টুশি খুব সাবধানে ছিপিটা খুলে ফেলে ভিতরে উঁকি দেয়, কিছু দেখা যায় না। সাবধানে সেটা টেবিলে উপুড় করে–ভিতর থেকে কিছুই বের হল না। সে কয়েকবার ঝকাল তারপর বোতলে •ক লাগিয়ে শুঁকে দেখল ভেতরে আঁঝালো এক রকমের গন্ধ। তপু জিজ্ঞেস করল, “ভি-ভ-ভিতরে কী টু-টুশি আপু?”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “কিছু নাই।”
“দেখি।”
টুশি বোতলটা তপুর হাতে দিল। তপু সেটা হাতে নিয়ে ঝাঁকিয়ে দেখে, চোখে লাগিয়ে দেখে এবং নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে বলল, “প-পচা গন্ধ।”
“হ্যাঁ। অনেকদিন থেকে বন্ধ তো সেইজন্যে।”
“কিন্তু ভি-ভিতরে কিছু না-নাই কেন?”
টুশি এত সহজে এরকম রহস্যময় একটা বোতলের এই পরিণতি মেনে নিতে রাজি হল না। গম্ভীর গলায় বলল, “এর মাঝে হয়তো আনন্দ ঠেস ভরা ছিল, সেটা বের হয়ে এখন ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে।”
“য-য-যদি আনন্দ না হয়ে অ-অন্য কিছু হয়?”
“অন্য কী হবে?”
“ভূ-ভূ-ভূত?”
“ধুর গাধা! ভূত কি বোতলের ভিতরে থাকে। ভূত থাকে শোনে। গাবগাছে।”
“কিন্তু–”
তপু ভূতসংক্রান্ত আরও একটা প্রশ্ন করতে চাইছিল কিন্তু টুশি তাকে সুযোগ দিল না। বলল, “আয় আগে রান্নাঘরটা পরিষ্কার করে ফেলি।”
“চ-চলো।”
দুজনে রান্নাঘরে গিয়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে থাকা জিনিসগুলো পরিষ্কার করতে থাকে।
.
ঠিক সেই সময় টুশি আর তপুর ঘরে খুব বিচিত্র একটা জিনিস ঘটতে থাকে। ছিপি খুলে রাখা বোতলটার ভিতর থেকে প্রথমে ভালো করে দেখা যায় না এরকম সূক্ষ্ম একটা ধোঁয়ার রেখা বের হয়ে আসতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই ধোঁয়া বাড়তে থাকে, তারপর একসময় কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। ধোয়াটুকু সারা ঘরে ছড়িয়ে না পড়ে বোতলের উপরে ছাদের কাছাকাছি জমাট বাঁধতে থাকে। জমাটবাধা ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে প্রথমে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু ধীরে ধীরে সেখানে একটা মানুষের মূর্তি স্পষ্ট হতে থাকে। প্রথমে মাথা শরীর আর পাতাপর সেখানে খুঁটিনাটি জিনিস ফুটে ওঠে–চোখ নাক মুখ, হাত, হাতের আঙুল। মানুষের মূর্তির রংটুকু হয় ধূসর, আস্তে আস্তে সেখানে রঙের ছোঁয়া লাগতে থাকে। লম্বা দাড়ি আর চুলে-ঢাকা একজন মানুষ, মাথায় উজ্জ্বল একটা পাগড়ি। লম্বা জরিদার আচকান–লাল রঙের পায়জামা, কোমর থেকে একটা বিশাল তরবারি ঝুলছে। দুই কানে দুটি বড় বড় রিং, গলায় রঙিন পাথরের মালা। পায়ে হাঁটুসমান উঁচু নকশিদার জুতো। মানুষটার বড় বড় গোল গোল চোখ, ফোলা গালে লালচে আভা।
মানুষটা ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলী তাকে পাক খেয়ে ঘোরাতে থাকে। মানুষের মূর্তিটা দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে ধোয়ার সাথে সাথে ঘুরতে থাকে এবং একসময় টেবিলে আঘাত খেয়ে প্রচণ্ড শব্দ করে মেঝেতে আছাড় পড়ল। মানুষের মূর্তিটা যন্ত্রনার একটা শব্দ করে চোখ খুলে তাকালো তারপর কোনোমতে টেবিল ধরে উঠে দাঁড়াল।
রান্নাঘরে প্লেট ধুতে ধুতে টুশি এবং তপু স্পষ্ট শুনতে পেল তাদের ঘরের ভিতরে ধড়াম করে কিছু-একটা আছড়ে পড়েছে, দুজনে একসাথে চমকে উঠল। তপু ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “ও-ও-ওইটা কি-কি-কিসের শব্দ?”
টুশি সাহস দেওয়ার জন্যে বলল, “কিছু না। ইঁদুর হবে।”
তপু বলল, “ক-ক-কত বড় ইঁদুর?”
টুশি উত্তর দিল না, ঘরের ভেতরে যে শব্দ হয়েছে সেরকম শব্দ করার জন্যে ইঁদুরটার একটা মোষের মতো বড় হওয়া দরকার। টুশি রান্নাঘরের আশেপাশে তাকিয়ে রুটি বানানোর বেলুনটা হাতে তুলে নিল, তারপর তপুকে বলল, “আয় আমার সাথে।” ।
দুজনে পা টিপে টিপে তাদের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ঠিক সেই সময় ঘরের ভেতর থেকে লম্বা চুল দাড়ি, বড় বড় চোখের বিচিত্র পোশাকের বিশালবপু প্রাণীটি বাইরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
ঘরের দরজায় টুশি এবং তপুর সাথে সেই মূর্তির দেখা হল।
০৪. কাবিল কোহকাফী
টুশি এবং তপু যত জোরে চিৎকার করল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই কিম্ভুতকিমার মূর্তি তার থেকে একশ গুণ জোরে চিৎকার করে লাফ দিয়ে পিছনে সরে গেল। ভয়ের চোটে টুশি কী করছে বলতে পারে না–বেলুনটা উপরে তুলে সে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে, সেই ভয়ানক মূর্তিটা ছুটে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল, কোনোমতে উঠে পা চেপে ধরে কঁকাতে কঁকাতে লাফাতে থাকে, হঠাৎ করে আবার টুশি আর তপুর দিকে চোখ পড়ে যায় তখন আবার বিকট চিৎকার করে লাফাতে থাকে এবং কিছু বোঝার আগেই টান দিয়ে কোমরে ঝুলিয়ে রাখা তরবারিটা টেনে বের করে নিয়ে আসে। দুই হাতে তরবারি ধরে সে ঘোরাতে থাকে এবং একবার বিকট চিৎকার করে সামনে কোপ বসিয়ে দেয়। তরবারিটা তাদের পড়ার টেবিলে দুই আঙুল গেঁথে গেল, মূর্তিটা সেটা টেনে বের করে নিয়ে টুশি আর তপুর দিকে এগিয়ে এসে তরবারিটা ঘোরাতে থাকে–বাতাশে শাঁই শাঁই শব্দ হতে থাকে–ভয়ে আর আতঙ্কে টুশির মনে হল সে বুঝি মরেই যাবে। তপু যদি টুশিকে জাপটে ধরে চিৎকার করতে না থাকত তা হলে সে মনে হয় মরেই যেত–শুধুমাত্র তপুকে সাহস দেবার জন্যে মনে হয় সে কোনোভাবে বেঁচে রইল, বিশাল শরীরের সেই মূর্তি তরবারি হাতে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল এবং তার বিরুদ্ধে টুশি রুটি বানানোর বেলুনটা অস্ত্র হিসেবে ধরে চিৎকার করতে থাকে।
মূর্তিটা আরও কাছে এসে একটা লাফ দিয়ে তরবারি দিয়ে একটা কোপ মারার চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ কেমন যেন কুঁজো হয়ে যন্ত্রণায় কোঁকাতে থাকে। টুশি এবং তপু অবাক হয়ে দেখল ভয়ংকরদর্শন মূর্তিটা তার কোমরটা ধরে যন্ত্রণায় কাতর শব্দ করতে করতে এগিয়ে সোফার উপর ধড়াম করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। হাত থেকে তরবারি ছিটকে পড়ল নিচে এবং মূর্তিটি যন্ত্রণার কে কে শব্দ করতে লাগল।
টুশি এবং তপু দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রূদ্ধশ্বাসে এই মানুষটাকে দেখে। খানিকক্ষণ পর টুশি একটু সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? তোমার কী হয়েছে?”
মানুষটা কোঁ কোঁ করতে করতে বলল, “রগে টান পড়েছে।”
“কোথায় টান পড়েছে?”
“রগে। রগে। অনেকদিন থেকে এক্সারসাইজ নাই তো–বডি ফিট নাই।”
টুশি ঢোক গিলে বলল, “এক্সারসাইজ নাই?”
“নাহ্! কীভাবে করব? এইটুকু বোতলের মাঝে মানুষ এক্সারসাইজ করে কীভাবে?” বোতলটা দেখাতে গিয়ে মানুষটার রগে আবার টান পড়ল–যন্ত্রণার শব্দ করে আর্তনাদ করে ওঠে, “ও বাবাগো! গেলাম গো! মা গো।”
টুশি আর তপু একজন আরেকজনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল, দুইজন একসাথে বলল, “বোতলের মাঝে?”
“হ্যাঁ, বোতলের মাঝে।”
টুশি এবারে তপুর মতো তোতলাতে শুরু করল, “বো-বো-বোতলের মাঝে?”
মানুষটা মুখ ভেংচে বলল, “হ্যাঁ, বো-বো-বোতলের মাঝে?”
টুশি এবার রেগে গিয়ে বলল, “তুমি আমাকে ভ্যাঙাচ্ছ কেন?”
“কেন ভ্যাঙাব না, পিঠের যন্ত্রণায় মারা যাচ্ছি, তার মাঝে এক কথা একশবার বলতে হচ্ছে!”
টুশি এক পা এগিয়ে এসে বলল, “বাজে কথা বললে এক কথা একশবার কেন হাজার বার বলতে হবে।”
টুশির কথা শুনে মানুষটা যন্ত্রণা সহ্য করে কোনোমতে বাঁকা হয়ে টুশির দিকে তাকাল, তারপর ফোঁস করে নিশ্বাস নিয়ে বলল, “মেয়েমানুষ তো, এইজন্যে তেজ বেশি!”
টুশি রেগে গিয়ে বলল, “কী বললে? কী বললে তুমি?”
“আমি কী ভুল বলেছি? এইটুকুন একটা বোতলের মাঝে আমাকে এক হাজার বছর কে আটকে রেখেছিল?”
“কে?”
“আবার কে? একজন মেয়েমানুষ। শাহজাদি দুনিয়া।”
টুশি আর তপু আবার একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তারা এখনও ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। টুশি জিজ্ঞেস করল, “তুমি বোতলের মাঝে থাকো?”
মানুষটা রেগে উঠে বলল, “ইচ্ছা করে থাকি নাকি?” বেকায়দা নড়ে উঠে আবার কোথায় জানি যন্ত্রণা করে ওঠে, মানুষটা কাতর শব্দ করে বলল, “ও বাবাগো–গেলাম গো! মরলাম গো!”
টুশি জিজ্ঞেস করে বলল, “বোতলের মাঝে কেন থাকো?”
মানুষটা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “সব শাহজাদি দুনিয়ার কারসাজি। আমাকে ট্রিক্স করে বোতলের মাঝে ঢুকিয়েছিল। আমি বুঝতে পারি নাই”।
“তার পর থেকে তুমি বোতলের মাঝে থাকো?”
“ইচ্ছে করে কি আর থাকি। আটকা পড়ে থাকি।” মানুষটা একটু নড়ে উঠে আবার যন্ত্রণায় কে কে করে ওঠে। খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নিয়ে বলল, এই মেয়ে আমার পিঠটা একটু ডলে দাও না। প্লিজ!”
টুশি মুখ শক্ত করে বলল, “তোমার পিঠ ডলে দেব আমি? তোমার তো সাহস কম না–একটু আগে ঐ তরবারি দিয়ে আমাদের মারতে গিয়েছিলে মনে আছে?”
মানুষটা তার লম্বা দাড়িগোঁফের ফাঁক দিয়ে দুর্বলভাবে হাসল, বলল, “আহা হা, তুমি ঠাট্টাও বোঝ না? প্রথম দেখা হলে একটু ভয় দেখাতে হয় না? হাজার হলেও আমি জিন–মানুষকে যদি একটু ভয় না দেখাই” ।
“তুমি জিন?” চিৎকার করে টুশি আর তপু এক লাফে পিছনে সরে যায়। “জিন? তুমি জিন?”
“একশ ভাগ খাঁটি জিন। কোনো ভেজাল নাই।”
টুশি তখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না, “তু-তুমি জিন?”
“হ্যাঁ। আমার নাম কাবিল বিন মুগাবালি মাহিন্দর কোহকাফী।”
“এত বড় নাম?”
“আগে আরও বড় ছিল। শাহজাদি দুনিয়া পুরোটা মনে রাখতে পারত না বলে ছোট করেছি।”
“ছোট করেই এই! নাম হতে হয় দুই শব্দের তা হলে বলা যায়, মনে রাখা যায়।
“ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। আরও ছোট করে দিই।” জিনটা বিরক্ত হয়ে বলল, “কাবিল কোহকাফী। হয়েছে?”
“হয়েছে। কাবিল কোহকাফী।”
“এখন বকবক না করে পিঠটা ডলে দাও। আচ্ছা করে মালিশ করে দাও। যা টাটাচ্ছে সেটা আর বলার মতো না । ভেড়ার চর্বি গরম করে তার মাঝে দুই ফোঁটা তাৰ্পিন দাও। সেখানে এক রতি কর্পূর আর ধানকুচি পাতার রস।”
টুশি চোখ কপালে তুলে বলল, “এইসব আমি কোথায় পাব?”
তপু এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি, এবারে সাহস করে বলল, “আ-আ আব্দুর পা ম-ম-মচকে গিয়েছিল। তখন একটা ম-ম-মলম লাগিয়েছিল। সে-সে সেটা দিয়ে হবে?”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হবে। কোথায় আছে?”
“ড-ড-ড্রয়ারের মাঝে।”
“যা নিয়ে আয়।”
.
একটু পর টুশি সাবধানে কাবিল কোহকাফীর পিঠে সেই ঝাঁঝালো গন্ধের মলম ডলে দিতে থাকে। কাবিলের চোখ আরামে বন্ধ হয়ে আসে, মুখে বলতে থাকে, “আ-হা-হা-! উ-ম-ম-ম-ম! আ-আ-আ–।”
টুশিকে দেখে সাহস পেয়ে তপুও এগিয়ে আসে, সেও টুশির সাথে হাত লাগায় এবং কিছুক্ষণের মাঝে কাবিল কোহকাফী সোজা হয়ে সোফার মাঝে উঠে বসে। দুই হাত উপরে তুলে একটা হুংকার দিয়ে হঠাৎ করে সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, ভয়ে আতঙ্কে টুশি আর তপু ছিটকে সরে গেল। তারা ভয় পাচ্ছিল কাবিল কোহকাফী বুঝি তরবারিটি তুলে নিয়ে তাদের দিকে তেড়ে আসবে, কিন্তু সেরকম কিছু হল না। কাবিল কোহকাফী তার বুকে থাবা দিয়ে হঠাৎ করে বিকট গলায় গান গাইতে শুরু করে,
“শাহাজাদী দুনিয়া পেয়ারের মুনিয়া
বুক ভেঙে কই গেলি খুনিয়া
কলিজার টুকরা
ছাতিনার হাড়ি
বাগদাদি কুকরা
ওরে ও শাজহাদী দুনিয়া আ-আ-আ-”
কাবিল কোহকাফী ঘরের মাঝে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে গাইতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে টুশি আর তপুর দিকে তাকাল, তারপর পেটে হাত দিয়ে বলল, “খিদে লেগেছে।”
টুশি বলল, “খিদে?”
কাবিল কোহকাফী মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। এক হাজার বছর কিছু খাই নাই, মনে হচ্ছে তোমাদের দুইজনকে ধরে কচমচ করে খেয়ে ফেলি!”
“আ-আমাদের?” টুশি এক লাফে দুই পা পিছিয়ে গেল, তপু তার চাইতেও বড় লাফ দিয়ে টুশির পিছনে লুকিয়ে গেল।
কাবিল হাত নেড়ে বলল, “জলদি জলদি খানা লাগাও। শিক কাবাব, বোখরা মিঠাই, তন্দুরি রুটি, বেদানার রস–”
টুশি ঢোক গিলে বলল, “আ-আসলে তো বাসায় খাবার তো সেরকম নেই। একটা বিস্কুটের প্যাকেট–”।
তপু বাধা দিয়ে বলল, “টু-টু-টুশি আপু। খি-খি-খিচুড়িটা দিয়ে দাও।”
“ও হ্যাঁ।” টুশি মাথা নাড়ল, “একটু খিচুড়ি আছে। তুমি খাবে?”
“খিচুড়ি ঘিচুড়ি ফিচুড়ি মিচুড়ি যা আছে তাই নিয়ে আসো। যত খিদে লেগেছে আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারি।”
টুশি দৌড়ে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল, পিছুপিছু কাবিল কোহকাফী ছুটে আসে। ফ্রিজটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “এইটা কিসের বাক্স?”
“এইটা বাক্স না। এইটার নাম ফ্রিজ। এর ভিতরে খাবার রাখে।” টুশি ফ্রিজের দরজা খুলে খিচুড়ির বড় ডেকচিটা টেনে বের করে এনে ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখল। কাবিল ঢাকনা খুলে উল্লসিত চোখে বলল, “মারহাবা! মারহাবা।” হঠাৎ করে ফ্রিজের ভিতরে কাবিল কোহকাফীর চোখ পড়ল, ফ্রিজের দরজায় সাজানো ডিমগুলো দেখে তার চোখ গোল গোল হয়ে ওঠে, চিৎকার দিয়ে বলল, “ডিম! ডিম! ডিম! আহাহা কত দিন ডিম দেখি নাই” সে খাবলা দিয়ে একটা ডিম হাতে নিয়ে সেটাকে চুমো খেতে থাকে।
টুশি বলল, “তোমার ডিম খেতে ভালো লাগে?”
“ডিম আমার জান।” কাবিল কোহকাফী হাত ছড়িয়ে বলল, “ডিম আমার প্রাণ। ডিম আমার চানকে চান, মানকে মান।”
“তোমাকে একটা ডিম ভাজা করে দেব?”
“ভাজা করে ভালো একটা ডিমকে তুমি নষ্ট করতে চাও?” বলে কাবিল কোহকাফী আস্ত একটা ডিম ভেঙে কোঁৎ করে পুরোটা খেয়ে ফেলল।
সুমি কিংবা অপু এর আগে কখনও কাউকে কাঁচা ডিম খেতে দেখে নি, কাবিলকে এভাবে একটা কাঁচা ডিম গিলে ফেলতে দেখে তাদের গা গুলিয়ে আসে।
কাবিল কোহকাফী সবগুলো ডিম কোলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর লাফ দিয়ে উঠে বসল–চেয়ারে বসে যে খেতে হয় ব্যাপারটা সে মনে হয় জানেই না। তার ভারী শরীরের ওজনে মনে হল পুরো টেবিলটা মট মট করে ভেঙে পড়বে– কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ল না। কাবিল একহাত দিয়ে এক খাবলা খিচুড়ি নিয়ে মুখে পারে, অন্য হাত দিয়ে একটা ডিম ভেঙে তার শাস কুসুম মুখে ঢেলে দিয়ে হুম হাম শব্দ করে খেতে থাকে। সারা মুখ থেকে খাবার ছিটকে পড়তে থাকে– তার গোঁফদাড়িতে খিচুড়ি ডিম লেগে কিছুক্ষণেই তার চেহারা কিম্ভুতকিমাকার হয়ে যায়।
টুশি আর তপু একটা বিস্ময় নিয়ে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এর আগে তারা কখনওই একজন মানুষকে এত তৃপ্তি নিয়ে কিছু খেতে দেখে নি। এক হাজার বছর না খেয়ে থাকলেই বুঝি শুধু মানুষ এত তৃপ্তি করে কিছু খেতে পারে। যে খিচুড়িটুকু আগামী এক সপ্তাহে সবাই মিলে খেয়ে শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় নি কাবিল কোহকাফী একবারে সেটা চেটেপুটে খেয়ে বিশাল একটি ঢেকুর তুলল।
টুশি জিজ্ঞেস করল, “তোমার পেট ভরেছে?”
কাবিল কোহকাফী তার বড় পেটে হাত বুলিয়ে বলল, “আপাতত। ফাসক্লাস রান্না। শাহজাদি দুনিয়ার বাবুর্চিও এত ভালো রান্না করতে পারত না। আর তিতির পাখির ডিমগুলিও একেবারে অমৃত–”।
“এগুলো তিতির পাখির ডিম না, এগুলো মুরগির ডিম।”
“মুরগির ডিম? মুরগির আবার ডিম হয় নাকি?” কাবিল কোহকাফী আবার গগনবিদারী একটা ঢেকুর তুলে লাফ দিয়ে টেবিল থেকে নেমে বলল, “এখন ঘুম।”
টুশি বলল, “ঘুম?”
“হ্যাঁ, এক হাজার বছর ঐ চিপা বোতলের ভিতর আমি আটকা পড়েছিলাম। পেরেছি দাঁড়াতে না পেরেছি বসতে না পেরেছি হাত-পা ছড়িয়ে শুতে।” কাবিল কোহকাফী দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দিয়ে এক পাক ঘুরে বলল, “আজ আমি দুই : হাত দুই পা ছড়িয়ে ঘুমাব।” কথা বলতে বলতে তার দুই চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। কোনোমতে খোলা রেখে টুশিকে জিজ্ঞেস করল, “বিছানা কোথায়?”
“বিছানা?”
“হ্যাঁ। বালিশ তুলতুলে নরম তো? কোলবালিশ আছে তো? আমি কোলবালিশ ছাড়া কিন্তু ঘুমাতে পারি না।” কাবিল কোহকাফী ঢুলুঢুলু চোখে বলল, “কোথায় বিছানা?”
টুশি কিছু বলার আগেই হঠাৎ করে বেডরুমে চাচা-চাচির বড় বিছানাটা তার চোখে পড়ল। সে টলতে টলতে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল এবং কিছু বোঝার আগেই ধড়াম করে বিছানার মাঝে আছাড় খেয়ে পড়ল। বিছানায় মাথা স্পর্শ করার আগেই সম্ভবত সে ঘুমিয়ে পড়েছিল কারণ এক মুহূর্ত পরেই টুশি আর তপু প্লেনের ইঞ্জিনের গর্জনের মতো তার নাকডাকার শব্দ শুনতে পেল।
টুশি আর তপু কিছুক্ষণ কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার বিশাল পেটটা নাকডাকার শব্দের সাথে সাথে একবার উপরে উঠছে একবার নিচে নামছে। চুল দাড়ি গোঁফে খিচুড়ি আর ডিম লেগে আছে। দুই হাত দুই দিকে ছড়ানো, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা জুতো না খুলেই সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
তপু ফিসফিস করে বলল, “এ-এ-এখন কী হবে?”
টুশি মাথা চুলকাল, বলল, “পুলিশে খবর দিতে হবে মনে হয়।”
“পু-পু-পুলিশে? কে-কে-কেন?”
“তা হলে কাকে খবর দেব?”
তপু কোনো উত্তর দিল না, অবাক হয়ে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে বলল, “আ-আমি ভেবেছিলাম সত্যিকারের জি-জিন দেখলে ভ ভয় লাগবে। এখন এ-এ-একটুও ভয় লাগছে না।”
“ভয় লাগছে না? এখন যদি চাচা-চাচি আসে? এসে যদি থেকে তাদের বিছানায় খিচুড়ি-মাখা এই জিন এরকম মোটা পেট নিয়ে শুয়ে আছে তখন কী হবে?”
টুশির এই কথা শুনে তপুর মুখ শুকিয়ে গেল। বলল, “স-স-সর্বনাশ! ত-তখন কী হবে?”
“বলেছেন তো আজ রাত্রে আসবেন না। না আসলেই ভালো। কাল সকালে দেখা যাবে।”
“এ-এখন আমরা কী করব?”
“কী আর করব? ঘুমাব।”
“রাত্রে য-যদি জিন জেগে ওঠে?”
“উঠলে উঠবে। যেভাবে ঘুমাচ্ছে মনে হয় উঠবে না।”
তপু মাথা নাড়ল, যেভাবে গভীর ঘুমে কাবিল কোহকাফী অচেতন হয়ে আছে, আজ রাত্রে তার ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না।
রাত্রিবেলা তপু আর টুশির ঘুম হল ছাড়া ছাড়া। একটু পরেপরে তাদের ঘুম ভেঙে গেল এবং শুনতে পেল পাশের ঘর থেকে প্লেনের ইঞ্জিনের মতো শব্দ করে কাবিল কোহকাফী ঘুমাচ্ছে। টুশি কখনও চিন্তাও করে নি যে সে কোনোদিন একটা জিনকে পাশের ঘরে নিয়ে ঘুমাবে! এই জিন নিয়ে যে তাদের কপালে কত দুর্ভোগ আছে তখনও তারা তার কিছুই জানত না।
০৫. দিনের আলোয়
সকালবেলা ভয়ংকর এক চিৎকার শুনে হঠাৎ করে একসাথে টুশি আর তপু লাফিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল। কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে ব্যাপারটা কী–বসার ঘর থেকে কাবিল কোহকাফী চিৎকার করছে, একই সাথে ভয়ের এবং ক্রোধের একধরনের চিৎকার। টুশি এবং তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারপর বিছানা থেকে নেমে একছুটে বসার ঘরে গিয়ে তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। টেলিভিশনে একটা মারামারির দৃশ্য দেখাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে ভয়ংকর চেহারার একজন মানুষ অস্ত্র-হাতে লাফঝাঁপ করছে, কাবিল কোহকাফী তার সামনে তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং টেলিভিশনের সেই মানুষের সাথে যুদ্ধ করার চেষ্টা করছে। কাবিল কোহকাফী লাফাচ্ছে এবং তরবারি নেড়ে তেড়ে যাচ্ছে, চিৎকার করে বলছে, “খুন করে ফেলব–একেবারে খুন করে ফেলব বেতমিজ! খামোশ! কাছে আসবি না আমার, খবরদার কাছে আসবি না। বেল্লিক-নালায়েক-বদমাইশ—“
টুশি আর তপু বুঝতে পারল কাবিল কোহকাফী টেলিভিশনের দৃশ্যটাকে সত্যি ভাবছে আর সেটা নিয়েই এই ঝামেলা। টুশি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে সোফার উপর থেকে রিমোট কন্ট্রোলটা হাতে নিয়ে টিভিটা অফ করে দেয়।
কাবিল কোহকাফী বন্ধ টিভিটার দিকে তাকিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিতে থাকে তার চোখমুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে আছে, দুই হাত দিয়ে তরবারিটা শক্ত করে ধরে রেখেছে, মনে হচ্ছে টেলিভিশন থেকে কেউ বের হয়ে এলেই এক কোপে তার গলা আলাদা করে ফেলবে। টুশি আর তপুর দিকে তাকিয়ে কাবিল কোহকাফী বলল, “সাবধান। খুব সাবধান–এই বাক্সের ভিতর থেকে খুন করতে আসছে।”
টুশি বলল, “এই বাক্সের ভিতর থেকে কেউ আসছে না। এটার নাম টেলিভিশন। টেলিভিশনে অনুষ্ঠান হয়, মানুষ সেই অনুষ্ঠান দেখে।”
কাবিল কোহকাফী অবাক হয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হল সে তার কথা ঠিক বুঝতে পারছে না। টুশি রিমোটটা দেখিয়ে বলল, “এই যে দ্যাখো, এটা দিয়ে টেলিভিশন অন করে।”
টুশি টেলিভিশনটা চালাতেই কাবিল কোহকাফী তরবারিটা ধরে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু তখন সেখানে একটা সাবানের বিজ্ঞাপন হচ্ছে, সুন্দরী একটা মেয়ে নেচে নেচে গান গাইছে এবং সেটা দেখে কাবিল কোহকাফীর চোখ গোল গোল হয়ে উঠল। টুশি রিমোট টিপে আবার টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়ে বলল, “এই দ্যাখো এইটা টিপে আবার অফ করে দেয়া যায়।”
কাবিল হা হা করে বললে, “কই গেল? ঐ মেয়েটা কই গেল? একেবারে শাহজাদি দুনিয়ার মতো দেখতে!”
টুশি বলল, “এইটা সত্যিকারের মেয়ে না। এইটা টেলিভিশনের ছবি। তুমি নিশ্চয়ই ভুল করে এই রিমোটটা টিপে দিয়েছিলে!”
“হ্যাঁ।” কাবিল কোহকাফী মাথা নাড়ল, “টিপে দিতেই বাক্সের ভিতর থেকে একটা লোক আক্রমণ করল!”
টুশি হাসি গোপন করে বলল, “তোমার চিৎকার শুনে যা ভয় পেয়েছিলাম!”
কাবিল বলল, “আমিও ভয় পেয়েছিলাম। কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ বাক্সের ভিতর থেকে পাগলা মানুষ চাকু হাতে ছুটে আসছে! ওহ্!”
“তোমার রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়েছিল?”
“হ্যাঁ। এক হাজার বছর পর হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমালাম। কী আরাম! আহ্! শুধু এই দাড়ি আর চুল–কুট কুট কুট কুট করে। আজকে সব কেটে ফেলব।”
কথা শেষ করেই কাবিল একমুঠি দাড়ি ধরে টেনে তরবারি দিয়ে কাটার চেষ্টা। করতে লাগল। টুশি বলল, “আরে কী করছ। গাল কেটে যাবে তো?”
“দাড়ি কাটতে হলে একটু গাল কাটেই!”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “না। তরবারি দিয়ে কেউ দাড়ি কাটে না। দাড়ি কাটার জন্যে কাঁচি আছে, রেজর আছে।”
“সেগুলো আবার কী? এই দুনিয়ায় দেখি একটার পর আরেকটা ম্যাজিক!”
কাজেই কাবিল কোহকাফীকে বাথরুমে নিয়ে কাঁচি, রেজর, শোভিং ক্রিম সাবান টুথপেস্ট টুথব্রাশ এইসব দেখিয়ে দিল। কাবিল কোহকাফী সবচেয়ে বেশি অবাক হল পানির ট্যাপ দেখে, ট্যাপ খুললেই পানি বের হয়ে সেটা সে সে বিশ্বাসই করতে পারে না। সে হাঁ হয়ে পানির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর পানিতে হাত দিয়ে আনন্দে হা-হা, করে হাসতে থাকে। চোখ বড় বড় করে টুশি আর তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এক হাজার বছর গোসল করি নাই! এক হাজার বছর!”
টুশি নাক কুঁচকে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকাল, তার শরীর থেকে যে বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে এক হাজার বছর গোসল না করলে এরকম গন্ধ হতেই পারে! সে মুখ শক্ত করে বলল, “খুব ভালো করে গোসল করো–এক হাজার বছর গোসল না করা ভালো ব্যাপার না!”
টুশি কাবিল কোহকাফীকে একটা শুকনো তোয়ালে, তপুর আব্দুর একটা ঢিলে পায়জামা আর পাঞ্জাবি দিয়ে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল।
কাবিন কোহকাফী অনেক হৈচৈ করে ভেতরে চুল দাড়ি কেটে গোসল করতে লাগল। একসময় সাবান চোখে যাওয়ায় সে ভেতর থেকে ভয়ংকর চিৎকার করতে শুরু করে। তখন টুশিকে বলতে হল ভয় পাওয়ার কিছু নেই, পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পরেই ভেতর থেকে কাবিল গলা ফাটিয়ে গান গাইতে লাগল। হঠাৎ করে গান থেমে গেল এবং হুটোপুটির শব্দ শোনা গেল। আবার হুটোপুটি থেমে গিয়ে গানের শব্দ বের হতে লাগল–মনে হতে লাগল ভেতরে কেউ গোসল করছে না, বুঝি কারো সাথে কুস্তি করছে।
শেষ পর্যন্ত বাথরুম থেকে যখন কাবিল কোহকাফী বের হয়ে এল তখন তাকে দেখে টুশি এবং তপু চমৎকৃত হয়ে যায়, দাড়িগোঁফ শেভ করা, মাথার চুল কেটে ছোট করা, একটা পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরে আছে পরিষ্কার ভদ্রলোকের মতো চেহারা। লম্বা চুল, লম্বা দাড়ি, কানে দুল গলায় মালা, হাতে তরবারি জরিদার জাব্বাজোব্বা পরা যে ভয়ংকর জিনকে দেখে রাত্রে তারা ভয় পেয়েছিল সকালবেলার এই কাবিল কোহকাফীর মাঝে তার কোনো চিহ্নই নেই। তাকে দেখে কোনোভাবেই জিন মনে হয় না, সে পুরোপুরি একজন মানুষ এবং তাকে দেখে হঠাৎ টুশির এখন অন্যরকম একটা ভয় হতে লাগল, তার মনে হতে লাগল কাবিল কোহকাফী আসলে জিন না, লে একজন মানুষ, কীভাবে কীভাবে জানি বাসায় ঢুকে গেছে। সে তপুকে ফিসফিস করে বলল, “তপু!”
“কী-কী হয়েছে?”
“আমার কী মনে হচ্ছে জানিস?”
“কী?”
“কাবিল কোহকাফী আসলে জিন না, আসলে একজন মানুষ।”
তপু অবাক হয়ে বলল, “মা-মা-মানুষ হলে বো-বোতলের ভিতর ঢুকেছে কেমন করে?”
“বোতলের ভিতরে কখনও ঢুকে নাই। আমাদের মিথ্যে কথা বলছে। দেখছিস না একেবারে মানুষের মতো!”
রাত্রিবেলা কাবিল কোহকাফীকে দেখে তপু যেরকম ভয় পেয়েছিল এখন তাকে দেখে তার মোটেই সেরকম ভয় লাগছে না, টুশির কথা শুনে সে একেবারে সরাসরি কাবিলকে জিজ্ঞেস করে বসল, বলল, “তু-তুমি আসলে জিন না?”
কাবিল কোহকাফী ভুরু কুঁচকে বলল, “এ্যা! কী বললে?”
“বলেছি তু-তুমি জিন না। তু-তুমি মানুষ।”
কাবিল কোহকাফীকে দেখে মনে হল তপুর কথা শুনে সে খুব অপমানিত হয়েছে। মুখ চোখ লাল করে বলল, “ছি ছি ছি, তুমি কী বলছ? আমি মানুষ কেন হব? আমি জিন?”
এবারে টুশিও তপুর সাথে যোগ দিল, বলল, “আসলে তুমি জিন না, আসলে তুমি মানুষ। রাত্রিবেলা তুমি যখন ওরকম জামাকাপড় পরে ঢং করে লাফঝাঁপ দিয়েছ তখন আমরা ভয় পেয়ে ভেবেছিলাম তুমি জিন! এখন বুঝতে পারছি পুরোটা তোমার অ্যাকটিং। তুমি দাড়ি কেটে গোসল করে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ। তুমি একজন মানুষ।”
কাবিল পা কাঁপিয়ে বলল, “আমি জিন।”
টুশিও সমান জোরে পা কাঁপিয়ে বলল, “তুমি মানুষ! আমি আরব্য রজনীর গল্প পড়েছি। আমি জিন ভূতের কিচ্ছা পড়েছি। আমি পড়েছি জিনেরা এসেই সালাম দিয়ে বলে, আমি আপনার বান্দা, হুকুম করুন। তখন যেটাই হুকুম করা হয় সেটাই জিনেরা শোনে।” টুশি তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না রে তপু?”
তপু মাথা নাড়ল, টুশি যে-কথাই বলে সে সবসময় সেটাতে মাথা নাড়ে। কিন্তু কাবিল কোহকাফী টুশির কথা মানল না, হাত নেড়ে বলল, “আরে ধুর! বাজে কথা, জিনেরা কখনও কারও হুকুম শোনে না।”
টুশি বলল, “একশবার শোনে।”
“তা হলে সেই আগের যুগে শুনত। আজকাল শোনে না।”
টুশি বলল, “তা হলে তোমাকে কোনো হুকুম করা যাবে না?”
“নাহ্।”
টুশি রেগে গিয়ে বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
“তুমি আসলে জিন না–তুমি মানুষও না, তুমি হচ্ছ সন্ত্রাসী। তুমি এই বাসায় ডাকাতি করতে এসেছ। তোমার দলের আরও লোকজন আছে তারাও ডাকাতি করতে রেডি হচ্ছে। তোমার একটা অন্য নামও আছে, খচ্চর কাবিল কিংবা পিচ্চি মহিন্দর কিংবা ট্যারা কোহকাফী”
টুশির কথা শুনে কাবিল খুব রেগে গেল, চিৎকার করে বলল, “কক্ষনো না। আমার নাম খচ্চর কাবিল না। আমি জিন। হান্ড্রেড পার্সেন্ট খাঁটি জিন।”
টুশি বলল, “কী প্রমাণ আছ যে তুমি জিন দেখাও একটা প্রমাণ। দেখাও।”
“কী প্রমাণ চাও?”
“এক ঘড়া সোনার মোহর নিয়ে এসো।”
“সোনার মোহর?” কাবিল কোহকাফী মুখ ভেংচে বলল, “আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই, এখন আমি তোমার জন্যে জঙ্গলে জঙ্গলে সোনা খুঁজে বেড়াই!”
তপু টুশির হাত ধরে বলল, “না টু-টুশি আপু। বলে একটা ক-ক কম্পিউটার।”
“হ্যাঁ। টুশি মাথা নাড়ল। ঠিক বলেছিস, একটা কম্পিউটার নিয়ে আসো।”
কাবিল কোহকাফী বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমি একটা জিন, আমি চোর না। তোমার জন্যে আমি চুরিচামারি করে জিনিস আনব? আমার আর কাজ নাই?”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে।” টুশি বিচিত্র সেই বোতলটা নিয়ে এসে বলল, “তুমি তা হলে আবার এই বোতলের ভিতর ঢোকো।”
কাবিল কোহকাফী হা হা করে হেসে বলল, “তুমি আমাকে বেকুব পেয়েছ? শাহজাদি দুনিয়া এই ট্রিক্স করে আমাকে বোতলের ভিতরে ঢুকিয়েছিল। জিনেরা এত বোকা না, তারা এক ভুল দুইবার করে না!”
“তার মানে তুমি কোনো প্রমাণ দিতে পারবে না যে তুমি জিন। জিনেরা কত রকম অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করে, তুমি তার কিছুই করতে পার না। তুমি সত্যিকারের জিন হলে সেগুলি করতে পারতে।” কথা শেষ করে টুশি তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না রে তপু?”।
তপু আবার বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। কাবিল কোহকাফী এবার হেঁটে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে সেটার উপর প্রচণ্ড থাবা দিয়ে বলল, “অবশ্যই আমি অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করতে পারি।”
টুশিও কাবিল কোহকাফীর পিছনে পিছনে গিয়ে টেবিলে সমান জোরে থাবা দিয়ে বলল, “কী করতে পার?”
“আমি বাতাসে উড়তে পারি। জাদু দিয়ে মানুষকে টিকটিকে বানাতে পারি। মন্ত্র পড়ে লোহাকে সোনা বানাতে পারি।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে পরীক্ষা হয়ে যাক!” টুশি তপুর দিকে তাকিয়ে বললো, “তপু যা তো লোহার কিছু-একটা নিয়ে আয়।”
তপু প্রায় ছুটে গিয়ে তার আব্দুর টুল-বক্স থেকে বড় একটা হাতুড়ি নিয়ে এল। সেটাকে ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে বলল, “এ-এ-এটাকে সোনা বানাও।”
কাবিল কোহকাফী তার পাঞ্জাবির হাত গুটিয়ে খুব গম্ভীর মুখ করে এগিয়ে এল। হাতুড়িটার দিকে তাকিয়ে হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে শরীর দুলিয়ে সে মন্ত্র পড়তে শুরু করে,
“অজটং ভজটং লোহাটং সোনা
সোনাটং সোনাটং লোহাটং মোনা
টুকুল টুকুলি মুকুলি ঘাস
ঝুককুর মুককুর পেটাটুং ফাস”
হঠাৎ মনে হল সে মন্ত্রটা ভুলে গেছে। কয়েকবার চেষ্টা করে মাথা চুলকে। বলল, “ফাসটুলি মাসটুলি এ্যা–ইয়ে মানে ভোম্বাটুলি লাশ।” তারপর চোখ বন্ধ করে হাতুড়িতে ফুঁ দিয়ে বলল, “হয়েছে?”
টুশি বলল, “না, হয় নাই।”
“হয় নাই?” কাবিল কোহকাফী খুব অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “কী আশ্চর্য!”
“এর মাঝে আশ্চর্যের কিছু নাই। তুমি একটা ভড়ং করেছ আর কিছু না।”
“আমি মোটেও ভড়ং করি না।”
টুশি রেগে বলল, “তা হলে?”
“আসলে মন্ত্রের শেষ লাইনটা ভুলে গেছি। অনেকদিন প্র্যাকটিস করি নাই তো সেজন্যে মনে নাই। শেষ লাইনটা হবে মাসটুলি ফাঁসটুলি–”।
টুশি বাধা দিয়ে বলল, “থাক থাক । অনেক হয়েছে। তোমার আর মন্ত্র পড়তে হবে না। তার চাইতে আমি একটা কথা বলি তুমি সেটা মন দিয়ে শোনো।”
“কী কথা?”
“আমরা এখন হানড্রেড পার্সেন্ট শিওর যে তুমি একটা ফালতু মানুষ। চোর কিংবা ডাকাত, কোনো একটা বদ মতলব নিয়ে এসেছ। বাসার ভিতরে তুমি কীভাবে এসেছ সেটা আমরা এখনও বুঝতে পারি নাই–কিন্তু সেটা অন্য ব্যাপার। তাই আমি কী ঠিক করেছি জান?”
“কী ঠিক করেছ?”
“আমি এক্ষুনি দারোয়ানকে ডাকব। সে এসে তোমাকে বেঁধে নিয়ে যাবে। আর সেটা যদি না চাও তুমি নিজে নিজে বের হয়ে যাও।”
কাবিল কোহকাফী এত অবাক হল যে সেটা আর বলার মতো নয়। চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি এরকম একটা পুঁচকে মেয়ে আমাকে বের হয়ে যেতে বলছ?”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “বলছি।” তারপর তপুর দিকে তাকিয়ে বলল,” তপু তুই দরজাটা খুলে দে তো।”
কাবিল কোহকাফী মাথা নেড়ে বলল, “আমাকে তুমি বের করে দিচ্ছ? আমি একজন সম্মানী জিন। তোমাদের একজন মেহমান।”
“যাদেরকে দাওয়াত দিয়ে আনে তারা হচ্ছে মেহমান। তোমাকে এখানে কে দাওয়াত দিয়েছে?”
কাবিল কোহকাফী এবারে সত্যিই একটু কাহিল হয়ে গেল। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “তা হলে তুমি বিশ্বাস করছ না যে আমি জিন?”
“না।”
“আমি যদি উড়ে দেখাই তা হলে বিশ্বাস করবে?”
“আগে দেখাও।”
কাবিল কোহকাফী ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ওড়ার জন্যে প্রস্তুত হল। বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে দুই পাশে দুইটা হাত নিয়ে হঠাৎ করে পাখির মতো করে হাত ঝাঁপটাতে শুরু করল। হাত ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে সে ঘরের মাঝে দৌড়াতে থাকে, ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে সে টেবিল-ল্যাম্পের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল। সেখান থেকে উঠে হাত ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে সে শেলফে ধাক্কা খেল, শেলফ থেকে কয়েকটা বই নিচে পড়ে গেল, তার উপর দিয়ে কাবিল কোহকাফী দৌড়ে গেল, মুখে চিৎকার করতে লাগল, “আমি উড়ছি! আমি উড়ছি। এই দ্যাখো আমি উড়ছি।”
তপু মাথা নেড়ে বলল, “না। তু-তুমি ওড়ো নি।”
টুশি কঠিন মুখে বলল, “মাটি থেকে তুমি এক ইঞ্চিও উপরে উঠ নি।”
কাবিল কোহকাফী হাত নেড়ে নেড়ে দৌড়ানো বন্ধ করে বলল, “উপরে উঠি নি? কী আশ্চর্য!”
“হ্যাঁ। তুমিআবার একটা ভড়ং করছ।”
“আসলে অনেকদিন উড়ি নাই তো সেইজন্যে প্র্যাকটিস নাই। শাহজাদি দুনিয়াকে নিয়ে যখন বাগদাদ থেকে কোহকাফ নগরে উড়ে গেলাম”।
টুশি মুখ শক্ত করে দরজার দিকে আঙুল দিয়ে বলল, “আউট। এক্ষুনি আউট। যদি আউট না হও তা হলে আমি আর তপু ধাক্কা দিয়ে তোমাকে আউট করে দেব। তাই না রে তপু?”
তপু বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল।
তবে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার দরকার হল না। কারণ ঠিক সেই সময় বাসার বেল বাজল। বাইরে তপুর আব্ব আর আম্মুর গলায় স্বর শোনা গেল।
টুশি কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচে বলল, “এখন হয়েছে তো? চাচা-চাচি এসেছেন। তাদের সামনে তোমার জিনগিরি দেখাও। আমি তো ভালো মানুষের মতো তোমাকে খালি বাসা থেকে বের করে দিচ্ছিলাম, তারা তোমাকে নিশ্চয়ই পুলিশে দেবেন!”
কাবিল কোহকাফী ভয়-পাওয়া মুখে কিছু-একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই টুশি দরজা খুলে দিয়েছে এবং সেই খোলা দরজা দিয়ে প্রথমে চাচা এবং তার পিছুপিছু চাচি এসে ঢুকলেন।
কাবিল কোহকাফী পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে, চাচা এবং চাচি সোজা তার দিকে এগিয়ে এলেন।
০৬. কোহকাফী এবং চাচা-চাচি
টুশি এবং তপু কী হয় দেখার জন্যে চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে রইল। তারা দেখল চাচা সোজা কাবিল কোহকাফীর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে ধাক্কা খেলেন, ধাক্কা খেয়ে কাবিল কোহকাফি এবং চাচা দুইজন দুইদিকে উলটে পড়লেন এবং দুইজনেই যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন। চাচি চাচাকে ধরে টেনে তুলতে তুলতে বললেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমার?”
চাচা ভয়-পাওয়া ফ্যাকাশে মুখে বললেন, “বুঝতে পারলাম না, হঠাৎ মনে হল কোথায় যেন ধাক্কা খেলাম”
“ধাক্কা খেলে?” চাচি গলা উঁচু করে বললেন, “ফাঁকা ঘরে তুমি কেথায় ধাক্কা খাবে?”
তারা দুজনেই সামনের দিকে তাকায়, টুশি এবং তপু অবাক হয়ে দেখল তাদের দৃষ্টি কাবিল কোহকাফীর উপর দিয়ে ঘুরে সারা ঘর হয়ে ফিরে এল কিন্তু তারা কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পেলেন না। কী আশ্চর্য! শুধু তাই না, কাবিল কোহকাফী চাচার সাথে ধাক্কা খেয়ে যে ছিটকে পড়ে যন্ত্রণায় কো কো করে শব্দ করছে সেটাও তাঁরা শুনতে পাচ্ছেন না। তপু কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, টুশি তার হাতে চাপ দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল–ব্যাপারটা বোঝা দরকার।
চাচা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে কাবিল কোহকাফীর একেবারে গা ঘেঁষে এগিয়ে গেলেন কিন্তু তবু তাকে দেখতে পেলেন না। চাচা একটা চেয়ারে বসে কেমন যেন ভয় পেয়ে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। চাচি কঠিন মুখে বললেন, “এখন কেমন লাগছে?”
“কেমনে আবার লাগবে। আমি বলছি কী-একটার সাথে যেন ধাক্কা খেলাম”
“তুমি কোথাও ধাক্কা খাও নাই। তুমি হঠাৎ করে কলাপস করেছ। আমি একশবার করে বলছি খাওয়া কমাও খাওয়া কমাও–তুমি আমার কথা শোন না।” চাচি যখন চাচাকে গালাগাল শুরু করেন সেটা সাধারণত খুব ভয়ংকর ব্যাপার হয়, এবারেও তা-ই হল। চাচি তার খনখনে গলায় বলতে লাগলেন, “খেয়ে খেয়ে খাসির মতো মোটা হয়েছ, ব্লাডপ্রেশার হয়েছে, কোলেস্টেরল হয়েছে, এখন নিশ্চয়ই হার্ট এটাক হয়েছে। নিশ্চয় তুমি হার্ট এটাক হয়ে পড়ে গেছ।”
চাচা দুর্বল গলায় বললেন, “না। আমার হার্ট এটাক হয় নাই।”
“তা হলে কি স্ট্রোক করেছে?”
চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, “স্ট্রোক করবে কেন? তোমার সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি।”
চাচি চোখ-মুখ লাল করে বললেন, “আমার সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি? তুমি হাঁটতে হাঁটতে আছাড় খেয়ে পড়ে যাও আর সেটা নিয়ে কথা বললে আমার বাড়াবাড়ি হয়?”
চাচা কিছু না বলে তাঁর পেটে হাত বুলাতে বুলাতে চারিদিকে তাকাতে লাগলেন।
টুশি আর তপু দেখতে পেল কাবিল কোহকাফী উঠে এসে তাদের একেবারে কাছে এসে চাচা-চাচির ঝগড়া দেখতে দেখতে আনন্দে হাসতে লাগল। তারপর টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন বিশ্বাস হল যে আমি জিন? দেখছ এরা আমাকে দেখতে পাচ্ছে না? আমার কথাও শুনতে পাচ্ছে না?”
সত্যি সত্যি চাচা-চাচি কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পেলেন না, শুনতেও পেলেন না–দুজনে নিজেদের মতো ঝগড়া করতে লাগলেন। কাবিল কোহকাফী বুকে থাবা দিয়ে বলল, “বিশ্বাস হল আমি জিন?”
টুশি কিছু বলল না, তপু মাথা নেড়ে বলল, “বি-বিশ্বাস হয়েছে।”
চাচা এবং চাচি তপুর কথা শুনে তার দিকে ঘুরে তাকালেন, বললেন, “কী বললি? কী বিশ্বাস হয়েছে?”
তবু একেবারে থতমত খেয়ে গেল, এমনিতেই তার কথায় একটু তোতলামো এসে যায় এখন একেবারে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল, বলল, “না-না-না– মা মা-মা–জি-জি-জি–”
টুশি তাকে রক্ষা করল, বলল, “না চাচি কিছু না। আমি বলেছিলাম আপনারা সকালবেলাতেই চলে আসবেন, তপু আমার কথা বিশ্বাস করে নাই। এখন জিজ্ঞেস করছিলাম আমার কথা বিশ্বাস হয়েছে কি না–তাই বলছিল বিশ্বাস হয়েছে। তা ই না রে তপু?”
তপু বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে খুব জোরে জোরে মাথা নাড়ল। চাচি এবারে চাচার পাশে একটা চেয়ারে বসে দুজনের দিকে প্রথমবার ভালো করে তাকালেন। বেশ চেষ্টা করে গলাটা একটু নরম করে বললেন, “রাত্রিবলা একা একা থাকতে ভয় করেছিল?”।
কাবিল কোহকাফী বলল, “ভয় করবে কেন? আমি ছিলাম না!”
চাচা-চাচি অবশ্যি কাবিল কোহকাফীর কথা শুনতে পেলেন না, টুশি মাথা নেড়ে বললেন, “না চাচি ভয় করে নাই।”
“রাত্রে কী খেয়েছিলে তোমরা?”
“খিচুড়ি বেঁধে নিয়েছিলাম। আর ডিম ভাজা।”
কাবিল কোহকাফী বলল, “ফাস্ট ক্লাস রান্না হয়েছিল!” চাচা-চাচি সেটা শুনলেন না। চাচি বললেন, “ভেরি গুড। আই অ্যাম সরি, হঠাৎ করে আটকা পড়ে গেলাম তাই আসতে পারলাম না।”
টুশি সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় আটকা পড়েছিলেন?”
“মায়ের বাসায়। তপুর নানির শরীরটা ভালো না তো।”
“কী হয়েছে?”
“বয়স হয়েছে তো তাই। মাথায় একটু গোলমালের মতো হয়েছে।”
তপু অবাক হয়ে বলল, “না-না-নানি পা-পাগল হয়ে গেছে?”
চাচি অস্বস্তি নিয়ে বললেন, “না, ঠিক পাগল না তবে
চাচা ভেংচে বললেন, “বুড়ির ভিমরতি হয়েছে। এত বড় প্রপার্টি এতিমখানায় দান করে দেবে। ঢং দেখে বাঁচি না!”
চাচার কথা শুনে কাবিল কোহকাফী দুই পা এগিয়ে এসে বলল, তাতে অসুবিধে কী হয়েছে? একজন মানুষ তার প্রপার্টি দান করতে পারে না?”
চাচা সেই কথা শুনতে পেলেন না, গজগজ করে বললেন, “এতগুলো মানুষ মিলে বোঝালাম, বুড়ি তবু বোঝে না।”
চাচি বললেন, “থাক থাক, বাচ্চাদের সামনে এইসব কথা বলে লাভ নেই।”
কাবিল বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমার সামনে বলো। আমি বাচ্চা না। আমার বয়স এক হাজার দুইশ বাইশ।”
চাচা তার কথা শুনলেন না তাই কিছু বললেন না, কিন্তু কাবিল তাতে শান্ত হল না, সে টেবিলের মাঝখানে একটা থাবা দিয়ে বলল, “কী হল? কথা কানে যায় না?”
চাচা এবং চাচি কাবিলের কথা শুনতে পেলেন না, কিন্তু টেবিলের থাবাটা ঠিকই শুনতে পেলেন, চাচা চমকে উঠে বললেন, “কী হল? টেবিলটা এভাবে শব্দ করে কেঁপে উঠল কেন?”
চাচিও অবাক হয়ে টেবিলটার দিকে তাকালেন, কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “কী জানি!”
টুশি এবারে চেষ্টা করে কাবিল কোহকাফীর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় তাকে পাগলামো করতে নিষেধ করল। কাবিল কোহকাফী চোখ মটকে বলল, “এখন কেমন জব্দ হয়েছ বাছাধন? একটু আগে যে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিচ্ছিলে–এখন কেমন জব্দ হয়েছ? তোমার চাচা-চাচিকে আরেকটু শিক্ষা দেব? দেব নাকি?”
টুশি ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে নিষেধ করল। কাবিল কোহকাফী চোখ পাকিয়ে বলল, “আর আমার সাথে বেয়াদপি করবে? করবে বেয়াদপি?”
টুশি তার চাচা-চাচির দৃষ্টি এড়িয়ে মাথা নেড়ে জানাল যে আর বেয়াদপি করবে না।
“মনে থাকে যেন। আমি হচ্ছি কাবিল বিন মুগাবালি মাহিন্দর কোহকাফী। শাহজাদি দুনিয়া আমার জন্যে পাগল ছিল। আমি আসল সোলেমানি জাদু জানি ইচ্ছা করলে মন্ত্র পড়ে সবাইকে টিকটিকি বানিয়ে দিতে পারি। আমার সাথে বেয়াদপি করলে খবর আছে! আর আমাকে বাসা থেকে বের করে দেবে?”
টুশি এবং তপু মাথা নাড়ল–এবারে চাচা-চাচির দৃষ্টি এড়াতে পারল না। চাচি ভুরু কুঁচকে বললেন, “এরকম বোকার মতো মাথা নাড়ছ কেন?”
টুশি ঢোক গিলে বলল, “না-মানে ইয়ে–”।
চাচি এবারে বাসার চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, “বাসার এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে বাসার মাঝে ঝড় হয়ে গেছে। যাও–বাসাটা পরিষ্কার করো!”
টুশি এবং তপু চাচা-চাচির সামনে থেকে সরে গেল। টুশি আর তপু বসার ঘরে বইগুলো শেলফে তুলে টেবিল-ল্যাম্পটাকে সোজা করল, টেবিলটাকে ঠিক জায়গায় রেখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ম্যাগাজিনকে টেবিলে সাজিয়ে রাখতে লাগল। তখন কাবিল কোহকাফী তাদের ঘরে এসে দাঁড়াল। টুশি ফিসফিস করে বলল, “ঘরটাকে তুমি এই অবস্থা করেছ। তুমি কেন পরিষ্কার করছ না!”
“আমি একটা সম্মানী জিন। আমি ঝাড় দার না।”
“বেশি ঢং করলে চাচা-চাচিকে বলে দেব তোমার কথা!”
কাবিল কোহকাফী মুখ ভেংচে বলল, “বলে দেবে আমার কথা? বলে দাও তা হলে–তারা তোমার কথা বিশ্বাস করবে? তুমি প্রমাণ করতে পারবে যে আমি আসলেই আছি?”
টুশি মাথা চুলকাল, কাবিল কোহকাফী সত্যি কথাই বলেছে। অদৃশ্য কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে তারা একটু অবাক হতে পারে কিন্তু এইখানে একটা অদৃশ্য জিন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা কখনওই কেউ বিশ্বাস করবে না। জোর করে বললে উলটো ব্যাপার হতে পারে–ভাবতে পারে তাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। টুশি বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমার কথা কাউকে বলব না। তুমি থাকো। কিন্তু বেশি চিৎকার কোরো না–বেশি লাফঝাঁপ দিও না। বুঝেছ?”
“পুঁচকে মেয়ে, তোমার আমাকে উপদেশ দিতে হবে না। আমি একজন জ্ঞানী জিন। কখন কী করতে হয় আমি জানি। ক্রিটিক্যাল সময়ে আমি রাইট ডিসিশন নিতে পারি। খলিফা হারুন অর রশিদের সময়ে যখন–”
ঠিক তখন তারা শুনতে পেল তপুর আব্বা তার মোটা শরীর নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসছেন, চিৎকার করে বলছেন, “শায়লা, শায়লা দেখে যাও বাথরুমে!”
“কী হয়েছে?”
“বাথরুমে কাটা লম্বা চুলদাড়ি, জরিদার পোশাক–”
টুশি কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকাল, ফিসফিস করে বলল, “ক্রিটিক্যাল সময়। রাইট ডিসিশন নাও দেখি!”
কাবিল মাথা চুলকাল, “সর্বনাশ! এখন কী হবে?” তপু বলল, “তো-তোমাকে কেউ দেখে না! তু-তুমি যাও–ওগুলো লুকিয়ে ফেলো। দৌড়াও।”
তপুর কথা শেষ হবার আগেই কাবিল কোহকাফী বাথরুমে ছুটে গেল, চোখের পলকে তার জরিদার পোশাকে কাটা চুলদাড়ি সবকিছু চেঁছে পুছে সরিয়ে নিয়ে চলে এল। কয়েক মুহূর্ত পরে চাচিকে চাচা বাথরুমে নিয়ে গেলেন, সেখানে কী হয় দেখার জন্যে টুশি এবং তপু এবং কাবিল কোহকাফীও হাজির হল। বাথরুমের দরজা খুলে চাচি বাথরুমের ভিতরে চারিদিকে তাকিয়ে বললেন, “কোথায়?”
চাচার মুখ হাঁ হয়ে গেল। চারদিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললেন, “এ-এ-এইখানে ছিল!”
“কী ছিল?”
“জরিদার পোশাক। এই লম্বা লম্বা কাটা চুলদাড়ি–”
চাচি চোখ ছোট ছোট করে চাচার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চাচা ফ্যাকাশে মুখে বললেন, “কী হল? তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”
চাচি কেমন জানি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “তোমার শরীর ভালো আছে ইমতিয়াজ?”
চাচা কেমন জানি রেগে উঠলেন, বললেন, “আমার শরীর ভালো থাকবে না কেন? তুমি ভাবছ আমি মিথ্যা কথা বলছি? আমি আসলে দেখি নাই?”
চাচি বললেন, “এই বাথরুমে তাকাও। কোথাও কিছু আছে?”
“না নাই। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি স্পষ্ট দেখেছি।”
“আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি, সেইজন্যেই বলছি।”
“কী বলছ?”—
“তুমি বিছানায় শুয়ে থাকো। আমি আইসব্যাগটা নিয়ে আসি।”
চাচা মুখ শক্ত করে বললেন, “কেন?”
“তোমার মাথায় দিতে হবে। তোমার নিশ্চয়ই হেলুসিনেশান হচ্ছে। তুমি বিছানায় শুয়ে থাকো। তুমি উলটাপালটা জিনিস দেখছ। এটা ভালো লক্ষণ না।”
“কোনটা ভালো লক্ষণ না?”
“প্রথমে এমনিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে, এখন অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখছ।”
“আমি কোনো অদ্ভুত জিনিস দেখি নাই।” চাচা চিৎকার করে বললেন, “আমি যেটা দেখেছি সেটাই বলেছি।”
চাচি চাচাকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন–এক হাজার বছর গোসল না করা কাবিল কোহকাফী এই বিছানায় ঘুমিয়েছে তাই চাদরে বালিশে একটা বোটকা গন্ধ। চাচা দুর্বল গলায় বললেন, “কেমন জানি গন্ধ গন্ধ লাগছে।”
চাচি বললেন, “সব তোমার মনের ভুল। তুমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো।” চাচা চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন।
.
দুপুরে খাবার টেবিলে খাওয়া শুরু করার কিছুক্ষণের মাঝেই চাচি হঠাৎ করে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন টেবিলে রাখা সব খাবার শেষ হয়ে গেছে। চাচি ভুরু কুঁচকে চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডাক্তাররা না বলেছ তুমি কম করে খাবে!”
চাচা মুখ কালো করে বললেন, “আমি কম করেই খাচ্ছি।”
“কম করে খাচ্ছ? সারা সপ্তাহের জন্যে রান্না করেছি তুমি একা সাবাড় করে দিয়েছ।”
চাচা রেগে উঠে বললেন, “আমি কখন খেয়েছি? একটু মুখে দিয়েছি না কি দিই নি”
চাচি টেবিলে রাখা ডেকচি কাত করে দেখিয়ে বললেন, “এই দ্যাখো। দুইটা মুরগি রান্না করেছিলাম, শুধু পাখনার একটা হাড্ডি আছে। তুমি খাওনি তো কে। খেয়েছে?”
টুশি আর তপু শক্ত হয়ে বসে রইল। শুধু তারাই আসল ব্যাপারটি দেখেছে– কাবিল কোহকাফী ঘুরে ঘুরে খাচ্ছে, একটু পরপর টেবিল থেকে খাবার তুলে নিচ্ছে। এক হাজার বছরের অভুক্ত জীনের ক্ষুধা এক দুইদিনে মিটবে বলে মনে হয় না।
চাচি বললেন, “বলো কে খেয়েছে।”
চাচা রেগে চিৎকার করে বললেন, “তুমি খেয়েছ। তুমি।”
ব্যস–সাথে সাথে দুজনের তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। ঝগড়াটা একটু জমে ওঠার সাথে সাথে প্রায় নিয়মমাফিক তাদের রাগটা এসে পড়ল তপুর ওপর। চাচা হুংকার দিয়ে বললেন, “কী হল? তুই খাচ্ছিস না কেন?”
তপু বলল, “খা-খা-খাচ্ছি আলু।”
চাচি বললেন, “খবরদার কথা বলবি না, চুপ করে খা।”
তপু কথা বলল না, মাথা নেড়ে চুপচাপ খাবার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতে মনে হল চাচির রাগ আরও বেশি হয়ে গেল। চোখ লাল করে বললেন, “কী বলেছি আমি?”
“ব-ব-ব–” ভয় পেয়ে তপুর কথা মুখে আটকে যায়। চাচি তখন আরও হিংস্র হয়ে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, “কী বলেছি আমি?”
তপু অসহায়ভাবে একবার টুশির দিকে তাকিয়ে আবার বলার চেষ্টা করল, “ব ব-ব–বলেছ–খ-খ-খ-” তপুর মুখ লাল হয়ে গেল, ঠিক করে কথা বলার চেষ্টায় তার চোখে পানি এসে যায়, ঠোঁটে কামড় দিয়ে সে প্রাণপণে আবার চেষ্টা করে– “খ-খ-খ “
চাচি চিলের মতো চিৎকার করে বললেন, “কথা বলো ঠিক করে বদমাইশ পাজি ছেলে–”
কাবিল কোহকাফী চাচির দিকে দুই পা এগিয়ে এসে বলল, “এই যে এই যে লেডি, কী করছেন আপনি? দেখছেন না ছেলেটা নার্ভাস–কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে দেখছেন না–”
চাচি কাবিল কোহকাফীকে দেখছেন না, তার কথাও শুনছেন না, ডালের চামুচটা হাতে নিয়ে ওপরে তুলে মারের ভঙ্গি করে আরেকবার গালাগাল করার জন্যে মুখ খুললেন ঠিক তখন কাবিল কোহকাফী চাচির মুখটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরল। চাচি একেবারে হতবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন তিনি মুখ খুলতে পারছেন না, কয়েকবার চেষ্টা করে উঁ উঁ উঁ করে একটু শব্দ করে ছটফট করতে লাগলেন। চাচা অবাক হয়ে বললেন, “কী হয়েছে তোমার? কথা বলছ না কেন?”
কাবিল কোহকাফী চাচির মুখটা একটু ফাঁক করে দুই-একটা শব্দ বলতে দিল, “ক-ক-কথা ব-ব-বলতে পারছি না।” কাবিল কোহকাফী আবার শক্ত করে মুখ চেপে ধরল। চাচি মুখ খোলার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু কোনো লাভ হয় না। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে, যায় চোখে পানি এসে যায় কিন্তু মুখ থেকে একটি শব্দ বের হয় না।
কাবিল কোহকাফী শেষ পর্যন্ত চাচির মুখ ছেড়ে দিয়ে সরে গেল, হুংকার দিয়ে বলল, “এখন বুঝেছেন কথ না বলতে পারলে কেমন লাগে? বুঝেছেন লেডি?”
চাচি কাবিল কোহকাফীর কথা না শুনতে পারলেও কথা বলতে না পারার কষ্টটা প্রথমবার টের পেলেন। সাবধানে নিজের দুই গালে, চোয়ালে মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “কী কী সর্বনাশ! ম-ম-মনে হল কেউ মুখ চেপে ধরে রেখেছে কথা বলতে দিচ্ছে না।”
চাচাকে কেন জানি হঠাৎ খুব খুশি মনে হল। দুলে দুলে হেসে বললেন, “এখন বুঝেছ তপু কেন তোতলা হয়েছে?”
“কেন?”
“ফ্যামিলিগত ব্যাপার। তুমি তোতলা, তোমার ছেলেও তোতলা।”
“আমি মোটেও তোতলা না।”
“তা হলে একটু আগে কথা বলতে পারছিলে না কেন?”
“সেটা অন্য ব্যাপার” চাচি আরও কী-একটা বলতে চাইছিলেন কিন্তু তার । আগেই কাবিল কোহকাফী এসে চাচির মুখ শক্ত করে চেপে ধরল। চাচি প্রাণপণে কথা বলতে চাইলেন কিন্তু তাঁর মুখ দিয়ে শুধু উ উ ধরনের একটা শব্দ বের হল, কোনো কথা বের হল না।
চাচা উল্লসিত হয়ে বললেন, “এই দ্যাখো তুমি আবার তোতলাচ্ছ!”
কাবিল কোহকাফী চাচির মুখটাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “মনে থাকে যেন লেডি। এই ছোট ছেলেটাকে আপনি যদি উৎপাত করেন আপনার মুখ আমি চেপে ধরে রাখব। আমাকে চেনেন না–হুঁ! আমি হচ্ছি কাবিল বিন মুগাবালি মহিন্দর কোহকাফী।”
চাচি কিংবা চাচা কেউই কাবিল বিন কোহকাফীর কথা শুনতে পেলেন না, কিন্তু ঠিক করে কথা বলতে না পারার জন্যে ছোট একটা ছেলেকে যে যন্ত্রণা দেয়া যায় না হঠাৎ করে সেই জিনিসটা বুঝে গেলেন।
খাবার টেবিলে সবাই নিঃশব্দে খেতে লাগল। খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যেত টুশি এবং তপু চোখের কোনা দিয়ে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।
বিচিত্র এই জিনটাকে টুশি এবং তপু একসাথে ভালোবেসে ফেলল।
০৭. স্কুল
রাত্রিবেলা কাবিল কোহকাফী টুশি আর তপুর ঘরে ঘুমাল। টুশি তার বালিশটা কাবিল কোহকাফীকে দিয়েছিল, কিন্তু তার জন্যে নরম বিছানায় ব্যবস্থা করা গেল না। কাবিল কোহকাফী ইচ্ছে করলে বাইরের ঘরে সোফায় শুয়ে ঘুমাতে পারে, কিন্তু ভোরবেলা চাচা ঘুম থেকে উঠে সোফায় বসে কিছুক্ষণ টিভি দেখেন–ভুল করে যদি অদৃশ্য কাবিল কোহকাফীর ভুঁড়ির উপর বসে যান তা হলে যা, একটা কেলেঙ্কারি হবে সেটা আর বলার মতো নয়!
টুশি এবং তপু দুজনের ঘুমই হল ছাড়া-ছাড়া তাদের দুজনের কেউ টের পায় নি নাকডাকার ব্যাপরটি এরকম ভয়ংকর হতে পারে। যখনই ঘুমিয়েছে তখনই স্বপ্ন দেখেছে যে তারা একটা প্লেনে করে যাচ্ছে কিংবা একটা সিংহ গর্জন করে তাদের তাড়া করছে কিংবা একটা মিছিলে হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করছে–একটু পরে পরে তাদের ঘুম ভেঙে গেছে আর তারা আবিষ্কার করেছে যে প্লেনের শব্দ, সিংহের গর্জন বা মিছিলের চিৎকারের শব্দ ঘুম ভাঙার পরও শোনা যাচ্ছে– খানিকক্ষণ পর তারা টের পেয়েছে যে সেটা কাবিল কোহকাফীর নাকডাকার শব্দ!
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে টুশি আর তপু তাদের স্কুলের জন্যে রেডি হতে থাকে তখন তারা শুনতে পেল চাচি রান্নাঘর থেকে চিৎকার করছেন, কে নাকি ফ্রিজ থেকে সব রুটি খেয়ে ফেলেছে! এটা নিশ্চয়ই কাবিল কোহকাফীর কাজ–টুশি আর তপু ভয়ে ভয়ে থাকল–ব্যাপারটি নিয়ে চাচা কিংবা চাচি কোনোকিছু সন্দেহ না করে বসেন। কিন্তু সেরকম কিছু হল না, কারণ চাচা বিরক্ত হয়ে চাচিকে বললেন, “কী ভোরবেলা উঠেই তুমি ক্যাটক্যাট শুরু করলে–”
চাচি তখন রেগে আগুন হয়ে বললেন, “কী? আমি ক্যাটক্যাট করি? তোমার এত বড় সাহস”
ব্যস দুজনে খেপে গেলেন এবং তার এক ফাঁকে টুশি আর তপু স্কুলের জন্যে বের হয়ে যায়। তারা মাত্র বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় পা দিয়েছে তখন শুনল কাবিল কোহকাফী পিছন থেকে চিৎকার করতে করতে আসছে, “দাঁড়াও! দাঁড়াও আমিও যাব।”
টুশি আর তপু অবাক হয়ে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকাল, টুশি জিজ্ঞেস করল, “তুমি? তুমি কোথায় যাবে?”
“তোমরা যেখানে যাচ্ছ।”
“আমরা স্কুলে যাচ্ছি।”
“আমিও স্কুলে যাব।”
টুশি মাথা নেড়ে বলল, “বড় মানুষেরা স্কুলে যায় না। স্কুলে যায় ছোট ছেলে মেয়েরা, আর তুমি বড় মানুষও না, তুমি হচ্ছ একটা জিন!”
তপু টুশির হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “টু-টু-টু-শি আপু–”
“কী হল?”
“তু-তু-তুমি এইভাবে কথা বোলো না, স-স-সবাই তোমার দিকে অবাক হয়ে দে-দেখছে।”
টুশির হঠাৎ করে মনে পড়ল যে রাস্তায় যারা যাচ্ছে আসছে তাদের কেউ কাবিল কোহকাফীকে দেখছে না, তাই সে যখন অদৃশ্য কাবিল কোহকাফীর সাথে কথা বলছে তাকে নিশ্চয়ই সবাই ভাবছে মাথা খারাপ! টুশি নিশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিকই বলেছিস।” তারপর আড়চোখে কাবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা এখন সোজাসুজি তোমার দিকে তাকিয়ে কথাও বলতে পারব না। তা হলে সবাই আমাদের পাগল ভাববে।”
কাবিল কোহকাফী চুটকি বাজিয়ে বলল, “কোনো চিন্তা নাই। আমার দিকে না তাকিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কথা বলো–আমি শুনে নেব।”
তপু বলল, “টু-টু-টুশি আপু। তাড়াতাড়ি চলো, দে-দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“হ্যাঁ চল।”
কাবিল কোহকাফীও বলল, “চলো।”
টুশি আর তপু সামনে এবং তাদের দুই পা পিছনে কাবিল কোহকাফী হাঁটতে শুরু করে। বড় রাস্তায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে কয়েকটা অঘটন ঘটে গেল, মাথায় টুকরি নিয়ে একজন পুরানো কাগজ শিশি-বোতল নিয়ে যাচ্ছিল, কাবিল কোহকাফীর সাথে ধাক্কা খেয়ে তার পুরানো কাগজের বাণ্ডিল রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল–মানুষটা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে টুকরিতে কাগজের বাণ্ডিল তুলতে তুলতে বলল, “কী আজব কাণ্ড–মনে হল ধাক্কা খেলাম কিন্তু ধাক্কা খাওয়ার কিছু নাই।”
কাবিল মানুষটাকে সাহায্য করার জন্যে আসতে চাইছিল, টুশি নিষেধ করল, সাহায্যের বদলে তখন উলটো ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে–মানুষ যখন দেখবে কাগজের বাণ্ডিল নিজে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে টুকরিতে ঢুকে যাচ্ছে সেটা একটা মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে।
টুকরি মাথায় মানুষের সাথে ধাক্কা থেকেও চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল যখন আট দশ বছরের কয়েকটা বাচ্চা কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে কোথা থেকে ছুটে এল এবং তাদের মাঝে একজন অদৃশ্য কাবিল কোহকাফীর ভেতর দিয়ে বের হয়ে। যাবার চেষ্টা করল। বাচ্চাটা আরেকটু হলে আছাড় খেয়ে পড়ত, কিন্তু কাবিল কোহকাফী তাকে ঠিক সময়ে ধরে ফেলে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়। কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পাচ্ছে বলে ব্যাপারটি টুশি আর অপুর কাছে মোটেও অস্বাভাবিক মনে না হলেও অন্য বাচ্চাগুলোর চোখ গোল আলুর মতো বড় হয়ে। যায়। তারা দেখল বাচ্চাটি আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ার শেষ মুহূর্তে হঠাৎ ম্যাজিকের মতো সোজা হয়ে আকাশের দিকে উঠে মাটিতে দু-পায়ের ওপর। দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটি কীভাবে সম্ভব কেউ সেটা বুঝতে পারল না।
কাবিল কোহকাফীকে সাথে নিয়ে গেলে এরকম আরও কত কী ঘটবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাই তারা তাড়াতাড়ি স্কুলে যাবার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু বড় রাস্তায় এসে কাবিল কোহকাফীকে নড়ানো খুব মুশকিল হয়ে যায়। সে এর আগে কখনও গাড়ি দেখে নি এবং রাস্তার গাড়িগুলোর দিকে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। চোখ কপালে তুলে বলল, “ইয়া মাবুদ! এটা কী তেলেসমাতি!”
টুশি কাবিলের দিকে না তাকিয়ে বলল, “এইটা তেলেসমাতি না। এইটার নাম গাড়ি।”
“চলে কেমন করে? ঘোড়াগুলো কোথায় ঢুকিয়েছে?”
টুশি মাথা নেড়ে বলল, “এর মাঝে কোনো ঘোড়া নাই। এগুলো ইঞ্জিন দিয়ে চলে।”
“ইঞ্জিন! সেগুলো আবার কীরকম জানোয়ার? কখনও নামও শুনি নাই। কোন দেশে পাওয়া যায়?”
“এগুলো কোনো জন্তু-জানোয়ার না। এগুলো মেশিন!”
“কী আশ্চর্য!” কাবিল কোহকাফী চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে থেকে বলল, “কী আচানক ব্যাপার!”
টুশি কাবিল কোহকাফীকে খোঁচা দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি চলো, তা না হলে স্কুলে দেরি হয়ে যাবে।”
দুই-দুইবার ধাক্কা খেয়ে কাবিল কোহকাফী এবারে মানুষের ধাক্কা বাঁচিয়ে খুব সাবধানে যেতে থাকে, তার পরেও একজন অন্ধ ফকির, একজন হকার আর একজন ট্রাফিক পুলিশের সাথে ছোট মাঝারি আর বড় একটা ধাক্কা লাগিয়ে ফেলল। শুধু যে মানুষের সাথে ধাক্কা লাগিয়েই গোলমাল পাকাল তা নয়, একেবারে নিজে নিজেও সে একটা গোলমাল পাকাল। সেটা শুরু হল এভাবে।
একজন খুব সেজেগুজে থাকা ফিটফাট মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে জুতো পালিশ করাচ্ছে, জুতো পালিশ করছে একটা ছোট ছেলে। ছেলেটা খুব যত্ন করে জুতো পালিশ করে সেটা চকচকে একটা আয়নার মতো করে ফেলেছে। মানুষটা। দেখে খুব খুশি হয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা ময়লা নোট ছুঁড়ে দিল। ছেলেটা চোখ কপালে তুলে বলল, “স্যার এইটা কী দিলেন?”
ফিটফাট মানুষটা বলল, “যা যা বেটা ভাগ! যা দিয়েছি বেশি দিয়েছি।”
“বেশি দিয়েছেন?” ছেলেটা রেগে বলল, “এইটা বেশি হল?”
মানুষটা রেগে এবারে ছেলেটার মাথায় একটা চটি মেরে বলল, “চুপ কর ছোটলোকের বাচ্চা। চড় মেরে দাঁত ভেঙে ফেলব।”
ছোট ছেলেটার মনে হয় বেশ তেজ আছে, তেরিয়া হয়ে বলল, “কী বললেন? আমি ছোটলোকের বাচ্চা? এতক্ষণ ধরে জুতো পালিশ করলাম আর এই ছেঁড়া একটা নোট দিয়ে আমারে বলেন ছোটলোকের বাচ্চা? কে আসলে ছোটলোকের বাচ্চা?”
ফিটফাট মানুষটা এবারে হুংকার দিয়ে বলল, “তবে রে হারামজাদা–” তারপর পা তুলে সে ছোট ছেলেটাকে কষে একটা লাথি মেরে বসল–অন্তত সে তা-ই ভাবল। আসলে অবশ্যি সেটা ঘটল না, কারণ কাবিল কোহকাফী বিদ্যুদ্বেগে মাঝখানে গিয়ে তার লাথিটা ফেরাল, তারপর টুশি আর তপু কিছু বোঝার আগে মানুষটার বুকের কাপড় ধরে ওপরে তুলে তাকে পিছনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। টুশি এবং তপুর কাছে মনে হল কাজটি ভয়ংকর কিন্তু অন্য সবার কাছে মনে হল কাজটি অবিশ্বাস্য রকমের হাস্যকর। তারা কেউ কাবিল কোহকাফীকে দেখেনি, তারা দেখেছে ফিটফাট একটা মানুষ ছোট একটা বাচ্চাকে লাথি মারতে গিয়ে হঠাৎ মাঝখানে তার পা ব্রেক কষেছে, তারপর হঠাৎ করে রকেটের মতো সে উপরে উঠে গিয়ে উলটো দিকে ডাইভ দিয়ে কাদা-পানির মাঝে উলটো হয়ে পড়েছে। কোনো মানুষ কাদায় পিছলে পড়লে হাসা উচিত নয় জেনেও সবাই হেসে ফেলে–এখানে ফিটফাট একটা মানুষ নিজে থেকে একটা হাস্যকর ভঙ্গিতে উলটোভাবে কাদার মাঝে লাফিয়ে পড়েছে মানুষজন হাসতেই পারে। আশপাশে যারা ছিল সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করে দেয়। সবচেয়ে জোরে হাসল জুতো পালিশ করা ছেলেটা–সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটোপুটি খেতে থাকে।
ফিটফাট মানুষটা, যে আর ফিটফাট নেই, কোনোমতে কাদা থেকে উঠে ছেলেটার দিকে তেড়ে আসছিল, তখন রাস্তার লোকজন তাকে থামায়–একজন বলল, “ভাই! আপনি জোকারি করে কাদার মাঝে লাফাচ্ছেন–পোলাপান হাসবে না? হাসার কাজ করলে তো তোক হাসবেই।”
মানুষটা মুখ খিঁচিয়ে বলল, “আমি লাফ দেই নাই–আমাকে ধাক্কা মেরেছে।”
“কে ধাক্কা মেরেছে? বাতাস?”
মানুষটা এর কোনো উত্তর দিতে পারল না, রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। জুতো পালিশ করা ছেলেটা একটু নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে চিৎকার করে বলল, “গরিবের বন্ধু হচ্ছে আল্লাহ্! আপনি গরিবকে ঠকিয়েছেন তাই আল্লাহ্ আপনার শাস্তি দিয়েছে!” ছেলেটার চোখেমুখে অবশ্যি ঠকে যাওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না, সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “খোদার কসম স্যার আপনি যে সার্কাস দেখাইলেন চাইনিজ সার্কেও সেটা দেখাতে পারবে না।”
মানুষটা আবার তেড়ে গেল কিন্তু ছেলেটা ততক্ষণে দৌড়ে সরে গেছে, অনেকদূর থেকে তার হাসির শব্দ শোনা যেতে থাকে।
টুশি আর তপু দ্রুত সেই জায়গা থেকে চলে গেল–কাবিল কোহকাফী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ চিৎকার করতে চাইছিল, কিন্তু টুশি আর তপু তাকে সেই সুযোগ দিল না।
স্কুলের কাছাকাছি এসে টুশি কাবিল কোহকাফীকে বলল, “তুমি স্কুলের ভিতরে আবার কোনো গোলমাল শুরু করো না যেন।”
কাবিল কোহকাফী বলল, “আমি কখনও কোনো গোলমাল করি না।”
টুশি চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললে, গোলমাল কর না? একটু আগে কী করেছ?”
কাবিল কোহকাফী মুখ শক্ত করে বলল, “এটা গোলমাল হল। একজন পাজি মানুষকে একটু টাইট করা হল–”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “মনে থাকে যেন স্কুলের ভিতরে তুমি কাউকে টাইট দিতে পারবে না।”
কাবিল কোহকাফী মুখ সুচালো করে বলল, “খুব যদি পাজি হয়–ডাবল গেজ পাজি–তখন আমি যদি শুধু”।
“তুমি কারও গায়ে হাত দিতে পারবে না।”
“হাত দিতে পারব না? একটু ধাক্কা–একটু কাতুকুতু একটু ডলাডলি–”
“উঁহু।” টুশি গম্ভীর মুখে বলল, “তুমি আমাকে কসম খেয়ে বলো কারও গায়ে তুমি হাত দেবে না।”
কাবিল কোহকাফী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে কথা দিচ্ছি।”
“কী কথা দিচ্ছ? স্পষ্ট করে বল।”
কাবিল কোহকাফী বিরক্ত হয়ে বলল, “কথা দিচ্ছি যে কারও গায়ে হাত দেব না।”
“কসম খেয়ে বলো।”
“কসম? কসম খেয়ে কেন বলতে হবে?”
“কারণ তোমাকে আমি চিনি। খাও কসম।”
“ঠিক আছে ঠিক আছে কসম খাচ্ছি।” কাবিল কোহকাফী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “শাহজাদি দুনিয়ার চোখের ভুরুর কসম, তার রেশমি চুলের কসম, তার গালের তিলের কসম। কোহকাফ নগরের কসম। আসমান জমিনের কসম মুরগির রোস্টের কসম”
টুশি কী করবে বুঝতে না পেরে চোখ কপালে তুলে হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল।
.
তবে কাবিল কোহকাফী তার কথা রেখেছিল, সে স্কুলে কারও গায়ে হাত দেয় নি। স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরে কিছু দোলনা আছে–ছোট ছোট বাচ্চারা সেখানে উঠে আবিষ্কার করল কোনো কারণ ছাড়াই আজ দোলনাগুলো দুলছে। অন্যদিন সেগুলো দুলিয়ে দেবার জন্যে অন্যদের সাধাসাধি করতে হত–আজকে কাউকে বলতেও হচ্ছে না দোলনাগুলো বেশ নিজে নিজেই দুলছে! শুধু তা-ই নয়, কেউ যদি অন্যকে চড়তে না দিয়ে নিজে নিজে বেশিক্ষণ দোলনায় বসে থাকতে চায় তা হলে কেন জানি বসতে পারে না–পিছলে পড়ে যায়। বেশি ছোট বাচ্চা নিজে থেকে উঠতে না পারলেও কীভাবে কীভাবে জানি দোলনায় উঠে যাচ্ছে। ব্যাপারগুলো খুব বিচিত্র, বলা যেতে পারে অবিশ্বাস্য কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চারা সেটা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাল না। শুধু টুশি আর তপু আসল ব্যাপারটা দেখতে পেল, কাবিল কোহকাফী মহা আনন্দে ছোট বাচ্চাদের সাথে দোলনা নিয়ে খেলছে, দোলনা ধাক্কা দিচ্ছে, ছোটদের দোলনায় তুলে দিচ্ছে, যারা বেশি সময় ধরে দোলনায় বসে আছে তাদের। নামিয়ে দিচ্ছে–কেউ তাকে দেখছে না, শুধু তার মজার কাজকর্মগুলো টের পাচ্ছে। বয়স্ক কোনো মানুষ হলে হয়তো ঘাবড়ে যেত কিন্তু ছোট হওয়ার অনেক মজা কেউই ব্যাপারটি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।
আরও কিছু বিচিত্র ব্যাপার ঘটল–যেটা কেউই ঠিক বুঝতে পারল না। যেমন তপুর কথায় একটু তোতলামো আছে বলে ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা তাকে নিয়মিতভাবে ভ্যাংচায়, আজ হঠাৎ করে তাদের বিপদ হয়ে গেল। যেমন বাইরে ছোটাছুটি করে। সবাই কুমির কুমির খেলছে, তপু লাফ দিয়ে সিঁড়িতে উঠে বলল, “আমি ডা-ডা ডাঙায়–”
তাকে ঠাট্টা করে সাদিব নামে ছেলেটা দাঁত বের করে হেসে বলল, “ডা-ডা ডাঙা ভা-ভা-ভাঙা– ডা-ডা-ডাঙা ভা-ভা-ভাঙা–”
সাথে সাথে খুব একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে যায়, সাদিবের মনে হল তার শার্টের কলার ধরে কেউ যেন উপরে তুলে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিচে নামিয়ে দিয়েছে। সে যা ভয় পেল সেটি আর বলার মতো নয়। একটু পর খেলতে খেলতে তপু যখন মাঠে নেমে চিৎকার করে বলল, “কু-কু-কুমির তোর জলে নেমেছি” তখন তাদের ক্লাসের পাজি একটা মেয়ে, নাম শাওন, মুখ ভেংচে বলল, “কু-কু কুমির কু-কু-কুমির–”
হঠাৎ করে শাওনের মনে হল তার বেণিটায় কেউ একটা হ্যাঁচকা টান দিয়েছে, শাওন যন্ত্রণায় চিৎকার করে পিছনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। সে যত না অবাক হল ভয় পেল তার থেকে অনেক বেশি। সারাদিন এরকম ঘটনা ঘটতে থাকল– তপুকে কেউ টিটকারি করা মাত্র সাথে সাথে তার শাস্তি পেয়ে যায় এবং দিনের শেষে আর কেউ তপুকে নিয়ে টিটকারি করার সাহস পেল না। ব্যাপারটা টুশি এবং তপু দুজনেই লক্ষ করেছে–তপুর যা আনন্দ হল সেটা আর বলার মতো নয় কিন্তু টুশি ব্যাপারটাকে একেবারেই ভালো চোখে দেখল না। কাবিল কোহকাফীকে এক কোনায় ঠেলে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি বলেছ তুমি কারও গায়ে হাত দেবে না।”
কাবিল কোহকাফী বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমি কারও গায়ে হাত দেই নাই।”
“একটু আগে তুমি একটা মেয়ের বেণি ধরে টান দিয়েছ।”
“বেণি হচ্ছে চুল–আমি চুলে হাত দিয়েছি গায়ে হাত দেই নাই”
এই নিয়ে তর্ক করা যেত কিন্তু ঠিক সেই সময়ে ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেল। টুশি ক্লাসে যাবার সময় ফিসফিস করে বলল, “দ্যাখো–তুমি যদি আমার ক্লাসে ঢোকো ভালো হবে না কিন্তু।”
কাবিল কোহকাফীর চোখ উত্তেজনায় চকচক করে উঠল, সে দুই পা এগিয়ে এসে আগ্রহ নিয়ে বলল, “কেন? ক্লাসে ঢুকলে কী হবে?”
টুশি দুর্বলভাবে চেষ্টা করল, বলল, “তুমি আমাকে কথা দিয়েছ–”
“আমি কথা দিয়েছি কারও গায়ে হাত দেব না।” কাবিল কোহকাফী চোখ নাচিয়ে বলল, “কিন্তু আমি তোমার ক্লাসে ঢুকব না সেটা তো কথা দিই নাই।”
টুশি রেগেমেগে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখন টুশির ক্লাসের একটি মেয়ে টুশির দিকে অবাক হয়ে বলল, “তুমি একা একা কথা বলছ কেন?”
টুশি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা চোখে বলল, “আমার যখন খুব মেজাজ খারাপ হয় তখন আমি নিজে নিজে কথা বলি।”
মেয়েটা, যে ক্লাসের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরী কিন্তু যে সারা ক্লাসের মাঝে সবচেয়ে পাজি, যার নাম ফারিয়া, একেবারে নায়িকাদের মতো ঢং করে খিলখিল করে হেসে বলল, “ও মা! তোমার চেহারা যেরকম অদ্ভুত তোমার স্বভাবও সেরকম অদ্ভুত!”
কাবিল কোহকাফী ফারিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, টুশি দাঁতে দাঁত ঘষে ফিসফিস করে বলল, “খবরদার কাবিল কোহকাফী।”
ফারিয়া বলল, “কী বলছ?”
টুশি চোখ লাল করে বলল, “কিছু বলি নাই।”
০৮. বিজ্ঞান ক্লাস
বিজ্ঞান ক্লাসে রেহানা আপা আজকে নানারকম জিনিসপত্র নিয়ে ঢুকলেন। টেবিলে সেগুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে গম্ভীর মুখে বললেন, “আজকে তোমাদের বিজ্ঞানের সৌন্দর্য দেখাব।”
রেহানা আপা টুশিদের বিজ্ঞান পড়ান। তার চেহারা খুব সুন্দর, ফরসা রং ফাঁপানো চুল, টানা-টানা চোখ। মানুষের চেহারা সুন্দর হলেই প্রথমে সবাই তাকে পছন্দ করে ফেলে, ধরেই নেয় তার চেহারা যেরকম সুন্দর মনটাও নিশ্চয়ই সেরকম সুন্দর–কিন্তু দেখা গেছে সেটা সবসময় সত্যি হয় না। রেহানা আপা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন কিন্তু সেগুলো বলেন শুধু তার পছন্দের ছেলেমেয়েদের সাথে। এমনিতে মানুষটা কেমন যেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির–সবাই তাঁকে কেমন যেন ভয় পায়। তাই যখন টেবিলে নানারকম জিনিসপত্র রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বিজ্ঞানের সৌন্দর্যের কথা বললেন তখন ক্লাসের কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু ফারিয়া খিলখিল করে হেসে বলল, “বিজ্ঞানের সৌন্দর্য হয় নাকি আপা? আমি শুধু ভাবতাম যে মানুষের চেহারায় সৌন্দর্য হয়।”
টুশি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না যে কেউ এরকম গাধার মতো একটা কথা বলতে পারে। কিন্তু রেহানা আপার কাছে সেটা গাধার মতো কথা মনে হল না। আপাও খুব মধুর হাসি দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ ফারিয়া, ফুলের যেরকম সৌন্দর্য আছে, চেহারার যেরকম সৌন্দর্য আছে ঠিক সেরকম বিজ্ঞানেরও একটা সৌন্দর্য আছে।”
টুশি দাঁতে দাঁত চেপে একটা নিশ্বাস ফেলল, একজন টিচার কীভাবে এরকম কথা বলে? চেহারার সৌন্দর্যের কথা নয়, বলা উচিত ছিল মানুষের ভেতরকার সৌন্দর্যের কথা–চরিত্রের সৌন্দর্যের কথা। কিন্তু রেহানা আপা মনে হয় সেগুলোর কথা জানেনই না।
রেহানা আপা টেবিলে একটা চুম্বক, একটা পেন্ডুলাম, বিকারে একটু পানি, একটা মোমবাতি, কিছু মার্বেল, মার্কার পেন্সিল এসব সাজিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, “বিজ্ঞান পড়ার আগে বিজ্ঞানকে জানতে হয়–বিজ্ঞানকে বুঝতে হয়। বিজ্ঞানকে অনুভব করতে হয়।”
ক্লাসের সবাই একটু উসখুস করে বসল, এখন না রেহানা আপা আবার গভীর জ্ঞানের একটা প্রশ্ন করে বসেন। মনে-মনে সবাই যেটা ভয় পাচ্ছিল তা-ই হল, রেহানা আপা জিজ্ঞেস করলেন, “বলো দেখি বিজ্ঞান বলতে আমরা কী বুঝি?”
টুশি তাড়াতাড়ি চিন্তা করে মনে-মনে উত্তরটা ঠিক করার চেষ্টা করল কিন্তু রেহানা আপা তার দিকে তাকালেন না, কখনোই তার দিকে তাকান না। ক্লাসের পিছনের দিকে বসে থাকা হাবাগোবা টাইপের শাফকাতকে জিজ্ঞেস করলেন। শাফকাত দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে বলল, “হ্যাঁ ইয়ে মানে–যেটা দিয়ে মানে মেশিন টেশিন বানায় মানে হচ্ছে গিয়ে”
রেহানা আপা গর্জন করে বললেন, “গাধা কোথাকার!” তারপর মুখ ভেংচে বললেন, “যেটা দিয়ে মেশিন বানায়! বুদ্ধির চেঁকি। বসো।”
শাফকাত চট করে বসে পড়ল, টুশি একবার ভাবল হাত তোলে, কিন্তু সাহস হল না–উত্তরটা পছন্দ না হলে তার আরও খারাপ গালি শুনতে হবে। তার গায়ের রং নিয়ে চেহারা নিয়ে খোটা দেয়া হবে। রেহানা আপা কঠিন মুখে সারা ক্লাসের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে ফারিয়ার দিকে তাকালেন, তখন তাঁর কঠিন মুখ নরম হয়ে গেল, চোখ হাসি-হাসি হয়ে উঠল। আপা জিজ্ঞেস করলেন, “ফারিয়া, তুমি বলো দেখি বিজ্ঞানটা কী?”
ফারিয়া নেকু নেকু ভাব করে নায়িকাদের মতো চুল পিছনে সরিয়ে বলল, “টেলিভিশন লাইট এইসব হচ্ছে বিজ্ঞান।”
টুশি অপেক্ষা করে রইল দেখার জন্যে রেহানা আপা কী বলেন। শাফকাতকে যদি গাধা আর বুদ্ধির ঢেঁকি বলা হয় তা হলে ফারিয়াকে কমপক্ষে ছাগল আর বেকুব ডাকা উচিত। কিন্তু রেহানা আপা সেটা ডাকলেন না। কষ্ট করে মুখে হাসিটা ধরে রেখে বললেন, “ভেরি গুড ফারিয়া–তুমি বিজ্ঞানের আবিষ্কারের চমৎকার দুইটা উদাহরণ দিয়েছ। একটা জিনিস বোঝার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে উদাহরণ দিয়ে বোঝা। টেলিভিশন আর লাইট–এই দুটি হচ্ছে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ। ভেরি গুড।” ।
রেহানা আপার কথা শুনে ফারিয়ার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করতে লাগল, গাধা মেয়েটা জানতেও পারল না যে সে কী বোকার মতো কথা বলেছে।
রেহানা আপা এবারে টেবিল থেকে একটা চুম্বক তুলে বললেন, “এই যে ছেলে এবং মেয়েরা, আমার হাতে আছে একটা চুম্বক। চুম্বক দিয়ে কী হয় বলো দেখি?”
টুশির কথা বলার ইচ্ছে নেই তাই সে চুপ করে বসে রইল, অনেকে বলল, “চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে আপা।”
“হ্যাঁ। চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে।” রেহানা আপা মাথা নেড়ে বললেন, “চুম্বক কি কাঠকে আকর্ষণ করে?”
ফারিয়া সবার চেয়ে জোরে চিৎকার করে বলল, “না আপা করে না।”
“ভেরি গুড–”
রেহানা আপা আরও কিছু কথা বললেন কিন্তু টুশি তার কিছু শুনতে পেল না, কারণ সে বিস্ফারিত চোখে দেখল ঠিক তখন কাবিল কোহকাফী হেলতে দুলতে ঢুকছে, টুশিকে দেখে সে চোখ টিপে হাত নাড়াল। টুশি মুখ শক্ত করে চোখের ইশারায় কাবিলকে সরে যেতে বলল–কাবিল সেই ইশারাকে একেবারে কোনো পাত্তা না দিয়ে রেহানা আপার টেবিলের একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে একধরনের আনন্দের ভাব যেটা টুশির একেবারেই পছন্দ হল না।
রেহানা আপা চুম্বকটা হাতে নিয়ে বললেন, “এই চুম্বকটা কাঁচকে আকর্ষণ করে, কাঠকে আকর্ষণ করে না, ডাস্টারকে আকর্ষণ করে না, চককে আকর্ষণ করে না–শুধু লোহাকে আকর্ষণ করে। এই দ্যাখো–”
বলে রেহানা আপা চুম্বকটা একটা চকের কাছে ধরতেই সবাই অবাক হয়ে দেখল চকটা লাফ দিয়ে চুম্বকের গায়ে লেগে গেল–আসল কারণটা দেখতে পেল শুধু টুশি–কাবিল কোহকাফী চকটাকে টান দিয়ে নিয়ে এসেছে, অন্য সবাই বিস্ময়ের একটা শব্দ করল।
রেহানা আপা কেমন যেন ঘাবড়ে গেলেন। তিনি ভয়ে ভয়ে চুম্বকটা আবার কয়েকটা চকের কাছে ধরতেই চকগুলো জীবন্ত প্রাণীর মতো তার উপর লাফিয়ে পড়ল। রেহানা আপা ভয় পেয়ে চুম্বকটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে দূরে সরে গেলেন। সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, শুধু ফারিয়া হি হি করে হেসে বলল, “খুব শক্তিশালী চুম্বক তাই না আপা? চককেও আকষর্ণ করে।”
রেহানা আপা কোনো কথা না বলে চুম্বকটা হাতে নিতেই টেবিলের উপর রাখা পানির বিকারটা চুম্বকের আকর্ষণে সেটার দিকে ছুটে গেল এবং সেই পানি ছিটকে রেহানা আপাকে ভিজিয়ে দিল। রেহানা আপা চিৎকার করে পিছনে সরে গিয়ে ভয় পেয়ে চুম্বকটা হাত থেকে ফেলে দিরেন। ক্লাসের কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু ফারিয়া বলল, “খুব শক্তিশালী চুম্বক তাই না আপা? পানিকেও আকর্ষণ করে।”
টুশি নিচু গলায় বলল, “চুম্বক পানিকে আকর্ষণ করে না গাধা।”
“এই যে করল!”
“করে নাই। অন্য কিছু হয়েছে।”
ফারিয়া তখন রেহানা আপাকে নালিশ করে নেকু নেকু গলায় বলল, “দেখেছেন আপা কী বলছে!”
রেহানা আপা তখনও চুম্বকটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, ঢোক গিলে বললেন, “কী বলেছে?”
“বলেছে চুম্বক নাকি পানিকে আকর্ষণ করে না। খুব শক্তিশালী চুম্বক হলে করে। তাই না আপা?”
রেহানা আপা শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের শরীর মুছতে মুছতে বললেন, “ইয়ে মানে সাধারণত করে না, কিন্তু আজকে মানে ইয়ে মনে হচ্ছে–” রেহানা আপা থেমে গিয়ে বললেন, “চুম্বকটা থাক। তোমাদের বরং অন্য একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাই।” রেহানা আপা টেবিলের ওপর রাখা স্ট্যান্ড থেকে ঝুলে থাকা পেন্ডুলামটা দেখিয়ে বললেন, “এই যে এটা হচ্ছে একটা পেন্ডুলাম। এটা দুলিয়ে দিলে কী হবে?”
ক্লাসের অফিসিয়াল ভালো ছেলে জাবেদ বলল, “এর দোলনকাল হবে দৈর্ঘ্যের বর্গমূলের সমানুপাতিক।”
রেহানা আপা মাথা নাড়লেন, খুব অনিচ্ছার সাথে বললেন “গুড।” ফারিয়া ছাড়া আর কারও উত্তর বা কথাবার্তা তার ভালো লাগে না। তিনি পেন্ডুলামটা ধরে একপাশে টেনে এনে বললেন, “এই যে পেন্ডুলামটা আমি একপাশে টেনে এনে ছেড়ে দিচ্ছি দেখবে এটা দুলতে থাকবে ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। সমানতালে। এই দ্যাখো–”
রেহানা আপা পেন্ডুলামটা ছাড়লেন সেটা দুলে অন্য পাশে যেতেই কাবিল কোহকাফী সেটা খপ করে ধরে ফেলল। ক্লাসের সবাই এবং রেহানা আপা বিস্ফারিত চোখে দেখলেন পেন্ডুলামটা অন্য পাশে গিয়ে আটকে গেছে, সেটা আর নড়ছে না। ফারিয়ার চোখ আনন্দে ঝলমল করতে থাকে, সে হাত নেড়ে বলল, “পেন্ডুলামটা বেশি ভারী দেখে আটকে গেছে আর নড়ছে না, তাই না আপা?”
রেহানা আপা কোনো কথা না বলে পেন্ডুলামটা ধরতে গেলেন ঠিক তখন সেটা তাঁর হাত গলে উপরে উঠে গেল। রেহানা আপা কিছুক্ষণ হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর পেন্ডুলামটা ধরতে গেলেন তখন সেটা কেমন যেন নাচের ভঙ্গিতে লাফাতে লাগল এবং সেটা দেখে ফ্যাকাশে ভঙ্গিতে রেহানা আপা এক লাফে পিছনে সরে গেলেন।
টুশি দেখল কাবিল কোহকাফী পেন্ডুলামটা ছেড়ে দিয়ে আনন্দে হাসতে হাসতে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছে। সে চোখের ইশারায় তাকে নিষেধ করার চেষ্টা করল কিন্তু কাবিল কোহকাফী ভ্রূক্ষেপ করল না।
পেন্ডুলামটা থামার পর রেহানা আপা খানিকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “পেন্ডুলামটাও থাকুক। তোমাদের তাপ নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাই।”
টুসি একধরনের আতঙ্ক নিয়ে দেখল কাবিল কোহকাফী একগাল হেসে এক্সপেরিমেন্ট দেখার জন্যে এগিয়ে এল।
রেহানা আপা একটা মোমবাতি টেবিলে বসিয়ে মোমবাতিটি জ্বালালেন, কাবিল সাথে সাথে ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিল। রেহানা আপা আবার জ্বালালেন, কাবিল কোহকাফী আবার নিভিয়ে দিল। রেহানা আপা একটু বিরক্ত হয়ে এবারে হাত দিয়ে আড়াল করে একটু সাবধানে মোমবাতিটি জ্বালালেন। মোমবাতিটি ঠিকভাবে জ্বলা পর্যন্ত কাবিল কোহকাফী অপেক্ষা করল, তারপর ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। রেহানা আপা একটু অবাক হয়ে এদিক-সেদিক তাকালেন, ওপরে তাকালেন তারপর আবার জ্বালালেন। মোমবাতিটি যখন স্থির হয়ে জ্বলতে লাগল তখন কাবিল কোহকাফী ফুঁ দিয়ে সেটাকে নিভিয়ে দিল।
টুশি চোখ পাকিয়ে কাবিলের দিকে তাকাল কিন্তু কাবিল টুশির দৃষ্টি এড়িয়ে মোমবাতি নেভাতে লাগল। রেহানা আপার কেমন জেদ চেপে গেল, তাঁর চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে, হাত কাঁপতে থাকে, জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকেন। একটার পর একটা ম্যাচ জ্বালাতে থাকেন আর কাবিল ফুঁ দিয়ে নেভাতে থাকে। সারা ক্লাসেই কেমন যেন রুদ্ধশ্বাস রুদ্ধশ্বাস ভাব চলে আসে। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে–সবাই কেমন জানি ভয় পেয়ে যায়। রেহানা আপা শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়লেন–ম্যাচটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে নিজের মাথা খামচে গোঙানোর মতো একধরনের শব্দ করতে লাগলেন। কাবিল কোহকাফীকে দৃশ্যটা বেশ উপভোগ করতে দেখা গেল।
কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পেল না, শুধু বোকাসোকা ফারিয়া হি হি করে হেসে বলল, “আপা আজকের দিনটা মনে হয় উলটাপালটা। আজকে মনে হয়। বিজ্ঞানের কোনোকিছু কাজ করবে না।”
রেহানা আপা তার টেবিলের উপর রাখা জিনিসপত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তাই তো দেখছি!”
টুশি একটু আগেই লক্ষ করেছিল–অন্যেরা এখন দেখল যে মোমবাতিটি হঠাৎ করে নিজে নিজে জ্বলে উঠছে–এবং এখন আর নিভে যাচ্ছে না। ব্যাপারটি যে ঘটা উচিত নয় সেটা ফারিয়ার সাদাসিধে মাথায় ঢুকল না, সে আনন্দে হাততালি দিয়ে। বলল, “জ্বলে গেছে! মোমবাতি নিজে থেকে জ্বলে গেছে!”
রেহানা আপা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটু ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, “কিন্তু এটা নিজে থেকে জ্বলার কথা না! কেমন করে জ্বলল?”
ফারিয়া ব্যাখ্যা দিল, “আপা বিজ্ঞান হচ্ছে ম্যাজিকের মতো–তাই ম্যাজিকের মতো জ্বলে গেছে।”
কেউ কোনো কথা বলল না, তাই ফারিয়া একটু উৎসাহ পেয়ে গেল, নেকু নেকু গলায় বলল, “তাই না আপা?”
ফারিয়ার এই ঢঙের কথা শুনে টুশির পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল, রেহানা আপা তাকে পছন্দ করে না তাই সে এতক্ষণ কিছু বলছিল না, কিন্তু আর পারল না। বলল, “বিজ্ঞান মোটেও ম্যাজিকের মতো না। বিজ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞানের মতো।”
ফারিয়ার কথার কেউ প্রতিবাদ করবে, তাও তার প্রিয় রেহানা আপনার ক্লাসে সেটা সে বিশ্বাস করতে পারল না। নেকু নেকু গলায় বলল, “তা হলে কেমন করে এগুলো হচ্ছে?”
“আর হবে না।”
“হবে না?”
“না।”
রেহানা আপা ভুরু কুঁচকে বললেন, “আর হবে না?”
টুসি আমতা-আমতা করে বলল, “আমাকে যদি করতে দেন তা হলে আর হবে না।”
“কেন?”
“বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করতে হয় আপা। বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করলে সবকিছু ঠিকঠাক হয়।”
রেহানা আপা খানিকক্ষণ টুশির দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, “আসো।”
টুশি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল, সবাই অবাক হয়ে দেখল সে কনুইটা হঠাৎ করে পিছনে সজোরে নিয়ে যায়, মানুষ কনুই দিয়ে কারও পেটে গুতো মারতে হলে এরকম করে–কিন্তু এখানে কোনো মানুষ নেই, সে কেন এরকম করছে কে জানে! কাবিল কোহকাফী পেটে গুঁতো খেয়ে একটু সরে গিয়েছে, টুশি তখন টেবিলে এগিয়ে যায়, চুম্বকটা হাতে নিয়ে বলল, “এই দ্যাখোচুম্বক চককে আকর্ষণ করে না, পানিকেও আকর্ষণ করে না। শুধু লোহাকে আকর্ষণ করে।”
সবাই দেখল চক লাফিয়ে গেল না, পানিও ছলকে উঠল না, চুম্বকটা শুধু লোহাগুলোকে আকর্ষণ করল। পেন্ডুলামটাও ঠিক ঠিক দুলতে শুরু করল, নাচানাচি করল না। মোমবাতির শিখাটাও নিভে গেল না, টেস্ট টিউবের মাঝে এক টুকরো বরফ একটা তার দিয়ে নিচে আটকে রেখে উপরের পানিটিও রেহানা আপা ফুটিয়ে ফেলতে পারলেন। কাবিল কোহকাফী টুশিকে বিরক্ত করার চেষ্টা করল না, একটু কাছে থেকে এসে দেখার চেষ্টা করছিল কিন্তু টুশি কোনো ঝুঁকি নিল না, হাতের কনুই দিয়ে শরীরের শক্তি দিয়ে গুঁতো মেরে তাকে সরিয়ে রাখল।
তার এই অঙ্গভঙ্গি দেখে জাবেদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “টুশি, তুমি একটু পরে পরে তোমার কনুই দিয়ে ওরকম করছ কেন?”
“কে বলেছে একটু পরে পরে করছি?”
“হ্যাঁ করেছ। এই যে একটু আগে করলে!”
“ও আচ্ছা ওইটা? ওইটা মনের আনন্দে করেছি!”
“মনের আনন্দে?”
“হ্যাঁ। মনের আনন্দে কেউ হাততালি দেয়, কেউ হাত উপরে তুলে বলে ইয়াহু, আমি এরকম করি!” টুশি ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে আরও একবার করে দেখাল–কাবিল ছাড়াই!
“তোমার মনে এত আনন্দ হচ্ছে কেন?”
“বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট দেখলে আমার মনে খুব আনন্দ হয়!” টুশি সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “তোমাদের হয় না?”
রেহানা আপা সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তাই সবাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “হয়।”
টুশি গম্ভীর হয়ে বলল, “ভেরি গুড।”
রেহানা আপা টুশি নামের এই একটু বিচিত্র মেয়েটাকে ভালো করে এবং একটু অন্যরকমভাবে লক্ষ করলেন।
ঠিক কী কারণ জানা নেই তাই দেখে ফারিয়া একেবারে জ্বলেপুড়ে কাবাব হয়ে গেল!
০৯. নানি
বাসায় এসে তপু এবং টুশি আবিষ্কার করল তপুর নানি বাইরের ঘরের সোফায় দুই পা তুলে বসে আছেন। তপুর নানি আগেও এক দুইবার এই বাসায় এসেছেন, একেবারে থুরথুরে বুড়ো, মাথার চুল শনের মতো সাদা কিন্তু খুব হাসিখুশি। টুশি আগেও লক্ষ করেছে মানুষ দুরকমভাবে বুড়ো হয়, এক ধরনের মানুষকে দেখে মনে হয় বুড়ো অন্য ধরনের মানুষকে দেখে মনে হয় শিশু। তপুর নানি দ্বিতীয় ধরনের তাকে দেখে কেমন যেন ছোট বাচ্চার মতো মনে হয়। টুশির বয়সী ছেলেমেয়েরা সাধারণত বুড়ো মানুষদের পছন্দ করে না, কিন্তু টুশির কথা আলাদা। প্রায় সারাটা জীবনই সে তার নানার সাথে কাটিয়েছে তাই বুড়ো মানুষদের তার খুব ভালো লাগে। তাই নানিকে দেখে তপু যেটুকু খুশি হলো টুশি খুশি হলো আরও বেশি! সে ছুটে গিয়ে নানিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “নানি–তোমাকে দেখতে আজকে কত। সুইট লাগছে।”
নানি দাঁতহীন মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “সুইট লাগবে না! দেখছিস না ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছি, গায়ে পাউডার দিয়েছি, কপালে টিপ দিয়েছি, লাল শাড়ি পরেছি!”
টুশি বলল, সত্যি সত্যি একদিন তোমার ঠোঁটে লিপস্টিক, গালে পাউডার, কপালে টিপ দিয়ে লাল শাড়ি পরিয়ে দেব!”
তপু বলল, “তোমার নাকি শরীর খারাপ নানি?”
নানি একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “জোর করে সবাই যদি শরীর খারাপ করিয়ে দেয় তা হলে শরীর ভালো থাকবে কেমন করে?”
টুশি বলল, “তোমাকে দেখে কিন্তু একেবারেই মনে হচ্ছে না তোমার শরীর খারাপ!”
তপু বলল, “আ-আ-আব্বু বলছিল–”
আব্দু কী বলেছিল টুশি তপুকে সেটা বলতে দিল না, বাধা দিয়ে বলল, “নানি তুমি কিন্তু রাত্রে আমার সাথে ঘুমাবে।”
তপু বলল, “না-না–আমার সাথে!”
টুশি বলল, “নানি তুমি যদি তপুর সাথে শোও–সারারাত ঘুমাতে পারবে না। তপু বিছানায় টাকি মাছের মতো লাফায়”
নানি বললেন, “আমার কি আর ঘুম আছে? সারারাত বসে কুটুর কুটুর করি, উলটো তোরাই ঘুমাতে পারবি না।”
.
বাইরের ঘরে যখন নানির সাথে টুশি আর তপু গল্প করছে তখন শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে চাচা-চাচি ফিসফিস করে কথা বলছিলেন। চাচা বললেন, “যাক! বুড়িকে তো নিয়ে আসা গেল। আমি ভেবেছিলাম বুড়ি না আবার বেঁকে বসে।”
চাচি বললেন, “বেঁকে বসবে কেন? নাতির জন্যে মায়ের জান। আর টুশি নিজের নাতনি নামায়া তার জন্যে মনে হয় আরও এক ডিগ্রি বেশি। বললেই চলে আসেন।”
“ভেরি পিকিউলিয়ার। যে-ই দেখে এই মেয়েটাকে পছন্দ করে ফেলে। চেহারায় কোনো ছিরি ছাঁদ নাই কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা হয় না, দেখেছ?”
“হুঁ।” চাচি গম্ভীর মুখে বললেন, “ছেলেটাও কেমন বাধ্য দেখেছ? টুশির কথায় ওঠে বসে!”
“যা-ই হোক—-” চাচা ষড়যন্ত্রীদের মতো মুখ করে বললেন, “এখন প্ল্যানের সেকেন্ড পার্ট।”
চাচি শুকনো মুখে বললেন, “আমার কিন্তু কেমন জানি ভয় ভয় করছে!”
চাচা হাত নেড়ে বললেন, “আরে! ভয় কিসের?”
“যদি কিছু-একটা হয়ে যায়?”
“কী হবে? কিচ্ছু হবে না। এরা প্রফেশনাল। এতগুলো টাকা খামোখা দিচ্ছি?”
“তবুও” চাচি ইতস্তত করে বললেন, “মা বুড়ো মানুষ–”
“সেটাই তো কথা!” চাচা উত্তেজিত গলায় বললেন, “তোমার মায়ের যদি বয়স থাকত, সম্পত্তি ভোগ করতে চাইতেন, আমরা কি আপত্তি করতাম? এখন বয়স হয়েছে, এইসবের মায়া ছেড়ে দিতে হবে না?”
“ঠিকই বলেছ।”
“এত বড় একটা বাড়ি এরকম একটা সেন্ট্রাল লোকেশানে, সেইটা নাকি এতিমখানায় দিয়ে দেবে। ভিমরতি আর কারে বলে!”
“তা হলে ঠিক কীভাবে করা হবে?”
“টুশি আর তপু স্কুল থেকে বাসায় আসবে দুইটা তিরিশে। তুমি তাদেরকে খাইয়ে তিনটার ভিতরে বের হয়ে যাবে বাসায় থাকবে খালি বুড়ি, তপু আর টুশি।”
চাচি একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “আমার মাকে তুমি সবসময় বুড়ি ডাকো– এটা ঠিক না!”
“বুড়িকে বুড়ি ডাকব না তো কী ডাকব?”
“নিজের শাশুড়িকে কেউ বুড়ি ডাকে?”
চাচা হাত নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন এটা নিয়ে একটা ঝগড়া শুরু করে দিও না।”
“হ্যাঁ, বলো তারপর।”
“ঠিক সাড়ে তিনটার সময় পার্টি আসবে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকবে। আমি একটা চাবি দিয়ে রাখব আগে থেকে।”
“কজয়ন ঢুকবে?”
“তিনজন।” চাচা দাঁত বের করে হেসে তার সিরাজদ্দৌলার মতো গোঁফে হাত বুলিয়ে বললেন, “তিনজনের চেহারা দেখেই বুড়ি–আই মিন তোমার মায়ের না হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়! এই সাইজ একেকজনের, চোখে কালো চশমা, স্কিনটাইট টিশার্ট, হাতে কাটা রাইফেল।”
“তারপর?”
“একজন ধরবে তপুকে, একজন টুশিকে–আরেকজন সেই কাগজ নিয়ে যাবে বুড়ি–আই মিন তোমার মায়ের সামনে। বলবে এই মুহূর্তে সাইন করো, তা না হলে তোমার নাতি আর নাতনির মাথার মাঝে গুলি করে দেব। বুড়ি সুড়সুড় করে সাইন করে দেবে। নিজের মাথায় গুলি করলে বুড়ি ঢিট লেগে থাকবে, কিন্তু নাতির গায়ে হাত দিলে উপায় আছে?” চাচা আনন্দে হা হা করে হাসলেন।
চাচি শুকনো মুখে বললেন, “সব এখন ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে হয়। লোকগুলো কারা? সত্যিকার সন্ত্রাসী না তো?”
“এই কাজের জন্যে কি আর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পাব? তবে চিন্তা করো না, সব নিজেদের লোক।”
“দেখো আবার”।
“বলতে পার পুরো ব্যাপারটা হবে একটা নাটকের মতো। আগে হলে তপুকেও বলে রাখা যেত, যেন ভয় না পায়। এখন এই টুশি মেয়েটা এসে হয়েছে মুশকিল! তপুর আবার নিজের একটা পার্সোনালিটি হয়ে গেছে! ভালোমন্দ বোঝ আরম্ভ করেছে। কী মুশকিল!”
“যা-ই হোক–এখন তো আর কিছু করার নাই! দেখা যাক কী হয়!”
.
রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে টুশি আর তপু তাদের নানির দুই পাশে বসল গল্প শোনার জন্যে। টুশি বলল, “নানি, নানার সাথে তোমার প্রথম দেখা হল কেমন করে সেটা আবার বলো না, প্লিজ!”
নানি মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “ধুর পাগলি মেয়ে, এক গল্প কতবার বলে!”
টুশি বলল, “শোনা গল্প শুনতেই তো বেশি মজা–আগে থেকে জানি কোন জায়গাটা সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং–”
নানি বললেন, “ধুর বোকা।”
তপু বলল, “তা হলে একটা ভূ-ভূ-ভূতের গল্প বলো।”
টুশি বলল, “হ্যাঁ নানি বলো না। সুইট একটা ভূতের গল্প।”
নানি বললেন, “এই রাতে জিন-ভূতের গল্প শুনলে ভয় পাবি।”
টুশি আর তপু একসাথে বলল, “জিন?” তারা দুজন চোখ বড় বড় করে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। টুশি ঘুরে নানির দিকে তাকিয়ে বলল, “নানি? তুমি কখনও জিন দেখেছ?”
নানি বললেন, “দেখি নাই আবার!”
“দেখতে কেমন হয়?”
“এই লম্বা লম্বা দাড়ি। এইরকম ছোট। পায়ের মুড়া হয় উলটো দিকে।”
“তাদের মেজাজ কেমন হয়?”
“সব্বোনাশ! খুব রাগী হয়। চোখ দিয়ে একেবারে আগুন বের হয়।”
“নানি, এরকম কি হতে পারে যে তারা খুব ঠাণ্ডা মেজাজের হয়? খুব সুইট হয়? জোকারের মতন?”
নানি চোখ বড় বড় করে বললেন, “কী বলিস তুই? ঠাণ্ডা মেজাজ! কখনও না!”
“কেন নানি? তুমি আরব্যরজনী পড় নাই? জিনেরা এরকম বড় বড় কলসি ভরা সোনার মোহর নিয়ে আসত?”
নানি মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “ঐগুলো তো গল্প-গল্পে কতকিছু হয়!”
টুশি বলল, “কিন্তু সত্যি সত্যি কি জিন থাকতে পারে না যেটা খুব ভালো?”
নানি একটু চিন্তার মাঝে পড়ে গেলেন, শনের মতো পাকা চুলে হাত দিয়ে বিলি কেটে বললেন, “সেটা মনে হয় থাকতে পারে।”
“সেই জিনকে আমরা যদি কিছু-একটা করতে বলি সেটা কি করবে?”
নানি হেসে বললেন, “তুই জিন পাবি কোথায়? ঢাকা শহরে কী আর জিন আছে? আর থাকলেই কি সেটা তোর কথা শুনবে?”
তপু জ্বলজ্বলে চোখে টুশির দিকে তাকাল, কাবিল কোহকাফীর কথা বলার জন্যে নিশ্চয়ই তপুর মুখ সুড়সুড় করছে। টুশি অবশ্যি তপুকে চিমটি কেটে থামাল। এখনও এটা বলার সময় হয় নাই এবং বললেও নানি বিশ্বাস করবেন না।
নানি মুখে ভয়ের একটা চিহ্ন ফুটিয়ে বললেন, “জিন বন্দি করার দোয়া আছে। অনেক কঠিন দোয়া–সেই দোয়া পড়ে জিন বন্দি করা যায়। তখন জিনকে যেটা বলা যায় জিন সেটা করে।”
তপু বলল, “জিনকে বন্দি করে কি বো-বোতলে ভরতি করা যায়?”
“বোতল? বোতলে কেন?”
“এই ইয়ে মা-মানে এমনি?”
নানি হি-হি করে হেসে বললেন, “জিন কি আমের আচার, নাকি ওষুধের ট্যাবলেট যে বোতলে আর শিশিতে ভরতে চাস!”
টুশি বলল, “আচ্ছা নানি মনে করো একটা জিনের সাথে আমার খুব খাতির হল। তা হলে কি সেই জিনটাকে আমি যেটাই বলি সেটাই করবে?”
নানি তাঁর পাকা শনের মতো চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, “তা নিশ্চয়ই করবে!”
“আমি যদি বলি, আমার চোহরাটা সুন্দর করে দাও–তা হলে কি সুন্দর করে দেবে?”
নানি টুশির থুতনি ধরে আদর করে বললেন, “ওমা! কী বলিস তুই? তোর চেহারা তো এখনই কত সুন্দর!”
“ছাই সুন্দর। তুমি আগে বলো জিন কী সুন্দর করে দিতে পারবে?”
নানি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন, বললেন, “নিশ্চয়ই পারবে। জিনেরা সবকিছু পারে।”
তপু চোখ বড় বড় করে টুশিকে বলল, “আপু তু-তুমি কি কা-কাবিলকে তাই বলবে?”
নানি বললেন, “কাবিল? কাবিলটা কে?”
টুশি তাড়াতাড়ি বলল, “না-না, কেউ না।” নানি ব্যাপারটি নিয়ে বেশি মাথা ঘামালেন না দেখে টুশি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তাড়াতাড়ি কথা ঘোরানোর জন্যে বলল, “নানি তোমার চুলে একটু তেল দিয়ে দিই?”
নানি বললেন, “দে দেখি বোনডি। মাথা দেখি খালি কুটকুট করে।”
তপু বলল, “আমি? আ-আমি তা হলে কী করব?”
টুশি বলল, “তুই নানিকে পান ঘেঁচে দে।”
তপু মনের মতো একটা কাজ পেয়ে খুব খুশি হয়ে উঠল।
একটু পরে দেখা গেল টুশি নানির মাথায় তেল দিয়ে চিরুনি দিয়ে তাঁর শনের মতো সাদা চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে–তার কাছে বসে তপু মহা উৎসাহে একটা ছোট পিতলের হামানদিস্তায় পান ঘেঁচে দিচ্ছে।
.
রাত্রিবেলা টুশির বিছানায় নানি যখন ঘুমিয়ে গেছেন তখন তপু এসে টুশিকে ফিসফিস করে বলল, “টু-টু-টুশি আপু।”
“কী হল?”
“কা-কাবিল কোথায় গেছে?”
“আমি কেমন করে বলব! মনে নাই সে ঘুরতে বের হল!”
“অ্যাকসিডেন্ট হয় নাই তো!”
“চিন্তার মাঝে ফেলে দিলি!” টুশি চিন্তিত মুখে বলল, অ্যাক্সডিন্টে হলে কেউ দেখতে পারবে না, হাসপাতালেও নিতে পারবে না।”
টুশির চিন্তার অবসান হল সাথে সাথে দরজায় ধুম ধুম করে কে যেন শব্দ করল। চাচা দরজা খুলে দেখলেন কেউ নেই, এদিক-সেদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে ফিরে এসে বিরক্ত হয়ে চাচিকে বললেন, “ফাজিল ছেলে-ছোঁকড়ার কাজ দেখেছ? এই এত রাতে দরজায় শব্দ করে পালিয়ে গেল!”
চাচি বললেন, “নিশ্চয়ই দোতালার ছেলেটা, চোহরা দেখলেই মনে হয় মহা বদমাইস।”
টুশি আর তপু বুঝতে পারল এটা মোটেও দোতলার পাজি চেহারার ছেলেটা না–এটা কাবিল কোহকাফী, সারা শহর ঘুরে এখন ফিরে এসেছে।
টুশি আর তপু নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল, দেখল গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে কাবিল কোহকাফী এসে ঢুকছে। তাকে এখন আর চেনা যায় না–তার পরনে একটা রংচঙে টিশার্ট, জিন্সের প্যান্ট এবং টেনিস শু। মাথায় লাল রঙের একটা বেসবল ক্যাপ। টুশি আর তপুর দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল, “হা হা হা। আজকে কী মজা হয়েছে শুনলে তোমরা হাসতে হাসতে মারা যাবে”
টুশি আর তপু দুজনেই জানে যে কাবিল কোহকাফীর কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না, তাকে কেউ দেখতেও পাচ্ছে না, তার পরেও তারা ভয়ে সিঁটিয়ে রইল, নানি তার গলার স্বর শুনে জেগে ওঠেন কি না সেই ভয়ে বারবার তার দিকে তাকাতে লাগল। নানি বা চাচা-চাচি কেউই অবশ্যি কাবিল কোহকাফীর কথা শুনতে পেলেন। না–কাবিল তাই বলে যেতে লাগল, “বুঝলে তোমরা–আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ দেখি এক মাস্তান–”
কাবিল হঠাৎ নানিকে দেখে চমকে উঠে গলা নামিয়ে বলল, “ওরে বাবা! এখানে ডাইনি বুড়ি কোথা থেকে এসেছে?”
টুশি রেগে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ডাইনি বুড়ি কেন হবে? আমাদের নানি!”
কাবিল কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস করল না, কাছে এসে নানিকে দেখে পিছিয়ে গেল, বলল, “সব্বোনাশ! দেখে ভয় লাগে।”
টুশি চাপা গলায় বলল, “ভয় লাগার কী আছে? এত সুইট আমাদের নানি।”
“আমি যখন বাগদাদে ছিলাম, শাহজাদি দুনিয়ার সাথে এইরকম একজন ডাইনি বুড়ি ছিল। আমাকে জাদু করে দিল। একেবারে হাত-পা নাড়াতে পারি না
হাত-পা নাড়াতে না পারার কারণে তার কী অবস্থা হয়েছিল সেটা কাবিল তাদের অভিনয় করে দেখাল।
কাবিল আবার কাছে এসে নানিকে দেখে আবার লাফিয়ে পিছনে সরে গেল, বলল, “বাবারে বাবা! আমি এই ঘরে এই বুড়ির সাথে ঘুমাতে পারব না!”
তপু ফিসফিস করে বলল, “কো-কো-কোথায় ঘুমাবে তা হলে?”
“বাইরের ঘরে। গদিওয়ালা চেয়ারে।” কাবিল কোহকাফী মাথা নাড়তে নাড়তে বের হয়ে গেল। একটু পরেই তারা তার নাকডাকার শব্দ শুনতে পেল, মনে। হল সারা বাড়ি বুঝি থরথর করে কাঁপছে।
ভাগ্যিস কেউ তার নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায় না–তা হলে কী যে সর্বনাশ হত! টুশি অবশ্যি খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমাল–চাচা প্রতিদিন সকালে উঠে সোফায় বসে খানিকক্ষণ টেলিভিশন দেখেন। কাল সকালে যখন সোফায় বসতে গিয়ে কাবিল কোহকাফীর ভুড়িতে বসে যাবেন তখন কী যে একটা কেলেঙ্কারি হবে সেটা নিয়ে তার ঘুম হারাম হয়ে গেল। সকালে তার নিশ্চয়ই ঘুম ভাঙবে চেঁচামেচি এবং হইচই দিয়ে।
সত্যি সত্যি সকালে টুশি এবং তপুর ঘুম ভাঙল চেঁচামেচি এবং হইচই দিয়ে তবে কারণটা একটু ভিন্ন, চাচি চিৎকার করছেন চাচার উপরে, কারণ সকালে উঠে আবিষ্কার করেছেন যে বাইরের ঘরের দরজা খোলা। রাত্রিবেলা চাচা শেষবার দরজা খুলেছিলেন কাজেই তিনি নিশ্চয়ই দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়েছেন। চাচা দুর্বল গলায় বললেন, “আমার স্পষ্ট মনে আছে দরজা বন্ধ করেছি।”
“ছাই মনে আছে!” চাচি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “তোমার ঐ মোটা মাথায় ব্রেন কতটুকু যে এতকিছু মনে রাখতে পারবে?”
অন্য কোনোদিন হলে ঝগড়া অবশ্যি অনেকক্ষণ ধরে চলত–আজকে চাচা চাচি ইচ্ছে করেই সেটা বন্ধ করে ফেললেন। দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণঝগড়াঝাটি দিয়ে সেটা কেউই শুরু করতে চাচ্ছে না।
সকালবেলা নাস্তার টেবিলে সবাই তাড়াহুড়ো করে নাস্তা করছে। টুশি আর তপু যাবে স্কুলে, চাচা যাবেন অফিসে–অন্যদিন হলে চাচিও যেতেন, আজ নানির জন্যে চাচি বাসায় থাকছেন, টুশি আর তপু বাসায় ফেরত এলে কাজে যাবেন। সকালবেলা টুশির একেবারেই খেতে ইচ্ছে করে না, খুব কষ্ট করে রুটি টোস্ট জেলি মাখিয়ে খাচ্ছে, তখন হঠাৎ চাচা খবরের কাগজ দেখতে দেখতে বললেন, “ভেরি পিকিউলিয়ার!”
চাচি জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
“খুব আশ্চর্য একটা খবর ছাপা হয়েছে।”
“কী খবর?”
“শোনো আমি পড়ছি।” চাচা পড়তে লাগলেন, “চান্দিছোলা জব্বর গ্রেফতার। ঢাকা বারোই অক্টোবর–ফার্মগেট এলাকা থেকে অপরাহু তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে কুখ্যাত সন্ত্রাসী চান্দিছোলা জব্বরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ চান্দিছোলা জব্বর ফার্মগেটের সামনে একটি গাড়ি থেকে কিছু অর্থ ছিনতাই করে পলায়ন করার সময় হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং তাকে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিসহকারে নৃত্য করতে দেখা যায়। সে শূন্যে ঝুলে থাকে এবং হাত-পা নেড়ে নিজেকে আঘাত করে এবং বিকট গলায় আর্তনাদ করতে থাকে। চান্দিছোলা জব্বর এক পর্যায়ে তার রংচঙে টিশার্ট, জিন্সের প্যান্ট, টেনিস শু এবং মাথার বেসবল ক্যাপ খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র একটি অন্তর্বাস পরে অপ্রকৃতস্থের মতো ক্রন্দন করতে থাকে। ফার্মগেটের মোড় থেকে পুলিশ এসে তখন তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে। তার খুলে ফেলা কাপড়, প্যান্ট এবং টিশার্ট উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি বলে তাকে শুধু অন্তর্বাস পরা অবস্থায় থানা-হাজতে প্রেরণ করা হয়। এই ব্যাপারে জোর পুলিশি তদন্ত চলছে।”
চাচা খবরটি পড়ে শেষ করার আগেই টুশি এবং তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। চান্দিছোলা জব্বরের এই দুর্গতি কে করেছে এবং কাবিল কোহকাফী কোথা থেকে তার বিচিত্র পোশাক পেয়েছে বুঝতে তাদের বাকি থাকে না। কাল রাতে সে কী মজার ঘটনা বলতে চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত বলতে পারে নি সেটাও এখন পরিষ্কার হয়ে গেল।
খবরটি শুনে চাচি হাসি হাসি মুখে বললেন, “বড় বড় ক্রিমিনালরা যদি নিজেরাই নিজেদের কিল ঘুসি মেরে অ্যারেস্ট হয়ে যায় তা হলে তো মন্দ হয় না!”
চাচা বললেন, “কিন্তু আমি খবরের মাথা-মুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না! একজন মানুষ নিজে নিজে শূন্যে ঝুলে থাকে কেমন করে?”
চাচি হাত নেড়ে বললেন, “ওগুলো হচ্ছে খবরের কাগজের বিক্রি বাড়ানোর ফন্দি!”
টুশি আর তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল–শুধু তারা দুজনেই জানে এটা খবরের কাগজের বিক্রি বাড়ানোর ফন্দি নয়। শুধু তা-ই নয়, শুধু তারাই জানে সত্যি সত্যি খবরে কাগজের বিক্রি বাড়ানোর খবরটি কী হতে পারে!
১০. তিন মূর্তি
চাচি ঘড়ি দেখে চিৎকার করে বললেন, “সর্বনাশ! তিনটা বেজে গেছে!”
টুশি বুঝতে পারল না তিনটা বেজে গেলে সর্বনাশ হবে কেন। তারা স্কুল থেকে আসার পর খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে মাঝে মাঝেই তিনটা বেজে যায়। চাচি আজকে কেন জানি দেরি করলেন না, বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সবসময় যেরকম ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে একটু কমপ্যাক্ট, চোখে আইলাইনারের ছোঁয়া এবং ঠোঁটে লিপস্টিক দেন, আজকে তাও করলেন না, চুলের মাঝে চিরুনি চালাতে চালাতে বাসা থেকে একরকম দৌড়ে বের হয়ে গেলেন। কী নিয়ে তাঁর এত তাড়াহুড়ো টুশি কিংবা তপু বুঝতে পারল না, তারা সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাল না।
নানি ছোট বাচ্চাদের মতো দুই পা সোফায় তুলে গুটিসুটি মেরে বসেছিলেন। টুশি এবং তপু যতক্ষণ স্কুলে থাকে তার সময়টা কাটতে চায় না, বাচ্চা দুটো চলে এলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। তার কাছ থেকে গল্প শোনার জন্যে পাগল হয়ে থাকে, তাদের সাথে গল্প করে সময়টা বেশ কেটে যায়। আজকেও তা-ই হচ্ছে, টুশি একটা বাটিতে খানিকটা সরষের তেল এনে নানির পায়ে ডলে ডলে মাখিয়ে দিচ্ছে, তপু মহা উৎসাহে হামানদিস্তায় পান-সুপুরি ঘেঁচে দিচ্ছে। নানির দাঁত নেই বলে একেবারে মিহি হতে হবে সেজন্যে সে একটু পরে পরে আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে।
নানি তাঁর ছেলেবেলার গল্প করছেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তার কী অবস্থা তার একটা ভয়ংকর বর্ণনা দিচ্ছেন, কিন্তু সেই ভয়ংকর অবস্থার গল্প শুনে দুজনেই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। নানি কপট রাগে চোখ বড় বড় করে বলছেন, “এইটা হাসির কথা হল? আমি মরি দুঃখে আর তোরা সেই গল্প শুনে হাসিস”
এরকম সময়ে দরজায় কলিংবেলের শব্দ হল। থেমে থেমে দুইবার। টুশি এবং তপু একজন আরেকজনের দিকে তাকায়–কাবিল কোহকাফী কি এসেছে? সে ঢাকা শহরে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, তার বর্ণনা খবরের কাগজে উঠে আসছে–কখন কী বিপদ হবে কে জানে! টুশি উঠে দরজা খুলতে গেল। কিন্তু দরজা খোলার আগেই সে দেখতে পেল, বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজা খুলে। ভিতরে তিনজন মানুষ ঢুকে গেছে।
তিনজন মানুষ দেখতে তিন রকম। একজন ছোট এবং শুকনো, চেহারার মাঝে একটা নেংটি ইঁদুরের ভাব। মুখটা ইঁদুরের মতো ছুঁচালো, চোখ দুটো কুতকুতে। তার পিছনে দুইজন মানুষের আকার বিশাল। একজনের মুখটা গোল, গায়ের রং ফরসা, সারা শরীরে মাংস, টাইট একটা টিশার্টের নিচে সেগুলো কিলবিল কিলবিল করছে, মানুষটাকে দেখলেই গণ্ডারের কথা মনে পড়ে। অন্য মানুষটির মাথাটা সরাসরি শরীরের উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে–কোনো গলা নেই। হাত দুটি লম্বা। এবং কেমন জানি সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। গায়ের রং কুচকুচে কালো–সব মিলিয়ে একটা গরিলা-গরিলা ভাব। টুশি কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে হাঁ করে এই বিচিত্র তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। সে একেবারে একশত ভাগ নিশ্চিত ছিল যে এরা ভুল করে এখানে চলে এসেছে, তার পরেও জিজ্ঞেস করল, “আপনারা। ভিতরে কেমন করে ঢুকেছেন? কাকে চান?”
ইঁদুরের মতো মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “এইটা ইমতিয়াজ সাহেবের বাসা না?” মানুষটার গলা ফাটা বাঁশের মতো কর্কশ।
টুশি মাথা নেড়ে বলল, “জি। কিন্তু চাচা বাসায় নাই।”
ইঁদুরের মতো মানুষটা কর্কশ গলায় বলল, “তাতে কোনো অসুবিধা নাই। আমাদের দরকার তার শাশুড়ির সাথে!” এই বলে টুশিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনজন ভিতরের দিকে রওনা দিল। টুশি এত অবাক হল যে ভয় পাওয়ারও সময় পেল না, গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কে? এখানে কী চান?”
ইঁদুরের মতো মানুষটা টুশিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, “কালাচান দরজাটা বন্ধ কর। দবির মিয়া বুড়িরে খুঁজে বের কর।”
টুশি দেখল কুচকুচে কালো গরিলার মতো মানুষটার নাম দবির মিয়া, সে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। ফরসা এবং গণ্ডারের মতো মানুষটার নাম নিশ্চয়ই কালাচান, সে দরজা বন্ধ করে বলল, “জে মন্তাজ ওস্তাদ।” তার গলার স্বর মিহি মনে হয় পয়লা বৈশাখে পাঞ্জাবি পরে রমনার বটমূলে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে যায়।
টুশি এবার এত রেগে গেল যে অবাক হবার সময় পেল না, চিৎকার করে বলল, “আপনারা কেন এখানে এসেছেন? কেমন করে বাসার ভিতরে ঢুকেছেন? এক্ষুনি বাইরে যান–”
তখন টুশি আবিষ্কার করল, ইঁদুরের মতো মানুষটি যাকে কালাচান মন্তাজ ওস্তাদ বলে ডাকছে, তার হাতের ব্যাগ খুলে সেখান থেকে একটা বেঁটে রিভলবার বের করছে। টুশি তখন প্রথমবার বুঝতে পারল, এখানে খুব বড় গোলমাল আছে। এবং সে এই প্রথমবার ভয় পেল।
ওস্তাদ রিভলবারটা পরীক্ষা করে হাতে নিয়ে বলল, “এই মেয়ে, তুমি যদি আর একটা বাজে কথা বলো তা হলে গুলি করে তোমার খুলি ফুটো করে দেব। বুঝেছ?”
টুশি মাথা নাড়ল, ওস্তাদকে জানাল যে সে বুঝেছে। এরকম সময় বাইরের ঘর থেকে খুব ভারী এবং মোটা গলায় দবির মিয়া বলল,”ওস্তাদ, বুড়িরে পাইছি।”
ওস্তাদ তখন টুশিকে বাইরের ঘরের দিকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে পিছনে পিছনে হেঁটে ঘরে ঢুকল। তপু এবং নানি অবাক হয়ে এই বিচিত্র দলটার দিকে তাকাল। নানি অবাক হয়ে বললেন, “কী গো বোনডি! এরা কারা?”
টুশি চিঁ চিঁ করে বলল, “আমি চিনি না নানি।”
“কার কাছে আসছে?”
“আপনার কাছে।”
“আমার কাছে?” নানি অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কে বাবা? বাড়ি থেকে আসছ নাকি? তুমি জলিলের ভাই না?”
ইঁদুরের মতো মানুষটি, যে নিশ্চয়ই এই দলের নেতা এবং যাকে অন্য দুইজন মন্তাজ ওস্তাদ বলে ডাকছে এবারে নানির কাছে এগিয়ে বলল, “না খালা, আমি জলিলের ভাই না।”
“তা হলে তুমি কে?”
“আপনি আমারে চিনবেন না। আমরা আপনার কাছে বিশেষ কাজে এসেছি।”
“কী কাজ?”
“খিলগাঁয়ে আপনার একটা বাড়ি আছে না–”
নানি লোকটাকে কথা শেষ করতে দিলেন না, হঠাৎ করে চিলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “ও আমার নেউলের বাচ্চা নেউল, খাটাশের বাচ্চা খাটাশ–আমার সাথে রং-তামাশা করতে আসছ–ঝাড় দিয়ে পিটিয়ে তোমার পিঠের ছাল যদি আমি না তুলি”
টুশি একটু কেশে বলল, “নানি।”
নানি তেরিয়া হয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”
“এদের কাছে পিস্তল।”
তপু বলল, “পি-পি-পি-পি–” সে কথা শেষ করতে পারল না, টুশি ধরে নিল পিস্তল বলতে গিয়ে ভয়ের চোটে কথা আটকে গেছে।
নানি জিজ্ঞেস করলেন, “পিস্তলটা আবার কী?”
“বন্দুকের মতো। সাইজে ছোট।”
তপু বলল, “ব-ব-ব-ব-ব” টুশি ধরে নিল বন্দুক বলতে গিয়ে কথা শেষ করতে পারছে না।
মন্তাজ ওস্তাদ এইবারে পিস্তলটা হাতবদল করে বলল, “খালার চোখ মনে হয়। ভালো না। ছানি পড়েছে। ভালো দেখতে পান না। এই যে এইটারে পিস্তল বলে, ট্রিগার টানলে গুলি বের হয়।”
“খাটাশের বাচ্চা খাটাশ, তুই আমারে কী পেয়েছিস? আমি কি তোর পিস্তলরে ভয় পাই?” নানি আবার মুখে তুবড়ি ছোটালেন, “খ্যাংড়া কাঠির ঝাড় দিয়ে তোর ভূত আমি নামাব। খড়ম দিয়ে পিটিয়ে সিধা করব”।
মন্তাজ ওস্তাদের কালো মুখে অপমানের বেগুনি ছোপ ছোপ রং দেখা গেল। গণ্ডারের মতো চেহারার কালাচান তার মিহি রবীন্দ্রসংগীতের গলায় বলল, “ওস্তাদ এই মহিলার মুখ তো দেখি খুব খারাপ। একটা গুলি দিব নাকি চাঁদির মাঝে? মুখ বন্ধ করে দিব?”
মন্তাজ ওস্তাদ কালাচানকে ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর বেকুব। মুখ বন্ধ করে দিলে কাজ শেষ করব কেমন করে?” তারপর পিস্তলটা নাচাতে নাচাতে নানির একেবারে কাছে গিয়ে বলল, “খালা আপনার তো দুই পাই কবরে পিস্তলরে তো আপনার ভয় পাওয়ার কথা না। তবে–” ওস্তাদ খুব অর্থপূর্ণভাবে হেসে বলল, “আপনার দুই নাতি-নাতনির কিন্তু একেবারে কাঁচা বয়স। তারা মনে হয় পিস্তলরে ভয় পায়!”
“তুই কী বলতে চাস ছাগলের বাচ্চা ছাগল?”
“এই যে দেখছেন আমার দুই অ্যাসিস্টেন্ট তাদের নাম হচ্ছে কালাচান আর দবির মিয়া। এরা খালি হাতে টিপি দিয়ে ছোট বাচ্চার কচি মাথা মুরগির ডিমের মতো পটাশ করে ফাটিয়ে দিতে পারে। আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে তাদেরকে নিয়ে এসেছি। কেন এনেছি জানেন?”
“কেন?”
“এই দবির মিয়া ধরবে মেয়েটারে, কালাচান ধরবে ছেলেটারে–আর আপনি যদি আমার কথা না শোনেন তা হলে দবির মিয়া পুটুস করে মেয়েটার মাথাটা টিপে গুঁড়ো করে দেবে, নাক দিয়ে তখন তার ঘিলু বের হয়ে আসবে। তাই না রে দবির?”
দবির মিয়া বাধ্য ছেলের মতো বলল, “জি ওস্তাদ।”
নানি কয়েকবার কিছু-একটা কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু এবারে তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হল না।
মন্তাজ ওস্তাদ তার দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দবির আর কালাচান–সময় নষ্ট করে লাভ নাই। দুইজন দুইটারে ধর। আগেই পুটুস করে মাথাটা গুঁড়া করিস না”
কালাচান তার মিহি গলায় বলল, “জি ওস্তাদ।” তারপর দুই পা হেঁটে তপুর ঘাড় ধরে তাকে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল। তপু বলল, “আ-আ-আ আ-_”
সে কী বলার চেষ্টা করছে টুশি এইবারে আন্দাজ করতে পারল না। দবির মিয়া। টুশির দিকে এগিয়ে এসে তার ঘাড় ধরে একপাশে টেনে নেয়। মানুষটার কালো লোমশ হাত দেখে টুশির কেমন জানি শরীর শিরশির করতে থাকে।
মন্তাজ ওস্তাদ এবারে গলার স্বর নরম করে নানিকে বলল, “খালা। আমি দশ পর্যন্ত গুনব। তার মাঝে আপনি এই কাগজটা সাইন করবেন। যদি না করেন তা হলে প্রথমে পুটুস করে মেয়েটার তার পরে ছেলেটার মাথাটা টিকটিকির ডিমের মতো গুঁড়ো করে দেয়া হবে। বুঝেছেন?”
নানি মুখ হাঁ করে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মুখ নড়ছে, দেখে
মন্তাজ ওস্তাদ হাতের পিস্তলটা নাচিয়ে বলল, “খালা আমাদের হাতে সাময় নাই। আমি দশ পর্যন্ত গুনব, তার মাঝে আপনার কাগজে সাইন করতে হবে। যদি না করেন, তা হলে–” কথা শেষ না করে ওস্তাদ হাত দিয়ে একজনের মাথা পিষে ফেলার ভঙ্গি করল।
তপু এবারে ভয় পেয়ে ফাসাস করে কাঁদতে শুরু করে। কালাচান মিহি গলায় বলল, “কাঁদছ কেন খোকা? মাথার হাড্ডি গুঁড়া করলে কিছু টের পাওয়া যায় না, তার আগেই শেষ!”
মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “এক।”
লাল মিয়া টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে ঠিক কোন জায়গায় ধরে চাপ দেবে সেই জায়গাটা একবার দেখে নিল। হাতটা যে শুধু কালো আর লোমশ তা-ই নয় হাতের মাঝে সিগারেটের বোটকা গন্ধ।
মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “দুই।”
তপু কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাবা-বা-বা-বা–” শব্দটা কী হতে পারে টুশি চিন্তা করে বের করতে পারল না।
মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “তিন।”
টুশির গলা শুকিয়ে যায়। এরা কারা কে জানে, কিন্তু মনে হচ্ছে একেবারে দয়ামায়াহীন দানব। সত্যি সত্যি যদি তার মাথা গুঁড়ো করে দেয়? মানুষটার হাত থেকে কি ছুটে যাবার চেষ্টা করবে? টুশি বুঝতে পারল তার কোনো উপায় নেই। মানুষটা একেবারে লোহার মতো শক্ত হাতে তার গলা এবং ঘাড় ধরে রেখেছে। নড়ার কোনো উপায়ই নেই।
মন্তাজ ওস্তাদ গুনল, “চার।”
নানি এবারে হাত বাড়িয়ে বললেন, “দে কাগজ হারামজাদা।”
মন্তাজ ওস্তাদ একগাল হেসে বলল, “খালা, আপনার মুখটা খুব খারাপ। কোনোদিন এর জন্যে আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন।” ওস্তাদ কাগজটা নানির হাতে দিয়ে বলল, “নেন খালা।”
“কলম কই?”
মন্তাজ ওস্তাদ তার পকেট থেকে কলমটা বের করে নানির হাতে দিচ্ছিল, ঠিক তখন দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। সাথে সাথে ঘরে সবাই একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। শুধু নানি খিক খিক করে মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “এই তো লোকজন এসে গেছে, এখন বোঝো মজা!”
কালাচান তার মিহি গলায় ফিসফিস করে বলল, “এটা কে হতে পারে। ওস্তাদ?”
মন্তাজ ওস্তাদের মুখে চিন্তার একটা ছায়া পড়ল, সে মাথা চুলকে বলল, “এখন তো কারও আসার কথা না।”
মনে হয় ওস্তাদের কথাটা ভুল প্রমাণ করার জন্যেই আবার দুইবার কলিংবেল বেজে উঠল। ওস্তাদ ফিসফিস করে নিচু গলায় বলল, “দবির তুই এই মেয়েটারে নিয়ে দরজার কাছে যা। মেয়েটা দরজা খুলে যে আসছে তারে বিদায় করবে।” তারপর টুশির দিকে তাকিয়ে রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “ছেমড়ি যদি তুমি কোনো তেড়িবেড়ি কর তা হলে কিন্তু এই ছেমড়ার জান শেষ। একেবারে মগজের মাঝে, গুল্লি। ঠিক আছে?”
টুশি মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”
দরজায় আবার দুইবার কলিংবেলের শব্দ হল, যে-ই এসে থাকুক মানুষটার শরীরে ধৈর্য নামক পদার্থটি একেবারে নেই।
মন্তাজ ওস্তাদ রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “যা কালাচান। নিয়ে যা।”
টুশিকে প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে দরজার কাছে নিয়ে গেল দবির মিয়া। দরজার কাছে নিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “দরজা খোলো।”
টুশি দরজা খুলল এবং সাথে সাথে তার মুখ একশ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। দরজার সামনে কাবিল কোহকাফী দাঁড়িয়ে আছে। আজকে তার চেহারা আরও খোলতাই হয়েছে। চোখে কালো চশমা আর গলা থেকে একটা লাল গামছা ঝুলছে। টুশিকে দেখে মুখ খিঁচিয়ে বলল, “এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?”
টুশি কোনো কথা না বলে কাবিল কোহকাফীর চোখের দিকে তাকিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে তাকে একটা সংকেত দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু কাবিলের ভিতর কোনো সূক্ষ্ম ব্যাপার নেই, সে কিছুই বুঝতে পারল না। দবির মিয়া ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কে? বিদায় করে দাও তাড়াতাড়ি।”
টুশি বেশ কষ্ট করে মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ ফুটিয়ে দরজা খুলে বলল, “কেউ না।”
“কেউ না?” দবির মিয়া নিজেও এবারে এগিয়ে আসে–সে কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পায় না কিন্তু কাবিল কোহকাফী তাকে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠে বলল, “ইয়া মাবুদ! এই কালা বিরিশ কোথা থেকে এসেছে?”
টুশি কোনো কথা বলল না, দরজাটা আরেকটু খুলে দিল, কাবিল কোহকাফী সাবধানে ভিতরে ঢুকে যায়। দবির মিয়া দরজা দিয়ে মাথা বের করে দুই দিকে দেখে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়ে নিল আসলেই কেউ নেই। তখন সে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে দরজাটা বন্ধ করে টুশির ঘাড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে ভিতরের দিকে যেতে শুরু করে। কাবিল চিৎকার করে বলল, “এই ব্যাটা কালা বিরিশ, তুই এই মেয়েটার ঘাড়ে ধাক্কা দিচ্ছিস যে?”
তার কথা টুশি আর তপু ছাড়া কেউ শুনতে পেল না। টুশি কিছু বলল না, কিন্তু তপু সবকিছু ভুলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল–”কা-কাকা-কা–”
ভাগ্যিস সে কথা শেষ করতে পারল না। ওস্তাদ তপুর দিকে তাকিয়ে বলল,– “কী হল, তুমি কাকের মতো কা কা করছ কেন?”
কাবিল বসার ঘরে এসে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে বলল, “কী হচ্ছে এখানে? এই বদমাইশগুলো কী করতে চায়?”
তপু আবার বলার চেষ্টা করল, “কা-কাকা-কা” কিন্তু এবারেও বেশিদূর এগুতে পারল না। টুশি অনুমান করল শব্দটা নিশ্চয়ই কাবিল হবে।
মন্তাজ ওস্তাদ কলমটা এবারে নানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “খালা কেউ আসে নাই। আমরা অনেক হিসাব করে এসেছি। এখন এখানে কেউ আসবে না। কাজেই দেরি না করে এইখানে একটা সাইন করেন খালা।”
ব্যাপারটি কী হচ্ছে বোঝার জন্যে কাবিল ওস্তাদের খুব কাছাকাছি এগিয়ে গেল। তার চোখেমুখে চরম বিরক্তি, ওস্তাদকে একটা মজা বোঝানোর জন্যে সে হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ করে প্রস্তুত হতে শুরু করে।
নানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইন করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখন টুশি বলল, “নানি।”
নানি অবাক হয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হল বোনডি?”
“তোমার যদি ইচ্ছা না করে তা হলে তুমি সাইন কোরো না।”
মন্তাজ ওস্তাদ হুঙ্কার দিয়ে বলল, “কী বলিস পুঁচকে মেয়ে? তোর সাহস তো দেখি কম না!”
টুশি ওস্তাদকে একেবারে কোনো পাত্তা না দিয়ে বলল, “নানি, তুমি এক কাজ করো–ইঁদুরের মতো দেখতে লোকটার পেটে একটা ঘুসি মারো।”
নানি চোখ কপালে তুলে বলল, “ঘুসি মারব?”
“হ্যাঁ নানি।”
নানি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুসি?”
“হ্যাঁ–দেখবে ব্যাটার কী অবস্থা হয়।”
“সত্যি বলছিস বোনডি?”
“সত্যি বলছি।”
ঘুসি কীভাবে মারতে হয় নানির জানা নেই। তবুও তিনি হাতটা ঘুরিয়ে অত্যন্ত হাস্যকর একটা ভঙ্গিতে ওস্তাদের পেটে একটা ঘুসি মারলেন। কিন্তু সেই ঘুসির ফল হল ভয়ানক–ওস্তাদ একেবারে ছিটকে প্রায় উড়ে গিয়ে ঘরের অন্যপাশে আছাড় খেয়ে পড়ল, দেয়ালে মাথা ঠুকে তার চোখ একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। আসল ব্যাপারটি দেখল শুধু টুশি আর তপু। নানির ঘুসির সাথে তাল মিলিয়ে কাবিল তার সমস্ত শক্তি দিয়ে মন্তাজ ওস্তাদের পেটে একটা ঘুসি মেরেছে!
কালাচান এবং দবির মিয়া একেবারে হতবাক হয়ে নানির দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের দুইজন থেকেও বেশি অবাক হল ওস্তাদ এবং ওস্তাদ থেকেও বেশি অবাক হলেন নানি। তিনি অবাক হয়ে যেই হাত দিয়ে ঘুসি মেরেছেন সেই হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
টুশি বলল, “নানি ছেড়ে দিও না। গিয়ে আর কয়টা কিল-ঘুসি মারো।”
নানি উৎসাহ পেয়ে সোফা থেকে নেমে গুটি গুটি হেঁটে গিয়ে মন্তাজ ওস্তাদের মুখে আরেকটা ঘুসি মারলেন, কাবিল সেই ঘুসিতে সাহায্য করল এবং ওস্তাদ বিকট আর্তনাদ করে একেবার ধরাশায়ী হয়ে গেল। টুশি দেখল মানুষটারে উপরের পাটির একটা দাঁত খুলে এসেছে এবং থুঃ করতেই দাঁতটা বের হয়ে এল।
টুশি বলল, “নানি এখন আমাদেরকে রক্ষা করো।”
নানি এবারে গুটি গুটি তাদের দিকে এগুতে লাগলেন। টুশি টের পেল দবির মিয়া এবং কালাচান এবারে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে গেছে। তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল-দবির মিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “খবরদার, ভালো হবে না কিন্তু কালাচান তার মিহি গলায় বলল, “শেষ করে দিব আমরা–”
নানির এখন তার নতুন শক্তিতে পুরোপুরি বিশ্বাস–একটুও না ঘাবড়ে বললেন, “বলদের বাচ্চা বলদ, ছারপোকার ডিম, ইঁদুরের লেজ, তোদের চেহারা যেরকম খারাপ খাসলত সেরকম খারাপ, আজকে যদি আমি তোদের পিটিয়ে সিধে
করি, ঘুসি মেরে যদি ভুড়ি ফাঁসিয়ে না দিই, জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে যদি কুকুরকে না খাওয়াই”
নানি তাঁর শুকনো পাতলা দুর্বল শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসতে লাগলেন। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে তিনি আগে কখনও কাউকে ঘুসি মারেন নি আজকে প্রথম দুটি ঘুসিতে যেভাবে ওস্তাদকে কাবু করেছেন তার বিশ্বাস এই দুজনকেও সেভাবে কাবু করতে পারবেন। টুশি চোখের কোনা দিয়ে দেখল কাবিল কোহকাফীও প্রস্তুত হয়ে আছে। ওস্তাদ শুকনো পাতলা মানুষ ছিল, সে ঘুসি মেরে কাবু করে দিয়েছে, কিন্তু এই দুজন প্রায় ছোটখাটো পাহাড়ের মতো, কাবিল ঘুসি মেরে কাবু করতে পারবে সে ব্যাপারে এতটা নিঃসন্দেহ নয়। তাই সে একটা চেয়ার হাতে ধরে রেখেছে, নানি ঘুসি মারার সাথে সাথে সে পিছন থেকে এটা দিয়ে মাথায় মারবে।
নানি মূর্তিমান যমের মতো এগিয়ে আসতে লাগলেন, টুশি বলল, “নানি বেশি কাছে আসার দরকার নাই। দূর থেকেই ঘুসি মারো–”
নানি একটু দূর থেকেই মারলেন–ঘুসিটা কালাচানের গায়ে লাগল কী না বোঝা গেল না কিন্তু সাথে সাথে বিকট আর্তনাদ করে ধড়াম করে সে নিচে পড়ে গেল। নানি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “কত বড় সাহস, আমার সাথে লাগতে আসে!”
দবির মিয়ার বুকের ভেতর যেটুকু সাহস ছিল কালাচানের অবস্থা দেখে সেটুকুও উবে গেছে। সে টুশিকে ছেড়ে দিয়ে এবারে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু নানি এত সহজে তাদের ছেড়ে দেবার পাত্র নন, বললেন, “ধর–ধর বেটা বদমাইশকে”
ঘুসির মতো কথাতেও কাজ হল, দবির মিয়ার বিশাল দেহ কলাগাছের মতো পড়ে গেল, নানি দেখতে পেলেন না যে কাবিল তাকে পা বাধিয়ে ফেলে দিয়েছে।
তিনজনকেই ধরাশায়ী করে নানি হাত ঝাড়া দিয়ে কোমরে হাত রেখে অনেকটা বিজয়ী জেনারেলের মতো বললেন, “কেমন শিক্ষা হয়েছে এই ইন্দুরের বাচ্চাগুলোর?”
তপু বলল, “ভা-ভা-ভা “।
টুশি তপুর অসমাপ্ত কথা শেষ করে বলল, “ভালো শিক্ষা হয়েছে!”
নানি জিজ্ঞেস করলেন, “আর কোনোদিন তেড়িবেড়ি করবে?”
টুশি মাথা নাড়ল, “না নানি। আর সাহস পাবে না।”
নানি বললেন, “আয় দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলি।”
বাসায় দড়ি খুঁজে পেল না তাই টুশি বুদ্ধি করে চাচির একটা শাড়ি বের করে সেটা দিয়ে তিনজনের হাত বেঁধে ফেলল। মানুষগুলো কোনো প্রতিবাদ করল না দুই কারণে, প্রথমত, নানি ক্যারাটের ভঙ্গিতে ঘুসি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দ্বিতীয়ত, তপু ওস্তাদের পিস্তলটা হাতে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলছিল, “একটু নড়লেই খু-খু খুন করে ফেলব।”
“খুন করে ফেলব” কথাটাই খুব ভয়ংকর সেটাকে যখন “খু-খু-খুন করে ফেলব” বলা হয় তখন সেটাকে আরও একশ গুণ বেশি ভয়ংকর শোনায়।
১১. ষড়যন্ত্র
বাসায় ঢুকে চাচা এবং চাচি যখন দেখলেন মন্তাজ ওস্তাদ এবং তার দুই সাগরেদকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা আছে, ওস্তাদের উপরের পাটির সামনের একটা দাঁত নেই, দবির মিয়ার কপালটা উঁচু হয়ে ফুলে আছে এবং কালাচানের নাকে রক্ত শুকিয়ে আছে তখন তাদের চোয়াল ঝুলে পড়ল। চাচা এবং চাচি দুজনেই কথা বলতে চেষ্টা করলেন কিন্তু কেউই কথা বলতে পারলেন না। চাচার মুখ বেশ কয়েকবার নড়ল এবং শেষ পর্যন্ত রিকশার টায়ার থেকে বাতাস ছেড়ে দেয়ার মতো একটা শব্দ বের হল।
তপু রিভলবারটা নাচিয়ে বলল, “আব্ব সব কয়টাকে ধরে ফেলেছি।”
তার কথায় তোতলামোর চিহ্ন নেই কিন্তু সেটা চাচা এবং চাচি খেয়ালও। করলেন না, চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন করে ধরেছিস?”
“নানি ঘুসি মেরে সবগুলোকে ফেলে দিয়েছে।”
তপুর উত্তর শুনে চাচি একটা চেয়ার ধরে নিজেকে সামলে নেন–চাচা সাবধানে একটা চেয়ারে বসলেন। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বললেন, “ঘুসি মেরে?”
“জি।”
“তোর নানি?”
“জি।”
চাচা মেঝেতে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সত্যি?”
মন্তাজ ওস্তাদ এবং অন্য দুইজন পুতুলের মতো মাথা নেড়ে ব্যাপারটা স্বীকার করল। চাচা আবার রিকশার চাকা থেকে বাতাস বের করে দেয়ার মতো শব্দ করলেন। চাচি ভয়ে ভয়ে নানির দিকে তাকালেন, নানি হাত ঝেড়ে বললেন, “এইবার ছেড়ে দিয়েছি। পরের বার কিন্তু ছাড়ব না–একেবারে খুন করে ফেলব।”
টুশি বলল, “চাচা, এরা কী-একটা কাগজে সাইন করাতে এসেছিল–”
কাগজে সাইন করানোর কথা শুনে চাচা হঠাৎ কথা ঘুরানোর জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, “ও, আচ্ছা ঠিক আছে-”তোমরা কেউ কোনো ব্যথা পাও নাই তো?”
টুশি বলল, “না, চাচা। কিন্তু এই যে কাগজটা দেখেন”।
চাচা ছোঁ মেরে কাগজটা নিয়ে দেখার ভান করে তাড়াতাড়ি ভাঁজ করে পকেটে রেখে বললেন, “ইয়ে তার মানে মনে হয় ঠিকই কিন্তু যা বলছিলাম”।
কথাটার কী মানে টুশি কিছুই বুঝতে পারল না, সে আবার বলল, “নানির কী একটা বাড়ি নিয়ে সমস্যা–”
এবারে চাচি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন, নানির দিকে তাকিয়ে বললেন, “মা, তোমার ব্লাডপ্রেশার বাড়ে নাই তো?”
নানি বললেন, “আর ব্লাডপ্রেশার! এই বয়সে মারপিট করতে হলে ব্লাডপ্রেশার ঠিক থাকে কেমন করে?”
টুশি বলল, “এদেরকে পুলিশে দিতে হবে না?”
চাচা আবার মাছের মতো খাবি খেলেন, বললেন, “পু-পুলিশ?”
“হ্যাঁ।”
“আমি ফোন করব?”
চাচা এবারে লাফ দিয়ে উঠে একেবারে হা হা করে উঠলেন, “না-না–তোমার করতে হবে না। তোমার করতে হবে না। আমি করব। আমি করব।”
“ঠিক করে বাঁধতে পারি নাই। যদি পালিয়ে যায়?”
“কী দিয়ে বেঁধেছ?”
“চাচির একটা শাড়ি দিয়ে।”
চাচি এবারে প্রথমবার তাঁর শাড়িটা দেখে আঁতকে উঠে কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, “আমার সবচেয়ে ফেবারিট সিল্কের শাড়ি!”
নানি মুখ ভেংচে বললেন, “রাখ তোর শাড়ি! বাঁধা যে হয়েছে এই বেশি!”
পুলিশের কথাটা আসার পর থেকে চাচা কেমন ছটফট করতে শুরু করলেন। চাচির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, “এদেরকে পুলিশে দিতে হবে, তা ই না?”
চাচিকেও কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখা গেল, বললেন, “মনে হয়।”
চাচা বললেন, “আমি নিয়ে যাই পুলিশের কাছে। কী বল?”
চাচি বললেন, “হা হা, সেটাই ভালো। পুলিশ বাসায় আসলে আবার হাজার ঝামেলা।”
টুশি ঠিক বুঝতে পারল না, তার কাছে মনে হল পুলিশকে ফোন করে বলে দেওয়াটাই সবচেয়ে সহজ, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে চাচা-চাচি সেটা করতে চাচ্ছেন না। পুরো ব্যাপারটার মাঝেই কেমন জানি একটা রহস্যের গন্ধ, কিন্তু রহস্যটা কোথায় টুশি ঠিক বুঝতে পারল না।
পুরো সময়টুকু কাবিল কোহকাফী সোফায় গম্ভীর হয়ে বসে আলাপ শুনছিল এবং মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত যখন তিন মূর্তিকে লাইন ধরিয়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হল কাবিল কোহকাফী বলল, “বুঝেছ সোনার চাঁদেরা–এইবারে তো ডাইনি বুড়ির হয়ে একটু কেচে দিয়েছি। পরের বার নিজের হয়ে হালুয়া করে ছেড়ে দেব।”
তার কথা টুশি এবং তপু ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না।
.
মাইক্রোবাসটা ছাড়তেই চাচা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “মন্তাজ, এরকম সহজ একটা কাজ করতে গিয়ে একদম গুবলেট করলে?”
মন্তাজ ওস্তাদ শীতল গলায় বলল, “আগে হাতের বাঁধনটা খুলেন। ব্লাড সার্কুলেশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
দবির মিয়া বলল, “এইটুকু মেয়ের জোর কম না–এমন করে বেঁধেছে যে হাত কেটে বসে যাচ্ছে।”
দেখা গেল বাঁধনটা খোলা সহজ না, টুশি এমন করে গিঁট মেরেছে, যে ভোলার কোনো উপায়ই নেই। চাচির সবচেয়ে ফেবারিট সিল্কের শাড়ি জানার পরও চাচা। সেটা কেটে ওস্তাদ এবং তার দুই সাগরেদের হাতগুলো মুক্ত করলেন।
মন্তাজ ওস্তাদ তার হাতের কবজিতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “ইমতিয়াজ সাহেব, আমি আজ বারো বছর এই লাইনে, আমি কাঁচা কাজ করি না। কিন্তু আজকের ব্যাপার অন্যরকম–”
চাচা রেগে উঠে বললেন, “মন্তাজ, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বল, সত্ত্বর বছরের থুরথুরে বুড়ি তোমাদের মতো এইরকম তিনজন প্রফেশনাল মানুষকে পিটিয়ে ফ্ল্যাট করে দিয়েছে?”
কালাচান তার মিহি গলায় কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, ওস্তাদ বাধা দিয়ে বলল, “ইমতিয়াজ সাহেব, আপনি কী বিশ্বাস করতে চান আর কী চান না সেইটা আপনার ইচ্ছা। আমি বলছি আমি যেটা দেখেছি। নিজের চোখে দেখেছি”
“কী দেখেছ?”
ওস্তাদ দাঁতের পাটি বের করে তার ফোকলা দাঁত দেখিয়ে বলল, “একটা দাঁত নাই। গত বারো বছরে দাঁত দূরে থাকুক একটা নখ কেউ ধরতে পারে নাই।”
“তুমি এই সামান্য কাজটা করতে পার না?” চাচা রেগেমেগে বললেন, “আমি এত টাকা দিয়ে বায়না করলাম”
“আপনার বায়নার টাকা আমি ফিরিয়ে দেব।” ওস্তাদ গম্ভীর গলায় বলল, “আমি এই কেস নিতে পারব না।”
কালাচান এবং দবির মিয়া ওস্তাদের সাথে তাল মিলিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “অসম্ভব।”
চাচা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এ কী বিপদে পড়লাম? প্রথমে বুড়ি ছিল শুধু একগুঁয়ে। এখন বুড়ি হয়ে গেছে বক্সার মোহাম্মদ আলি! এখন কী দশা হবে?”
ওস্তাদ তার ফোকলা দাঁতটায় হাত বুলিয়ে গভীর দুঃখের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনাকে একটা উপদেশ দেই ইমতিয়াজ সাহেব?”
“কী উপদেশ?”
“এই বুড়ির বাড়িতে আপনি হাত দিবেন না। বুড়ি যেটা করতে চায় সেটা করতে দেন।”
চাচা চোখ কপালে তুলে বললেন, “সেটা করতে দেব?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“কারণ এই বুড়ি খুব ডেঞ্জারাস। তার সাথে তেড়িবেড়ি করলে সে আপনারেও ফিনিশ করে দেবে।”
চাচা কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে ফোকলা দাঁতের ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “কালাচান দরজা বন্ধ কর।”
কালাচান দরজা বন্ধ করে ওস্তাদের কাছে ফিরে এল। ওস্তাদ তার নিজের এপার্টমেন্টে একটা চেয়ারে বসে আছে, হাতে একটা ছোট আয়না, সে এই আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখছে। তার উপরের পাটির একটি দাঁত উধাও হয়ে যাওয়ার পর চেহারার কী পরিমাণ পরিবর্তন হয়েছে সেটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছে।
দবির মিয়া তার কপালের ফোলা অংশে হাত বুলিয়ে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আজকে কী-একটা ঘটনা ঘটল! তিনজন কী-একটা মার খেলাম!”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “সতুর বছরের এক বুড়ির কাছ থেকে এইরকম ধোলাই খেয়েছি–খবরটা ছড়িয়ে গেলে কি আমাদের বিজনেস থাকবে?”
দবির মিয়া বলল, “যদি ইমতিয়াজ সাহেব সময়মতো না আসতেন তা হলে সেই ডেঞ্জারাস মেয়েটা নিশ্চয়ই পুলিশকে খবর দিত!”
কালাচান মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, পুলিশ একবার ধরলে আর উপায় আছে?” দবির মিয়া শিউরে উঠে বলল, “এইরকম কুফা আমাদের জীবনে আর লাগে নাই!”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের দিন।”
মন্তাজ ওস্তাদ এতক্ষণ কোনো কথা না বলে গভীর মনোযোগ দিয়ে দুইজনের কথা শুনছিল, এইবারে সে মুখ খুলল, বলল, “আসলে বলা যায় আজকের দিনটা হচ্ছে আমাদের জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যের দিন।”
কালাচান এবং দবির মিয়া একসাথে চমকে উঠল, মন্তাজ ওস্তাদ কী বলছে বুঝতে না পেরে দুজনেই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। ওস্তাদ পড়ে-যাওয়া দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচকি করে থুতু ফেলে বলল, “বলা যায় আজকের দিনটা আমাদের সবচেয়ে আনন্দের দিন।”
কালাচান কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “কী বলছেন মন্তাজ ওস্তাদ? আনন্দের দিন? একটা বাচ্চা ছেলে আর মেয়ের সামনে একটা বুড়ি এইভাবে পিটিয়ে আমাদের বেইজ্জতি করল আর সেইটা আমাদের আনন্দের দিন?”
মন্তাজ ওস্তাদ মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
দবির মিয়া ঢোক গিলে বলল, “সহজ একটা অপারেশন করতে গিয়ে মাখিয়ে ফেললাম–বায়নার টাকা পর্যন্ত ফিরিয়ে দিতে হবে। সেইটা আনন্দের দিন?”
“হ্যাঁ।” মন্তাজ ওস্তাদ চোখ ছোট ছোট করে বলল, “হ্যাঁ–সেইটা আনন্দের দিন। সেইটা সৌভাগ্যের দিন।”
কালাচান বলল, “আপনি কী বলছেন আমি তো তার কিছুই বুঝতে পারছি না মন্তাজ ওস্তাদ।”
মন্তাজ ওস্তাদ আয়নায় শেষবার তার দাঁতের গর্তটা লক্ষ করে আয়নাটা সরিয়ে বলল, “তোরা যদি সব জিনিস বুঝতে পারতিস তা হলে তোরা একদিন আমার মতো ওস্তাদ হতে পারতি। কিন্তু তোরা বুঝিস না। তোরা সারাজীবন কালাচান আর দবির মিয়া থেকেয়াবি। চোখ থেকেও তোরা অন্ধ। কান থেকেও তোরা কালা।”
কালাচান এবং দবির মিয়া, তাদের মাথা নেড়ে উৎসুক হয়ে মন্তাজ ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। মন্তাজ ওস্তাদ দুই পাটি দাঁত বের করে দুইজনকে দেখিয়ে বলল, “আমার কোন দাঁতটা পড়েছে?”
কালাচান কিছু না বুঝে বলল, “উপরের পাটির মাঝখানের দাঁতটা।”
“ভেরি গুড। এখন বল বুড়ি ঘুসি মেরেছে কোনখানে?”
কালাচান এবং দবির মিয়া দুজনেই মাথা চুলকাল। দবির মিয়া বলল, “তা তো খেয়াল নাই।”
“সে আমার কোন দিকে ছিল?”
“ডানদিকে।”
“ডানদিক থেকে একজন থুরথুরে বুড়ি একটা ঘুসি মারল আর সামনের একটা দাঁত পড়ে গেল–ব্যাপারটা কী?”
কালাচান আর দবির মিয়া একজন আরেকজনের দিকে তাকায়, কিছু বলতে পারে না। মন্তাজ ওস্তাদ এবারে কালাচানের দিকে তাকিয়ে বলল, “এইবারে কালাচান তুই বল। বুড়ি তোর কোনখানে ঘুসি মেরেছে?”
“ইয়ে মনে হয়–পেটে।”
“আর তুই ব্যথা পেয়েছিস কোনখানে?”
কালাচান কপালে হাত দিয়ে বলল, “মাথায়।
“ভেরি গুড।” মন্তাজ ওস্তাদ এবারে দবির মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইবারে দবির মিয়া তুই বল। তোর নাকের এই অবস্থা কেন?”
দবির মিয়া ইতস্তত করে বলল, “পড়ে গিয়েছিলাম।”
“কেমন করে পড়লি?”
“ইয়ে–তা তো জানি না। কোথায় জানি পা বেঁধে পড়ে গেলাম।”
“তার অর্থ খালি ময়দানে তুই পা বেঁধে পড়ে গেলি।” মন্তাজ ওস্তাদ তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে আবার পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “এখন আমাকে শেষ প্রশ্নটার উত্তর দে। ভেবেচিন্তে উত্তর দিবি–বেকুবের মতো উত্তর দিবি না।”
“জে ওস্তাদ। বলেন–”
“থুরথুরে একটা বুড়ি–যেই বুড়ি ঠিক করে হাঁটতে পারে না, থাবা দিয়ে একটা মশা পর্যন্ত মারতে পারে না, সেই বুড়ি ঘুসি মেরে আমার একটা দাঁত ফেলে দিল সেইটা কেমন করে সম্ভব?”
কালাচান বলল, “সেইটা তো আমারও প্রশ্ন। কী তেলেসমাতি কাণ্ড! কী আচানক ব্যাপার!”
মন্তাজ ওস্তাদ ধমক দিয়ে বলল, “আচানক ব্যাপার বলে শেষ? ব্যাপারটা কী বলবি না?”
দবির মিয়া মাথা চুলকে বলল, “কীভাবে বলব? নিজের চোখে দেখলাম অবিশ্বাস করি কেমন করে?”
মন্তাজ ওস্তাদ একটা রহস্যের ভান করে বলল, “নিজের চোখে দেখলেও অবিশ্বাস করতে হয়। এই চারটা অবিশ্বাসের জিনিস ঘটেছে তার কারণটা কী জানিস?”
“কী ওস্তাদ?”
“তার কারণ হচ্ছে সেই বাসায় আরও একজন ছিল!”
কালাচান আর দবির মিয়া একসাথে চিৎকার করে বলল, “আরও একজন ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায়? আমরা তো দেখলাম না!”
“দেখলে না তার কারণ হচ্ছে তারে চোখে দেখা যায় না।”
দবির মিয়া বুকে হাত দিয়ে বলল, “ইয়া মাবুদ! কী বলেন আপনি ওস্তাদ?”
“আমি ভুল বলি না। আমি ঠিক কথা বলি।”
“একজন মানুষ–তারে চোখে দেখা যায় না–সেইটা কি ভূত? নাকি জিন?”
“সেটা আমি জানি না।” মন্তাজ ওস্তাদ গম্ভীর গলায় বলল, “কিন্তু আমি জানি সেই ছেলে আর মেয়েটা তারে চিনে। তাদের সাথে খাতিরও আছে। তারা মনে হয় দেখতেও পায়”
কালাচান জিজ্ঞেস করল, “দেখতে পায়?”
“হ্যাঁ। মনে নাই মাঝখানে হঠাৎ কে দরজা ধাক্কা দিল–”
“জে ওস্তাদ মনে আছে।”
“দরজা খুলে দেখা গেল কেউ নাই?”
“জে ওস্তাদ।”
“আসলে তখন সেই অদৃশ্য মানুষ এসেছিল। সে এসে ঢোকার পরেই সেই ছেমড়ির সাহস বেড়ে গেল! মনে আছে?
কালাচান এবং দবির মিয়া একসাথে মাথা নাড়ল, “মনে আছে।”
“এখন বুঝতে পেরেছ কেন আজকে আমাদের সৌভাগ্যের দিন? আনন্দের দিন?”
কালাচান মাথা চুলকে বলল, “জে না ওস্তাদ।”
মন্তাজ ওস্তাদ রেগে বলল, “আরে বেকুব, এই সহজ জিনিসটাও বুঝিস না! এই অদৃশ্য মানুষের কথা জানে খালি সেই ছেমড়া আর ছেমড়ি! তাদের দুইজনরে ধোকা দিয়ে আমরা অদৃশ্য মানুষরে ধরে আনব!”
“কী বলেন ওস্তাদ?”
“হ্যাঁ। তারপরে বিজনেস। একটা অদৃশ্য মানুষ কত টাকায় বিক্রি হবে জানিস? বিক্রি করার আগে শো করা হবে। সার্কাসে সার্কাসে দেখানো হবে। দশ লাখ মানুষ দুইশ টাকা টিকিট দিয়ে দেখতে আসবে–”
দবির মিয়া মাথা চুলকে বলল, “যারে দেখা যায় না তারে কেমন করে দেখবে?”
“আরে গাধা যেটা দেখা যায় সেইটা কি পয়সা দিয়ে কেউ দেখতে আসে? যেটা দেখা যায় না মানুষ সেইটাই পয়সা দিয়ে দেখে।” মন্তাজ ওস্তাদ তার দাঁতের ব্যথা ভুলে গিয়ে দুলে দুলে হাসতে লাগল।
কালাচান জিজ্ঞেস করল, “অদৃশ্য মানুষরে কেমন করে ধরবে ওস্তাদ?”
মন্তাজ ওস্তাদ মাথায় টোকা দিয়ে বলল, “চিন্তাভাবনা করে। এইবারে কোনো ভুল যেন না হয়।”
“হবে না ওস্তাদ।”
“কাজ শুরু করার আগে দরকার খোঁজখবর। একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে বাসার সামনে রেখে সেখান থেকে এই বাসার উপরে খোঁজখবর রাখতে হবে। বাসার ভিতরে গোপন মাইক্রোফোন রেখে কথাবার্তা শুনতে হবে”।
দবির মিয়া দাঁত বের করে হেসে বলল, “একেবারে হলিউডের সিনেমার মতন!” মন্তাজ ওস্তাদ দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “হলিউডের সিনেমাও এইবারে ফেইল মারবে। আমরা হব হলিউডের সিনেমার বাপ!”
১২. কিডন্যাপ
কাবিল কোহকাফী খাবার টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে কলা খাচ্ছে। খেতে খেতে বলল, “আরেকবার পড়ো দেখি টুশি।”
টুশি বলল, “এক জিনিস কতবার পড়ব?”
কাবিল কোহকাফী কলায় একটা কামড় দিয়ে বলল, “আহ্! পড়ো না একবার!”
টুশি আর তপু স্কুল থেকে এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে এসে দেখে বাসায় চাচা বা চাচি নেই। কাবিল কোহকাফী ডাইনিং-টেবিলে বসে কলা খাচ্ছে। আজকাল প্রায় প্রত্যেক দিনই তার কোথাও-না-কোথাও একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়, পরদিন সেটা খবরের কাগজে ছাপা হয়। টুশিকে পরদিন তাকে সেটা পড়ে শোনাতে হয়।
টুশি পড়তে শুরু করল, “দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাত ছলিম গ্রেফতার। গতকাল দুপুরবেলা মতিঝিলে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে ছলিম নামে একজন দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাত ধরা পড়েছে। খবরে প্রকাশ অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সে প্রায় এগারো লক্ষ টাকা নিয়ে পলায়ন করার সময় হঠাৎ করে ফুটপাথে আছাড় খেয়ে পড়ে। সে উঠে দৌড়াতে শুরু করার পর আবার আছাড় খেয়ে পড়ে। ব্যাংকের সামনে তার সহযোগীরা গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত ছিল এবং মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুট স্থান অতিক্রম করতে গিয়ে এই দুর্ধর্ষ ডাকাত ছলিম ক্রমাগত আছাড় খেয়ে পড়তে থাকে এবং তখন পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে।
“দুর্ধষ ব্যাংক ডাকাত ছলিম পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি করার সময় জানায় যে তার মনে হচ্ছিল পায়ের ভেতর অন্য কেউ পা প্রবেশ করিয়ে তাকে ফেলে দিচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় কেউ সেখানে উপস্থিত ছিল না।
“সংবাদদাতা একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার পর ডাক্তার বলেছেন এটি সম্ভবত মাংশপেশি এবং স্নায়ুর একটি দুরারোগ্য রোগ। রোগটি সংক্রামক হতে পারে সন্দেহ করে এই দুর্ধর্ষ ডাকাত ছলিমকে হাজতে আলাদা করে রাখা হয়েছে বলে জানানো হয়।
“পুলিশ সূত্র জানায় এ ব্যাপারে জোর তদন্ত চলছে।”
টুশি পড়া শেষ করে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকাল–কাবিল কোহকাফী তখন দুলে দুলে হাসছে। তৃতীয় কলাটাতে একটা কামড় দিয়ে বলল, “তোমরা যদি ছলিম ডাকাতের অবস্থাটা দেখতে তা হলে হাসতে হাসতে মারা যেতে!”
টুশি বলল, “আচ্ছা কাবিল কোহকাফী, মানুষকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া ছাড়া তুমি আর অন্য কিছু করতে পার না?”
“অন্য কী?”
টুশি একটু ইতস্তত করে বলল, “আমরা আরব্য রজনীতে পড়েছি জিনেরা আরও কত কী করতে পারে! আকাশে উড়তে পারে। বড় হতে পারে ছোট হতে পারে। মানুষের ইচ্ছাপূরণ করতে পারে।”
“কে বলেছে পারি না। আমিও পারি।”
“তা হলে সেগুলো করে দেখাও না কেন?”
“কী দেখতে চাও?”
“যেমন মনে করো–” টুশি হঠাৎ ইতস্তত করে থেমে যায়।
তপু বলল, “আমি বু-বুঝেছি আপু কী চায়!”
কাবিল তপুর দিকে তাকাল, “কী চায়?”
“টু-টুশি আপু মনে করে তার চেহারা বেশি ভালো না, সেইজন্যে চেহারাটা সু-সুন্দর করতে চায়!”
কাবিল কোহকাফী হা হা করে হেসে উঠল। টুশি একটু রেগে উঠে বলল, “কী হল, তুমি হাসছ কেন? এইটা কি হাসির ব্যাপার?”
কাবিল মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ এইটা হাসির ব্যাপার। কারণ চেহারার মাঝে ভালো আর খারাপ নাই। মানুষ ভালো হলে চেহারাটা ভালো লাগে, মানুষ খারাপ হলে তার চেহারাটাও খারাপ লাগে।”
টুশি কঠিন মুখ করে বলল, “যাক আর বড় বড় কথা বলতে হবে না। তুমি বলো আমার চেহারা তুমি ভালো করে দিতে পারবে কি না।”
“চেহারার পরিবর্তন তো আমাদের জন্যে ডালভাত। আমরা জিনেরা হচ্ছি এর এক্সপার্ট। ভালো চেহারা খারাপ করে দিতে পারি। ভালো ঠ্যাং লুলা করে দিতে পারি। ভালো চোখ কানা করে দিতে পারি”।
“এইগুলো তো সবাই পারে! তুমি উলটোটা পার কী না বলো। লুলা ঠ্যাং ঠিক করতে পার? কানা চোখ ভালো করতে পার? খারাপ চেহারা ভালো করতে পার?”
কাবিল কোহকাফী মাথা চুলকে বলল, “পারার কথা! তোমরা তো জান জিন হচ্ছে খুব উঁচু পর্যায়ের একটা ব্যাপার। আমাদের অনেক ক্ষমতা!”
“ওহ্!” টুশি অধৈর্য হয়ে বলল, “তুমি সোজাসুজি বলে দাও না–আমার চেহারাটা তুমি ভালো করে দিতে পারবে কি না!”
কাবিল কোহকাফী ইতস্তত করে বলল, “মনে হয় পারব।”
টুশি সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কেন? মনে হয় কেন? তুমি শিওর না কেন?”
“কারণ এইসব কাজকর্মের জন্যে অনেক প্র্যাকটিস করতে হয়। কেউ বেশি পারে, কেউ কম পারে।”
তপু জিজ্ঞেস করল, “তুমি বেশি পার না কম পার?”
“আমি?” কাবিল কোহকাফী একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি–মানে আসলে হয়েছে কি-শাহজাদি দুনিয়ার পিছনে ঘুরোঘুরি করে ইয়ে মানে”।
টুশি মাথা নেড়ে বলল, “তার মানে তুমি পার না। তুমি হচ্ছ অপদার্থ জিন। লাফাংরা।”
“লাফাংরা?”
“হ্যাঁ। লাফাংরা মানে হচ্ছে ফালতু।”
কাবিল কোহকাফী রেগে গিয়ে বলল, “আমি মোটেও লাফাংরা না। প্রত্যেক দিন পত্রিকায় আমার উপর খবর বের হয়।”
“সেটাতে তোমার কোনো কেরানি নাই। মানুষ অদৃশ্য হলে এগুলো করতেই পারে। যে-কেউ পারবে। আমি অদৃশ্য হলে আমিও করতে পারব।” টুশি মুখ শক্ত করে বলল, “যদি পার তা হলে আমার চেহারাটা ঠিক করে দাও।”
কাবিল কোহকাফী টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “ঠিক আছে! আমি যদি জিনের বাচ্চা জিন হই, কোহকাফ নগরের আগুন দিয়ে যদি আমার শরীর তৈরি হয়ে থাকে তা হলে এক সপ্তাহের মাঝে তোমার চেহারাকে আমি আগুনের খাপরার মতো সুন্দর করে দেব!”
তপু জিজ্ঞেস করল, “আ-আগুনের খাপরা?”
“হ্যাঁ। তোমার গায়ের রং হবে বেদানার মতো, ভুরু হবে ধনুকের মতো, চোখ। হবে ভ্রমরের মতো, দাঁত হবে মুক্তার মতো–”
টুশি লজ্জা পেয়ে বলল, “এত কিছুর দরকার নাই। শুধু দেখে যেন কেউ নাক না সিঁটকায়, তা হলেই হবে।”
তপু জিজ্ঞেস করল, “তু-তুমি কেমন করে করবে?”
“একটা জিন জীবনে কমপক্ষে একটা জাদু করতে পারে। আমি সেই জাদুটা করব!”
“কীভাবে ক-করবে?”
“আসল সোলেমানি জাদু নামে একটা বই আছে। দুই হাজার বছর আগের বই। সেই বইটা যোগাড় করতে হবে। সেইখানে জিনদের সব জাদুর কথা লেখা আছে।”
“কী কী জাদু আছে সেখানে?”
“সবরকম জাদু। মানুষকে কীভাবে টিকটিকি বানাতে হয়। লোহাকে কীভাবে সোনা বানাতে হয়। আকাশে কীভাবে উড়তে হয়। অত্যাচারী রাজাকে কীভাবে শাস্তি দিতে হয়। সবকিছু আছে।”
“কীভাবে অ-অদৃশ্য হতে হয় সে-সেটা লেখা আছে?”
কাবিল কোহকাফী মাথা চুলকে বিমর্ষ হয়ে বলল, “সেটা মনে হয় নাই।”
“কেন নাই?”
“কারণ এইটা অনেক বড় জাদু। সবাই পারে না।”
টুশি জিজ্ঞেস করল, “তা হলে তুমি অদৃশ্য হয়ে আছ কেমন করে?”
“আমাকে অনেক বড় জাদুকর বাণ মেরে অদৃশ্য করে রেখেছে। শাহজাদি দুনিয়ার নানি ছিল আসল ডাইনি বুড়ি। শাহজাদি দুনিয়া যখন ট্রিক্স করে আমাকে বোতলের মাঝে ভরে দিল–সেই ডাইনি বুড়ি তখন বোতলের মুখ লাগিয়ে বাণ মেরে দিয়েছে!”
“তা হলে তোমাকে কখনও কেউ দেখবে না?”
কাবিল কোহকাফী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কেউ যদি সেই বাণ ছুটাতে পারে তা হলে দেখবে।”
টুশি জিজ্ঞেস করল, “সেই বাণ কেমন করে ছোটাবে?”
“ডাইনি বুড়ি সেটা জানি কোথায় লিখে রেখেছে।”
“কোথায়?”
“সেটা তো জানি না। শাহজাদি দুনিয়া অনেক অনুরোধ করল তখন মন্ত্রটা লিখে দিল।”
তপু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা-তা হলে তোমাকে আর কেউ কখনও দে-দেখবে না?”
কাবিল কোহকাফী মুখ কালো করে বলল, “নাহ্।”
টুশি জিজ্ঞেস করল, “তা হলে আমরা দুইজন কেমন করে দেখি?”
কাবিল কোহকাফী মাথা চুলকে বলল, “সেইটা আমি জানি না। মনে হয় আমি যখন বোতল থেকে বের হই তখন সেই ধোঁয়া তোমাদের নাকে গেছে। মনে হয় সেই ধোঁয়া যাদের নাকে যায় তারা দেখতে পায়?”
যুক্তিটা টুশির খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না, কিন্তু সে সেটা নিয়ে আপত্তিও করল না।
তপু কথা বলতে বলতে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে কিছু-একটা দেখে ভালো করে দেখার জন্যে পরদা তুলে তাকাল। টুশি জিজ্ঞেস করল, “কী দেখিস?”
“একটা মা-মাইক্রোবাস।”
“মাইক্রোবাসে দেখার কী আছে?”
“না, কেমন জানি স-সন্দেহ হচ্ছে।”
“কী সন্দেহ?”
“কয়েকবার এদিক ঘু-ঘুরেছে। এখন রাস্তার পা-পা-পাশে দাঁড়িয়ে আছে! প পরদা দিয়ে ঢাকা। ভেতরে কে দে-দে-দেখা যায় না।”
টুশি হাত দিয়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ধুর! ঢাকা শহরে কয় হাজার মাইক্রোবাস আছে তুই জানিস?”
টুশির কথা সত্যি। ঢাকা শহরে আসলেই কয়েক হাজার মাইক্রোবাস আছে। তবে এটি ছিল একটি বিশেষ মাইক্রোবাস। এর ভিতরে মন্তাজ ওস্তাদ, কালাচান। আর দবির মিয়া ছাড়াও আরও দুইজন মানুষ ছিল। শুধু মানুষ নয়, টুশিদের বাসাটাকে চোখে-চোখে রাখার জন্যে এই মাইক্রোবাসটা যন্ত্রপাতিতে বোঝাই করা ছিল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তপু জানতেও পারল না দামি ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে ঠিক সেই মুহূর্তে তার ভিডিও করে কম্পিউটারে সেটা বিশ্লেষণ করা শুরু করে দেয়া হয়েছে!
পরদিন যে-খবরটি কাবিল কোহকাফীকে পড়ে শোনাতে হল সেটি ছিল এরকম :
নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা
“গতকাল মতিঝিলের একটি ব্যস্ত সড়কে একটি শিশু নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জানা যায় যে একটি শিশু হঠাৎ করে রাস্তা পার হওয়ার জন্যে দৌড় দিয়ে একটি চলন্ত ট্রাকের সামনে পড়ে যায়। ট্রাক ড্রাইভার তার চলন্ত ট্রাক থামাতে সক্ষম না হলেও শিশুটি সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে ট্রাকের তলা থেকে রাস্তার একপাশে চলে আসে। শিশুটি জানায় তার মনে হয়েছে যে কোনো-একজন মানুষ তাকে টেনে রাস্তা থেকে সরিয়ে এনেছে যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা সেখানে কোনো মানুষ দেখে নি।
এই অলৌকিক ঘটনার পর শিশুটি “পিচ্চি পীর” নামে পরিচিত হয়েছে এবং স্থানীয় মানুষেরা তার থেকে পানি পড়া নেয়ার জন্যে ভিড় জমাচ্ছে। শিশুটির পিতা তার সন্তানের জন্যে একটি খানকায়ে শরিফ স্থাপনের জন্যে ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন।”
.
এর পরের দিন যে-খবরটি কাবিল কোহকাফীকে পড়ে শোনাতে হল সেটি এরকম :
পুলিশ সার্জেন্ট নাজেহাল
“গতকাল মহাখালি এলাকায় একজন পুলিশ সার্জেন্টকে অত্যন্ত বিচিত্র উপায়ে নাজেহাল হতে দেখা গেছে। খবরে প্রকাশ এই পুলিশ সার্জেন্ট একটি চলমান ট্রাককে থামিয়ে প্রকাশ্যে ট্রাক ড্রাইভারের নিকট থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে। ট্রাকটি চলে যাবার পর পুলিশ সার্জেন্ট সরে যাওয়ার চেষ্টা করে রাস্তার উপর পড়ে যায়। সে কিছুতেই হাঁটতে পারছিল না এবং তাকে ঘিরে একটি ভিড় জমে যায়।
পুলিশ সার্জেন্টকে ধরাধরি করে রাস্তার পাশে নিয়ে যাবার পর দেখা যায় তার জুতোর দুটি ফিতা গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে সে হাঁটতে পারছিল না।
কে কীভাবে তার জুতোর ফিতায় গিঁট দিয়েছে সেটি এখনও রহস্যাবৃত তবে ঘটনাটি এই এলাকায় কৌতুকের সৃষ্টি করেছে।”
.
এর পরের দিন কাবিল কোহকাফীকে যে খবরটি পড়ে শোনানো হচ্ছিল, সেটি এরকম :
স্কুলছাত্রীর সাহসিকতা
স্কুলছাত্রীকে উত্যক্ত করার কারণে কীভাবে সে কিছু বখাটে ছাত্রকে তুলোধুনা করেছে সেই খবরটি যখন মাত্র পড়তে শুরু করেছে ঠিক তখন টুশি শুনতে পেল কে যেন দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে।
টুশি এবং তপু মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যায়। দরজায় মন্তাজ ওস্তাদ, কালাচান এবং দবির মিয়া। মন্তাজ ওস্তাদের হাতে একটা রিভলবার, দবির মিয়ার হাতে একটা কাটা রাইফেল এবং কালাচান একটা বড় বস্তা ধরে রেখেছে। টুশি কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারল না, হাঁ করে এই তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। তপু বলল, “ততা-তো-তোমরা? পু-পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে?”
মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “না, ছাড়ে নাই।”
“তা হলে?”
“তোমার বাবা খুব বুদ্ধিমান মানুষ। তাই আমাদেরকে পুলিশে দেয় নাই। পুলিশের সাথে আমাদের খুব খাতির, পুলিশ আমাদের কখনও ধরে না।”
টুশি চোখের কোনা দিয়ে একবার কাবিলকে দেখল, কাবিল কোহকাফী যতক্ষণ ঘরে আছে তাদের কোনো ভয় নেই। সে চোখ পাকিয়ে বলল, “তোমরা কেন বাসায় এসেছ? এক্ষুনি বের হয়ে যাও।”
মন্তাজ ওস্তাদ চোখ টিপে বলল, “না গেলে কী করবে খুকি?”
“আগেরবার তো মাত্র একটা দাঁত ভাঙা হয়েছিল–এবার সবগুলো দাঁত ভেঙে দেয়া হবে।”
মন্তাজ ওস্তাদ এগিয়ে এসে খপ করে টুশির ঘাড় ধরে নিজের কাছে টেনে এনে তার মাথার কাছে রিভলবারটা ধরে বলল, “বেয়াদপ মেয়ে, বড়দের সাথে কেমন করে কথা বলতে হয় কেউ শেখায় নি?”
টুশি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। ততক্ষণে কালাচান তার বস্তা নিয়ে চলে এসেছে। বস্তা খুলতেই টুশি দেখল তার ভেতরে মুড়ি। এক বস্তা মুড়ি নিয়ে এই মানুষটি এখানে কেন এসেছে টুশি বুঝতে পারল না। সে অবাক হয়ে। দেখল কালাচান মুড়িগুলো মেঝেতে ঢালতে শুরু করেছে এবং দেখতে দেখতে সারা মেঝে মুড়িতে ঢেকে গেল!
টুশি অবাক হয়ে এই মানুষগুলোর কাজকর্ম দেখছিল–তার মাকে মন্তাজ ওস্তাদ তার মাথার পিছনের চুল ধরে তার মুখটি নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, “বেয়াদপ মেয়ে–তোমার এই কালা কুচ্ছিৎ চেহারা নিয়ে তো তোমার মনে খুব দুঃখ। আমি কী করব জান?”
টুশি অবাক হয়ে মন্তাজ ওস্তাদের দিকে তাকাল–সে কেমন করে জানে যে চেহারা নিয়ে তার মনে দুঃখ? মন্তাজ ওস্তাদ তার ফোকলা দাঁত দিয়ে পিচিক করে একটু থুতু ফেলে বলল, “আমি এখন রিভলবারের বাঁট দিয়ে তোমার নাকটা ভেঙে ফেলব। তোমার কুৎসিত চেহারা তখন আরও কুৎসিত হয়ে যাবে!”
টুশি ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “ছাড়ো আমাকে ছাড়ো বলছি।”
মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তোমাকে রেডি হওয়ার একটু সময় দিচ্ছি। আমি বলব ওয়ান টু থ্রি তারপর মারব তোমার নাকে। ঠিক আছে
টুশি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু মানুষটার হাত লোহার মতো শক্ত, কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারে না। মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “ওয়ান।”
কাবিল কোহকাফী এতক্ষণ চুপ করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে সে টুশিকে বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে এল। ঠিক তখন হঠাৎ করে টুশি মুড়ির রহস্য বুঝতে পারল। এই মানুষগুলো কাবিলকে দেখতে পায় না কিন্তু হাঁটার সময় মুড়িতে পা দিলে তার পায়ের চাপে মুড়িগুলো গুঁড়ো হয়ে যায় তারা সেই গুঁড়ো হয়ে যাওয়া মুড়ি দেখে বুঝতে পারে কাবিল কোথায় আছে। তিনজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল এবং কাবিল ঠিক কোনদিক দিয়ে টুশির কাছে এগিয়ে আসছে বুঝতে পারল। টুশি সাবধান করার জন্যে চিৎকার করে বলল, “না–কাবিল না–”
কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। কালাচান এবং দবির মিয়া হঠাৎ করে একসাথে কোথা থেকে দুটি রঙের ক্যান বের করে আনে, কিছু বোঝার আগে তারা নিখুঁতভাবে কাবিলের দিকে লক্ষ্য করে সেই রঙের ক্যানে চাপ দিয়ে রং স্প্রে করে দেয়। টুশি অবাক হয়ে দেখল মুহর্তে কাবিলের সারা মুখ হাত-পা স্প্রে ক্যানের রঙে। মাখামাখি হয়ে গেল। সাথে সাথে মন্তাজ ওস্তাদ টুশিকে ধাক্কা দিয়ে রিভলবারটা কাবিলের দিকে ধরে বলল, “কাবিল কোহকাফী, তুমি মানুষটা অদৃশ্য হতে পার– কিন্তু তোমার চোখে-মুখে হাতে যে রং লেগেছে সেটা আমরা দেখছি! একটু নড়লেই তোমাকে আমি গুলি করব।”
কাবিল তার পরেও নড়ার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে কালাচান এবং দবির মিয়া দুইপাশ থেকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
টুশি এবং তপু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে কিন্তু তার ভিতরে তিনজন মিলে কাবিল কোহকাফীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল।
টুশি খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছুটে যেতে চাইছিল কিন্তু দবির মিয়া তাকে ধরে ফেলল। কিছু বোঝার আগে তপু এবং টুশি এই দুজনকেও দুটি চেয়ারে বেঁধে ওদের মুখে মন্তাজ ওস্তাদ সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে দিল। ঘরের হুটোপুটি শুনে বাইরে কেউ এসেছে কি না সেটা সাবধানে পরীক্ষা করে, পকেট থেকে অ্যালকোহলের বোতল বের করে তুলো দিয়ে ভিজিয়ে কাবিল কোহকাফীর চোখ মুখের সব রং মুছে নেয়। তাকে পুরোপুরি অদৃশ্য করে মানুষ তিনজন যেভাবে এসেছিল সেভাবে এবারে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
সন্ধেবেলা চাচা-চাচি বাসায় এসে আবিষ্কার করলেন ঘর-বোঝাই মুড়ি এবং তার মাঝে টুশি এবং তপু চেয়ারে বাঁধা। তারা ছুটে এসে তাদের খুলে দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
টুশি কিছু বলল না। তপু কঠিন মুখে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বন্ধুরা এসেছিল আব্দু।”
চাচা অবাক হয়ে বললেন, “আমার বন্ধুরা?”
“হ্যাঁ। সেদিন যে তিনজনকে আমরা ধরেছিলাম তারা আজকে আবার এসেছে। বলেছে তারা তোমার বন্ধু।”
চাচার মুখ হাঁ হয়ে গেল, তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “ম-ম-মন্তাজ ওস্তাদ?”
তপু এতটুকু তোতলাল না, বলল, “হ্যাঁ। তারা বলেছে তুমি তাদেরকে পুলিশে দেও নাই।”
চাচা তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “কে-কে-কেন এসেছিল?”
তপু বলল, “আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? তোমার বন্ধুদের তুমি কেন জিজ্ঞেস কর না?”
টুশি অবাক হয়ে তপুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার কথায় তোতলামির কোনো চিহ্ন নেই।
চাচা কিছু-একটা বলার চেষ্টা করছেন–কিন্তু ঠিক বলতে পারছেন না, টুশি সেটা শোনার চেষ্টাও করছে না।
তার শুধু কাবিল কোহকাফীর কথা মনে পড়ছে। কোথায় আছে কাবিল কোহকাফী? কেমন আছে কাবিল কোহকাফী?
১৩. পরিকল্পনা
পরের দুই সপ্তাহে টুশি এবং তপু খুব বড় একটা জিনিস আবিষ্কার করল, সেটা হচ্ছে। পৃথিবীর সব মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগের নাম হচ্ছে ছোট মানুষ, অন্য ভাগের নাম হচ্ছে বড় মানুষ। ছোট মানুষদের বড় মানুষের সব কথা শুনতে হয় কিন্তু বড় মানুষেরা ছোট মানুষের কোনো কথাই শোনে না।
কাবিল কোহকাফীকে ধরে নিয়ে যাবার পর কী করবে বুঝতে না পেরে টুশি আর তপু অনেক চিন্তাভাবনা করে একদিন পুলিশকে ফোন করল। মোটা গলার স্বরে একটা মানুষ বলল, “হ্যালো।”
টুশি বলল, “এটা কি পুলিশের অফিস?”
মোটা গলার মানুষটা বলল, “কার সাথে কথা বলতে চাও খুকি?”
“পুলিশের সাথে।”
মোটা গলার মানুষটি তখন একটা ঢেকুর তুলল। তুলে বলল, “কেন কথা বলতে চাও?”
টুশি বলল, “একজন মানুষ কিডন্যাপ হয়েছে সেটা রিপোর্ট করতে চাই।”
টুশি ভেবেছিল সেটা শুনে পুলিশ অফিসার চমকে উঠে বলবে, “কে কিডন্যাপ হয়েছে? কখন কিডন্যাপ হয়েছে? কীভাবে কিডন্যাপ হয়েছে?” কিন্তু সেরকম কিছু হল না, মানুষটা এবারে আরেকটা ঢেকুর তুলে বলল, “ও আচ্ছা। বেশ বেশ। খুকি এখন তো আমরা খুব ব্যস্ত–তুমি পরে ফোন কর।”
টুশি অবাক হয়ে বলল, “পরে ফোন করব?”
“হ্যাঁ। তুমি না করে তোমার আব্বাকে ফোন করতে বলো। ঠিক আছে? আর খুকি–এখন যাও, তুমি পড়াশোনা করতে যাও।”
টুশি টেলিফোনটা রেখে কিছুক্ষণ দাঁত কিড়মিড় করে ঘরের ভেতর পা দাপদাপি করল। তপু বলল, “টুশি আপু, প-পত্রিকায় ফোন করো।
তখন খবরের কাগজ দেখে টেলিফোন নাম্বার বের টুশি সেখানে ফোন করল। পুলিশের ওখানে ফোন ধরেছিল খুব মোটা গলার একজন পুরুষমানুষ। এখানে ফোন ধরল খুব মধুর গলার একজন মেয়ে, বলল, “হ্যালো।”
টুশি বলল, “আমরা একটা কিডন্যাপ রিপোর্ট করতে চাই।”
“ভেরি গুড। খুকি তুমি একটু ধরো।”
এরপর কিছুক্ষণ বাজনা শোনা গেল তারপর একজন মানুষ নাকি গলায় বলল, “এ্যালো। ছোটদের পাতা–”
“আমরা একটা কিডন্যাপ রিপোর্ট করতে চাই।”
মানুষটা নাকি গলায় বলল, “বেরি গুঁড। বেঁরি গুঁড। এ ফোর কাগজে ডাবল স্পেস দিয়ে লিখে পাঠিয়ে দাও।”
“লিখে পাঠিয়ে দেব?”
“এ্যা। সুন্দর দেখে একটা নাম দিও। কিডন্যাপারের শাস্তি। কিংবা দুষ্ট কিডন্যাপার। ইচ্ছা করলে একটা উঁড়াও দিতে পার।”
“ছড়া?”
“এ্যা। বিও পাঠাতে পার। রঙিন জেঁয়োন দিয়ে আঁকবে। বেরি গুঁড।”
টুশি আমতা-আমতা করে বলল, “আমরা ছড়া কিংবা ছবি পাঠাতে চাই না। সত্যিকারের একটা কিডন্যাপ হয়েছে সেটা রিপোর্ট করতে চাই। আপনাদের পত্রিকায় সেটা ছাপাবেন।”
উত্তরে নাকি গলায় মানুষটা ঘোড়ার মতো শব্দ করে হাসল, “ইহ হি হি হি “
টুশি তখন রেগেমেগে ফোনটা রেখে দিল।
তপু বলল, “আপু অন্য পত্রিকায় ফো-ফোন করো।”
তখন দুজনে মিলে খোঁজাখুঁজি করে আরেকটা পত্রিকা অফিসে ফোন করল। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর একজন মানুষ টেলিফোন ধরে বলল, “হ্যালো।”
টুশি এবারে গলার স্বর একটু মোটা করে বড় মানুষের মতো ভঙ্গি করে বলার চেষ্টা করল, “দেখেন আমি খুব জরুরি একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাই। কার সাথে কথা বলব?”
“একটু ধরেন”
টুশি এবারে একটু ভরসা পায়, মানুষটি তাকে আপনি করে বলছে। খানিকক্ষণ পর আরেকজন ফোন ধরে বলল, “বার্তা-সম্পাদক–
টুশি আবার গলার স্বর একটু মোটা করে বড় মানুষদের মতো করে বলল, “আমরা আপনাদের কাছে একটা কিডন্যাপিং রিপোের্ট করতে চাই।”
“পুলিশকে জানানো হয়েছে?”
“পুলিশকে জানিয়েছিলাম তারা শুনতে রাজি হয় নাই।”
“হুম।” বার্তা-সম্পাদক বলল, “কে কিডন্যাপ হয়েছে? আপনার কী হয়?”
টুশি ইতস্তত করে বলল, “আমাদের কেউ না। মানুষটা মানে ইয়ে আসলে”।
“কত বয়স?”
“এ-এক হাজার”।
“কী বললেন? এক হাজার? আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?”
টুশি তাড়াতাড়ি বলল, “না-না-না ঠাট্টা করছি না। আসলে হয়েছে কি ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক। যাকে কিডন্যাপ করেছে সে আসলে অদৃশ্য–”
উত্তেজনার কারণে টুশি গলার স্বর মোটা রাখতে ভুলে গেল–আর অন্য পাশের মানুষটা রেগে গিয়ে বলল, “শোনো মেয়ে, আমরা খুব ব্যস্ত মানুষ, তোমার ইয়ার্কি করার অনেক সময় থাকতে পারে, আমাদের এরকম জিনিস নিয়ে নষ্ট করার সময় নেই।”
টুশি ব্যস্ত হয়ে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি কথা বলছি। সবকিছু শোনেন তা হলে বুঝতে পারবেন।”
বার্তা-সম্পাদক বলল, “এক হাজার বছরের অদৃশ্য মানুষের কিডন্যাপিং হওয়ার খবর ছাপানোর কিছু ট্যাবলয়েড পত্রিকা আছে। সেখানে ফোন করো, তারা তোমার ইন্টারভিউ পর্যন্ত ছাপিয়ে দেবে।”
টুশি উত্তরে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বার্তা-সম্পাদক খটাশ করে টেলিফোন রেখে দিয়েছে। টুশির যা মেজাজ খারাপ হল সেটি আর বলার মতো নয়।
.
পুলিশ আর পত্রিকার সাথে বেশি সুবিধে করতে না পেরে টুশি আর তপু শেষ পর্যন্ত একদিন চাচা-চাচিকে ব্যাপারটা খুলে বলার চেষ্টা করল। সকালবেলা সবাই নাস্তা করছে, তখন টুশি বলল, “চাচা, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”
“কী কথা?”
“আপনার মনে আছে, একরাতে আমি আর তপু বাসায় একা একা ছিলাম?”
চাচা ভুরু কুঁচকে বললেন, “হ্যাঁ, কী হয়েছে তখন?”
“সকালবেলা বাসায় এসে আপনি একটা অদৃশ্য জিনিসের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলেন, মনে আছে?”
চাচা সরু চোখে বললেন, “আমি কোনো অদৃশ্য জিনিসের সাথে ধাক্কা খাই নি। আমি ডাক্তারকে দেখিয়েছি, ডাক্তার বলেছে মাইল্ড স্ট্রোকের মতো। ব্লাডপ্রেশার খুব বেশি ছিল বলে–”
“না, চাচা। ব্লাডপ্রেশার না, আপনি আসলে একটা অদৃশ্য মানুষের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলেন। ঠিক মানুষ না, জিন। একটা শিশি থেকে বের হয়েছে।”
চাচা একটা কথাও না বলে চোখ বড় বড় করে টুশির দিকে তাকিয়ে রইলেন, খানিকক্ষণ কোনো শব্দ নেই। চাচা খুব সাবধানে চাচির দিকে একবার তাকালেন তারপর আবার টুশির দিকে তাকালেন তারপর আবার চাচির দিকে তাকালেন। চাচি ভুরু দিয়ে একটা ইঙ্গিত করলেন যার অর্থ “এই-মেয়ে-পাগল-একে-ঘাঁটিও না।” চাচা তখন টুশির দিকে তাকিয়ে মুখে একটা অত্যন্ত মধুর হাসি ফুটিয়ে বললেন, “অবশ্যই শিশি থেকে বের হয়েছে। জিন যদি শিশি থেকে বের না হয় তা হলে কি মশা বের হবে?”
টুশি একটুকু অস্থির হয়ে বলল, “চাচা আপনি বিশ্বাস করছেন না? আমি সত্যি কথা বলছি। তা-ই নারে তপু?”
তপু মাথা নাড়ল, চাচি মাথা নাড়লেন এবং চাচাও মাথা নাড়লেন। চাচা জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “কে বলেছে আমি বিশ্বাস করছি না? আমি অবশ্যই বিশ্বাস করেছি। অদৃশ্য জিন তো থাকতেই পারে। জিন যদি অদৃশ্য না হয় তা হলে কে অদৃশ্য হবে? তা হলে কি মানুষ অদৃশ্য হবে?”
টুশি হঠাৎ করে কেমন যেন হাল ছেড়ে দেয়। চাচা-চাচি কোনোভাবেই এটা বিশ্বাস করবেন না, লাভের মাঝে লাভ হল যে চাচা-চাচি তাকে একটা পাগল ভেবে নিলেন।
টুশি আবিষ্কার করল চাচা আর চাচি ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে তার দিকে তাকাচ্ছেন, কে জানে এখন তাকে জোর করে একটা পাগলা-গারদে ভরতি না করে দেন। টুশি কী করবে বুঝতে পারল না, রাগে-দুঃখে তার নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল।
.
এই ঘটনার দুইদিন পর খবরের কাগজ খুলে টুশি আর তপু স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। খবরের কাগজের ভিতরে পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে বিজ্ঞাপন, সেখানে বড় বড় করে লেখা :
অদৃশ্য দানব! অদৃশ্য দানব!! অদৃশ্য দানব!!!
বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে বড় অলৌকিক ঘটনা। নিজের চোখে দেখুন, ইতিহাসের অংশ হোন। মানুষরূপী একটি ভয়ংকর রক্তপিপাসু হিংস্র প্রাণী সম্প্রতি ধরা পড়েছে। এই প্রাণীটি পুরোপুরি অদৃশ্য–তাকে প্রথমবারের মতো মঞ্চে নিয়ে আসা হচ্ছে।
নিজের চোখে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় অলৌকিক ঘটনাটি দেখুন। এই অদৃশ্য দানবের উপর বিশেষ প্রতিবেদন আজকে রাত সাড়ে আটটায় টেলিভিশনে।
টিকিটের জন্যে অবিলম্বে যোগাযোগ করুন।
.
টুশি আর তপু অনেকক্ষণ কথা বলতে পারে না। তপু শেষ পর্যন্ত বলল, “কা কাবিল কোহকাফী মোটেই ভ-ভয়ংকর না।”
টুশি মাথা নাড়ল, “না।”
“অনেক ভালো।”
“হ্যাঁ। অনেক ভালো আর সুইট।”
তপু মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কেন লি-লিখেছে অনেক ভ ভয়ংকর? অনেক হি-হিংস্র?”
টুশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মনে হয় কী জানিস? তাকে তো বেঁধে রেখেছে সেইজন্যে লিখেছে হিংস্র, লিখেছে রক্তপিপাসু। ভালো মানুষকে কি বেঁধে রাখা যায়?”
তপু বলল, “ঠি-ঠিক বলেছ।”
“তা ছাড়া হিংস্র বললে, কেউ কাছে আসবে না। বদমাইশগুলো নিশ্চয়ই চায় না কেউ কাছে আসুক। নিশ্চয়ই চায় সবাই দূর থেকে দেখুক।”
“ইশ! বেচারা কা-কাবিল কোহকাফী! এখন কী হবে?”
টুশি খুব দুশ্চিন্তিত মুখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কিছু-একটা করতে হবে। সাহায্য করার জন্যে আমাদের যেতে হবে।”
“ কিন্তু কে-কেমন করে যাব? ক-কত টাকা টিকেট দেখেছ?”
“যত টাকাই হোক যেতে হবে।”
“টা-টাকা কোথায় পাবে?”
“আমার নানা ট্রাস্ট করে আমার জন্যে টাকা রেখে গেছে, সেখান থেকে নেব।”
তপু মুখ শুকনো করে বলল, “কিন্তু তা-তারপর কী হবে?”
টুশি বলল, “দেখি কী করা যায়। কিছু-একটা আমাদের করতেই হবে।”
.
রাত্রিবেলা টুশি আর তপু টেলিভিশনে অদৃশ্য-দানবের ওপর বিজ্ঞাপনটি দেখল। ছোট এক মিনিটের বিজ্ঞাপন। প্রথমে মন্তাজ ওস্তাদ কীভাবে সুন্দরবন অভিযানে গিয়ে সেখানে জলের ভেতর থেকে এই ভয়ংকর হিংস্র প্রাণীটা ধরেছে সেটা নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে দুই-একটা কথা বলল। তারপর একটা খচা নিয়ে আসা হল–তার ভেতরে নাকি অদৃশ্য দানব। তখন হিংস্র জন্তুর গর্জন শোনা যেতে লাগল, ভয়ের ছবিতে যেরকম ভূত-প্রেত-দানব দেখা যায় সেরকম ভয়ংকর কিছু দাপাদাপি করল, ভয়-পাওয়া মানুষের আতঙ্ক এবং চিৎকার শোনা গেল। তারপর একজন সুন্দরী মেয়ে এসে বলল, “এই আদিম ভয়ংকর রক্তপিপাসু হিংস্র দানবটিকে আপনারা দেখতে পারবেন প্রদর্শনী শোতে। এই দেখাঁটি আপনারা ভুলতে পারবেন না– কারণ প্রাণীটি অ-দৃশ্য!”
টুশি রিমোট চেপে টেলিভিশনটি বন্ধ করে দিয়ে বলল, “কত বড় বদমাইশ! কাবিল কোহকাফী হচ্ছে একটা সুইট জিন। আর তাকে বানিয়েছে হিংস্র দানব।”
“কেউ তো দে-দেখতে পায় না তাই।”
টুশি তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি সবাই দেখতে পারত তা হলে আর কেউ বদমাইশি করতে পারত না।”
তপু টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা যদি সেই ম-মন্ত্রটা খুঁজে বের করতে পারতাম!”
“কোন মন্ত্রটা?”
“যেটা বললে কা-কাবিলের বাণ কেটে যাবে!”
টুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটা আমরা কোথায় পাব! কত হাজার বছর আগের কথা!”
তপু টুশির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু।”
“কী হল?”
“তুমি ও-ওষুধের শিশি দেখেছ?”
“দেখেছি। কেন?”
“ওষুধের শি-শিশির উপরে স-সবসময় লেখা থাকে ক-কখন খেতে হয়, সেরকম তার বোতলটিতে কি কা-কাবিল কোহকাফীর উপর লে-লেখা আছে?”
টুশি বলল, “কিছু লেখা থাকলে কি চোখে পড়ত না?”
“কিন্তু আমরা তো ভা-ভালো করে দেখি নাই।”
টুশি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আয় তা হলে ভালো করে দেখি।”
টুশি আর তপু কাবিল কোহকাফীর শিশিটা বের করে খুব ভালো করে দেখল। শিশিটা মনে হয় পাথরের তৈরি, বেশ ভারী। ছিপিটা ভেঙে খোলা হয়েছে, সেটা মনে হয় কোনো একটা ধাতুর তৈরি। এত বছর পরেও ধাতুটিতে জং ধরে নি– কাজেই মনে হয় খুব ভালো কোনো ধাতু হবে! টুশি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কোনোকিছু না পেয়ে তপুর হাতে দিল। তপু টেবিল-ল্যাম্পের নিচে ধরে ভালো করে দেখে হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, “আ-আপু।”
“কী হয়েছে?”
“মনে হয় উপরে কিছু লেখা আছে–”।
“কোথায়?”
“এই দ্যাখো-খুব হালকা, বো-বোঝা যায় না এরকম।”
টুশিও এসে দেখল, খুব ভালো করে তাকালে মনে হয় সত্যিই কিছু-একটা লেখা আছে। খুব অস্পষ্ট লেখা। টুশি বলল, “মনে হয় এক হাজার বছরের ময়লা লেগে এই অবস্থা। পরিষ্কার করে নিই।”
“কী দিয়ে প-পরিষ্কার করবে আপু?”
“নেল পালিশ রিমুভার।”
ছোট একটা টিসু পেপারে চাচির নেলপালিশ রিমুভার লাগিয়ে টুশি পাথরের শিশিটা ঘষতেই বাদামি রঙের ময়লা উঠে নিচের লেখা পরিষ্কার বের হয়ে এল। তপু হাতে কিল দিয়ে বলল, “পেয়ে গেছি! লে-লেখা পেয়ে গেছি!”
টুশি বলল, “আগেই এত খুশি হয়ে যাস নে।”
“কেন?”
“লেখাটা আগে দ্যাখ।”
তপু দেখল এবং সমস্যাটা বুঝতে পারল। লেখাটি কোনো পরিচিত ভাষায় লেখা নয়। আরবির মতো–কিন্তু আরবি নয়। জিজ্ঞেস করল, “কী ভাষা এটা?”
“জানি না।”
“তা-তা হলে পড়ব কেমন করে?”
টুশি মাথা নেড়ে বলল, “সেটাও জানি না।”
দুজনে মিলে খানিকক্ষণ জল্পনা-কল্পনা করল। মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে পড়িয়ে নেয়া যায় কি না আলোচনা করল কিন্তু তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। ইউনিভার্সিটিতে অনেক জ্ঞানীগুণী থাকে তাদের কাছে নিয়ে গেলে হয়তো কেউ-একজন এটা পড়ে দিতে পারে কিন্তু সেখানে কার কাছে নিয়ে যাবে তারা। বুঝতে পারল না। মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া যায়, সেখানকার কিউরেটর হয়তো বলতে পারবে। কিন্তু ছোট মানুষ বলে তাদের কোনো পাত্তা দেবে বলে মনে হয় না। লাইব্রেরিতে অনেক বইপত্র থাকে, সেখানে গিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে হয়তো এটা কোন ভাষা বের করে ফেলতে পারবে। কিন্তু সেই ভাষাটা শিখে ওপরের লেখাটা পড়তে পারবে বলে মনে হয় না। টুশি এবং তপু নূতন করে ছোট থাকার সমস্যাটা বুঝতে পারল, তারা যদি বড় মানুষ হত কিংবা কোনো একজন বড় মানুষের সাথে তাদের পরিচয় থাকত তা হলে হয়তো এই সমস্যাটার সমাধান বের করে ফেলত। যখন দুজনে প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন তপু চোখ বড় বড় করে বলল, “আপু”।
“কী হল?”
“ই-ই-ইন্টারনেট!”
“ইন্টারনেট?”
“হ্যাঁ।” তপু উত্তেজিত হয়ে বলল, “ই-ইন্টারনেটে খোঁজ করি–সে-সেখানে হয়তো খোঁজ পাওয়া যাবে।”
টুশি হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস!” পরমুহূর্তে চিন্তিত হয়ে বলল, “কিন্তু ইন্টারনেট পাব কোথায়?”
“ম-মনে নাই” তপু হড়বড় করে বলল, “স্কুলে যা-যাবার সময় রা-রাস্তায় একটা সা-সাইবার কাফে আছে?”
টুশি আবার হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস।”
পরমুহূর্তে আবার সে চিন্তিত হয়ে বলল, “কিন্তু এই শিশিটা ইন্টারনেটে কেমন করে পাঠাব?”
“শিশিটাতো পা-পাঠানো যাবে না। শিশির উপরের লে-লেখাটা স্ক্যান করে পা-পাঠাব।”
টুশি আবার হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস! আয় তা হলে কাজ শুরু করে দিই।”
একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুব সাবধানে পরীক্ষা করে টুশি আর তপু শিশির উপরের লেখাটা প্রথমে একটা কাগজে লিখে নিল। তারপর দুজন ছুটলো। সাইবার কাফের দিকে।
টুশি আর তপু এর আগে কখনও সাইবার কাফেতে আসে নি। কী করে কী করতে হয় দুজনের কেউই জানে না। সাইবার কাফের কর্মচারীটি তাদের দুজনকে একটা কম্পিউটারের আসনে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল, দুজনে মিলে যখন কী-বোর্ড আর মাউস নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে তখন পাশের কম্পিউটারে বসে থাকা এলোমেলো চুলের তেরো-চোদ্দ বছরের টিশার্ট পরা একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী করছ?”
টুশি এবং তপু দুজনেই একটু সন্দেহের চোখে ছেলেটার দিকে তাকায়। কিন্তু ছেলেটা সেটা লক্ষ করল বলে মনে হল না, গলা নামিয়ে বলল, “এই সাইবার কাফে মহা গিরিংগিবাজ–কী করতে চাও যদি না জান হলে ছিল খেয়ে যাবে।”
টুশি আর তপু কিছু বলল না। ছেলেটা তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মেশিনের মতো কি-বোর্ডে কিছু-একটা টাইপ করতে করতে বলল, “তোমরা নূতন মক্কেল। কোন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করছ?”
“না মানে”
ছেলেটা বাম হাত দিয়ে মাউস ক্লিক করে কিছু-একটা ঘটিয়ে দিয়ে বলল, “কী করতে চাও?”
টুশি তখন কাগজটা বের করে সেই বিচিত্র লেখাটা দেখিয়ে বলল, “এইখানে কী লেখা সেটা বের করতে চাই!”
টুশি নিশ্চিত বড় কোনো মানুষকে এই কথা বললে সে হয় হা হা করে হেসে উঠত নাহয় ধমক দিয়ে বসত। কিন্তু টিশার্ট পরা এলোমেলো চুলের ছেলেটা তার কিছুই করল না, মুখটা ছুঁচালো করে বলল, “ভেরি ইন্টারেস্টিং। এনক্রিপশান প্রবলেম। তিনটা ইউজার গ্রুপ আছে তার মাঝে দুইটা সুপার।”
টুশি আর তপু কী বলবে বুঝতে পারল না। ছেলেটা কাগজটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানাদিক থেকে দেখে বলল, “কোথায় পেয়েছ?”
“এটা একটা খুব পুরানো ভাষায় লেখা।”
ছেলেটা চোখ কপালে তুলে বলল, “কসম?”
টুশি বলল, “কসম।”
ছেলেটা এবারে চোখ ঘুরিয়ে বলল, “মাইয়ারে মাইয়া।”
কথাটার মানে কী টুশি কিংবা তপু কেউই বুঝতে পারল না বলে দুজনেই চুপ করে রইল। ছেলেটা কম্পিউটারে খুটখাট করতে করতে বলল, “তোমাদের ই মেইল অ্যাড্রেস আছে?”
তপু মাথা নাড়ল, “না–নাই।”
“এই লেখাটা স্ক্যান করেছ?”
তপু মাথা নাড়ল, “না।”
“যাও, আগে স্ক্যান করিয়ে আনো। আমি ততক্ষণে তোমাদের একটা ই-মেইল অ্যাকাউন্ট খুলে দিই।”
টিশার্ট পরা উশকো-খুশকো চুলের ছেলেটা থাকার কারণে আধা ঘণ্টার মাঝে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ভাষায় বিশেষজ্ঞ এরকম অনেক মানুষের কাছে এই লেখাটা পাঠানো হয়ে গেল। ছেলেটা বলল, যদি কেউ এর সমাধান বের করতে পারে তা হলে আজ কালকের মাঝেই তাদের সেটা জানিয়ে দেবে। টুশি আর তপুকে সাইবার কাফেতে এসে প্রত্যেক দিন তাদের ই-মেইল পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোনো উত্তর এসেছে কি না।
সত্যি কথা বলতে কি কোনো উত্তর চলে আসবে সেটা টুশি কিংবা তপু কেউই একেবারে আশা করে নি। তাই পরের দিন স্কুল থেকে আসার সময় যখন সাইবার কাফেতে গিয়ে তাদের ই-মেইল এসেছে কি না পরীক্ষা করতে গেল তখন তারা অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি চারটা ই-মেইল চলে এসেছে। প্রথম ই-মেইলটাতে লেখা :
“তোমরা যে লেখাটি পাঠিয়েছ আমি সেটা সম্পর্কে পরিচিত নই। লেখার গঠনভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এটা প্রাচীন হিব্রু ভাষায় একটি অপভ্রংশ।” দ্বিতীয় ই-মেইলটাতে লেখা :
“তোমাদের লেখাটি দেখে মনে হচ্ছে এটি পঞ্চদশ শতাব্দীতে তাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে-ওঠা একটি সভ্যতার লিপি। এই লিপিটি বর্তমানে মৃত। তোমরা কোথায় এটি পেয়েছ জানার জন্যে খুব আগ্রহী। তৃতীয় ই-মেইলটাতে লেখা :
“তোমাদের পাঠানো ই-মেইলে সংযুক্ত লিপিটি পেয়ে আমি চমৎকৃত হয়েছি। এটি অধুনালুপ্ত কিফুস ভাষার লিখনলিপি। আমি দীর্ঘদিন থেকে এই ভাষার উপরে গবেষণা করছি। এখানে লেখা : কাবিল তুমি দুই হস্ত প্রসারণ করে মস্তিষ্ক নত করো, উচ্চারণ করে উচ্চকণ্ঠে, মাগারুফাস মাগারুফাস এবং মাগারুফাস। এই লিপিটি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছ আমাকে জানাও। আমাদের জাতীয় মিউজিয়াম এর প্রকৃত কপিটি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হবে।”
চতুর্থ ই-মেইলটি পাঠিয়েছে একজন বদমেজাজি প্রফেসর, সে লিখেছে : “ভবিষ্যতে আমাকে এই ধরনের আজেবাজে জিনিস পাঠালে মাথা ভেঙে দেব। দূর হও হতভাগা সকল।”
অন্য তিনটি ই-মেইল পেয়ে টুশি আর তপু এত খুশি হয়ে গেল যে বদমেজাজি প্রফেসরের ই-মেইলটির জন্যে তারা কিছু মনে করল না। যিনি এই রহস্যময় লেখাটার অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন টুশি আর তপু তাঁকে বিশাল লম্বা একটা চিঠিতে সবকিছু লিখে পাঠাল। মানুষটা নিশ্চয়ই কিছু বিশ্বাস করবেন না কিন্তু টুশি আর তপু সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। অন্য যে-দুজন তাদের কাছে ই-মেইল পাঠিয়েছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ দিয়ে সাথে সাথে উত্তর পাঠিয়ে দিল।
বদমেজাজি প্রফেসরকেও তারা একটা ই-মেইল পাঠাল, সেখানে লিখল :
“হে বদমেজাজি প্রফেসর জন্মের সময় তোমার মা কি তোমার
মুখে মধু দিতে ভুলে গিয়ে আলকাতরা দিয়েছিল?”
তারপর তারা ছুটল বাসায়। কাবিল কোহকাফীকে অদৃশ্য থেকে উদ্ধার করার মন্ত্র তারা এখন পেয়ে গেছে!
১৪. অদৃশ্য দানব
অনেক মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢোকার একটা লম্বা লাইন সেই লাইন ধরে মানুষেরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরে বিশাল একটা পোস্টার সেখানে ভয়ংকর একটা ছবি। বিশাল একটা দানব শেকল দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, দানবটি শেকল ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করছে, পারছে না। দানবটির মুখে হিংস্র এবং পৈশাচিক হাসি। ছবিটি দেখেই আত্মা শুকিয়ে যায়।
টুশি আর তপু লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। তপু ফিসফিস করে বলল, “ছ ছবিটা দেখেছ আপু?”
“দেখেছি।”
“কা-কাবিল কোহকাফী মোটেই দে-দেখতে এরকম না।”
“হ্যাঁ। কাবিল কোহকাফী কত সুইট!”
তপু টুশির হাত ধরে বলল, “আপু।”
“কী হল?”
“আমরা কি কা-কাবিল কোহকাফীকে উদ্ধার করতে পা-পারব?”
টুশি জোর গলায় বলল, “একশবার পারব। না পারার কী আছে?”
টুশি মনে-মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে তপুকে সাহস দেবার জন্যে অনেক জোর দিয়ে বলেছে একশবার পারবে, না পারার কী আছে! কিন্তু আসলে সে ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পাচ্ছে। তার পেটের ভেতরে কেমন যেন পাক দিচ্ছে। যতবার পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করছে ততবার ভয়ে তার হাত-পা শরীরের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে। মন্তাজ ওস্তাদ, কালাচান আর দবির মিয়ার মতো খারাপ খারাপ মানুষগুলো এখানে আছে। তারা টুশিকে আর তপুকে চেনে, যদি তাদের দেখে ফেলে তখন কী হবে? কাবিল কোহকাফীকে নিশ্চয়ই খুব কড়া পাহাড়ায় শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। তপুকে নিয়ে সে কেমন করে সেখানে যাবে? যদি যেতেও পারে তাকে কি সে মন্ত্রটা বলতে পারবে? যদি বলতেও পারে কাবিল কোহকাফী কি তার কথা শুনতে পাবে?
টুশির শরীর কেমন জানি শক্ত হয়ে যায়–জোর করে সে মনের ভেতর থেকে সবকিছু দূর করে দিতে চেষ্টা করল।
গেটে টিকিট দেখিয়ে টুশি আর তপু ভেতরে ঢুকল। হোটেলের বিশাল বলরুমে আয়োজন করা হয়েছে। সামনে বিশাল স্টেজ। স্টেজ লাল ভেলভেটের পরদা দিয়ে ঢাকা। হলঘরের ভেতরে বেশ ঠাণ্ডা, কুলকুল করে এয়ার কন্ডিশনের বাতাস বইছে। ভেতরে আবছা অন্ধকার দেখে টুশি একটু স্বস্তি পেল, মন্তাজ ওস্তাদ আর তার খারাপ খারাপ সাঙ্গোপাঙ্গগুলো তা হলে তাদের দেখতে পাবে না।
ভেতরে সুন্দর কাপড় পরা অনেক মানুষ, তারা টিকিট পরীক্ষা করে সবাইকে তাদের সিটে বসাচ্ছে। টেলিভিশনের লোকজন ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। তারা এখন দর্শকদের দিকে ক্যামেরা তাক করে রেখেছে। যদি হঠাৎ করে তাদের ছবি উঠে যায়, টেলিভিশনে সেটা দেখান হয়–আর চাচা-চাচি সেটা দেখে ফেলেন তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। টুশি আর তপু মিলে অনেকরকম কায়দা-কানুন করে মিথ্যে কথা বলে এখানে এসেছে। চাচা-চাচিকে বুঝিয়েছে তার বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে যাচ্ছে–একা একা যেতে ইচ্ছে করছে না বলে তপুকে নিয়ে যাচ্ছে। ধরা পড়ে গেলে কী হবে কে জানে।
টুশি আর তপুর সিট ইল সামনের দিকে। তারা দুজনে নিজের সিটে গিয়ে বসল। টুশি ফিসফিস করে তপুকে জিজ্ঞেস করল, “বোতলটা আছে তো?”
তপু পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিশ্চিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ আছে।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই টুশি আর তপু কাবিল কোহকাফীর বোতলটা সাথে। করে নিয়ে এসেছে। বোতলের উপরে মন্ত্রটা লেখা–সেই মন্ত্র বলার সময় যদি বোতলটা কাছাকাছি থাকে তা হলে কে জানে হয়তো মন্ত্রের জোর আরও বেশি হবে।
তপু কিছুক্ষণ উসখুস করে বলল, “আপু, আমরা ক-কখন ভেতরে যাব?”
টুশি ঘড়ি দেখে বলল, “বেশি আগে যেয়ে কাজ নেই। মানুষের ভিড় আরেকটু বাড় ক।”
তপু জিজ্ঞেস করল, “কো-কোনদিক দিয়ে যাব আপু?”
স্টেজের দুইপাশে দুটি সিঁড়ি ভিতরে ঢুকে গেছে–সেদিক দিয়ে ছাড়া আর যাওয়ার জায়গা নেই। টুশি দেখাল, “ঐ যে ওদিক দিয়ে।”
“যদি আমাদের ধ-ধরে ফেলে?”
“ধরলে ধরবে। দুইজন দুইদিক দিয়ে যাবে। একজন কোনোভাবে ঢুকে যাব, বুঝলি? ভিতরে ঢুকে কাবিল কোহকাফীর খাঁচার কাছে গিয়ে বলব, “মাথা নিচু হাত উঁচু মাগারুফাস মাগারুফাস মাগারুফাস, মনে আছে তো?”
“হ্যাঁ। ম-মনে আছে।”
পরদা ওঠার পর যখন সবাই দেখবে কাবিল কোহকাফী বসে আছে–অদৃশ্য না ছাই তখন বদমাইশগুলো আচ্ছা মতন জব্দ হবে।”
তপু মাথা নাড়ল, “জ-জ-জব্দ হবে।”
টুশি উত্তেজিত গলায় বলল, “বুঝলি তপু এই বদমাইশগুলোর বিজনেসের। আসল ব্যাপারটাই হচ্ছে অদৃশ্য একজন মানুষ। কিন্তু যদি দেখা যায় মানুষটা অদৃশ্য না তা হলেই বিজনেসের বারোটা বেজে যাবে।”
তপু মাথা নাড়ল, “বা-বারোটা বেজে যাবে।”
টুশি মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, বিশাল হলঘর মানুষে ভরে যাচ্ছে। বড় বড় মানুষেরা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। যারা বড় তাদের চোখেমুখে একধরনের অবিশ্বাসের হাসি, ছোটরা খুবই উত্তেজিত। যারা একটু বেশি ছোট তারা ভয় পেয়ে তাদের বাবা-মাকে ধরে রেখেছে। ঠিক এরকম সময় একটা ভয়ের মিউজিক বাজতে শুরু করল, উপস্থিত সবাই তখন নড়েচড়ে বসে।
টুশি ঘড়ি দেখে বলল, “চল এখন।”
তপু বলল, “আমার ভ-ভয় করছে আপু।”
টুশি তপুর ঘাড়ে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “ভয়ের কী আছে? কুলহু আল্লাহ্ পড়ে বুকে একটা ফুঁ দে দেখবি ভয় চলে যাবে।”
তপু বিড়বিড় করে কুলহু আল্লাহ্ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে স্টেজের দিকে এগুতে থাকে। সামনে এখনও কিছু মানুষ হাঁটাহাটি করছে। কাজেই আলাদা করে কেউ তাদের লক্ষ করল না। উইংসের সামনে একজন মানুষ পাহারা দিচ্ছে, মানুষটি দুইজন দর্শককে কী-একটা বোঝাচ্ছে, সেই ফাঁকে টুশি আর তপু চট করে ভিতরে ঢুকে গেল। বিশাল একটা উইংস তার পিছনে আবছা অন্ধকার, সেখানে নিজেদের আড়াল করে রেখে তারা একটা নিশ্বাস ফেলল।
উইংসের আড়াল থেকে স্টেজটাকে দেখে তারা হতবাক হয়ে যায়। বিশাল স্টেজ তার মাঝামাঝি একটা বড় খাঁচা, সেটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। কাবিল কোহকাফীকে নিশ্চয়ই এর ভেতরে বেঁধে রাখা আছে। খাঁচার দুই পাশে খুব জমকালো সেট তৈরি করা হয়েছে। দেখে মনে হয় সেটা বুঝি বিশাল একটি অরণ্য। তার পিছনে প্রাসাদের মতো একটা ঘর–দেখে মনে হয় পুরোটা বুঝি একটা রূপকথার রাজ্য। পেছনে বিশাল স্ক্রিনে বড় বড় করে লেখা–
পৃথিবীর এক এবং অদ্বিতীয়
সবচেয়ে আশ্চর্য এবং সবচেয়ে ভয়ংকর
অদৃশ্য দানব!
স্টেজের দুই পাশে বিশাল কিছু স্পিকার, একেবারে ছাদ পর্যন্ত চলে গেছে। বেশ কয়েকজন মানুষ মিলে সেগুলো পরীক্ষা করছে। মাঝে মাঝেই সেগুলো গুম গুম শব্দ করছে, মনে হয় শব্দে ছাদ ধসে পড়বে। স্টেজের জন্যে নানারকম আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, নানা রঙের স্পটলাইট ঝুলছে, স্টেজের দুই পাশেও অনেক মানুষ বড় বড় স্পটলাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে লাইট জ্বলছে এবং নিভছে। সুন্দর সুন্দর কাপড় পরা সেজেগুজে থাকা কয়েকজন পুরুষ এবং মহিলা খুব ব্যস্ত হয়ে স্টেজের উপর হাঁটাহাঁটি করছে। তারা নিশ্চয়ই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবে। টুশি এবং তপু অবাক হয়ে এই ব্যস্ততা এবং হইচই দেখতে থাকে, এত মানুষের ভিড়ের মাঝে কোথাও তারা মন্তাজ ওস্তাদ কালাচান কিংবা দবির মিয়াকে দেখতে পেল না। তারা হচ্ছে গুণ্ডা এবং সন্ত্রাসী, এই অনুষ্ঠানে সেজন্যে তারা নেই, হয়তো গ্রিনরুমে কোথাও বসে আছে।
তপু জিজ্ঞেস করল, “আপু এখন কী-ক-করব?”
টুশি স্টেজটা ভালো করে পরীক্ষা করে ফিসফিস করে বলল, “প্রথমে লুকিয়ে এক দৌড়ে ঐ সেটের পিছনে যেতে হবে। তা হলে কেউ দেখতে পাবে না। তারপর সেটের পিছন দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খাঁচার কাছে যাব।”
তপু বলল, “যদি ধ-ধ-ধরা পড়ে যাই?”
“ধুর গাধা! ধরা পড়বি কেন?” টুশি তপুকে সাহস দিয়ে বলল, “লাইটটা যখন কমাবে তখন মাথা নিচু করে একটা দৌড় দিবি। সোজা সেটার দিকে।”
“তু-তুমি আসবে না?”
“আসব কিন্তু একসাথে না। দুইজন আলাদা আলাদা, যেন ধরা পড়লেও একজন ধরা পড়ি। বুঝেছিস?”
তপু বলল, “বু-বুঝেছি।”
দূজন কয়েক মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, স্টেজের লাইটিং পরীক্ষা করতে করতে একসময় আলোগুলো নিবুনিবু করেছে তখন টুশি তপুর পিঠে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “যা।”
তপু তখন নিচু হয়ে একছুটে উইংস থেকে একটা বিশাল কার্ডবোর্ডের গাছের নিচে আড়াল হয়ে গেল। টুশি কয়েক মুহূর্ত নিশ্বাস বন্ধ করে থাকে কেউ দেখতে পায় নি। টুশি যদি নাও যেতে পারে কিংবা ধরাও পড়ে যায় তা হলেও এখন ক্ষতি নেই, তপু হামাগুড়ি দিয়ে কাবিল কোহকাফীর কাছে পৌঁছে যেতে পারবে।
টুশি আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল, আবার যখন স্পটলাইটের আলোটা ঘুরে অন্যদিকে চলে গেল টুশি মাথা নিচু করে একছুটে সেটের আড়ালে চলে গেল তাকেও কেউ দেখতে পায় নি। টুশি কিছুক্ষণ বড় বড় নিশ্বাস নেয় তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকে, ঠিক তখন একটা বিপর্যয় ঘটে গেল।
স্টেটাকে সাজানোর জন্যে যে বড় বড় সেট তৈরি করা হয়েছে সেগুলো কাঠের ফ্রেম ব্যবহার করে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। দেখে সেগুলোকে বিশাল বড় মনে হলেও আসলে এগুলো তৈরি হালকা কার্ডবোর্ড দিয়ে। টুশি সেটা বুঝতে পারে নি-পিছন থেকে একটার ওপর হালকাভাবে হেলান দিতেই তাকে নিয়ে পুরোটা হুড়মুড় করে স্টেজের ওপর পড়ে গেল–সাথে সাথে হইচই চেঁচামেচি চিৎকার শুরু হয়ে যায়। টুশি শুনতে পেল, একজন বলল, “বাবারে গেছিরে!”
কয়েকজন দৌড়ে এল তার কাছে। একজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কেমন করে পড়ল?”
যার মাথার উপর পড়েছে সে কোকাতে কোকাতে বলল, “জানি না। এত করে বললাম শক্ত করে পেরেক মার–”
“মেরেছি তো শক্ত করে।”
অন্যজন ধমক দিয়ে বলল, “শক্ত করে মারলে এইভাবে মাথার মাঝে খুলে পড়ে?”
আরেকজন বলল, “পিছনে গিয়ে দ্যাখ কী হয়েছে।”
টুশি বুঝতে পারল কয়েকজন মানুষ ব্যাপারটা দেখতে আসছে। সে তাড়াতাড়ি অন্য একটা কার্ডবোর্ডের গাছের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু তার আগেই একজন তাকে দেখে চিৎকার করে বলল, “আরে! আরে! এইখানে এই মেয়ে কোথা থেকে এসেছে?”
টুশি ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে কিছুই হয় নি এরকম ভান করে তার ফ্রক ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে এল। লিকলিকে চিকন একজন মানুষ খপ করে তার হাত ধরে বলল, “এই মেয়ে? তুমি এখানে কী করছ?”
টুশি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “আমার ইঁদুরের বাচ্চা–”
‘ইঁদুরের বাচ্চা?”
“হ্যাঁ, আমার পোষা একটা ইঁদুরের বাচ্চা আছে। হঠাৎ হাত থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল। এদিকে কোথায় জানি লুকিয়েছে।”
মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। একজন বলল, “তুমি তোমার ইঁদুরের বাচ্চা নিয়ে এখানে এসেছ?”
টুশি দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমার পোষা ইঁদুর, সবসময় আমার সাথে থাকে।”
“সেইজন্যে তুমি এখানে এসে সব ভেঙেচুরে ফেলছ?” মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, “তোমার বাবা-মা কোথায়?”
টুশি অনির্দিষ্ট একটা ভঙ্গি করে বলল, “ঐ তো ওখানে।”
একজন বলল, “যাও, ভাগো এখান থেকে।”
আরেকজন বলল, “আজকালকার ছেলেপিলে যে কী পাজি চিন্তাও করা যায় না। সাহস কত বড়–এখানে ঢুকে গেল!”
মানুষগুলো তার গল্প বিশ্বাস করেছে টুশি তাই আরও একটু চেষ্টা করল, “কিন্তু আমার ইঁদুর?”
লিকলিকে মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, “তোমার ইঁদুরের খেতা পুড়ি। ভাগে” তারপর একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে স্টেজ থেকে বাইরে নিয়ে যেতে থাকে। টুশি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, এতক্ষণে তপু নিশ্চয়ই কাবিল কোহকাফীর কাছে। পৌঁছে গেছে–তাকে তার মন্ত্রটাও বলে দিয়েছে। কাবিল কোহকাফীকে যখন দেখানো হবে তখন সবাই দেখবে নাদুস-নুদুস একজন ভালো মানুষকে এরা ধরে বেঁধে রেখেছে! অদৃশ্য মানবের পুরো ব্যাপারটাই তখন একটা ঠাট্টা হয়ে যাবে এরা সবাই পাবলিকের যা একটা মার খাবে সেটা আর বলার মতো নয়।
পোষা ইঁদুরকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে এরকম মন খারাপের ভঙ্গি করে টুশি হাঁটতে থাকে ঠিক তখন ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটে গেল। টুশি তাকিয়ে দেখে স্টেজের এক পাশ থেকে মন্তাজ ওস্তাদ এবং দুই পাশে কালাচান আর দবির মিয়া তার দিকে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। টুশি তখন ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে এক দৌড়ে বাইরে চলে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, কালাচান আর দবির মিয়া দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলেছে। মন্তাজ ওস্তাদ হুংকার দিয়ে বলল, “এই মেয়ে এখানে কোথা থেকে এসেছে?”
লিকলিকে মানুষটা হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, “ফালতু মাইয়া-ইন্দুরের পিছনে পিছনে চলে আসছে!”
মন্তাজ ওস্তাদ হিংস্র মুখে বলল, “ফালতু মাইয়া? তুমি জান এইটা কে?”
লিকলিকে মানুষটা আমতা-আমতা করে বলল, “কে?”
“এই মেয়ে তোমাকে দশবার কিনে দশবার বিক্রি করে দিতে পারবে। এর মতো ধুরন্ধর মানুষ আমি আমার জন্মে দেখি নাই”
“কী বলছেন আপনি?”
“হ্যাঁ।” মন্তাজ ওস্তাদ কঠিন মুখে বলল, “এই মেয়ে কেন এসেছে জান?”
“কেন?”
“আমাদের অদৃশ্য দানবকে ছুটিয়ে নেবার জন্যে।”
“কীভাবে নেবে?”
“সেইটা তোমার ব্রেনে ধরবে না–তাই বোঝার চেষ্টাও কোরো না।”
লিকলিকে মানুষটার মনে হল একটু অপমান হল, সে কিছু-একটা বলতে চাইছিল কিন্তু মন্তাজ ওস্তাদ তাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে তার দুই সাগরেদকে বলল, “কালাচান, দবির মিয়া”
“জে?”
“এই মেয়েকে যদি এখানে পাওয়া যায় তার অর্থ কী জানিস?”
“কী?”
“তার অর্থ এইখানে সেই তোতলা পিচ্চিটাও আছে। এক্ষুনি খুঁজে বের কর।”
লিকলিকে মানুষটা চোখ কপালে তুলে বলল, “তোত পিচ্চি?”
“হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি যা খাঁচার কাছে–নিশ্চয়ই সেখানে আছে। দৌড়া-”
একসাথে তখন অনেকে দৌড়ে গেল খাঁচার দিকে।
.
তপু যখন হামাগুড়ি দিয়ে কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা খাঁচাটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ করে কার্ডবোর্ডের গাছটা স্টেজে ভেঙে পড়েছে। তপু ভয়ে চমকে উঠল, সাথে সাথে বুঝতে পারল টুশি এখন ধরা পড়ে যাবে কাজেই যা। করার তার নিজেরই করতে হবে। ভয় তার বুকের ভিতর একটা কাঁপুনি দিয়ে গেল। নিজেকে শান্ত করে তপু তাড়াতাড়ি আরও একবার কুলহু আল্লাহ পড়ে নিজের বুকে ফুঁ দিয়ে নেয় তারপর হামাগুড়ি দিয়ে খাঁচাটার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কালো কাপড় তুলে ভেতরে তাকাল, আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল খাঁচার দেয়ালে হেলান দিয়ে কাবিল কোহকাফী বসে আছে। চোখেমুখে একধরনের ভয়ংকর মন খারাপ-করা উদাস ভঙ্গি। কাবিল কোহকাফীর দুই হাত দুই পা এবং গলা শিকল দিয়ে খাঁচার ভেতরে বাঁধা–দেখেই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। তপু ফিসফিস করে ডাকল, “কাবিল কো-কোহকাফী–”
কাবিল কোহকাফী চমকে তপুর দিকে তাকাল, তাকে দেখে হঠাৎ তার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, শিকল পরা অবস্থায় তার দিকে এগিয়ে এস বলল, “আরে তপু! তুমি কোথা থেকে এসেছে?”
তপু হড়বড় করে বলল, “তো-তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি!”
“কেমন করে তুমি উদ্ধার করবে?”
“যে জি-জিনিসটা বললে তো-তোমাকে সবাই দেখতে পাবে সে-সেটা বলতে এসেছি।”
কাবিল কোহকাফী অবাক হয়ে বলল, “সেটা তুমি কেমন করে জান?”
“আমরা বে-বে-বের করেছি। তুমি যে বো-বোতলটার ভেতরে ছিলে, সে সেখানে লেখা ছিল।”
“কী তাজ্জবের ব্যাপার!”
“হ্যাঁ। তু-তুমি সেটা বললেই স-সবাই তোমাকে দেখতে পাবে। ত-ত-তখন তোমাকে আর বেঁধে রা-রা-রাখতে পারবে না!”
কাবিল কোহকাফী আনন্দে তার শিকল ঝাঁকিয়ে বলল, “জবরদস্ত! চমৎকার!”
“হ্যাঁ, তুমি মা-মাথা নিচু করে দু-দু-দুই হাত দুই পাশে রাখো। তারপর বলো “
কাবিল কোহকাফী মাথা নিচু করে দুই হাত দুই পাশে রেখে বলল, “কী বলব?”
“বলো–মা-মা-মাগারুফাস”
কাবিল বলল, “মা-মা-মাগারুফাস।”
তপু বলল, “না, নামা-মা-মাগারুফাস না”
মাগারুফাস বলতে গিয়ে আবার তপুর মুখে কথাটা আটকে গেল, সে বলল, “মা-মা-মাগারুফাস”
কাবিল বলল, “তাই তো বললাম, মা-মা-মাগারুফাস।”
তপু উত্তেজিত হয়ে বলল, “না মা-মা-মাগারুফাস”
হঠাৎ করে সে নার্ভাস হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে সে কোননাভাবেই এখন আর এই ছোট কথাটা ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারবে না। তার পরও সে প্রাণপণে চেষ্টা করল, বলল, “তোমাকে মা-মা-মাত্র তিনবার বলতে হবে। বলবে মা-মা-মাগারুফাস-” আবার তার মুখে কথাটা আটকে গেল। রাগে-দুঃখে তপুর চোখে পানি এসে যায়, সে মেঝেতে পা দাপিয়ে বলল, “আমি ঠি-ঠি-ঠিক করে বলতে পা-পারছি না। মা-মা-মা “
কাবিল বলল, “নার্ভাস হওয়ার কিছু নাই তপু। তুমি ঠাণ্ডা মাথায় আস্তে আস্তে বলো। কোনো তাড়াহুড়া নাই–
তপু বড় করে একটা নিশ্বাস নিল। চোখ বন্ধ করে মনে-মনে সে শব্দটা ঠিক করে উচ্চারণ করল। তখন সে চোখ খুলে যেই বলতে শুরু করল ঠিক তখন দুই পাশ থেকে দুইজন খপ করে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে শূন্যে তুলে ফেলে বলল, “পেয়েছি!”
তপু চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কে যেন তার মুখটা খপ করে ধরে ফেলল, সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্যে ছটফট করতে থাকে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। যারা তাকে ধরেছে তাদের হাত লোহার মতো শক্ত, গায়ে মোষের মতো জোর।
তপু তাকিয়ে দেখল, টুশিকেও মন্তাজ ওস্তাদ ধরে রেখেছে। টুশি তার মাঝেই তপুকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বলল, “তপু–বলেছিস?”
তপু মাথা নেড়ে বলল, “না আপু। বলতে পা-পারি নি।”
টুশির মুখটা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল। বলল, “পারিস নি?”
তপুর চোখে পানি এসে যায়। মাথা নিচু করে বলল, চে-চেষ্টা করেছিলাম। মু মুখে আটকে গেল।”
তপু মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী হবে আপু?” টুশি কোনো কথা না বলে তপুর দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যিই তো–এখন কী হবে?
১৫. বিপত্তি
মন্তাজ ওস্তাদ ছোট গ্রিনরুমটার একপাশ থেকে অন্য পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ফিনিশ করে দিতে হবে।”
দবির মিয়া তার ঘাড়বিহীন মাথা নাড়ল, বলল, “জে ওস্তাদ। ফিনিশ করে দিতে হবে।”
“একেবারে ফিনিশ না করলে বিপদ। এইটুকুন দুইটা পিচ্চি কিন্তু কী ডেঞ্জারাস . দেখেছিস?”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “অসম্ভব ডেঞ্জারাস।”
দবির মিয়া বলল, “কীভাবে ফিনিশ করবেন ওস্তাদ? গুল্লি?”
“উঁহু।” মন্তাজ ওস্তাদ খুব চিন্তিত মুখে বলল, “এমনভাবে ফিনিশ করতে হবে যেন কেউ সন্দেহ না করে।”
কালাচান বলল, “সেইটা কীরকম?”
“দেখে যেন মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট।” “অ্যাক্সিডেন্ট?”
“হ্যাঁ।” মন্তাজ ওস্তাদ বলল, “এইখানে আজকে যারা শো করছে তারা আসল জিনিস জানে না। আসল জিনিস জানি খালি আমরা কয়েকজন। আর জানে এই দুই পিচ্চি। আসল জিনিস জানাজানি হয়ে গেলে কিন্তু আমরা কোনো বিজনেস করতে পারব না।”
কালাচান আর দবির মিয়া একসাথে মাথা নাড়ল।
“কাজেই এমনভাবে এই দুই পিচ্চিরে মার্ডার করতে হবে যেন কেউ বুঝতে না পারে। সবাই যেন মনে করে অ্যাক্সিডেন্ট।”
“সেইটা কীভাবে করবে ওস্তাদ?”
“এই স্টেজে করতে হবে। সবার সামনে। আজকেই।”
“আজকেই?”
“হ্যাঁ। শো শুরু হলেই।”
কালাচান আর দবির মিয়া মাথা চুলকে বলল, “কীভাবে করবে ওস্তাদ?”
“দেখি–আমাকে একটু চিন্তা করতে দে।” মন্তাজ ওস্তাদ তার ফোকলা দাঁত দিয়ে পিচিক করে একবার থুতু ফেলে একটা সিগারেট ধরাল। কালাচান আর দবির মিয়া ধৈর্য ধরে ওস্তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
.
ঠিক এই সময়ে টুশি আর তপু ছোট একটা ঘরে একটা প্যাকিংবাক্সের উপর বসে ছিল। ঘরটিতে কোনো জানালা নেই–নানারকম জঞ্জালে ভরতি। উপরে একটা উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে, সেই আলোতে জঞ্জালভরা এই নোংরা ঘরটাকে দেখে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। তপু বলল, “টু-টুশি আপু, এখন কী হবে?”
টুশির নিজেরও খুব ভয় করছিল, কী হবে সে জানে না, এই মানুষগুলো এত খারাপ যে ভয়ংকর কিছু হতে পারে। টুশি অবশ্যি সেটা তপুকে বুঝতে দিল না। বলল, “কী আর হবে, আমাদেরকে কিছুক্ষণ আটকে রেখে ছেড়ে দেবে।”
“য-যদি না দেয়?”
প্রশ্নটা খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন, কিন্তু টুশি হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “না দেবে কেন? কাবিল কোহকাফীর অনুষ্ঠান শেষ হলেই আমাদেরকে ছেড়ে দেবে।”
তপু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আর কা-কাবিল কোহকাফীর কী হবে?”
টুশি একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, “দেখিস আমরা ঠিক চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলব।”
ঠিক এই সময়ে তারা খুব জোরে জোরে একটা বাজনার শব্দ শুনতে পেল, তার সাথে প্রচণ্ড হাততালি। টুশি বলল, “নিশ্চয়ই পরদা তুলেছে।”
.
টুশির ধারণা সত্যি। ঠিক তখন বিশাল লাল ভেলভেটের পরদা টেনে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, ভেতরে আলো-আঁধারের খেলা। স্টেজে গাছপালা এবং পুরনো একটা প্রাসাদের মতো একটা সেট। মাঝখানে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা লোহার খাঁচা। ঠিক তখন দুই পাশ থেকে দুজন ছুটে স্টেজে এল, একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। তারা মাথা নুইয়ে অভিভাদন করে বলল, “পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর সবচেয়ে বিচিত্র এবং সবচেয়ে ভয়ংকর অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ। আপনারা এখন দেখবেন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে অভাবনীয় সৃষ্টি। অদৃশ্য দানব।”
সবার প্রচণ্ড হাততালির শব্দের মাঝে দুজন কালো পরদাটা সরিয়ে নিতেই বিস্ময়করভাবে সবার হাততালি থেমে গেল কারণ খাঁচার ভিতরে কিছু নেই, শুধু কয়েকটি শিকল ঝুলছে। পুরুষমানুষটি বলল, “আপনারা ভাবছেন এখানে কি সত্যিই কেউ আছে? আমরা যদি দেখতেই না পাই তা হলে বিশ্বাস করব কেমন করে?”
মহিলাটি বলল, “আপনাদের সেই অবিশ্বাস দূর করার জন্যে এই খাঁচার ভেতরে আমরা স্প্রে পেইন্ট করব–অদৃশ্য মানুষের শরীরে সেই ক্ষণস্থায়ী পেইন্ট থেকে আপনারা তাকে দেখবেন–সবচেয়ে ভয়ংকর সবচেয়ে আশ্চর্য এবং সবচেয়ে বিচিত্র এক অদৃশ্য দানব।”
জোরে জোরে বাজনা বাজতে থাকে তখন সুসজ্জিত কিছু মানুষ বাজনার তালে তালে এসে প্রবেশ করে। তাদের পিঠে ব্যাকপেকে পেইন্ট, হাতে স্প্রে করার টিউব। খাঁচার কাছাকাছি এসে তারা ভেতরে উজ্জ্বল লাল রঙের স্প্রে করতে থাকে। হাজার হাজার দর্শক তখন অবাক হয়ে দেখে খাঁচার ভেতরে রক্তের মতো লাল একটি অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই বিচিত্র অবয়ব নড়ছে, ঝাঁঝালো কটু গন্ধের স্প্রে থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে! বাইরে থেকে শেকলে হ্যাঁচকা টান দিতেই সেই বিচিত্র অবয়বটি সোজা হয়ে দাঁড়াল–লাল রঙের পেইন্টে ঢাকা বিচিত্র ভয়ংকর একটি মূর্তি। হাজার হাজার দর্শক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে তারপর বিস্ময়ের একটা ধ্বনি করে প্রচণ্ড হাততালিতে পুরো হলঘরটিকে কাঁপিয়ে দেয়।
কেউ জানতেও পারল না যে-ভয়ংকর অদৃশ্য দানবকে দেখে সবাই ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠেছে, শিকল-বাঁধা অবস্থায় যাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়েছে সেই দানবটি আসলে ছিল একটি অত্যন্ত দুঃখী প্রাণী–গভীর কষ্টে তখন তার বুকটি ভেঙে যাচ্ছিল। তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধের উজ্জ্বল লাল রঙের পেইন্ট ছাপিয়ে তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি বের হয়ে আসছিল, কিন্তু কোনো মানুষ তার চোখের সেই অশ্রু দেখতে পাচ্ছিল না।
.
মন্তাজ ওস্তাদ সিগারেটটা পায়ে পিষে বলল, “তা হলে আমার প্ল্যানটা বুঝতে পেরেছিস তো?”
“বুঝেছি ওস্তাদ।”
“ব্যাক স্ক্রিনের মইটা দিয়ে দুইজনকে স্টেজের উপরে তুলে দে। স্টেজ থেকে কমপক্ষে তিরিশ ফুট। তারপর ভয় দেখিয়ে বল স্পটলাইটের র্যাকটা দিয়ে স্টেজের মাঝামাঝি যেতে। দরকার হলে ভয় দেখা।”
কালাচান দাঁত বের করে মিহি গলায় বলল, “ওইটা কোনো ব্যাপারই না।”
“তারপর আমরা ভান করব তাদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। করব উলটোটা, ঝাঁকিয়ে উপর থেকে নিচে ফেলে দেব। খাঁচার ধারালো শিকে গেঁথে যাবে দুইজন। বুঝলি?”
“একেবারে পানির মতন।”
“যা তা হলে। দেরি করিস না।”
কালাচান আর দবির মিয়া হেঁটে হেঁটে জঞ্জাল রাখার ছোট ঘরটার কাছে গিয়ে সাবধানে ছিটকিনি খুলে ভিতরে উঁকি দিল। টুশির শরীরে হেলান দিয়ে তপু বসে ছিল, দরজা খুলতেই দুজনেই সোজা হয়ে বসল। দবির মিয়া তার গরিলার মতো ভারী শরীরটা ঘরের ভেতরে অর্ধেক ঢুকিয়ে হাত নেড়ে বলল, “আয়।”
টুশি দাঁড়িয়ে বলল, “কোথায়?”
“নিজেরাই দেখবি কোথায়।”
টুশি আর তপু তবুও অনিশ্চিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল, তখন দবির মিয়া ভিতরে ঢুকে খপ করে দুইজনের ঘাড় ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এসে বলল, “তোদের সাহস খুব বেশি বেড়েছে?”
টুশি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা আমাদের কী করবে?”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “ছেড়ে দেব। কিন্তু তার আগে তোদের একটু শিক্ষা দিতে চাই।”
টুশি ভয়ে ভয়ে বলল, “কী শিক্ষা?”
“এমন শিক্ষা যেন জীবনে আর আমাদের সাথে তেড়িবেড়ি না করিস।”
তপু ভয়ে ভয়ে বলল, “কে-কেমন করে?”
তপুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে টুশি আর তপুর ঘাড় ধরে কালাচান আর দবির মিয়া ততক্ষণে তাদেরকে স্টেজের পেছনে মইটার কাছে দাঁড় করিয়েছে। দুজনের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এই মইটা দিয়ে উপরে উঠে যাবি, তারপর ঐ যে র্যাকটা দেখছিস সেইটার উপর দিয়ে স্টেজের ঠিক মাঝখানে চলে যাবি।
টুশি উপরে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল, “সর্বনাশ! যদি পড়ে যাই?”
“সেইটাই তোদের শাস্তি। পড়তে পারবি না, পড়ে গেলে নিচের শিকে গেঁথে মরে যাবি। বুঝেছিস?”
তপু মাথা নেড়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “আমি পা-পারব না।”
কালাচান কোমর থেকে একটা রিভলবার বের করে তপুর মাথায় ধরে বলল, “না পারলে এখানেই খুন করে ফেলব হারামজাদার বাচ্চা।”
তপু কেঁদে ফেলতে গিয়ে থেমে গেল, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল এদের সামনে কেঁদে কোনো লাভ নেই। এরা দয়ামায়াহীন পশু।
কালাচান টুশির ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে মইয়ের উপরে ফেলে দিয়ে বলল, “ওঠ।”
দবির মিয়া বলল, “ঐ র্যাক থেকে সবগুলো লাইট জ্বলছে–জায়গাটা আগুনের মতো গরম। ঐ গরমে এক ঘণ্টা বসে থাকবি, সেইটা হচ্ছে তোদের শাস্তি।”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “এখন বল, তোরা কী চাস? এখানেই খুন হয়ে যেতে চাস নাকি ঐ র্যাকে বসে এক ঘণ্টা শাস্তি ভোগ করতে চাস?”
টুশি বলল, “তারপর আমাদের ছেড়ে দেবে?”
কালাচান মিহি গলায় বলল, “ছেড়ে না দিয়ে কী করব? তোদেরকে কি আমরা সারাজীবন পালব নাকি?”
দবির মিয়া বলল, “লাথি মেরে বিদায় করব যেন আর কখনও আমাদের সাথে লাগতে না আসিস।”
তপু উপরে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল “আমার ভয় করছে আপু।”
টুশি মুখে সাহসের একটা ভাব করে বলল, “ভয়ের কী আছে? আমি তোকে ধরে রাখব, আয়।”
কালাচান রিভলবার দিয়ে তপুর পিঠে একটা পুঁতো দিয়ে বলল, “ওঠ।”
তখন প্রথমে তপু তার পিছুপিছু টুশি মই দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে গিয়ে তারা র্যাকটার নাগাল পেল। অ্যালুমিনিয়ামের সরু একটা ব্ল্যাক, তার সাথে ব্র্যাকেট লাগানো এবং সেই ব্র্যাকেট থেকে ফ্লাডলাইটগুলো ঝুলছে। তীব্র উজ্জ্বল আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তার ভেতর থেকে আগুনের হলকার মতো গরম বাতাস আসছে–টুশি আর তপুর মনে হতে থাকে তারা বুঝি গরমে সেদ্ধ হয়ে যাবে।
টুশি আর তপু উপর থেকে নিচে তাকাল, স্টেজের উপর তখন কাবিল কোহকাফীকে দিয়ে একটা নৃশংস খেলা দেখানো হচ্ছে, সে স্টেজ ভেঙে বের হয়ে আসতে চাইছে এরকম একটা কথা বলে তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে খাঁচার মাঝখানে আটকে রাখার চেষ্টা করছে। তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে বলে টুশি আর তপু ভালো করে কাবিল কোহকাফীকে দেখতে পাচ্ছে না–কিন্তু যেটুকু দেখছে সেটা দেখেই কাবিল কোহকাফীর কষ্টে তাদের বুক ভেঙে যেতে লাগল।
টুশি তপুকে বলল, “সামনে যা তপু।”
তপু কোনোরকমে কান্না আটকাতে আটকাতে বলল, “আমার ভ-ভয় করছে। আপু। য-যদি পড়ে যাই?”।
“পড়ে গেলে মরে যাবি তাই খবরদার পড়ে যাবি না। দুই হাতে শক্ত করে ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যা। খবরদার নিচে তাকাবি না, নিচে তাকালেই কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে যাবি।”
“আমি পা-পারব না আপু।”
নিচে কালাচান রিভলবার তাক করে ধরে রেখেছে, সেদিকে একনজর তাকিয়ে টুশি বলল, “নিচে বদমাইশগুলো রিভলবার ধরে রেখেছে। পরে গুলি করে দেবে। সামনে আগাতে থাক। আমি তোকে ধরে রাখছি।”
তপু চোখ মুছে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে শুরু করে। র্যাকটা প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে স্টেজের দুইপাশ থেকে ঝোলানো, তারা এগুতে শুরু করা মাত্র সেটা বিপজ্জনকভাবে দুলতে শুরু করল। তপু সাথে সাথে বুক লাগিয়ে শুয়ে পড়ে চাপা স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। টুশির বুকও ভয়ে ধকধক করতে থাকে, মনে হয় এক্ষুনি বুঝি উপর থেকে নিচে পড়ে যাবে।
দুলুনি একটু কমে আসতেই টুশি আবার তপুর পিঠে হাত দিয়ে বলল, “ভয় পাবি না। আর একটু এগিয়ে যা।”
তপু তখন খুব সাবধানে প্রায় বুক আর পেটে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে শুরু করল। টুশি পিছনে পিছনে যেতে থাকে, নিচে তাকাবে না তাকাবে না করেও হঠাৎ করে নিচে তাকিয়ে টুশির মাথা ঘুরে গেল, একটা আর্তচিৎকার করে সে থেমে যায়। তপু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে টু-টুশি আপু?”
টুশি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, কিছু না।”
খুব সাবধানে র্যাকটির উপর বুক লাগিয়ে প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে দুজনে মাঝামাঝি এসে হাজির হল। নিচে আগুনের মতো গরম বাতাস, মনে হয় সারা শরীর বুঝি পুড়ে যাবে, তাদের মুখ শুকিয়ে যায়, সমস্ত শরীর ঝা ঝা করতে থাকে। তপু বলল, “আপু আর পারি না।”
টুশি বলল, “দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাক। দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা কেটে যাবে।”
ঠিক তখন নিচে কাবিল কোহকাফীকে নিয়ে একটা ভয়ংকর খেলা হচ্ছে, মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখছে কেমন করে একটা অদৃশ্য দানবকে আগুনের হলকা দিয়ে ভয় দেখানো যায়। পুরো ব্যাপারটি আরও ভয়ংকর করার জন্যে আলোর ঝলকানিতে চারদিক ঝলসে উঠছে, কান-ফাটানো ভয়ংকর একধরনের সংগীতে পুরো স্টেজ কেঁপে কেঁপে উঠছে।
হঠাৎ করে সবকিছু থেমে গেল, আলোর ঝলকানিও নেই, ভয়ংকর সংগীতও নেই, চারিদিকে একধরনের সুনসান নীরবতা। সুন্দর কাপড় পরা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক কাঁপা গলায় বলল, “উপস্থিত সুধীমণ্ডলী, একটি অত্যন্ত জরুরি কারণে আমাদের কিছুক্ষণের জন্যে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করতে হচ্ছে। আমাদের এই অনির্ধারিত বিরতির জন্যে আমরা দুঃখিত। আপনারা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন, কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা আবার অনুষ্ঠান শুরু করতে পারব।”
কী হয়েছে অনুমান করার জন্যে হলভরতি সব মানুষ নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করে। স্টেজের উপর নিরাপত্তা পোশাক পরা কিছু মানুষ এসে টুশি আর তপুর দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে কথা বলতে থাকে। উপস্থাপক এগিয়ে আসে, তাদের সাথে কথা বলে সে উপরে তাকায়, ফ্লাডলাইটের র্যাক ধরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা টুশি আর তপুকে দেখে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। সে আবার দর্শকদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, আমাদের স্টেজে একটি অত্যন্ত জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আপনারা কেউ নিজেদের আসন থেকে উঠবেন না। আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা এইমাত্র আমাদের জানিয়েছে একটি ছোট ছেলে এবং একটি ছোট মেয়ে এই স্টেজ থেকে ত্রিশ ফুট উঁচুতে ঝোলানো একটি র্যাকের উপরে উঠে পড়েছে। এই মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে তার পোষা ইঁদুরকে হারিয়ে ফেলেছিল বলে জানিয়েছে, সম্ভবত সে তার পোষা ইঁদুরকে খুঁজতে এই বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছে।”
উপস্থিত সব দর্শক আতঙ্কের একধরনের শব্দ করল। উপস্থাপক, বলল, “আপনারা ভয় পাবেন না। শিশু দুজনকে উদ্ধার করার জন্যে আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা উপরে উঠে যাচ্ছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন অবুঝ এই দুটি শিশুর এই বিপজ্জনক কাজের জন্যে আমাদের অনুষ্ঠানে এই বিঘ্ন ঘটেছে বলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”
টুশি এবং তপু উপস্থাপকের কথা শুনে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। কী বলছে এই মানুষগুলো–তারা তো এখানে নিজে থেকে ওঠেনি, তাদেরকে এখানে জোর করে তুলেছে। তপু কাঁপা গলায় বলল, “আমাদেরকে এখন কে উদ্ধার ক করবে আপু?”
ঠিক তখন টুশির মাথায় ভয়ংকর একটা চিন্তা এসেছে–সে জোর করে সেই চিন্তাটা দূর করে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। শুনলি না–তা-ই তো বলছে।”
“কি-কি-কিন্তু আপু আমরা তো নি-নিজে উঠিনি। এরা মি-মিথ্যা কথা বলছে কেন?”
এরা কেন মিথ্যা কথা বলছে কয়েক সেকেন্ড পরেই টুশি আর তপু বুঝতে পারল। তারা দেখল র্যাকের দুইপাশ থেকে কালাচান আর দবির মিয়া উঠে আসছে। তাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে আসার ভান করতে করতে কালাচান আর দবির মিয়া র্যাকটা দোলাতে শুরু করেছে, তাদের দুজনকে উপর থেকে নিচে ফেলে দেয়াই এদের উদ্দেশ্য। প্রচণ্ড আতঙ্কে তপু আর্তনাদ করে ওঠে, র্যাক থেকে সে প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে সরু র্যাকটা সে আঁকড়ে ধরল, তার সমস্ত শরীর পিছনে পড়ে গেছে, কোনোমতে শুধু দুই হাত দিয়ে র্যাকটা ধরে ঝুলে আছে। তপুকে বাঁচাতে টুশি হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল, সে নিজেও তখন তাল সামলিয়ে পড়ে গেল। নিচে খাঁচার ধারালো শিক, ত্রিশ ফুট উপর থেকে পড়লে তারা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে। টুশি শেষ মুহূর্তে র্যাকটা ধরে ঝুলে পড়ল। উপস্থিত দর্শকেরা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে পেল একটা সরু র্যাক থেকে ছোট একটা ছেলে আর মেয়ে কোনোমতে ঝুলে আছে। নিচে একটি খাঁচা–সেই খাঁচা থেকে ধারালো শিক উদ্যত হয়ে আছে, যে-কোনো মুহূর্তে এই বাচ্চা দুটি পড়ে সেখানে গেঁথে যেতে পারে। দর্শকেরা দেখতে পেল শিশু দুটিকে উদ্ধার করার জন্যে দুই পাশ থেকে দুজন বিশাল মানুষ এগিয়ে আসছে–কিন্তু তারা কাছে আসতে পারছে না। কারণ র্যাকটি বিপজ্জনকভাবে দুলছে। কেউ জানতেও পারল না পাহাড়ের মতো এই দুটি মানুষ আসলে বাচ্চা দুটিকে উদ্ধার করতে আসছে না–র্যাকটি তালে তালে দুলিয়ে বাচ্চা দুটিকে উপর থেকে ফেলে খুন করার চেষ্টা করছে।
টুশি আর তপু তখন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল–”কা-বি-লি- কো-হ-কা ফী “।
কাবিল কোহকাফী চমকে উঠল। সে হতবুদ্ধি হয়ে এতক্ষণ উপরে তাকিয়ে ছিল, বিস্ফারিত চোখে দেখছিল কী ভয়ংকর অসহায় আর নিরুপায়ভাবে ত্রিশ ফুট উঁচুতে টুশি আর তপু ঝুলছে। সে দেখছিল মুখে কী ভয়ানক একটি জিঘাংসা নিয়ে দুইদিক থেকে কালাচান আর দবির মিয়া র্যাকটিকে আঁকিয়ে তাদেরকে ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে তপু আর টুশির চিৎকার শুনে কাবিল কোহকাফী থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল তার শরীরের ভেতর যেন কী-একটা ঘটে গেছে। তার মাথার মাঝে যেন ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায়, সমস্ত শরীরের মাঝে যেন বিদ্যুৎ খেলতে শুরু করে। প্রচণ্ড ক্রোধে তার শরীরের প্রত্যেকটা কোষ যেন ফেটে গেল, হঠাৎ সে দুই হাত উপরে তুলে ভয়ংকর জান্তব একটা ক্রোধে অমানুষিক গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠে। হলভরতি দর্শকেরা হতবাক হয়ে দেখতে পেল খাঁচার ভেতরে আটকে-থাকা অদৃশ্য মানবটির সমস্ত শরীর হঠাৎ করে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে, দেখতে দেখতে তার সমস্ত শরীর ফুলে ফেঁপে উঠছে, তাকে ঘিরে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠতে শুরু করেছে। সারা শরীর ঘিরে আগুনের ফুলকি ছুটছে। হাতের ঝটকা দিয়ে সেই মূর্তিটি তার শিকল ভেঙে ফেলল, তারপর লাথি দিয়ে খাঁচাটিকে ভেঙে ফেলে। হলঘরের সবাই দেখল তার সমস্ত দেহ ধোঁয়ার কুণ্ডলির মতো বড় হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে, গগনবিদারী চিৎকারে সমস্ত হলঘর থরথর করে কেঁপে উঠছে।
টুশি আর তপু নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারল না। হাত ফসকে তারা নিচে পড়ে গেল কিন্তু কাবিল কোহকাফীর বিশাল এক মূর্তি দুই হাতে তাদের ধরে ফেলল। তাদেরকে নিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে সেই বিশাল মূর্তি মঞ্চটিকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়–স্টেজের মানুষ ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালাতে থাকে। টুশি আর তপুকে স্টেজে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কাবিল কোহকাফীর এই ভয়ংকর প্রতিমূর্তি বিকট চিৎকার করতে করতে জ্বলন্ত আগুনের মতো ঘুরতে থাকে তার বিশাল দেহ। থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, ভয়ংকর ক্রোধে তার চোখ আগুনের মতো জ্বলছে, মুখ থেকে আগুনের হলকা বের হচ্ছে।
উপস্থিত দর্শকেরা এবারে প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালাতে শুরু করল, মানুষের চিৎকার আর হুটোপুটিতে হলঘরের মাঝে একটা নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। টুশি বুঝতে পারল কাবিল কোহকাফীকে না থামালে এখানে একটা ভয়ংকর অবস্থা হয়ে যাবে। মানুষের পায়ের চাপেই কয়েকশ মানুষ মারা যাবে।
টুশি তখন চিৎকার করে বলতে লাগল, “থামো। কাবিল কোহকাফী তুমি থামো। প্লিজ!”
তপুও চিৎকার করে বলল, “থা-থা-থামো তুমি। থামো।”
টুশি তপুকে বলল, “বোতলটা দে, তাড়াতাড়ি।”
তপু পকেট থেকে বোতলটা বের করে দেয়, টুশি ছিপিটা খুলে উঁচু করে ধরে বলল, “কাবিল, আসো এখানে। এই বোতলের ভেতরে। এক্ষুনি। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
ছুটোছুটি করতে-থাকা দর্শকেরা অবাক হয়ে দেখল ভয়ংকর সেই প্রতিমূর্তি হঠাৎ ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে ছোট মেয়েটির হাতে ধরে রাখা বোতলের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সেই ভয়ংকর মূর্তি পুরোটুকু বাধ্য প্রাণীর মতো একটা ছোট মেয়ের হাতে ধরে থাকা বোতলের ভেতরে ঢুকে গেল।
টুশি বোতলটি মুখের কাছে এনে বলল, “থ্যাংক ইউ কাবিল কোহকাফী। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”
তারপর বোতলের ছিপিটা লাগিয়ে সামনে তাকাল। কয়েক হাজার নারী-পুরুষ দর্শক হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কারও মুখে একটা কথা নেই, নিজের চোখে দেখেও কেউ এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। টুশি শক্ত করে বোতলটা ধরে তপুকে বলল, “আয় তপু। আমরা যাই।”
“চ-চলো আপু।”
তারা স্টেজ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে থাকে, সব মানুষ সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দেয়। টুশি তপুর হাত ধরে হাঁটতে থাকে। টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো তাদের দুজনের দিকে মুখ করে ধরে রেখেছে কিন্তু টুশি আর তপু সেটা নিয়ে ভ্রূক্ষেপ করল না। অসংখ্য ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলো আর ক্লিক ক্লিক শব্দের মাঝে তারা ছুটতে লাগল। হঠাৎ সাহস করে একজন সাংবাদিক এগিয়ে এসে। জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা? এখানে কেন এসেছ?”
টুশি আর তপু সাংবাদিকের কথার উত্তর না দিয়ে এবারে ছুটতে থাকে– তাদের পিছুপিছু অসংখ্য সাংবাদিক ছুটে আসছে, তারা চিৎকার করে প্রশ্ন করছে। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তারা ছুটতে থাকে। দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখে বোতলটাকে যার ভেতরে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে কাবিল কোহকাফী। তাকে এবারে মুক্ত করে দিতে হবে। চিরদিনের মতো।
১৬. শেষ কথা
নানির দুই হাত ধরে টুশি আর তপু টেনে নিয়ে যাচ্ছে–তার পিছনে পিছনে সুট টাই পরা বেশ কয়েজন মানুষ। নানি মাঢ়ি বের করে হাসার চেষ্টা করে বললেন, “আমাকে এভাবে টানছিস কেন?”
টুশি বলল, “তোমার দেয়া বাড়িতে কী সুন্দর ‘শিশুসদন’ হয়েছে দেখবে না?”
“দেখতেই তো এসেছি। যেভাবে টানছিস আমি দেখব কেমন করে?”
পিছনের সুট-টাই পরা মানুষগুলো একটু হাসল, বলল, “আপনার নাতি নাতনি হচ্ছে ডেঞ্জারাস মানুষ, তারা জিনকে ধরে শিশিতে ভরে ফেলে–আপনাকে যে সেরকম কিছু করছে না সেইটাই বেশি!”
নানি বললেন, “সত্যি কথাই তো! তোরা সেই জিনকে কী করেছিস? টেলিভিশনে এখনও দুই বেলা দেখায়”
“ছেড়ে দিয়েছি।”
“ছেড়ে দেবার আগে বললি না কেন দুই ঘড়া সোনার মোহর নিয়ে আসতে?”
“বলেছিলাম নানি–আজকালকার মডার্ন জিনেরা খুব ফাঁকিবাজ, সোনাদানা আনতে চায় না!”
সুট-টাই পরা মানুষগুলো একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। একজন বলল, “এই যে এটা হচ্ছে শিশুসদনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের রুম! এই ভদ্রলোক না হলে আপনার শিশুসদন দাঁড় করানো যেত না! অসম্ভব কাজের মানুষ–”
“হ্যাঁ।” অন্য একজন বলল, “দিন নাই রাত নাই খেটে যাচ্ছেন।”
নানি চোখের চশমাটা ঠিক করে বললেন, “কী যেন নাম মানুষটার?”
তপু ফিসফিস করে বলল, “কাবিল কোহকাফী।”
“কী বললি?”
টুশি গলা উঁচিয়ে বলল, “বলেছে কফিল কোরায়শি।”
“ও আচ্ছা, হ্যাঁ।” নানি মাথা নাড়লেন, “কফিল কোরায়শি। বুড়ো হয়ে গেছি তো–তাই নাম মনে থাকে না!”
দরজার সামনে কথাবার্তা শুনে পরদা সরিয়ে শিশুসদনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কফিল কোরায়শি বের হয়ে এল, তার পরনে গাঢ় নীল রঙের সুট এবং টকটকে লাল টাই। চোখে চশমা, চুলের কাছে অল্প একটু পাক ধরেছে, মুখে মৃদু একটা হাসি। কাবিল কোহকাফীকে টুশি আর তপু ছাড়া আর কেউ কখনও দেখেনি, দেখলেও তারা প্রাক্তন কাবিল কোহকাফী কিংবা বর্তমান কফিল কোরায়শিকে চিনতে পারত কি না সন্দেহ!
নানির দিকে তাকিয়ে প্রাক্তন কাবিল কোহকাফী এবং বর্তমান কফিল কোরায়শি বলল, “আসুন, আসুন ভেতরে আসুন। আপনি আসবেন শুনে আমাদের শিশুসদনের সব বাচ্চারা একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে!”
“অনুষ্ঠান? গান-বাজনা?”
“হ্যাঁ। কফিল কোরায়শি বলল, “শুধু গান-বাজনা না, নাচ এবং কমিক সবকিছু আছে। আমাদের বাচ্চারা অসম্ভব ট্যালেন্টেড!”
কফিল কোরায়শি পিছনের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের ঠিক চিনতে পারলাম না!”
হাসিখুশি একজন এগিয়ে কফিল কোরায়শির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলল, “আমরা এসেছি টুশির জন্যে তৈরি ট্রাস্ট বোর্ড থেকে। আপনি হয়তো জানেন টুশির নানা তার সব প্রপার্টি একটা ট্রাস্টে দিয়ে আমাদের মতো কয়েকজন মেম্বারের হাতে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।”
কফিল কোরায়শি বলল, “হ্যাঁ শুনেছি।”
ট্রাস্টের দায়িত্ব হচ্ছে দেখা টুশি যেন একটা পারিবারিক অ্যাটমস্ফিয়ারে বড় হয়। বাচ্চাকাচ্চার সাথে। যেখানে সে খুশি থাকে।”
“আচ্ছা।”
“টুশি আমাদের কাছে অ্যাপ্লাই করেছে যে সে এই শিশুসদনে সব বাচ্চাদের সাথে থাকতে চায়। আমরা তাই দেখতে এসেছি। যদি দেখি সত্যিই এখানে থাকলে সে ভালো থাকবে আমরা তাকে থাকতে দেব!”
“ভেরি গুড!” কফিল কোরায়শি বলল, “সেটা খুব চমৎকার একটা ব্যাপার হবে। আমাদের এই শিশুসদনের বাচ্চারা টুশির জন্যে পাগল। এইটুকুন মানুষ কিন্তু ছোট বাচ্চাদের কী চমৎকারভাবে ম্যানেজ করে দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।”
ফরসামতন অন্য একজন ভদ্রলোক বললেন, “আমরা জানি। সব খবরই আমরা পাই!”
কফিল কোরায়শি বলল, “আসেন, বাচ্চারা আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছে!”
বারান্দার মতো একটা জায়গায় প্রায় গোটা ত্রিশেক নানা বয়সের বাচ্চা অপেক্ষা করছিল, নানিকে নিয়ে সবাই সেখানে হাজির হতেই সেখানে একটা আনন্দের ধ্বনি শোনা গেল। ছোট ছোট বাচ্চারা ছুটে এসে টুশিকে ঘিরে ধরল, তাদের সবারই কিছু-একটা বলার রয়েছে। হাঁটতে পারে না এরকম একজন হামাগুড়ি দিয়ে এসে টুশির পা ধরে বসে রইল।
নানি মাঢ়ি বের করে হেসে বললেন, “এরা দেখি তোকে খুব পছন্দ করে!”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, আমি তো এসে এদের গল্পবই পড়ে শোনাই, তাই!”
কফিল কোরায়শি গলা উঁচিয়ে বলল, “এখন সবাই নিজের জায়গায় গিয়ে বসো। আমরা আমাদের অনুষ্ঠান শুরু করব।”
অনুষ্ঠান শুরু করার আনন্দে বাচ্চাগুলো আবার আনন্দের একটা ধ্বনি করে প্রায় ছুটে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। কফিল কোরায়শি বলল, “সবার আগে স্বাগতম সংগীত গেয়ে শোনাবে মিতুল।”
পিছনে বসে থাকা অসম্ভব মায়াকাড়া চেহারার একটা মেয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে এল। নানি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, “আহারে! এই মেয়েটার পায়ে কী হয়েছে?”
টুশি বলল, “বাম পা’টা কেমন জানি শুকিয়ে গেছে।”
“ডাক্তার কী বলে?”
“নার্ভের কী যেন অসুখ। আস্তে আস্তে নাকি শরীরের অন্য জায়গাও শুকিয়ে যাবে।”
“আহা রে!”
“কিন্তু কী সুন্দর গান গায়–তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে নানি।”
টুশির কথা সত্যি–মিতুল গাইতে শুরু করতেই উপস্থিত সবাই একেবারে স্তব্ধ হয়ে মোহগ্রস্তের মতো এই ছোট মেয়েটির গান শুনতে লাগল। সবার মনে হল তারা বুঝি কোনো এক বিস্ময়কর স্বপ্নের জগতে চলে গেছে।
.
সেদিন সন্ধেবেলা কফিল কোরায়শির অফিসে টুশি আর তপু চুকচুক করে কোল্ড ড্রিংক খাচ্ছে, কাবিল কোহকাফী তার এক্সিকিউটিভ চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে! হাসতে হাসতে বলল, “তা হলে তোমরা দুইজন এখন সেলিব্রেটি?”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। সেদিন একটা সাবানের কোম্পানি এসেছে আমাদের দিয়ে একটা বিজ্ঞাপন করার জন্যে! ভেবে দ্যাখো আমার মতো কালো একটা মেয়ে করছে সাবানের বিজ্ঞাপন! কন্ট্রাক্ট সাইন করলেই বস্তা বস্তা টাকা দেবে!”
তপু বলল, “পত্রিকার মানুষেরা বলছে যদি ইন্টারভিউ দিই তা হলে আমাদের কয়েক লাখ টাকা দেবে!”
“টুশি বলল, নিউইয়র্কের একটা মিউজিয়াম তোমার শিশিটা বিশ হাজার ডলার দিয়ে কিনতে চাচ্ছে।”
কাবিল কোহকাফী মুচকি মুচকি হেসে বলল, “তা হলে রাজি হচ্ছ না কেন?”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “সর্বনাশ! যদি জানাজানি হয়ে যায় তুমিই সেই কাবিল কোহকাফী তা হলে আমাদের শিশুসদনের কী হবে?”
তপু বলল, “আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে থাকি, তারপরেই অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে যায়।”
টুশি এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “তুমি কি আবার আগের মতো অদৃশ্য হতে পারবে?”
“মনে হয় না। অলৌকিক যা ক্ষমতা ছিল সব মনে হয় খরচ করে ফেলেছি!”
“কী অলৌকিক ক্ষমতা?”
“এই মনে করো মানুষকে টিকটিকি বানানো–লোহাকে সোনা বানানো–”
তপু হি হি করে হেসে বলল, “তুমি এগুলো কিছু পার না আমরা জানি!”
কাবিল কোহকাফী কোনো কথা না বলে মিটিমিটি হাসতে লাগল। টুশি বলল, “কী হল, তুমি এভাবে হাসছ কেন?”
“মনে আছে, তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার চেহারাকে আগুনের খাপরার মতো সুন্দর করে দেব?”
“হ্যাঁ।”
“আমি মনে হয় এখন সেটা পারব।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“সত্যি। আমার ক্ষমতা তো কম তাই বেশি অলৌকিক কাজ করতে পারি না। যা ক্ষমতা ছিল শেষ করে ফেলেছি–আর মনে হয় একটা পারব। সত্যিকারের অলৌকিক একটা কাজ!”
টুশি তীক্ষ্ণ চোখে কাবিল কোহকাফীর দিকে তাকিয়ে বলল, “সত্যি পারবে?”
“হ্যাঁ। রাতারাতি তোমার চেহারা অন্যরকম হয়ে গেলে তো তোমাকে কেউ চিনবে না–তাই পুরো ব্যাপারটা হবে ধীরে ধীরে–মনে করো এক বছর সময় নিয়ে।”
টুশি বলল, “তুমি সত্যিই এরকম অলৌকিক একটা কাজ করতে পারবে?”
“হ্যাঁ। সব মন্ত্র ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করেছি।”
“ভেরি গুড!” টুশি মাথাটা একটু এগিয়ে বলল, “তুমি তোমার অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে মিতুলের পা ঠিক করে দাও।”
“মিতুলের পা?”
“হ্যাঁ। পারবে না?”
“পারব। কিন্তু তোমার না চেহারা নিয়ে এত দুঃখ ছিল?”
“এখন আর নেই। চেহারাটা বাইরের জিনিস–ভালো কিংবা খারাপ তাতে কিছু আসে যায় না!”
কাবিল কোহকাফী কিছুক্ষণ টুশির দিকে তাকিয়ে তার কাছে এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ টুশি। যারা তোমার পরিচিত তারাই ঠিক করে জানে তোমার চেহারা কত সুন্দর।”
.
বাসায় যাবার জন্যে টুশি আর তপু কফিল কোরায়শির সাথে সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন দেখতে পেল মোটাসোটা একটা ছেলে খুব মনোযোগ দিয়ে উপরে তাকিয়ে আছে। টুশি জিজ্ঞেস করল, “কী দেখছ তুমি?”
“টিকটিকি।”
টুশি হেসে ফেলল, “টিকটিকি একটা দেখার জিনিস হল?”
ছেলেটা বলল, “এগুলো অন্যরকম।”
“অন্যরকম?”
“হ্যাঁ ঐ দেখো, তিনটা টিকটিকি সবসময় একসাথে থাকে। একটা হচ্ছে। শুকনো সেইটা হচ্ছে লিডার। তার পিছে পিছে থাকে দুইটা ভোটকা ভোটকা টিকটিকি। একটা কালো রঙের আরেকটা সাদা রঙের। যেটা কালো সেটার ঘাড় বলতে গেলে নেই। যেটা সাদা সেইটা কেমন জানি চিকন গলায় ডাকে”
টুশি চোখ বড় বড় করে প্রায় চিৎকার করে বলল, “কী বললে? কী বললে তুমি?”
ছেলেটা অবাক হয়ে টুশির দিকে তাকাল। সাধারণ টিকটিকির কয়টা কথা শুনে টুশি এরকম করে চিৎকার করছে কেন সে কিছুতেই বুঝতে পারল না।