- বইয়ের নামঃ কাবিল কোহকাফী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. পূর্বকথা
কাবিল কোহকাফী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১. পূর্বকথা
ছাগলের ঘাস খাওয়া অঙ্কটা শেষ করে টুশি বানরের বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার অঙ্কটা শুরু করল। অঙ্ক করে বানরটিকে নিয়ে যখন ঠিক বাঁশের মাঝামাঝি পৌঁছাল তখন তার নানা দরজা খুলে ঘরে মাথা ঢুকিয়ে বললেন, “এই টুশি!”
টুশি মাথা না তুলে বলল, “উ?”
নানা গলা উঁচিয়ে বললেন, “উ আবার কীরকম উত্তর? ডাকছি কথা কানে যায় না?”
টুশি মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমাকে ডিস্টার্ব করো না নানা। একটা বানরকে তেল-মাখানো বাঁশ দিয়ে উপরে ওঠাচ্ছি। হঠাৎ করে ছেড়ে দিলে বানর আছাড় খেয়ে নিচে পড়বে। মহা কেলেঙ্কারি হবে তখন।”
নানা বললেন, “রাখ দেখি তোর বাঁদর! আয় এখন আমার সাথে।”
“তুমি বড় ডিস্টার্ব করো নানা, দেখছ না হোমওয়ার্ক করছি।”
“বাদরের বাদরামি আবার হোমওয়ার্ক হল কবে থেকে? আয় আমার সাথে।”
টুশি অঙ্কখাতা বন্ধ করে বলল, “কোথায়?”
নানা চোখেমুখে একটা রহস্যের ভান করে বললেন, “বড় সিন্দুকটা খুলব।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ, সত্যি। তালাটাতে সকাল থেকে কেরোসিন তেল দিয়ে রেখেছি, এতক্ষণে মনে হয় একটু নরম হয়েছে। একশ বছরের জং কি সোজা কথা নাকি!”
টুশি এবারে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার বয়স বারো, দেখে অবশ্যি আরও কম মনে হয়। তার জীবনের বারো বছরের গত নয় বছর সে তার নানার সাথে কাটিয়েছে। প্রথম তিন বছর সে তার বাবা-মায়ের সাথেই ছিল, একটা গাড়ি-অ্যাক্সিডেন্টে একসাথে দুজনেই মারা যাবার পর নানা তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। টুশির অবশ্যি কিছুই মনে নেই–জ্ঞান হবার পর থেকে দেখছে একটা বিশাল বাড়িতে সে আর তার নানা।
বাড়ি দেখাশোনার জন্যে অবশ্যি ইদরিস মিয়া নামে একজন পাহারাদার আছে–সে এত দুবলা যে টুশি পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিতে পারবে। কিন্তু ইদরিস মিয়ার গলার জোর সাংঘাতিক, যে-কোনো সময়ে সে চিৎকার করে মানুষের কানের পরদা ফাটিয়ে ফেলতে পারে, সেইজন্যে মনে হয় তাকে কেউ ঘটায় না। এ ছাড়াও বাসায় আছে জমিলার মাসে ইদরিস মিয়ার একেবারে উলটো, পেটে বোমা মারলেও তার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয় না। জমিলার মায়ের হাতে অবশ্যি জাদু আছে–সে যদি কেরোসিন তেল দিয়ে মাছ ভাজা করে তা হলেও মনে হয় সেই মাছ ভাজার স্বাদ হবে অমৃতের মতো। টুশি তার নানা আর এই দুজনকে নিয়ে এই বিশাল বাড়িতে বড় হয়েছে। মানুষ একা একা বড় হলে মনে হয় একটু আজব হয়ে যায়, টুশিও হয়েছে যদিও সে নিজে সেটা জানে না। স্কুলের বন্ধু বান্ধবেরা তাকে নিয়ে মাঝে মাঝে হাসাহাসি করে–টুশি অবশ্যি সেগুলো একেবারেই পাত্তা দেয় না–আজব হয়ে যাবার মনে হয় এটা আরেকটা লক্ষণ অন্যেরা কী ভাবছে সেটাকে কোনো পাত্তা না দেওয়া।
বড় সিন্দুক খোলার উত্তেজনায় টুশি তার নানার হাত ধরে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে ছুটে যাচ্ছিল, নানা তখন তাকে থামালেন, বললেন, “আস্তে, পাগলি মেয়ে আস্তে। আমি কি আর তোর মতো দৌড়াতে পারি?”
“কেন পার না?”
“আমার কি সেই বয়স আছে?”
নানার কথা শুনে টুশি ঘুরে তার দিকে তাকাল, নানা নিশ্চয়ই বুড়ো মানুষ, কিন্তু তাকে কখনওই টুশির বুড়ো মনে হয় নি। নানা যখনই নিজেকে বুড়ো বলে দাবি করেন তখনই টুশি আপত্তি করে, এবারেও করল, বলল, “তোমার আর এমন কী বয়স হয়েছে? তোমার যত বয়স রোনাল্ড রিগান সেই বয়সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিল।”
নানা মাথা নাড়লেন, বললেন, “আমেরিকাতে সব সম্ভব। ঐ দেশে সব পাগল। বুড়োকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেয়, স্কুল-পালানো পোলাপান হয় বিলিওনিয়ার!”
দোতালার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নানা মাঝখানে দাঁড়িয়ে বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, “বুঝলি টুশি”।
“কী?”
“আমি বলছিলাম কি–”
কিন্তু নানা কিছু না বলে খুব নির্মমভাবে দাড়ি চুলকাতে লাগলেন। নানা যখনই কোনো সমস্যায় পড়ে যান তখন এভাবে দাড়ি চুলকাতে থাকেন। টুশিকে নিয়ে একবার কান্তজীর মন্দির দেখতে গিয়েছিলেন, ট্রেনে উঠে আবিষ্কার করলেন মানিব্যাগ-টিকিট সবকিছু বাসায় ফেলে এসেছেন, তখন ঠিক এইভাবে ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাতে শুরু করলেন। টুশি খানিকক্ষণ নানার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “নানা, তোমার দাড়িতে উকুন হয়েছে নাকি?”
নানা দাড়ি চুলকানো বন্ধ করে বললেন, “কেন, উকুন কেন হবে? দাড়িতে কখনও উকুন হয় না জানিস না?”
“তা হলে এভাবে দাড়ি চুলকাচ্ছ কেন?”
“কে বলছে দাড়ি চুলকাচ্ছি?” বলে নানা অন্যমনস্কভাবে আবার দাড়ি চুলকাতে শুরু করলেন।
টুশি নানার হাত ধরে বলল, “কী হয়েছে তোমার?”
নানা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “না, মানে মাঝে মাঝে তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়।”
টুশি ভুরু কুচকে বলল, “আমার কী নিয়ে চিন্তা হয়?”
“এই যে–এই যে–মানে এই-যে–” নানা আবার দাড়ি চুলকাতে লাগলেন।
টুশি অধৈর্য হয়ে নানার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, “কী যে? পরিষ্কার করে বলো।”
নানা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি মরে গেলে তোর কী হবে?”