শুধু যে শব্দের জন্যে ডপলার এফেক্ট হয় তা নয়, যে কোন তরঙ্গের জন্যে ডপলার এফেক্ট হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ডপলার এফেক্ট ব্যবহার করে খুব সহজে গতিবেগ বের করা যায়। যে সব দেশে গাড়ি খুব বেশি এবং বাড়াবাড়ি গতিতে গাড়ি চালানোর সমস্যা আছে সেখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ হাতে এক ধরনের রাডার যন্ত্র নিয়ে বসে থাকে এবং ডপলার এফেক্ট ব্যবহার করে গাড়ির গতিবেগ মাপতে থাকে। কোন গাড়ি নির্ধারিত গতিসীমার থেকে বেশি গেলেই রয়েছে বিশাল জরিমানা!
আলোর তরঙ্গের ডপলার এফেক্ট মাপার প্রক্রিয়া বের করার পর বিজ্ঞানীরা প্রথম যে বস্তুগুলোর গতি মাপার চেষ্টা করলেন সেগুলো হচ্ছে মহাজাগতিক নক্ষত্র গ্যালাক্সি। বহুদূরের যে নক্ষত্রটা আকাশে মিটমিট করে জ্বলছে সেটি কী এক জায়গাতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাকি কোনো দিকে ছুটে যাচ্ছে সেটা জানতে সবারই আগ্রহ। যে নক্ষত্রটার গতি মাপতে যাচ্ছি সেখান থেকে যে আলো বের হয়ে আসছে তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যদি যা হওয়ার কথা তার থেকে লম্বা হয়ে যায় তার মানে নক্ষত্রটা দূরে সরে চলে যাচ্ছে। যদি তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যা হওয়ার কথা তার থেকে কম হয় তাহলে বুঝতে হবে সেটা আমাদের দিকে ছুটে আসছে। গতিবেগের কারণে যখন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে যায় সেটাকে বলে ডপলারের রেড শিফট (কারণ দৃশ্যমান আলোর লাল রঙটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি)। আবার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যখন কমে যায় তখন সেটাকে বলে ব্লু শিফট (কারণ দৃশ্যমান আলোর কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোটি হচ্ছে নীল)।
খুব সঙ্গত কারণেই একটা প্রশ্ন উঠতে পারে একটা নক্ষত্রের আলোতে রেড শিফট হয়েছে না ব্লু শিফট হয়েছে সেটা বিজ্ঞানীরা বোঝেন কেমন করে? যে আলোটা আসছে তার প্রকৃত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যই হয়তো সেটা! আসলে বিষয়টা খুব সহজ–বহুদূর গ্যালাক্সির কোনো নক্ষত্র বা তারাও আসলে তৈরি হয়েছে আমাদের পরিচিত পরমাণু দিয়ে। একটা পরমাণু সেটা পৃথিবীতেই থাকুক আর কোটি কোটি মাইল দূরেই থাকুক সেটা থেকে বিশেষ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে কিছু আলো বের হয়। তাই বিজ্ঞানীরা তার সঠিক তরঙ্গ দৈর্ঘ্য জানেন। তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের প্যাটার্ন দেখেই সেটা চিনে ফেলেন। যখন কোনো দূর নক্ষত্র থেকে আসার কারণে সেই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয়ে যায় সেটা বোঝা খুব সহজ। কতটুকু রেড শিফট বা ব্লু শিফট হয়েছে সেখান থেকে শুধু যে নক্ষত্রটার গতি বেগ বের করা যায় তা নক্ষত্রটা কি আমাদের দিকে আসছে নাকি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেটাও নিখুঁতভাবে বের করে ফেলা যায়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল মহাকাশের বিভিন্ন নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির গতিবেগ মেপে তারা দেখবেন কোনটা স্থির কোনটা গতিশীল। কোনটার গতি বেশি কোনটার গতি কম। কোনটা আমাদের দিকে ছুটে আসছে কোনটা আমাদের থেকে দূরে সরে চলে যাচ্ছে এক কথায় নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির গতিবেগগুলোর কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল ক্যালিফোরনিয়ার মাউন্ট উহলসনের একশ ইঞ্চি টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাকাশের নানা নক্ষত্র, নানা গ্যালাক্সির ডপলার শিপট মেপে দুটো অত্যন্ত বিচিত্র সত্য আবিষ্কার করলেন। মহাজগতের সকল নক্ষত্র বা গ্যালক্সিই আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে (অর্থাৎ, রেড শিফট হচ্ছে ) এবং যে নক্ষত্র আমাদের থেকে যতদূরে সেই নক্ষত্রটি তত জোরে সরে যাচ্ছে। প্রথমে মনে হতে পারে আমাদের পৃথিবীটা তাহলে নিশ্চয়ই সমস্ত মহাজগতের কেন্দ্রস্থল, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান কারণ এটাকে কেন্দ্রে রেখে সবকিছু দূরে সরে যাচ্ছে। আসলে ব্যাপারটি তা নয়, আমরা পৃথিবীতে বসে এই পরীক্ষাগুলো না করে যদি মহাজগতের অন্য কোনো গ্যালাক্সির অন্য কোনো গ্রহে বসে
এই পরীক্ষাগুলো করতাম তাহলেও হুবহু এই একটই জিনিস দেখতে পেতাম। ব্যাপারটা বোঝা খুব সহজ হয় একটি বেলুনকে দেখলে। বেলুনের উপর বেশ কয়েকটা বিন্দু এঁকে সেটাকে ফোলাতে থাকলে যে কোন বিন্দুরই মনে হবে অন্য বিন্দুগুলো তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী হাবলের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার থেকে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারল যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছু একটির কাছ থেকে অন্য একটি দূরে সরে যাচ্ছে। বেলুনের উদাহরণটি পুরাপুরি সঠিক ছিল না। কারণ, বেলুনের মাঝে আমরা শুধু পৃষ্ঠদেশে কয়েকটা বিন্দু আকঁতে পেরেছি। ত্রিমাত্রিক কোনো কিছুকে যদি ফোলানো যেত তাহলে সেটা আরও
সঠিক উদাহরণ হতো তাহলে আমরা দেখতাম কোনো একটা বিন্দু থেকে অন্য সব বিন্দু দূরে সরে যাচ্ছে এবং এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দু যতদূরে সেটি তত দ্রুতগতিতে সরে যাচ্ছে, ঠিক হাবল যেটা দেখেছেন।
বিজ্ঞানীরা যখন বুঝতে পারলেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আসলে স্থির নয়–এটা প্রচণ্ড গতিতে দ্রুত সরে যাচ্ছে, অন্যভাবে বলা যায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাই যেন ফুলে ফেপে উঠছে তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, “কেন?”
বিষয়টি দুভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলো, প্রথম ব্যাখ্যাটি হচ্ছে স্থিত অবস্থা (Stealy state)। এই ব্যাখ্যার অর্থ হচ্ছে এ-রকম : যদিও দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে অর্থাৎ, নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি একটি থেকে আরেকটি দূরে সরে যাচ্ছে কিন্তু এই ব্যাপারটিই আসলে এক ধরনের চলমান স্থিতি অবস্থা। অর্থাৎ, এভাবে চলতে থাকলে যেহেতু সময়ের সাথে সাথে একটি নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্র অনেক দূরে চলে যাবে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে বস্তুর ঘনত্ব কমে যাবে কাজেই সেটা ঠিক রাখার জন্যে মহাজগতে ক্রমাগত নূতন পদার্থের জন্ম হবে। এই স্থিতি অবস্থা ব্যাখ্যার জনক ছিলেন ফ্রেড হয়েল এবং তার এই ব্যাখ্যাটি সত্যি হতে হলে ক্রমাগত নূতন নূতন গ্যালাক্সির জন্ম হতে হবে। আসলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এত বড় যে ফ্রেড হয়েলের ব্যাখ্যাটি সত্যি হওয়ার জন্যে খুব বেশি পদার্থের জন্ম দেয়ার প্রয়োজন হয় না। এক কিউবিক মিটারে প্রতি বিলিওন বছরে (শত কোটি) একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর জন্ম দিতে পারলেই যথেষ্ট।