যেহেতু একেক রঙের আলোর জন্যে প্রতিসরাঙ্কের মান একেক রকম তাই আমরা দেখব একেকটি রং একেক গতিতে যাচ্ছে। শুরুতে সবগুলো রং একই সাথে থাকলেও এটা প্রতিসরিত হয়ে সূর্যের আলো তার রংগুলোতে আসলে আলাদা হয়ে যাবে, যেই আলোর সংকেতটা ছিল সরু সেটা ছড়িয়ে পড়বে। এটা হচ্ছে তরঙ্গের ধর্ম এবং সব তরঙ্গে আমরা এটা হতে দেখি (19.4 নং ছবি)। সলিটনে এটা ঘটে না তাই বিজ্ঞানীরা এত অবাক হয়েছিলেন। যে কারণে সেটা ঘটে না সেটাও কম চমকপ্রদ নয়।
আমরা বলেছি আলোর প্রতিসরাঙ্ক নির্ভর করে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের উপর। ঠিক সে রকম আলোর প্রতিসরাঙ্ক তরঙ্গের বিস্তারের উপরেও নির্ভর করে। তবে তরঙ্গের এই বৈশিষ্ট্যটি খুব ক্ষুদ্র, তাই সাধারণ হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা হতো না। সলিটনের বেলাতে হঠাৎ সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, বিজ্ঞানীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলেন যে যদি খুব শক্তিশালী একটা তরঙ্গ তৈরি করা যায় তাহলে সেটা প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন করতে পারে। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য একদিকে প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন করে, তরঙ্গের বিস্তার প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন করে অন্যদিকে, এবং পুরো ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটা সম্ভব একটা পরিবর্তনকে অন্য পরিবর্তন কাটাকাটি করে ফেলে। যার ফলে আমরা দেখতে পাই আসলে কোনো পরিবর্তন হয় নি, তাই যে তরঙ্গটুকু খানিক দূর যেতে যেতেই ভেঙে যাবার কথা, ছড়িয়ে পড়ার কথা আমরা সেই তরঙ্গকে যেতে দেখি অনির্দিষ্টকাল পুরোপুরি অবিকৃতভাবে। কম্পিউটারে সেই বিষয়টি খুঁজে পেয়ে বিজ্ঞানীরা হঠাৎ করে বুঝতে পালেন শতাধিক বছর আগে ইঞ্জিনিয়ার স্কট রাসেল ঠিক এই ধরনের একটা তরঙ্গের কথা বলেছিলেন, যে তরঙ্গটিকে একশ’ বছরের বেশি কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয় নি।
এখন অবস্থা পাল্টে গেছে, সলিটনকে সবাই গুরুত্ব দিয়ে নেয়। শুধু যে গুরুত্ব দিয়ে নেয় তা নয়, এখন সলিটন হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফ্যাশন, সবকিছুকে চেষ্টা করা হয় সলিটনকে দিয়ে ব্যাখ্যা করতে। কিছুদিন আগে একটা ভয়ঙ্কর সুনামী এসে আঘাত করেছিল, মনে করা হয় সেটাও বুঝি এক ধরনের সলিটন (তবে সলিটনের তরঙ্গ ওপর-নিচ করতে পারার কথা নয়। সুনামীতে ওপর-নিচ হয়, সুনামী আঘাত করার পূর্ব মুহূর্তে সমুদ্রের পানি নিচে নেমে গিয়েছিল।)। বৃহস্পতি গ্রহে যে বিশাল লাল রঙের একটা বৃত্তাকার অংশ আছে সেটাকেও মনে করা হয় সলিটন!
সলিটন যদিও একটা তরঙ্গের মতো কিন্তু এর মাঝে একটা বস্তু কণার ভাব আছে। একটা সলিটন আরেকটা সলিটনের সাথে ধাক্কা লাগতে পারে এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার একটা সলিটন অন্য একটা সলিটনের ভেতর দিয়ে একেবারে অবিকৃত অবস্থায় চলে যেতে পারে। সলিটনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে যেটার বিস্তার (উচ্চতা) যত বেশি সেটার গতিবেগ তত বেশি। তাই যদি দুটো সলিটন একদিকে যেতে থাকে তাহলে যেটার উচ্চতা বেশি সেটা দ্রুত গিয়ে অন্যটার উপর দিয়ে চলে যেতে পারে। একটা যখন আরেকটার ঠিক উপরে থাকবে তখন তরঙ্গের উচ্চতা হওয়া উচিত দুটি তরঙ্গের যোগফলের সমান কিন্তু সলিটনের বেলায় সেটি সত্যি নয়, সম্মিলিত তরঙ্গের উচ্চতা হয় কম (19.5 নং ছবি)। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় নন-লিনিয়ার সলিটনের বেলায় যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
কেউ যেন মনে না করে সেই দেড়শত বৎসর আগে এডিনবার্গে স্কট রাসেল পানির উপর একটা সলিটন দেখেছিলেন, তারপর আর কেউ কোনো সলিটন দেখে নি, সবাই কম্পিউটারে হিসেব করে সলিটনের নিয়ম-কানুন খুঁজে বের করছে। সলিটনের একটা খুব বড় ব্যবহার হয় ফাইবার অপটিক্সে যখন ডিজিটাল সিগনালকে সলিটন হিসেবে ফাইবারের ভেতর দিয়ে বিশাল দূরত্বে পাঠিয়ে দেয়া হয়। 1973 সালে বেল ল্যাবরেটরিতে এই বিষয়টা প্রথমে কল্পনা করা হয়েছিল। 1998 সালে ফ্রান্স টেলিকম সলিটন ব্যবহার করে 1 টেবিট (অর্থাৎ দশ হাজার কোটি বিট) পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল। 2001 সালে আলগেটি টেলিকম ইউরোপে প্রথম সলিটন ব্যবহার করে সত্যিকারের টেলি কমিউনিকেশান্সের সূচনা করেছে।
বলা যেতে পারে এটি মাত্র শুরু। সলিটনের শেষ কী দিয়ে হবে সেটি এখন শুধু কল্পনা। স্কট রাসেল বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন।
২০. নিউট্রিনো
আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখছি বলা যায় তার প্রায় পুরোটুকু তৈরি মাত্র তিনটি কণা দিয়ে। সেগুলো হচ্ছে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। আমরা বস্তু বলতে যা বোঝাই তার সবগুলো তৈরি হয়েছে অণু দিয়ে আর সব অণু তৈরি হয়েছে পরমাণু দিয়ে। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, সেই নিউক্লিয়াস তৈরি হয় প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে। এর মাঝে প্রোটনের চার্জ হচ্ছে পজিটিভ, নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই। প্রোটনের পজিটিভ চার্জে আটকা পড়ে তাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে নেগেটিভ চার্জের ইলেকট্রন। সবচেয়ে সহজ পরমাণু হচ্ছে হাইড্রোজেন তার মাঝে একটা প্রোটন এবং তাকে ঘিরে ঘুরছে একটা ইলেকট্রন। হাইড্রোজেন এত সহজ পরমাণু যে তার নিউক্লিয়াস শুধু একটা প্রোটন কোনো নিউট্রন পর্যন্ত নেই। পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে যখন প্রোটনের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন বাইরে ইলেকট্রনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। যেমন লোহার পরমাণুর কেন্দ্রে 26টা প্রোটন (এবং তিরিশটা নিউট্রন) বাইরে 26টা ইলেকট্রন। বিখ্যাত পরমাণু ইউরোনিয়ামের কেন্দ্রে 92টা প্রোটন (এবং 146টা নিউট্রন!) এবং তাকে ঘিরে ঘুরছে 92টা ইলেকট্রন। ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রনের মাঝে সবচেয়ে হালকা ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রনের ভর ইলেকট্রন থেকে প্রায় দুই হাজার গুণ বেশি। কাজেই কোনো কিছুর ভর আসলে সেই বস্তুটার মাঝে থাকা প্রোটন আর নিউট্রনের ভর।