- বইয়ের নামঃ আজ চিত্রার বিয়ে
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
চিত্রাদের বাড়ির পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক
আজ চিত্রাদের বাড়ির পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক। অথচ বাড়ির সবাই ভাব করছে যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। আজকের দিনটা আলাদা কোনো দিন না। অন্য আর দশটা দিনের মতোই। সবাই অভিনয় করে স্বাভাবিক থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। অভিনয় করে স্বাভাবিক থাকা বেশ কঠিন ব্যাপার। চিত্রাদে বাড়ির কেউই অভিনয়ে তেমন পারদর্শী না। কাজেই বাড়ির সবাইকে খানিকটা অস্বাভাবিক লাগছে। সবচে অস্বাভাবিক লাগছে চিত্রার মা শায়লা বানুকে। সামান্য কোনো উত্তেজনার বিষয় হলেই তার প্যালপেটিশন হয়, কপাল ঘামতে থাকে, ঘন ঘন পানির পিপাসা পায়। এই তিনটিই এখন তার হচেছ। অথট ভাল করছেন কিছুই হয়েছে না। তার সামনে পিরিচে ঢাকা পানির গ্লাস। কিন্তু তিনি এখনো গ্লাসে চুমুক দেন নি।
তারা সবাই অপেক্ষা করছে একটা টেলিফোন-কলের অন্যে। চিত্রার মেজোখালা উত্তরা থেকে টেলিফোনটা করবেন। বিশেষ খবরটা দেবেন। ইয়েস অথবা নো।
চিত্রার বিয়ের আলাপ-আলোচনা চলছে। বরপক্ষের লোকজন দুই দফা মেয়ে দেখে গেছে। কিন্ত তাদের কথাবার্তা মোটেই স্পষ্ট না। হ্যাঁ-না বলা দূরে থাকুক, কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত দিচ্ছে না।
ছেলে সবার খুব পছন্দের। লম্বা, গায়ের রঙ বিলেতি সাহেবদের মতো। বাবা-মার একমাত্র ছেলে। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ছেলের বাবার ঢাকা শহরেই তিনটা বাড়ি। তার চেয়েও আশ্চর্য কলা তাদের নাকি লন্ডনেও একটা বাড়ি আছে। ছুটি কাটাতে তারা যখন লন্ডন যায় তখন হোটেলে ওঠে না, নিজেদের বাড়িতে ওঠে। ছুটি কাটাতে সব সময় যে লন্ডন যায় তাও না। গত বছর গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। বড়লোকদের দুটা ভাগ আছে। এক ভাগ হলো সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া গ্রুপ। ছুটি ছাটায় এরা সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার বাইরে যেতে পারে না। আরেক ভাগ আমেরিকা-লন্ডন অপ। চিলার যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচেই সে আমেরিকা-লন্ডন পের।
সেই তুলনায় চিত্রারা কিছুই না। ঢাকা শহরে তাদেরও একটা বাড়ি আছে। দোতলা ফাউন্ডেশনের একতলা বাড়ি। এই বাড়ির জুনো ব্যাংকে লোন আছে বিশ লাখ টাকা। প্রতি দুমাস পরে পরে ব্যাংক থেকে একটা চিঠি আসে। তখন চিত্রার মা শায়লা বানুর মুখ শুকিয়ে যায়। সংসার চালানো, ব্যাংকের লোন দেয়া, দুই মেয়ের পড়াশোনা সবই তার একার দেখতে হয়। চিত্রার বাবা চৌধুরী খলিলুর রহমান মোটেই সংসারী মানুয় না। তিনি এজি অফিসের বিল সেকশানের নিচের দিকের অফিসার। চাকরি শুরু করেছিলেন হেড এসিসটেন্ট হিসেবে। দুটা প্রমোশন পেতে তার কুড়ি বছর লেগেছে। অফিসে যাওয়া, অফিস থেকে ফেরা। মাঝে মধ্যে অফিস থেকে ফেরার পথে টুকটাক কাঁচাবাজার করা ছাড়া সংসারে তার কোনো ভূমিকা নেই।
শায়লা বানু সংসারের এই অবস্থাতেও মোটামুটি ভেলকি দেখিয়েছেন। যাত্রাবাড়িতে সাড়ে তিনকাঠা জমির উপর বাড়ি করেছেন। রাজমিস্ত্রি ডেকে বাড়ি বানিয়ে ফেলা না, রীতিমতো আর্কিটেক্ট দিয়ে ডিজাইন করে বাড়ি বানানো। বাড়ির অর্ধেকটা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার টাকায় ব্যাংকের লোন শোধ দেয়া হচ্ছে। তিনি নিজে এনজিওতে একটা চাকরি যোগাড় করেছেন। সন্ধ্যার পর তাকে কাজে যেতে হয়। বয়স্কদের নিক্ষরতা দূর করার একটা প্রকল্পের তিনি শিক্ষিকা। এই চাকরিতেও তিনি খুব ভালো করছেন। শিক্ষিকা থেকে তিনি এখন হয়েছেন প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর। এনজিওর বেতন ভালো। বেতনের একটি টাকাতেও তিনি হাত না দিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করেন। টাকাটা জমা হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের খরচের জন্যে। তা ছাড়া এই বাড়ি তার দোতলা করা ইচ্ছা। দোতলা হয়ে গেলে পুরো একতলাটা তিনি কোনো এনজিওকে ভাড়া দিয়ে দেবেন। সে রকম কথাও হয়ে আছে।
তিনি যে অবস্থানে আছে। সেখান থেকে মেয়ের এত ভালো নিয়ে আশা করা ঠিক না। তিনি আশাও করেন নি। চিত্রা খুবই সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু গায়ের রঙ ময়লা। বাংলাদেশে মেয়ের সৌন্দর্যবিচারে গায়ের রক্তের ভূমিকাই প্রধান। গায়ের রঙ ধরে শাদা হলে ট্যারা চোখের মেয়ে, ভালো করে তাকালে যার নাকের নিচে সূক্ষ্ম গো দেখা যায় তাকেও রূপবতী হিসেবে গণ্য করা হয়। শাশুড়ি পাড়া-প্রতিবেশীকে গুন আহ করে সৃষ্ট দেখাতে দেখাতে গোপন অহঙ্কার নিয়ে লেন আমার বউয়ের গায়ের রঙটা ময়লা, খুব শখ ছিল— রঙ দেখে বউ আনব। কি আর করা, সব শখ তো পূরণ হয় না।
শায়লা শানুর সব শখই মনে হয় পূরণ হতে যাচেছ। খুবই আশ্চর্যজনকভাবে আমেরিকা-লন্ডন গ্রুপের একনে পাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। চিত্র কার্জন হল থেকে যাছিল ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে। এর আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় পানি জমে আছে। সে সাবধানে ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার পাশ শেষে একটা পাজেরো জিপ গেল এবং তাকে পানিতে-কাদায় মাখামাখি করে ফেলল। এরকম পরিস্থিতিতে গাড়ি কখনো দাঁড়ায় না। দ্রুত চোখের আড়াল হয়ে যায়। চিত্রার ব্যাপারে সেরকম হলো না। গাড়ি একটু সামনে গিয়েই ব্রেক কমে দাঁড়াল। গাড়ি যে চালাচ্ছিল সে নেমে এল (অত্যন্ত সুপুরুষ এক যুবক। গায়ের রঙ সাহেবদের মতো। উচ্চতা ছয় ফুট এক ইঞ্চি। পরনে মার্ক এন্ড স্পেনসার কোম্পানির গাঢ় নীল রেজার।) যে নেমে এল তার নাম আহসান খান। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। এই হলো যোগাযোগের সূত্র।