ভাইরাস এমনিতে অনেকটা প্রাণহীন জড় পদার্থের মতো। জীবিত প্রাণীর ভেতর আশ্রয় নিলে এটি জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভাইরাস আকারে খুবই ছোট, সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে এদের দেখা যায় না। এইচ.আই.ভি ভাইরাস তুলনামূলকভাবে একটু বড় হলেও রক্তের যে লোহিত কণিকার মাত্র ষাট ভাগের এক ভাগ। ভাইরাসদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নেয়ার কোনো উপায় নেই–যদি থাকত তাহলে এইচ. আই. ভি. ভাইরাস নিশ্চয়ই থাকত সবার উপরে। জীবজগতের হিসেবে যে প্রাণী যত বেশি দিন যত বেশি জায়গায় টিকে থাকতে পারবে সে তত সফল, সেই হিসেবে এইচ.আই.ভি, অত্যন্ত সফল কারণ সে একেবারে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে। একটা ভাইরাস যদি তার বাহনকে খুব দ্রুত শেষ করে ফেলে তাহলে তাকে ব্যবহার করে খুব বেশি দূর যেতে পারে না–যেমনটি হয়েছে এবোলা ভাইরাসের বেলায়। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভাইরাস হচ্ছে এবোলা ভাইরাস, এটা দিয়ে আক্রান্ত রোগী আক্ষরিক অর্থে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, শরীরের প্রতিটি বিন্দু দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে অত্যন্ত দ্রুত মারা যায়। এ কারণে এবোলা ভাইরাস বেশি দূর যেতে পারে না। সেই হিসেবে এইচ,আই,ভি, অত্যন্ত “বুদ্ধিমান”, একজন মানুষকে সংক্রমণ করার পর সে প্রায় দশ বছর সময় নেয় মানুষটি শেষ করার প্রক্রিয়া শুরু করতে। এই দশ বছর মানুষটি প্রায় সুস্থ-সবল মানুষের মতো থাকে, নিজের শরীরে ভাইরাসটি বহন করে এবং সে অন্যদের শরীরে সেটা ছড়িয়ে দেবার সুযোগ পায় । ভাইরাসটি কীভাবে ছড়াবে সে ব্যাপারেও এইচ, আই, ভি, অত্যন্ত সুবিবেচক-সর্দি-কাশির মতো বাতাসের ভেতর দিয়ে কিংবা এবোলা ভাইরাসের মতো স্পর্শের ভেতর দিয়ে ছড়ায় না। এইচ.আই.ভি, ভাইরাস ছড়ানো রীতিমতো কঠিন। একজন সুস্থ মানুষ যদি এইচ.আই.ভি. আক্রান্ত মানুষের থেকে ভাইরাসটি নিতে চায় তাকে তার জন্যে রীতিমতো পরিশ্রম করতে হবে, হয় তার সাথে দৈহিক মিলন করতে হবে কিংবা রক্ত নিতে হবে। এর মাঝে প্রকৃতি একটু নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে ফেলেছে–কারণ একজন শিশু সন্তান এইচ.আই.ভি আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ খেয়েও সেটা পেয়ে যেতে পারে। যেহেতু এইচ.আই.ভি.-এর কোনো ভ্যাক্সিন নেই কিংবা এইডসের কোনো চিকিৎসা নেই তাই এই কৌশলী ভাইরাসকে পরাস্ত করার একটাই উপায়, তার সংক্রমণকে বন্ধ করা। কাজটা সহজ নয় কারণ পৃথিবীতে অসচেতন বা অবিবেচক মানুষের অভাব নেই। তারা অনেক সময় জেনেশুনে এবং অনেক সময় না জেনেই এই কৌশলী ভাইরাসটিকে অন্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আমি যে এই ভাইরাসটিকে কৌশলী ভাইরাস বলছি তার একটা কারণ আছে, এটা কীভাবে কাজ করে শুনলে হতভম্ব হয়ে যেতে হয়। মোটামুটি গোলাকার এই ভাইরাসটি আমাদের শরীরে ঢুকে সোজাসুজি রোগ প্রতিরোধ করার যে কাষ আছে (T cell) সেগুলোকে আক্রমণ করে। সাধারণভাবে মনে হতে পারে ভাইরাসটা এই কোষগুলোকে আক্রমণ করে তাদের ধ্বংস করার জন্যে, আসলে সেটি সত্যি নয়। ভাইরাসগুলো অত্যন্ত কৌশলে কোষগুলোর দেওয়ালে মিলে গিয়ে ভেতরে তার দুটি আর.এন.এ.-এর টুকরো ঢুকিয়ে দেয়। (আমাদের জীবনের নীল নকশা থাকে ক্রোমোজমের ডি.এন.এ.-এর ভেতরে, ডি.এন.এ.তে দুটো সারি থাকে, তার একটা সারির একটা অংশকে বলে আর.এন.এ.) শুধু যে আর.এন.এ.কে ঢুকিয়ে দিয়েই সে কাজ শেষ করে তা নয়, সেই দুটি আর.এন.এ.কে প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয় মালমশলা ঢুকিয়ে দেয়। কোষের ভেতরে ঢুকেই তারা তাদের কাজ শুরু করে দেয় সেই আর.এন.এ.কে ব্যবহার করে তারা তার দুটি অবিকল কপি তৈরি করে। সেই অবিকল কপি দুটো একত্র হয়ে ডি. এন. এ. তৈরি করে। এরপর তারা যে কাজটি করে তার কোনো তুলনা নেই, তারা নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজমে গিয়ে তার আসল ডি.এন.এ. কেটে দুই ভাগ করে সেখানে নিজেকে জুড়ে দেয়। এইচ.আই.ভি, তখন সেই মানুষটার রোগ প্রতিরোধ কোষের একটা অংশ হয়ে যায়। সেই কোষ তখন তার অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজকর্মের সাথে সাথে এইচ.আই.ভি ভাইরাসের আর.এন.এ. তৈরি করতে থাকবে। সেই আর.এন.এ. কোষের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে পূর্ণাঙ্গ এইচ.আই.ভি, ভাইরাস তৈরি করে মুক্ত হয়ে বের হয়ে যায়। রোগ প্রতিরোধকারী সেই কোষ শেষ পর্যন্ত মারা পড়ে–তাই আমরা দেখতে পাই এইচ.আই.ভি, আক্রান্ত মানুষের রোগ প্রতিরোধকারী কোষ (T cell)-এর সংখ্যা কমে আসছে। এইচ,আই,ভি আক্রান্ত মানুষের শরীরের অবস্থা বোঝার জন্যে ডাক্তাররা প্রথমেই এই কোষগুলোর সংখ্যা গুনে দেখেন। রক্তে এর সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ থেকে কমে এলেই মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই কমে আসে। তখন এইডসের সূত্রপাত হয়।
এইডস AIDS হচ্ছে ইংরেজি Acquired Immune Dificiency Syndrome শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর দিয়ে তৈরি করা একটা শব্দ–নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে এই রোগে মানুষ তার প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শরীরে এইচ.আই.ভি, থাকলে বছর দশেক পর তার শরীরের টি-সেলের সংখ্যা যখন খুব কমে আসে তখন এইডস দেখা দেয়। এইডস দেখা দেবার পর মানুষ খুব বেশি সময় বাঁচে না, নয় মাস থেকে এক বছরের ভেতর সে মারা যায়। যেহেতু তার রোগ প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতা নেই তখন রাজ্যের যত রোগ-শোক আছে তাকে আক্রমণ করে। শরীরের ভেতরেই যে সব রোগ ঘাপটি মেরে ছিল, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্যে বেশি সুবিধে করতে পারছিল না, হঠাৎ করে সেই রোগগুলোই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে মানুষটি যক্ষ্মা, নিমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, ডায়রিয়া বা এরকম কোনো একটা রোগে মারা যায়।