স্টার ফিশ বা তারা মাছ কিন্তু এটাই নিয়মতিভাবে করে। ঝিনুক তার খুব প্রিয় খাবার। কখনো ঝিনুক পেলে সে তার বাহুগুলো দিয়ে সেটাকে জড়িয়ে ধরে। তার বাহুর নিচে যে হাজার খানেক পা আছে সেগুলো দিয়ে ঝিনুকের খোলসটাকে চুষে ধরে সে তখন ঝিনুকটাকে খোলার চেষ্টা করে। খুব বেশি নয় অল্প একটু খুলতে পারলেই সেই ফুটো দিয়ে সে তার পাকস্থলীটা ঝিনুকের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। স্টার ফিশের পাকস্থলীর জারক রস ঝিনুকের ভেতরকার নরম শরীরটাকে প্রায় হজম করে ফেলে–হজম হওয়া অংশটুকু পাকস্থলীতে ঢুকিয়ে পাকস্থলীটা আবার সুড়ুৎ করে স্টার ফিশ নিজের ভেতর নিয়ে নেয়। ভাগ্যিস আমাদের সেভাবে খেতে হবে না, তাহলে কী সমস্যাই না হতো!
অন্য প্রাণীদের খাওয়া নিয়ে আমরা কত রকম সমালোচনা করে ফেলছি, সেই প্রাণীগুলোও যদি আমাদের মতো সমালোচনা করতে পারত তাহলে তারা আমাদের খাওয়ার পদ্ধতি নিয়ে না জানি কী সমালোচনাই না করত! মা পাখি হয়তো তাদের বাচ্চাদের বলত–”তোমরা কী ভদ্র, আমরা তোমাদের খাইয়ে দিই তোমরা খাও! মানুষের বাচ্চা কী ভয়ঙ্কর–সরাসরি মায়ের শরীরে লেপটে থাকে, চুষে চুষে মায়ের দুধ খেয়ে ফেলে! কী ভয়ঙ্কর!”
ভাগ্যিস আমরা পাখির কথা শুনতে পাই না!
১২. খাদ্য যখন রক্ত
আমি যখন বেল কমিউনিকেশন্সে কাজ করি তখন আমার একজন সহকর্মী ছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধ ফেরৎ। একদিন গল্প করতে করতে বলল, “একবার ভিয়েতনামের জঙ্গলে হারিয়ে গেছি–দু’দিন থেকে খাওয়া নেই। তখন একটা গরুকে পেলাম। পেটে ভয়ঙ্কর খিদে তাই গরুর গলার একটা রগ কেটে চুমুক দিয়ে খানিকটা রক্ত খেয়ে নিলাম।” আমি বললাম, “সর্বনাশ! কী বলছ তুমি?” সে বলল, “এত অবাক হবার কী আছে? রক্ত খুব ভালো খাবার, অনেক প্রোটিন।”
কথাটি সত্যি, রক্তে অনেক প্রোটিন। প্রোটিন ছাড়াও রক্তে ধাতব মৌল লোহা থাকে। এই লোহা অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে লাল রং ধারণ করে বলে রক্তের রং লাল। কোনো কোনো প্রাণীর রক্তে লোহার বদলে থাকে তামা আর তামা যখন অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে তখন তার রং হয় নীল। গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া এবং কিছু কিছু মাকড়সার রক্ত এরকম, তার রং নীল। কীটপতঙ্গের রক্তে কোনো ধাতব মৌল থাকে না বলে তাদের রক্ত বর্ণহীন। তেলাপোকা থেঁতলে গেলে যে সাদা বস্তুটা বের হয়ে আসে সেটাই হচ্ছে তার সাদা রঙের রক্ত। তাই সব রক্তই যে লাল সেটা কিন্তু সত্যি নয়।
আমার ভিয়েতনাম যুদ্ধ ফেরৎ সহকর্মীর রক্ত খাওয়ার গল্পটা বাড়াবাড়ি মনে হলেও সেটা কিন্তু পুরোপুরি অবিশ্বাস্য নয়। আফ্রিকার মাসাই সম্প্রদায় গরুর কোনো একটা ধমনি থেকে রক্ত ঝরিয়ে তার সাথে দুধ মিশিয়ে নিয়মিতভাবে খায়। খাবার হিসেবে সেটা চমৎকার!
মানুষ রক্ত খাচ্ছে চিন্তা করলেই আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে কিন্তু কিছু কিছু প্রাণীর মূল খাবারই হচ্ছে রক্ত। এর মাঝে রয়েছে উকুন, ছারপোকা, এঁটেল পোকা এবং জোঁক।
কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে অনেক মানুষই জোঁককে খুব ভয় পায়, জোঁকের কথা শুনলেই ভয়ে, আতঙ্কে এবং ঘৃণায় তাদের সারা শরীর রি-রি করে ওঠে। কিন্তু কেউ কী জানে একসময় জোঁক ছিল সর্বরোগের চিকিৎসা? জোঁক চিকিৎসার পদ্ধতি হিসেবে এতই জনপ্রিয় ছিল যে 1864 সালে শুধুমাত্র ফ্রান্সেই 2 থেকে 3 কোটি জোঁক ব্যবহার করা হয়েছিল! কেন করবে না? জোঁকের ইংরেজি হচ্ছে Leech আর এটা হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় চিকিৎসকের একটা অত্যন্ত প্রাচীন প্রতিশব্দ, যার মানে এক সময় জোঁক ছিল চিকিৎসক।
পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ছয়শ ভিন্ন ধরনের সেঁক রয়েছে, জোঁক একেবারে ছোট কয়েক মিলিমিটার থেকে শুরু করে এক হাত পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। জোঁকের গঠন খুবই সহজ সরল–একটা হচ্ছে মুখ যেদিক দিয়ে খাবার ঢোকে অন্যটা হচ্ছে বহির্গমন পথ! দুটিই আবার চুষনির মতো, শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারে। জোকের চোয়াল তিনটি। সেই তিন চোয়ালে থাকে তিন পাটি দাঁত। কোনো কিছু কামড়ে ধরে যখন সে দাঁত দিয়ে কাটে তখন কাটাটুকু হয় ইংরেজি Y-এর মতো। জোঁকের লালা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং রহস্যময় বস্তুর একটি, সেটা নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। যখন সে কোনো প্রাণীর চামড়া কামড়ে ধরে রক্ত খাবার জন্যে সেটা কেটে ফেলে সেই প্রাণী কিন্তু মোটেও ব্যথা পায় না। তার কারণ জোঁকের লালায় যে রাসায়নিক দ্রব্য আছে সেটা হচ্ছে ব্যথা নিরাময়কারী, শুধু তাই নয় রক্তের প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্যে সেই লালায় রক্ত যেন জমাট না বাঁধে সেই জিনিসও রয়ে গেছে! জেঁক রক্ত খেয়ে আক্ষরিক অর্থে ঢোল হয়ে যায়। একটা জোক তার শরীরের ওজন থেকে প্রায় নয় গুণ বেশি রক্ত খেয়ে ফেলতে পারে। রক্ত খাওয়া শেষ হবার পর জোঁক তার কামড় ছেড়ে দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। ভালো করে এক পেট খাবার পর তার সেগুলো ধীরেসুস্থে হজম করতে হয়।
রক্ত খুব পুষ্টিকর খাদ্য তাই একবার ভালো করে খেলে জেকদের প্রায় কয়েক মাস কিছু খেতে হয় না। (জোঁকের তুলনায় আমরা মানুষেরা নেহায়েতই অগোছালো প্রজাতি–দিনে অনন্ত তিন বার না খেলে আমাদের ভালোই লাগে না!)
জোঁক একই সাথে নারী এবং পুরুষ। নারী দেহে যা থাকা দরকার এবং পুরুষ দেহে যা থাকা দরকার দুটোই তাদের আছে। যখন তাদের সন্তান জন্ম দেবার সময় হয় তখন একটি জোঁক অন্য জোঁককে জড়িয়ে ধরে একজনের ডিম্বাণুকে অন্যের শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত কুরে দেয়। তারপর একটা ছোট গুটলির মতো জায়গায় ডিম পেড়ে কোথাও রেখে দেয়। সেই ডিম ফুটে জোঁকের বাচ্চারা বের হয়ে আসে।