এরপর রাত্তিরে পর পর অনেকগুলো ঘটনা ঘটল। সেগুলো ঠিক মতো লেখার চেষ্টা করছি। বাইরে বারান্দায় সিঁড়ির দরজার পাশে একটা গ্র্যান্ডফাদার ক্লিক থাকার দরুন ঘটনার সময়গুলো আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়নি।
প্রথমেই বলে রাখি যে গদি বালিশ তেশকের দিক থেকে শোবার ব্যবস্থা ভাল হলেও, একটা ব্যাপারে গণ্ডগোল হয়ে যাওয়াতে প্রথম রাত্তিরে ঘুমটা একদম মাটি হয়ে গিয়েছিল।
তার কারণ আমাদের তিনজনের মশারিতেই ছিল ফুটা। মশারি ফেলার দশ মিনিটের মধ্যে ভেতরে মশা ঢুকে কামড় আর বিনবিনুনির জ্বালায় আমাদের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল। ফেলুদার সঙ্গে ওডোমস থাকে, শেষটায়। তাই মেখে কিছুটা আরাম পাওয়া গেল। বাইরের ঘড়িতে তখন ঢং ঢেং করে এগারোটা বেজেছে? দিনের বেলা মেঘলা থাকলেও এখন জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছিল। সবেমাত্র চোখের পাতাটা বুজে এসেছে এমন সময় একটা চেনা গলায় ধমকের সুরে কথা এল।
আমি শেষবারের মতো বলছি–এর ফল ভাল হবে না।
গলাটা মহীতোষবাবুর। উত্তরে কে যে কী বলল তা বোঝা গেল না। তার পরে সব চুপচাপ। আমার বাঁদিকে লালমোহনবাবুর মশারির ভিতর থেকে নাক ডাকার শব্দ শুরু হয়েছে। আমি ডান পাশে ফেলুদার খাটের দিকে ফিরে চাপা গলায় বললাম, শুনলে?
গম্ভীর ফিসফিসে গলায় উত্তর এল, শুনেছি। ঘুমো।
আমি চুপ করে গেলাম।
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমটা যখন ভাঙল তখনও ঘরে চাঁদের আলো রয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে মেঘের গর্জনও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। একটা লম্বা গুডগুড়ানি থামলে পর আরেকটা শব্দ কানে এল। ঘুট ঘুট…ঘুট ঘুট…ঘুট ঘুট…তালে তালে, একটানা শব্দ নয়। মাঝে মাঝে হচ্ছে, মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে মেঘের গর্জনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। শব্দটা হচ্ছে বেশ কাছ থেকেই। আমাদের ঘরের ভিতরেই। ফেলুদার খাটের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে কান পাততেই ওর জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ার শব্দ পেলাম ও ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু লালমোহনবাবুর নাক ডাকা বন্ধ কেন? ওঁর খাটের দিকে চেয়ে ডবল মশারির ভিতর দিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। কিন্তু একটা ক্ষীণ শব্দ যেন আসছে। খাটের দিক থেকে। এটা আমার চেনা শব্দ স্বাক্স-রহস্যের ব্যাপারে সিমলার বরফের মধ্যে একটা পিস্তলের গুলি লালমোহনবাবুর পায়ের কাছে এসে পড়ায় তার দাঁতে দাঁত লেগে ঠিক এই শব্দটাই হয়েছিল।
সেই সঙ্গে আবার সেই শব্দটা কানে এল। ঘুট ঘুট…ঘুট ঘুট…ঘুট ঘুট…
আমি ঘাড় কাত করে মেঝের দিকে চাইলাম। ফলে মশারিটা একটু নড়ে ওঠাতে বোধহয় লালমোহনবাবু বুঝলেন আমার ঘুম ভেঙে গেছে। একটা বিকট চাপা ঘড়ঘড় স্বরে তিনি বলে উঠলেন, ত-তপেশ-বা-বাঘ।
বাঘ শুনেই আমার চোখ মেঝের বাঘছালটার দিকে চলে গেল, আর যেতেই যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত জল হয়ে গেল।
জ্যোৎস্নার আলো বাঘের মাথাটার উপর পড়েছে, আর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মাথাটা মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক নড়ে উঠছে, আর তার ফলেই ঘুট ঘুট শব্দ হচ্ছে।
আর থাকতে না পেরে, যা থাকে কপালে ভেবে ফেলুদার নাম ধরে একটা চাপা চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ফেলুদার ঘুম যতই গাঢ় হোক না কেন, ও সব সময় এক ডাকে উঠে পড়ে, আর ওঠামাত্র ওর মধ্যে আর ঘুমের লেশমাত্র থাকে না।
কী ব্যাপার? চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?
আমারও প্রায় লালমোহনবাবুর দশা। কোনওরকমে ঢোক গিলে বলে ফেললাম, মেঝে…বাঘ।
ফেলুদা মশারির ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বাঘটার নড়ন্ত মাথাটার দিকে একদৃষ্টি খানিকক্ষণ দেখে নিল। তারপর দিব্যি নিশ্চিন্তভাবে এগিয়ে গিয়ে বাঘের থুতনিটা ধরে উপরে তুলতেই তার নীচ থেকে একটা গুবরে পোকা বেরিয়ে পড়ল। ফেলুদা অম্লান বদনে সেটাকে দু আঙুলের চাপে তুলে নিয়ে বলল, গুবরের আসুরিক শক্তির কথাটা কি তোদের জানা নেই? একটা কাঁসার জামবাটি চাপা দিয়ে রাখলে সেটাকে সুন্ধু টেনে নিয়ে সারা বাড়ি চক্কর দিতে পারে।
ভয়ের কারণটা এত সামান্য জানলে অবিশ্যি ঘামটাম আপনা থেকেই শুকিয়ে যায়। আমার আর লালমোহনবাবুরও তাই হল। এদিকে ফেলুদা গুবরেটাকে নিয়ে জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে দেখি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এই গভীর রাত্তিরে ফেলুদা কী দেখছে সেটা ভাবছি, এমন সময় ও ডাক দিল, তোপসে, দেখে যা।
আমি আর লালমোহনবাবু ফেলুদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আগেই বলেছি। পশ্চিমদিকটা বাড়ির পিছন দিক, আর এদিক দিয়েই কালকুনির জঙ্গল দেখা যায়। এই ক মিনিটের মধ্যেই কালো মেঘে চাঁদ ঢেকে ফেলেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল বটে, কিন্তু তা ছাড়াও আর একটা আলো দেখে অবাক লাগল। আলোটা মনে হল জঙ্গলের ভিতর ঘোরাফেরা করছে। টর্চের আলো।
হাইলি সাসপিশাস, ফিসফিস করে বললেন লালমোহনবাবু।
আলোটা এবার নিবে গেল।
এবার একটা চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের সঙ্গে সঙ্গে একটা কানফাটা বাজের আওয়াজ, আর তার পরমুহূর্তেই বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা শুরু হয়ে গেল। পশ্চিমদিক থেকেই ছাঁট, তাই দুটো জানালারই শার্সি বন্ধ করে দিতে হল। ফেলুদা বলল, একটা বেজে গেছে, শুয়ে পড়ে। কাল সকালে আবার জল্পেশ্বরের মন্দির দেখতে যাবার কথা আছে।
আমরা তিনজনেই আবার মশারির ভিতর ঢুকলাম।
জানালায় রঙিন কাচ থাকার ফলে বিদ্যুৎ চমকালেই ঘরে রামধনুর রং খেলছিল। সেই রং দেখতে দেখতেই আবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা টেরই পাইনি।
০৫. ফাস্ট ক্লাস চা
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল প্রায় সাতটায়। ফেলুদা অবিশ্যি তার আগেই উঠে যোগব্যায়াম, দাড়ি কামানো-টামানো সব সেরে ফেলেছে। কথা আছে, তড়িৎবাবু আটটায় এসে আমাদের নিয়ে জল্পেশ্বরের মন্দির দেখিয়ে আনবেন। মহীতোষবাবুর তিনজন চাকরের মধ্যে যার নাম কানাই, সে আমাদের চা দিয়ে গেল সাড়ে সাতটার কিছু পরে। ফেলুদা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কোলের উপর রাখা খোলা খাতাটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে প্রায় আপন মনেই বলে উঠল, ধন্যি আদিত্যনারায়ণ। তুখোড় বুদ্ধি বলতে হবে।