তড়িৎবাবু যে কখন দরজার মুখটাতে এসে দাঁড়িয়েছেন তা টেরই পাইনি। ভদ্রলোক শাস্তভাবেই বললেন, চরিতাভিধানটা নিয়েছিলাম, সেটা রেখে দিতে এসেছি।
ঠিক আছে, রেখে যাও। আর প্রুফটা দেখা হয়ে গিয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তা হলে কাল ওটা সঙ্গে করে নিয়ে যেয়ো। আর সেকেন্ড প্রফেও এত ভুল থাকে কেন এই নিয়ে কড়া করে কথা শুনিয়ে দিয়ে এসো তো।
তড়িৎবাবু হাতের বইটা আলমারির তাকে একটা ফাঁকের মধ্যে গুঁজে দিয়ে চলে গেলেন। মহীতোষবাবু বললেন, তড়িৎ কাল দিন-সাতেকের জন্য কলকাতা যাচ্ছে। ওর মা-র অসুখ।
ফেলুদা এখনও ছড়াটার দিকে দেখছিল। বলল, এ সংকেতের কথা আর কে জানে? মহীতোষবাবু ঘরের বাতি নিবিয়ে দিয়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, এটা পাওয়া গেছে। এই দিন-দশেক হল। আমাদের বংশের ইতিহাস লিখব বলে পুরনো বাক্স-প্যাটরা ঘেঁটে দলিলপত্তর বার করছিলাম। একটা স্টিল ট্রাঙ্কে ঠাকুরদার চিঠিপত্র ছিল। ফিতোয় বাঁধা চিঠির তাড়ার তলা থেকে এই বাক্সটা বেরোয়। আসলে কী জানেন— এটার কথা যে—কজন জানে— অথাৎ আমি, শশাঙ্ক আর আমার সেক্রেটারি— তাদের কারুরই ক্ষমতা নেই এর মানে উদ্ধার করার। এটার জন্যে একটা বিশেষ ক্ষমতার প্রয়োজন। ভাষার মারপ্যাঁচ জানা চাই। সেটা আপনি জানেন কি না সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
ফেলুদা কাগজটা ফেরত দিয়ে দিল।
সে কী, আপনি কি হাল ছেড়ে দিলেন নাকি? মাহীতোষবাবু ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
ফেলুদা হেসে বলল, না। ওটা আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। ঘরে গিয়ে খাতায় লিখে নিচ্ছি। এটা আপনাদের মূল্যবান পারিবারিক সম্পত্তি, এটা আপনাদের কাছেই থাকুক।
০৪. বাঘছাল
আপনি তো দিব্যি মশাই একটি বাঘছাল বাগাবেন বলে মনে হচ্ছে। আর আমি?
একটু যেন মনমরা হয়েই কথাটা বললেন লালমোহনবাবু। আমাদের খাওয়াদাওয়া হয়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক হল। তারপর নীচে বৈঠকখানায় বসে মহীতোষবাবুর কাছে নানারকম লোমহর্ষক শিকারের গল্প শুনে এই কিছুক্ষণ হল নিজেদের ঘরে এসেছি। লালমোহনবাবুর কথায় ফেলুদা বলল, কেন? যে-ই সংকেতটার সমাধান করবে। সেই বাঘছাল পাবে। অন্তত পাওয়া উচিত। কাজেই আপনিও তাল ঠুকে লেগে পড়তে পারেন। আপনি তো সাহিত্যিক মানুষ, ভাষার উপর বেশ দখল আছে।
আরো মশাই ভাষার উপর দখল মানে কি আর সংকেতের উপর দখল? মহীতোষবাবুও তো সাহিত্যিক। উনি হাল ছেড়ে দিলেন কেন? না মশাই, ও সব মুড়ো বুড়ো গাছ মাছ, তাল ফাঁক তুই ফাঁক-ওসব আমার দ্বারা হবে না। আপনার ভাগ্যেই বুলিছে বাঘছাল। এই এইটে দেবে নাকি?
লালমোহনবাবু মেঝোয় রাখা বাঘছালটির দিকে আঙুল দেখালেন। ফেলুদা বলল, ভদ্রলোক বড় বাঘের কথা বললেন শুনলেন না? ওসব চিন্তা-টিতায় আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।
ফেলুদা এর মধ্যেই ছড়াটা খাতায় লিখে নিয়েছে, আর খাটে বসে সেটার দিকে একদৃষ্ট্রে দেখছে।
কিছু এগোলেন? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
ফেলুদা খাতার পাতা থেকে চোখ না তুলেই বলল, গুপ্তধনের সংকেত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কী করে বুঝলেন? ওই মুড়ো-বুড়োর ব্যাপারটা কী?
সেটা এখনও জানি না, তবে একটা গাছের কথা যেন বলা হচ্ছে তাতে; তো কোনও সন্দেহ নেই। মুড়ো হয় বুড়ো গাছ। তারপর বলছে হাত গোন ভাত পাঁচ। এখানে হাতটা। ইম্পিট্যািন্ট। সাধারণত এসব সংকেত প্ৰথমে একটা বিশেষ জায়গার কথা বলে, তারপর সেখান থেকে কোনদিকে কতদূরে গেলে গুপ্তধন পাওয়া যাবে সেটা বলে। রবীন্দ্রনাথের গুপ্তধন পড়েননি? তেঁতুল বটের কোলে দক্ষিণে যাও চলে, ঈশান কোণে ঈশানি বলে দিলাম নিশ্বানি? তেমনই এখানেও হাত কথাটা পাচ্ছি, দিক কথাটা পাচ্ছি। এই জন্যেই বলছি–
ফেলুদার কথাটা শেষ হল না, কারণ ঘরে আরেকজন লোক ঢুকে পড়েছে।
দেবতোষ সিংহরায়।
সকালের সেই বেগুনি ড্রেসিং গাউনটা এখনও পরা, আর চোখে সেই অদ্ভুত চাহনি, যেন মনে হয় সকলকেই সন্ধে করেছেন। দেবতোষবাবু সোজা লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা কি ভোটরাজার লোক?
লালমোহনবাবু ফ্যাকাশে হয়ে ঢোক গিলে বললেন, ভ্-ভোট মানে কি আপনি ভ্-ভোটিং-মানে, ই-ইলেকশনের–?
না, উনি বোধহয় ভুটান রাজের কথা বলছেন।
ফেলুদা কথাটা বলায় দেবতোষবাবুর দৃষ্টি ফেলুদার দিকে ঘুরে গেল, আর তার ফলে লালমোহনবাবু একটা বিশ্ৰী অবস্থা থেকে উদ্ধার পেয়ে গেলেন।
শুনেছিলাম ভোটেরা নাকি আবার আসছে? দেবতোষবাবু প্রশ্নটা ফেলুদাকেই করলেন।
ফেলুদা খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল, সেরকম তো শুনিনি। তবে আজকাল ইচ্ছে করলে ভূটান যাওয়া যায়।
ও, তাই বুঝি।
মনে হল দেবতোষবাবু এই প্রথম খবরটা শুনলেন।
তা বেশ। উপেন্দ্ৰকে ভোটরাজ অনেক হেলপ করেছিল। ওরা ছিল বলেই নবাবের সেনা কিছু করতে পারেনি। ওরা যুদ্ধটা জানে। সবাই জানে কি? দেবতোষবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, হাতিয়ার কি আর সবার হাতে বাগ মানে? সবাই কি আর আদিত্যনারায়ণ হয়?
কথাটা বলে দেবতোষবাবু দরজার দিকে ঘুরে দু পা এগিয়ে গিয়ে থেমে গেলেন। তারপর মুখ ঘুরিয়ে মেঝের বাঘটার দিকে চেয়ে একটা অদ্ভুত কথা বললেন।
যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা মাটি ছুঁত না। তাও শেষটায় ছুঁল।
ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। তারপর ফেলুদা বিড়বিড় করে বলল, খড়ম পরেছে। তাতে রবারের সাইলেন্সার লাগানো।