আমরা আরেকটু হলেই বাঘ দেখে ফেলেছিলাম! ছেলেমানুষের মতো চেঁচিয়ে বলে উঠলেন লালমোহনবাবু।
বছর দশেক আগে এলে নিশ্চয়ই দেখে ফেলতেন, বললেন মহীতোষবাবু, আজ যে দেখতে পেলেন না, তার জন্যে অবিশ্যি আমাদের মতো শিকারিরাই খানিকটা দায়ী। শিকারটাকে যে স্পোর্টের মধ্যে ধরা হত কি না; আজকে নয়, আদ্যিকাল থেকে। পৌরাণিক যুগে রাজারা মৃগয়ায় যেতেন। মোগল বাদশাৱাও যেতেন। ইদানীংকালে আমাদের দুশো বছরের প্রভু সাহেবরাও যেতেন, আর আমরাও গেছি। এই দু হাজার বছরে তীরের ফল আর বন্দুকের গুলিতে কত জনোয়ার মরেছে ভাবতে পারেন? তারপর সার্কাস আর চিড়িয়াখানার জন্য কত জন্তু-জানোয়ার ধরা হয়েছে তার কোনও হিসেব আছে কি?
ফেলুদা মহীতোষবাবুর দিকে চেয়ার এগিয়ে দেওয়াতে ভদ্রলোক বললেন, বাসব না। আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে এসেছি। চলুন, আমার ঠাকুরদার ঘরে চলুন। ঘরটা দেখেও আনন্দ পাবেন।
মহীতোষবাবুর ঠাকুরদার ঘর উত্তরদিকের বারান্দায় উত্তর-পূর্ব কোণে। ঘরের দিকে যেতে যেতে ফেলুদা বলল, আপনার ঠাকুরদার শেষ বয়সে পাগল হয়ে যাওয়ার গল্প শুনছিলাম শশাঙ্কবাবুর কাছে।
মহীতোষবাবু একটু হেসে বললেন, পাগল হবার আগে ষাট বছর বয়স অবধি তার মতো পরিষ্কার মাথা খুব কম লোকেরই দেখেছি।
যে তলোয়ারটা দিয়ে বাঘ মারতে গিয়েছিলেন, সেটা এখনও আছে কি?
সেটা ঠাকুরদার ঘরেই আছে। চলুন দেখাচ্ছি।
আদিত্যনারায়ণ সিংহরায়ের ঘরের তিন দিকের দেয়ালে আলমারিতে ঠাসা বই, পুঁথিপত্র আর খবরের কাগজের ডাঁই। অন্য দিকের দেওয়ালের সামনে রয়েছে দুটো সিন্দুক আর একটা কাচের আলমারি। আলমারির মধ্যে খুঁটিনাটি কত রকম যে জিনিস রয়েছে তা একবার দেখে মনে রাখা অসম্ভব। বাঘের নখ, গণ্ডারের শিং, হাতির দাঁত আর ধাতুর তৈরি নানারকম ছোটবড় মূর্তি, পাথর-বিসানো ভুটিয়া গয়নাগাটি, তাঁর প্রিয় ভুটিয়া কুকুরের গলার বকলসতাতেও লাল নীল হলদে পাথর বসানো! এ ছাড়া আছে একটা রুপের কলম আর দোয়াত, একটা মোগল আমলের দূরবীন, আর দুটো মড়ার মাথার খুলি। ওপরের দুটো তাকের এই জিনিসগুলোর কথা আমার মনে আছে। নীচের দুটো তাকে রয়েছে খালি অস্ত্রশস্ত্ৰ। কারুকার্য করা তিনশো বছরের পুরনো পিস্তল, গোটা আষ্ট্রেক ছারা, ভোজলি আর কুকরি, আর একটা তলোয়ার। এই তলোয়ারটা নিয়েই আদিত্যনারায়ণ বাঘ মারতে গিয়েছিলেন। পাগল না হলে এমন কাজ কেউ করে না, কারণ তলোয়ারটা খুব বেশি বড় নয়। বিকনিরের কেল্লায় রাজপুত রাজাদের যে তলোয়ার দেখেছিলাম সেগুলো এর চেয়ে অনেক বেশি বড় আর ভারী।
ইতিমধ্যে মহীতোষবাবু একটা সিন্দুক খুলে তার ভিতর থেকে একটা হাতির দাঁতের কাজ করা ছাট্ট বাক্স বার করে এনেছেন। এবার সেটা থেকে একটা পুরনো ভাঁজ-করা কাগজ বার করে বললেন, ডিটেকটিভদের তো নানারকম ক্ষমতা থাকে শুনেছি। আপনি হেঁয়ালির সমাধান করতে পারেন কি, মিস্টার মিত্তির?
ফেলুদা বলল, এককালে ওদিকটায় ঝোঁক ছিল সেটা বলতে পারি।
ফেলুদা একটা ইংরেজি সংকেতের সমাধান করেছিল সোনার কেল্লার ব্যাপারে। বাংলা আর ইংরেজি হেঁয়ালির অনেক বই ওর কাছে আছে, আর বিদগ্ধমুখমণ্ডলম বলে একটা সংস্কৃত হেঁয়ালির বইও আছে। মহীতোষবাবু এবার হাতের কাগজটা ফেলুদাকে দিয়ে বললেন, আপনারা তিন দিন থাকবেন বলছিলেন। তার মধ্যে যদি এই সংকেতের সমাধান না হয়, তা হলে আরও তিনটে দিন সময় দিতে পারি। তার পরে–আর না।
শেষের কাটা কথা বলার সময় ভদ্রলোকের স্বরটা যে কীরকমভাবে বদলে গেল তা ঠিক লিখে বোঝাতে পারব না। কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারলাম যে মহীতোষবাবুর ভিতরে একটা কঠিন মানুষ রয়েছে, আর সময় সময় সেই মানুষটা বাইরে বেরিয়ে পড়ে। যেমন এখন পড়ল। গলার স্বরের সঙ্গে সঙ্গে মহীতোষবাবুর চোখের চাহনিটাও বদলে গিয়েছিল, আর সেটা স্বাভাবিক হবার আগেই ফেলুদার প্রশ্ন এল–
আর যদি পারি?
ফেলুদা যে ঠিক কড়া ভাবে প্রশ্নটা করেছিল তা নয়। এমনকী করার সময় ঠোঁট আর চোখের কোণে একটা হালকা হাসির ভাবও ছিল; কিন্তু এও বুঝতে পারলাম যে মহীতোষবাবুর ভিতরের শক্ত মানুষটাকে রুখে দাঁড়াবার মতো শক্তি ফেলুদার আছে।
মহীতোষবাবু এবার বেশ সহজভাবে হেসে বললেন, যদি পারেন তো আমার মারা বড় বাঘের একটা ছাল আমি আপনাকে উপহার দেব।
আজকালকার দিনে একটা রয়েল বেঙ্গলের ছাল যে নেহাত ফেলনা জিনিস নয়। সেটা আমি জানতাম।
মহীতোষবাবুর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে তাতে মুক্তোর মতো হাতের লেখা সংকেতটা ফেলুদা একবার বিড় বিড় করে পড়ল—
মুড়ো হয় বুড়ো গাছ
হাত গোন ভাত পাঁচব
দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে।
ফাল্গুন তাল জোড়
দুই মাঝে ভুঁই ফোঁড়
সন্ধানে ধন্দায় নবাবে।
আপনার ঠাকুরদা কি কোনও গুপ্তধনের সন্ধান দিয়েছেন এই সংকেতে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
আপনার কি তাই মনে হয়?
শেষের লাইনটাতে তো সেই রকমই একটা ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে হয়। সন্ধানে। ধন্দায় নবাবে। এমন জিনিস যার সন্ধান পেলে নবাবের মনও ধাঁধিয়ে যায়। ধনদৌলতের কথাই তো মনে হয়। অবিশ্যি আপনার ঠাকুরদা সে রকম লোক ছিলেন কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। সকলে তো আর সংকেত লিখে গুপ্তধন লুকিয়ে রাখে না।
ঠাকুরদার পক্ষে সব কিছুই সম্ভব ছিল। তিনি চিরকালই খামখেয়ালি মানুষ ছিলেন, রং-তামাশা করতে ভালবাসতেন, প্র্যাকটিক্যাল জোক পছন্দ করতেন। ছেলেবিয়সে একবার বাড়ির গুরুজনদের উপর রাগ করে মাঝরাত্তিরে উঠে তাঁদের প্রত্যেকের চটি জুতো খড়ম নাগরা সব নিয়ে তালগাছের মাথায় ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলেন। এটা যদি গুপ্তধনের সংকেত হয়, তা হলে সেটাও তার খামখেয়ালিপনারই একটা নমুনা বললে বোধহয় ভুল হবে না। মোটকথা। আপনি— কী চাই, তড়িৎ?