তিনটে খাটের উপরে মশারি খাটানো রয়েছে, আর রয়েছে প্রায় আট ইঞ্চি পুরু গদি, দুটো করে নকশা করা ওয়াড় লাগানো বালিশ, আর একটা করে পাশ বালিশ। লালমোহনবাবু সব দেখেটেখে বললেন, তিনটে দিন দিব্যি আরামে কাটবে বলে মনে হচ্ছে মশাই; তবে আশা করি, দাদাটি আর রাজুণ্টাজুর খবর নিতে বেশি আসবেন না। এদিকটায়। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, পাগলের সান্নিধ্যটা আমার কাছে রীতিমতো অস্বস্তিকর।
এ কথাটা আমারও যে মনে হয়নি তা নয়। তবে ফেলুদা ও নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত বলে মনে হল না। বাক্স খুলে জিনিস বার করতে করতে একবার খালি ভুরু কুঁচকে বলল, মহীতোষবাবু আমার কাছে কী ধরনের উপকার আশা করছেন সেটা এখনও বোঝা গোল
০৩. তড়িৎবাবু কাজে ব্যস্ত ছিলেন
তড়িৎবাবু কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলে বিকেলে আর আমাদের সঙ্গে বেরোতে পারলেন না। তার বদলে এলেন মহীতোষবাবুর বন্ধু শশাঙ্ক সান্যাল। ইনিও দেখলাম। এদিকে এত দিন থেকে জঙ্গল আর জানোয়ার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে ফেলেছেন। সাড়ে চারটেতেই প্রায় অন্ধকার হয়ে-যাওয়া জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে জিপে করে যেতে যেতে কত রকম গাছপালা আর কত রকম পাখির ডাক যে আমাদের চিনিয়ে দিলেন। ত্ৰিশ বছর আগে এ জঙ্গলে বাঘের ংখ্যা কত বেশি ছিল তাও বললেন। ত্রিশ বছর ধরেই আছেন। ভদ্রলোক লক্ষ্মণবাড়িতে। আসলে কলকাতার লোক, ইস্কুল আর কলেজে মহীতোষবাবুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছেন।
রোদ যখন প্ৰায় পড়ে এসেছে তখন একটা সরু নদীর ধারে এসে আমাদের গাড়িটা থামাল। শশাঙ্কবাবু বললেন, একবার নামবেন নাকি? চলন্ত গাড়ির ভিতর থেকে জঙ্গলের পরিবেশটিা ঠিক ধরতে পারবেন না।
জিপ থেকে নেমেই প্রথম বুঝতে পারলাম জঙ্গলটা কত গভীর আর নিস্তব্ধ। বাসায় ফিরে যাওয়া পাখির ডাক আর নদীর ফুরিয়ে আসা জলের কুলকুল শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। সঙ্গে বন্দুক না থাকলে ভয়ই করত। বন্দুক রয়েছে যার হাতে সে নাকি এখানকার একজন নামকরা পেশাদারি শিকারি। নাম মাধবীলাল। আগে যখন বিদেশ থেকে শিকারিরা এখানে আসত তখন মাধবীলালই নাকি তাদের গাইডের কাজ করত। কোন রাস্তায় বাঘ চলাফেরা করে, কোন গাছে মাচা বাঁধা উচিত, কোন জন্তুর ডাকের কী মানে, এ সব নাকি মাধবীলালই বলে দিত। বছর পঞ্চাশ বয়স, পেটানো শরীর, তাতে চর্বির লেশমাত্র নেই।
আমরা জিপ থেকে নেমে একটু এগিয়ে গিয়ে নদীর ধারে বালি আর নুড়ি-পাথরের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। এ কথা সে কথার পর ফেলুদা শশাঙ্কবাবুকে জিজ্ঞেস করল, দেবতোষবাবু পাগল হলেন কী করে?
শশাঙ্কবাবু বললেন, এদের বংশে ইনিই প্রথম পাগল নন। মহীতোষের ঠাকুরদাদারও শেষের দিকে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
তই বুঝি? তা হলে শিকারের ব্যাপারটা…?
সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হাতের কাছ থেকে বন্দুক-টন্দুক সব সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এক’দিন হঠাৎ বৈঠকখানার দেওয়াল থেকে একটা পুরনো তলোয়ার খুলে নিয়ে সেটাই হাতে করে জঙ্গলে চলে গেলেন বাঘ মারতে। ইস্কুলে থাকতে ইতিহাসের বইয়ে শের শাহ-র কথা পড়েছেন তো?–ইনি উত্তরুকালে তরবারির এক আঘাতে একটি বাঘের মস্তক ছেদন করিয়া শেয় আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। –পাগল অবস্থায় আদিত্যনারায়ণের শের শাহ হবার শখ জাগে।
তারপর? লালমোহনবাবু চোখ গোল গোল করে চাপা গলায় প্রশ্নটা করলেন।
সেই যে গেলেন, আর ফেরেননি। এক তলোয়ার ছাড়া আর প্রায় সব কিছুই বাঘের পেটে গিয়েছিল।
ঠিক এই সময় কাছেই একটা জানোয়ারের চিৎকার শুনে লালমোহনবাবু প্রায় তিন হাত লাফিয়ে উঠলেন। শশাঙ্কবাবু হেসে বললেন, আপনি এত অ্যাডভেঞ্চারের বই লেখেন, আর শেয়ালের ডাক শুনেই এই অবস্থা?
না, মানে লেখক বলেই কল্পনাশক্তিটা একটু বেশি কি না। আপনি বাঘের কথা বললেন, আর আমিও দেখলুম হলদে মতো কী জানি একটা ওই ঝোপটার পিছন দিয়ে চলে গেল।
এখনও যায়নি, তবে কিছুক্ষণের মধ্যে যেতে পারে।
কথাটা খুব নিচু গলায় বললেন শশাঙ্কবাবু।
ওইটাই কি বার্কিং ডিয়ারের ডাক? ফেলুদাও ফিসফিস জিজ্ঞেস করল।
একটা জন্তু ডেকে উঠেছে কয়েকবার। অনেকটা কুকুরের মতো ডাক। বাঘ কাছাকাছি এলেই বার্কিং ডিয়ার বা কাকর হরিণ ডেকে ওঠে এটা আমি ফেলুদার কাছে শুনেছি। শশাঙ্কবাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে আমাদের জিপে গিয়ে বসতে ইশারা করলেন। আমরা প্রায় নিঃশব্দে গিয়ে যে যার জায়গায় বসে পড়লাম; অন্ধকার আরও বেড়েছে। হরিণটা আবার ডেকে উঠল। জিপের হুড ফেলে দেওয়া হয়েছিল, কাজেই আশেপাশে কোনও জানোয়ার এলে আমরা সবাই দেখতে পাব। আমার বুকের ভিতরটা টিপ টিপ করছে; মাধবীলালও গাড়ির কাছে এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লালমোহনবাবু একবার আমার হাতটা ধরাতে বুঝতে পারলাম ওঁর হাতের তেলো বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
প্রায় ছটা পর্যন্ত দম বন্ধ করে অপেক্ষা করেও কোনও জানোয়ার দেখতে না পেয়ে আমরা বাড়ি চলে এলাম।
সন্ধ্যার দিকে পশ্চিমের আকাশ দেখতে দেখতে কালো মেঘে ছেয়ে গেল, আর চোখ ধাঁধানো শিকড় বার-করা বিদ্যুতে আকাশটা বার বার চিরে যেতে লাগল। আমরা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তাই দেখছিলাম, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খোলাই ছিল, ঘুরে দেখি মহীতোষবাবু।
কীরকম বেড়ালেন? ভদ্রলোক তাঁর জাঁদরেল গলায় প্রশ্ন করলেন।