ট্রোফি রুম মানে বাঘ ভালুক বাইসন হরিণ কুমিরের চামড়া আর মাথায় ভরা একটা বিশাল ঘর। ঘরের মেঝে আর দেওয়ালে তিল ধরার জায়গা নেই। এতগুলো জানোয়ারের জোড়া জোড়া পাথরের চোখ চারিদিক থেকে আমাদের দিকে চেয়ে আছে দেখলেই গা-টা ছমছম করে। শুধু জানোয়ার নয়; যেসব অস্ত্ৰ দিয়ে এই জানোয়ার মারা হয়েছে সেগুলোও ঘরের এক পাশে একটা খাঁজকাটা র্যাকের উপর রাখা রয়েছে। দোনলা একনলা পাখি-মারা বাঘ-মারা হাতি-মারা কতরকম যে বন্দুক তার ঠিক নেই।
এই সব দেখতে দেখতে ফেলুদা তড়িৎবাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনিও শিকার করেছেন নাকি?
তড়িৎবাবু একটু হেসে মাথা নেড়ে বললেন, একেবারেই না। আপনি গোয়েন্দা, আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারছেন না?
ফেলুদা বলল, শিকারি হলেই যে ষণ্ডা লোক হতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই। আসলে তা নার্ভের ব্যাপার। আপনাকে দেখে ও জিনিসটার অভাব আছে বলে মনে করার তো কোনও কারণ দেখছি না।
তা হয়তো নেই, তবে শিকারে প্রবৃত্তি নেই। আমি কলকাতার সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। শিকার-টিকারের কথা কোনওদিন ভাবতেই পারিনি।
ট্রোফি রুম থেকে বেরিয়ে বাইরের বারান্দা দিয়ে দোতলার সিড়ির দিকে যেতে যেতে ফেলুদা বলল, শহরের ছেলে জঙ্গলের দেশে এলেন যে বড়?
তড়িৎবাবু বললেন, পেটের দায়ে। বি এ পাস করে বসেছিলাম। কাগজে সেক্রেটারির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন মহীতোষবাবু। অ্যাপ্লাই করি, ইন্টারভিউয়ে ডাক পড়ে, আসি, চাকরিটা হয়ে যায়।
কদ্দিন আছেন?
পাঁচ বছর।
শিকার না করলেও জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেন বোধহয়?
মানে? তড়িৎবাবু একটু অবাক হয়েই ফেলুদার দিকে চাইলেন।
আপনার ডান হাতে তিনটে আচাড়ের দাগ দেখছি। মনে হল কাঁটাগাছ থেকে হতে পারে।
তড়িৎবাবুর গম্ভীর মুখে হাসি দেখা দিল। বললেন, আপনার দৃষ্টিশক্তির পরিচয় পাওয়া গেল! কালই লেগেছে। আঁচড়। জঙ্গলে ঘোরা একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাতিয়ার ছাড়াই? অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ফেলুদা প্রশ্ন করল।
তড়িৎবাবু শান্তভাবে জবাব দিলেন, ভয়ের তো কিছু নেই। এক সাপ আর পাগলা হাতির জন্য দৃষ্টিটা একটু সজাগ রেখে চললে জঙ্গলে কোনও ভয় নেই।
কিন্তু ম্যান-ইটার? চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
সেটার অস্তিত্ব প্রমাণ হলে জঙ্গলে যাওয়া ছাড়তে হবে বইকী।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকে একটা দরজা পেরোতেই একটা প্ৰকাণ্ড লম্বা কারান্দায় এসে পড়লাম। বাঁ দিকে রেলিং, ডানদিকে সারি সারি ঘর। প্রথম ঘরটাই নাকি মহীতোষবাবুর কাজের ঘর, তড়িৎবাবুকেও দিনের বেলা এখানেই বসতে হয়। কিছু দূর গিয়ে বারান্দাটা দিকে ঘুরে গেছে। এটা হল পশ্চিমদিক। এটারও ডান দিকে ঘরের সারি, আর তারই মধ্যে একটা ঘর হল আমাদের ঘর। ফেলুদা বলল, এত ঘরে করা থাকে মশাই?
তড়িৎবাবু বললেন, বেশির ভাগই ব্যবহার হয় না, বন্ধ থাকে। পুবের বারান্দায় একটা ঘরে মহীতোষবাবু থাকেন, আর একটায় ওঁর দাদা দেবতোষবাবু। শশাঙ্কবাবুর ঘর দক্ষিণে। আমারও তাই। আরও দুটো ঘর মহীতোষবাবুর দুই ছেলের জন্য রয়েছে। দুজনেই কলকাতায় চাকরি করে, মাঝে-মধ্যে আসে।
এবার চোখে পড়ল আমাদের উলটাদিকে পুবের বারান্দায় বেগুনি ড্রেসিং গাউন পরা একজন লোক রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টি আমাদের দিকে দেখছে। ফেলুদা বলল, উনিই কি মহীতোষবাবুর দাদা?
তড়িৎবাবু কিছু বলার আগেই গুরুগম্ভীর গলায় প্রশ্ন শোনা গেল— তোমরা রাজুকে দেখেছ, রাজু?
দেবতোষবাবু আমাদেরই উদ্দেশে প্রশ্নটা করেছেন। ভদ্রলোক এর মধ্যেই পুব থেকে উত্তরের বারান্দায় চলে এসেছেন, তাঁর লক্ষ্য আমাদেরই দিকে। এখন বুঝতে পারছি ভদ্রলোকের চেহারায় মহীতোষবাবুর সঙ্গে বেশ মিল আছে, বিশেষ করে চোয়ালের কাছটায়। তড়িৎবাবু আমাদের হয়ে জবাব দিয়ে দিলেন, না, এঁরা দেখেননি।
দেখেনি? আর হোসেন? হোসেনকে দেখেছে?
ভদ্রলোক ক্ৰমে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। এবার বুঝতে পারছি ওঁর চোখ দুটো কেমন যেন ঘোলাটে। মাথার সব চুল পাকা, আর মহীতোষবাবুর মতো ঘন নয়। লম্বায় হয়তো ভাইয়ের কাছাকাছি, কিন্তু কুঁজো হয়ে পড়াতে অতটা মনে হয় না!
তড়িৎবাবু, না, হাসেনকেও দেখেননি বলে আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে ইশারা করলেন।
দেখেনি? দেবতোষবাবুর গলায় যেন একটা হতাশার সুর।
না, তড়িৎবাবু বললেন, এঁরা নতুন এসেছেন, কিছু জানেন না।
রাজু আর হাসেন কারা মশাই? ঘরে ঢুকে ফেলুদা প্রশ্ন করল।
তড়িৎবাবু হেসে বললেন, রাজু হল কালাপাহাড়ের আরেক নাম। আর হাসেন হল হাসেন খাঁ। গৌড়ের সুলতান ছিল। দুজনেই বাংলাদেশের অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছে; জল্পেশ্বরের মন্দিরের মাথা হাসেন খাঁ-ই ভাঙে।
আপনি কি ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
না! সাহিত্য। মহীতোষবাবু জলপাইগুড়ির ইতিহাস লিখছেন, তাই সেক্রেটারি হিসেবে আমাকেও কিছুটা জেনে ফেলতে হচ্ছে।
তড়িৎবাবু চলে যাবার পর আমরা তিনজন প্রথম হাঁপা ছাড়ার সুযোগ পেলাম। ঘরটি দিব্যি ভাল। এ ঘরেও দুটো দরজার উপর দুটো হরিণের মাথা রয়েছে। অন্য ঘরে জায়গা হয়নি বলেই বোধহয় মেঝেতেও একটা মাথা সমেত চিতাবাঘের ছাল দুটো খাটের মাঝখানে হাত-পা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দুটো খািট আর একটা খাটিয়া গোছের জিনিস, সেটা বোধহয় আগে ছিল না, আমরা তিনজন লোক বলে এনে রাখা হয়েছে। ফেলুদা খাটিয়াটা দেখে বলল, দেখে মনে হয় এটাকে শিকারের মাচা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, দড়ি বাঁধার দাগ রয়েছে এখনও। তোপসে, তুই ওটাতে শুবি।