আশ্চর্য বলতে হবে, লালমোহনবাবু বললেন, পঞ্চাশ বছর বয়সে প্রথম বই লিখলেন, কিন্তু পড়লেই মনে হয় একেবারে পাকা লিখিয়ে।
শিকারিদের মধ্যে এ জিনিসটা আগেও দেখা গেছে! করবেটের ভাষাও আশ্চর্য সুন্দর। হয়তো এটা জংলি আবহাওয়ার গুণ। পৌরাণিক যুগে যে সব মুনি-ঋষিরা বেদ-উপনিষদ লিখেছেন, তাঁরাও জঙ্গলেই থাকেন।
শেয়ালদা ছাড়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই লক্ষ করছিলাম, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মাঝ রাত্তিরে যখন নিউ ফারাক্কা স্টেশনে গাড়ি থামল, তখন ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখি বাইরে তেড়ে বৃষ্টি হচ্ছে, আর তাঁর সঙ্গে ঘন ঘন মেঘের গর্জন। সকালে নিউ জলপাইগুড়িতে পৌঁছে বুঝলাম এ দিকটায় মেঘলা হলেও, গত ক দিনের মধ্যে বৃষ্টি হয়নি।
যে ভদ্রলোকটি আমাদের নিতে এলেন তিনি অবিশ্যি মহীতোষবাবু নন। ত্ৰিশের নীচে বয়স, রোগা, ফরসা, মাথার চুল উসকো-খুসকো, চোখে মোটা কাচের মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোক আমাদের দেখে যে খুব একটা বাড়াকড়ি রকম খাতিরের ভাব করলেন তা নয়, তবে তার মানে যে তিনি খুশি হননি সেটা নাও হতে পারে। মানুষের বাইরের ব্যবহার থেকে ফস করে তার মনের আসল ভাব সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নেওয়াটা যে কত ভুল, সেটা ফেলুদা বার বার বলে। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি মহীতোষবাবুর সেক্রেটারি। নাম তড়িৎ সেনগুপ্ত। আমাদের মধ্যে কোনজন প্রদোষ মিত্তির আর কোনজন লালমোহন গাঙ্গুলী সেটা ভদ্রলোক দিব্যি আন্দাজে ধরে ফেললেন।
স্টেশনের বাইরে মহীতোষবাবুর জিপ অপেক্ষা করছিল। আমরা দশ মিনিটের মধ্যে স্টেশনেই চা আর ডিমা-টাস্ট খেয়ে নিয়ে জিপে গিয়ে উঠলাম। আমাদের তিনজনের দুটো সুটকেস, আর ফেলুদার একটা কাঁধে-ঝোলানো ব্যাগ ছাড়া মাল বলতে আর কিছুই নেই, কাজেই জিপে জায়গার অভাব হল না। গাড়ি ছাড়ার মুখে তড়িৎবাবু বললেন, মহীতোষবাবু নিজে আসতে পারলেন না বলে দুঃখিত। ওঁর দাদার শরীরটা ভাল নেই; ডাক্তার এসেছিল, তাই ওঁকে থাকতে হল।
মহীতোষবাবুর যে দাদা আছে সেটাই জানতাম না। ফেলুদা বলল, বেশি অসুখ কি? আমি বুঝতে পারছিলাম অসুখের বাড়িতে অতিথি হয়ে গিয়ে হাজির হতে ফেলুদার একটা কিন্তু কিন্তু ভাব হচ্ছিল।
তড়িৎবাবু বললেন, না। দেবতোষবাবুর অসুখ অনেক দিনের। মাথার ব্যারাম। এমনিতে বিশেষ ঝঞাটি নেই। উন্মাদ নন মোটেই। দু মাসে তিন মাসে এক-আধবার মাথাটা একটু গরম হয়, তখন ডাক্তার এসে ওষুধের বন্দোবস্ত করে দেন।
বয়স কী রকম? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
চৌষট্টি। মহীতোষবাবুর চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। পণ্ডিত লোক ছিলেন। ইতিহাস নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছেন।
গাড়ি থেকে উত্তর দিকে হিমালয় দেখা যাচ্ছে। ওই দিকেই দাৰ্জিলিং। দাৰ্জিলিং আমি তিনবার গেছি, কিন্তু এবার যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে আগে কখনও যাইনি। আকাশে মেঘ জমে আছে, তাই গরমটা কম। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে চা বাগান পড়ছে। শহর ছাড়ার পর থেকেই দৃশ্য ক্রমে বদলে যাচ্ছে। এবার পুব দিকেও পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তড়িৎবাবু বললেন, ওটাই ভুটান।
তিস্তা পেরোবার কিছু পর থেকেই পথের ধারে জঙ্গল পড়তে লাগল। লালমোহনবাবু একপাল ছাগল দেখে হঠাৎ, হরিণ, হরিণ! বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ফেলুদা বলল, তাও ভাল, বাঘ বলেননি।
তড়িৎবাবুর কথায় জানলাম মহীতোষবাবুর বাড়ির পশ্চিম দিকে মাইল খানেকের মধ্যেই নাকি একটা জঙ্গল রয়েছে, তার নাম কাল বুনি। সেখানে এককালে অনেক বাঘ ছিল, আর সে-সব বাঘ সিংহরায়রা শিকারও করেছেন। কিন্তু এখন বড় বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর আছে কি না সন্দেহ, যদিও মাস তিনেক আগে নাকি কালকুনিতে মানুষখেকো বাঘ আছে বলে একটা শোরগোল উঠেছিল।
আসলে নেই? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
তড়িৎবাবু বললেন, এক’দিন একটি আদিবাসী ছেলের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল জঙ্গলে, তার গায়ে বাঘের আঁচড় ছিল।
কিন্তু মাংস খায়নি?
খেয়েছিল, কিন্তু সেটা বাঘ না হয়ে হয়না-জাতীয় কোনও জানোয়ারও হতে পারে।
মহীতোষবাবু কী বলেন?
উনি তখন ছিলেন না; হাসিমারার দিকে ওঁর চা বাগান আছে, সেখানে গিয়েছিলেন। বনবিভাগের কতাঁদের ধারণা বাঘ, কিন্তু মহীতাষবাবু বিশ্বাস করতে রাজি হননি। অবিশ্যি বনবিভাগের লোক এই তিন মাস খোঁজাখুঁজি করেও সে বাঘের কোনও সন্ধান পায়নি।
আর-কোনও মানুষ খাওয়ার ঘটনাও ঘটেনি?
না।
মানুষখেকোর কথাটা শুনেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। অবিশ্যি এ ব্যাপারে মহীতোষবাবুর কথাটাই মানতে হবে নিশ্চয়ই। লালমোহনবাবু সব শুনে-টুনে হাইলি ইন্টারেস্টিং বলে আরও বেশি ভুরু কুঁচকে জঙ্গলের দিকে দেখতে লাগলেন।
একটা ছোট নদী আর একটা বড় ভূজঙ্গল পেরিয়ে, বাঁয়ে একটা গ্রামকে ফেলে আমাদের জিপি পিচ-বাঁধানো রাস্তা ছেড়ে একটা কাঁচা রাস্তা ধরল। তবে ঝাঁকুনি বেশিক্ষণ ভোগ করতে হল না। মিনিট পাঁচেক চলার পর গাছের উপর দিয়ে একটা পুরনো বাড়ির মাথা দেখা গেল। আরও এগোতে ক্ৰমে গাছপালা পেরিয়ে গেটওয়ালা প্রকাণ্ড বাড়িটার পুরোটাই দেখতে পেলাম। বাড়ির রং এককালে হয়তো সাদা ছিল, এখন সমস্ত গায়ে কালসিটে পড়ে গেছে। রং যা আছে তা শুধু জানালার কাচগুলোতে; রামধনুর সাতটা রঙের কোনওটাই বাদ নেই।
শ্বেতপাথরের ফলকে সিংহরায় প্যালেস লেখা গোটটা পেরিয়ে আমাদের জিপ, বাড়ির গাড়ি-বারান্দার নীচে গিয়ে দাঁড়াল।
০২. মহীতোষবাবু যে এত ফরসা
মহীতোষবাবু যে এত ফরসা সেটা ছবি দেখে বোঝা যায়নি। লম্বায় ফেলুদার কাছাকাছি, যতটা রোগা ভেবেছিলাম ততটা না, মাথার চুল ছবির চেয়ে অনেক বেশি পাকা, আর বয়সের তুলনায় বেশ ঘন। শিকারিরা জঙ্গলে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে বসে থাকে বলে শুনেছি। ইনিও হয়তো তাই করেন, কিন্তু বাড়িতে কথা বলার সময় গলা থেকে যে গুরুগম্ভীর তেজীয়ান আওয়াজ বেরোয়, সেটা শুনলে হয়তো বাঘেরও চিন্তা হবে।