কী অনুরোধ?
এই গুপ্তধনের কিছু অংশ আমি আপনাকে দিতে চাই। সেটা আপনাকে নিতে হবে। ফেলুদা মহীতোষবাবুর চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে বলল, রৌপ্যমুদ্রা আমি চাই না মিস্টার সিংহরায়। কিন্তু একটা জিনিস। আমি নেব।
কী জিনিস?
আদিত্যনারায়ণের তলোয়ার।
লালমোহনবাবু কথাটা শোনা মাত্র এগিয়ে এসে ফেলুদার হাতে তলোয়ারটা দিয়ে দিল।
এই তলোয়ারটা আপনি চাইছেন? মহীতোষবাবু অবাক হয়ে বললেন। নারায়ণী রৌপ্যমুদ্রা না নিয়ে ইস্পাতের তলোয়ার নেবেন?
এ তলোয়ারকে আর সাধারণ তলোয়ার বলা চলে না মহীতোষবাবু! এর সঙ্গে ইতিহাস ছাড়াও আরও কিছু জড়িত হয়ে পড়েছে।
আপনি তড়িতের খুনের কথা বলছেন?
না।
তবে?
খুনের কথা বলছি না, কারণ তড়িৎবাবু খুন হননি।
তবে? আত্মহত্যা?
তাও না।
আপনি কি হেঁয়ালি তৈরি করছেন মিস্টার মিত্তির? মহীতোষবাবুর গলার স্বরে বুঝলাম, তার ভিতরের কঠিন মানুষটা আবার বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
ফেলুদা বলল, না, তা করছি না, মহীতোষবাবু। যা ঘটেছিল সেটাই বলতে যাচ্ছি। সেটা এত স্পষ্ট বলেই আমাদের দৃষ্টি সেদিকে যাচ্ছিল না। তলোয়ারটা তড়িৎবাবু নিজেই আদিত্যনারায়ণের ঘর থেকে সরিয়েছিলেন।
সে কী, কেন?
কারণ গুপ্তধন পেতে হলে তাকে মাটি খুঁড়তে হবে, আর তার জন্য শাবল জাতীয় একটা কিছুর দরকার। তড়িৎবাবুর হাতের সবচেয়ে কাছে ছিল এই তলোয়ারটা।
তারপর?
তারপর কী–সেটা বলার আগে এই তলোয়ারের একটা বিশেষত্ব আমি আপনাদের দেখতে চাই।
এই বলে ফেলুদা তলোয়ারটা নিয়ে কেন যেন শশাঙ্কবাবুর দিকে এগিয়ে গেল। শশাঙ্কবাবু সাহসী হলেও ফেলুদাকে ওইভাবে অস্ত্ৰ হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে একটু যেন উসখুসি করে উঠলেন। এবার ফেলুদা এক আশ্চর্য খেল দেখাল। সে তলোয়ারটা শশাঙ্কবাবুর হাতের বন্দুকের নলের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেল, আর খুব কাছাকাছি আসতেই একটা খটাং শব্দ করে ইস্পাতে ইস্পাতে জোড়া লেগে গেল।
এ কী, এ মে চুম্বক! বলে উঠলেন শশাঙ্কবাবু।
হ্যাঁ, চুম্বক, বলল ফেলুদা।তলোয়ারটাই চুম্বক, বন্দুকটা না। আগে চুম্বক ছিল না, কারণ আদিত্যনারায়ণের আলমারিতে তলোয়ারের পাশেই আরও ছোটখাটো অনেক লোহা আর ইস্পাতের জিনিস ছিল। চুম্বক হলে তলোয়ার বার করা বা রাখার সময় সেগুলো এর গায়ে আটকে যেত নিশ্চয়ই, কিন্তু যায়নি। এ তলোয়ার চুম্বকে পরিণত হয়েছে। পরশু রাত্রে।
কী করে? জিজ্ঞেস করলেন মহীতোষবাবু; সকলেই রুদ্ধশ্বাসে ফেলুদার কথা শুনছে। ফেলুদা বলল, কোনও মানুষের হাতে লোহা বা ইস্পাতের কোনও জিনিস থাকা অবস্থায় যদি তার উপর বাজ পড়ে, তা হলে সে জিনিস চুম্বকে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, সে জিনিস অনেক সময় বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করে। তড়িৎবাবুর মৃত্যু হয়েছিল বজ্ৰাঘাতে, এবং হয়তো এই তলোয়ারই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী। মাটি খুঁজে কলসি বার করার পর বৃষ্টি নামে, তার সঙ্গে বাজ ও বিদ্যুৎ। তড়িৎবাবু অশ্বত্থগাছের নীচে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসেন। বাজ পড়ে। তড়িৎবাবু ছিটকে পড়ার সময় তার হাতের তলোয়ার বুকে বিধে যায়। সম্ভবত মৃত্যুর পরমুহূর্তেই তলোয়ার তার দেহে প্রবেশ করে।
মহীতোষবাবুর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। তাঁর দৃষ্টি অশ্বত্থ গাছটার দিকে গেল। ভাঙা ভাঙা অস্ফুট স্বরে বললেন, তাই ভাবছিলাম, এই গাছটা হঠাৎ এত বুড়ো হয়ে গেল কী করে?
মহীতোষবাবুর কথার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লালমোহনবাবু বলে উঠলেন, তড়িৎবাবু শেষটায় তড়িৎপৃষ্ট হয়ে মারা গেলেন!
দুঃখের বিষয় ওঁর এই চমৎকার কথাটায় কান দেবার মতো মনের অবস্থা তখন কারুরই ছিল না।
***
আমরা আজ কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। আজ বাইরে রোদ, দু দিন বৃষ্টি হওয়ার দরুন গরমও কম। আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরে বসে আছি, মাঝে মাঝে বাইরে থেকে দেবতোষবাবুর গলা পাচ্ছি। সকালে উঠেই দেখেছি ওঁর ঘরের দরজায় আর তালা নেই; গাছ থেকে নামার সময় লালমোহনবাবুর হাঁটু ছড়ে গিয়েছিল। ক্ষতের উপর উনি স্টিকিং প্লাস্টার লাগাচ্ছেন, এমন সময় মহীতোষবাবুর চাকর একটা স্টিলের ট্রাঙ্ক মাথায় করে ঘরে ঢুকে সেটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, মহীতোষবাবু পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফেলুদা সেটা খুলতেই দেখা গোল তার মধ্যে খুব সাবধানে প্যাক করা রয়েছে একটা চমৎকার বাঘছাল। একটা খামও ছিল ট্রাঙ্কটার মধ্যে, তার ভিতরে তিন লাইনের একটা চিঠি—
ডিয়ার মিস্টার মিত্তির, আমার কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ এই বাঘছালটি গ্রহণ করিয়া আমাকে বাধিত করিবেন। ১৯৫৭ সালে সম্বলপুরের নিকটবর্তী এক জঙ্গলে আমার বন্ধু শ্ৰীশশাঙ্কমোহন স্যানাল কর্তৃক এই বাঘটি নিহত হইয়াছিল।
লালমোহনবাবু চিঠিটা পড়ে বললেন, দুজনের গুলিতে যেটা মরুল, সেটা কি দু ভাগে ভাগ করা হবে?
ফেলুদা বলল, না। ওটা শশাঙ্কবাবু আমাকেই দেবেন বলেছেন।
ও, তার মানে আপনি একাই…
না, একা না। দুটোর একটা আপনাকে উপহার দেব বলে স্থির করেছি।
উপহার?
উপহার। গাছের ডালে উঠে অজ্ঞান হয়েও যে মাটিতে না পড়ে ঝুলে থাকা যায়, সেইটে সৰ্বপ্রথম আপনিই প্রমাণ করেছেন।
লালমোহনবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন।
আরে মশাই, আমি তো বলেইছ আমার কল্পনাশক্তিটা সাধারণ লোকের চেয়ে একটু বেশি। আপনারা বলছেন বাঘ, আর আমি দেখছি একটা লেলিহান অগ্নিশিখা, আর তার মধ্যে একটা পৈশাচিক দানব দাঁত খিচুচ্ছে, আর সেই সঙ্গে কৰ্ণপটাহ বিদীর্ণ করা এক হুঙ্কার ছেড়ে একটা জেট প্লেন টেক অফ করছে আমারই উপর ল্যান্ড করবে বলে। এতেও যদি সংজ্ঞা না হারাই তো সংজ্ঞা জিনিসটা রয়েছে কী করতে?