মহীতোষবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, শশাঙ্ক যা করেছে তার বন্ধুর জন্য, তেমন আর কেউ করে না। ওর মতো শিকারি। আমাদের পরিষ্কারেও কেউ জন্মায়নি।
কিন্তু সম্প্রতি সেই বন্ধুত্বে কি একটু চিড় ধরেছিল?
মহীতোষবাবু আর শশাঙ্কবাবু দুজনেই চুপ করে আছেন দেখে ফেলুদা বলে চলল, বই বেরোবার আগে আমি অন্তত মহীতোষ সিংহরায়ের নাম শুনিনি। কিন্তু বেরোবার পরে আজ হাজার হাজার লোকে তাঁর নাম শুনেছে, এবং একটা বিরাট মিথ্যেকে সত্যি বলে মেনে নিচ্ছে। আসল শিকারি কিন্তু তাঁর ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেটা কি তিনি খুব সহজেই মেনে নিতে পারছেন? বন্ধুত্বের খাতিরে কতটা আত্মত্যাগ সম্ভব? আপনি সেদিন রাত্রে শশাঙ্কবাবুকেই কথা শোনাচ্ছিলেন না? আমি কি অনুমান করতে পারি যে, বেশ কিছুদিন থেকেই শশাঙ্কবাবু আর আপনার মধ্যে একটা মনোমালিন্য ও কথা কাটাকাটি চলছে?
এখনও দুজনে চুপ। ফেলুদা স্থির দৃষ্টিতে মহীতোষবাবুর দিকে চেয়ে থেকে বলল, মীনং সম্মতি লক্ষণম বলেই ধরে নিচ্ছি। আর, আরেকটা ব্যাপারেও আপনার বোধহয় মীন অবলম্বন ছাড়া রাস্তা নেই।
মহীতোষবাবু ভয়ে ভয়ে ফেলুদার দিকে চাইলেন। ফেলুদা বলল, তড়িৎবাবুর সাহিত্যকীর্তির জন্যই যে আপনি প্রশংসা পাচ্ছেন, সেটাও বোধহয় সত্যি। তাই নয়, মহীতোষবাবু? আপনি সেদিন আপনার পাণ্ডুলিপির কথা বললেন, কিন্তু আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আপনার লেখা একটি টুকরো কাগজও কোথাও পেলাম না। আসলে আপনি লিখতেন না, আপনি মুখে মুখে আপনার মতো করে বলতেন, আর তড়িৎবাবু সেটাকে তাঁর আশ্চর্য সাবলীল ভাষায় সাজিয়ে দিতেন। আর সেই সাজানো লেখা প্রকাশিত হত আপনার নামে। তড়িৎবাবুকে আপনি ভাল মাইনে দিতেন, তাকে আরামে রেখেছিলেন, তোয়াজে রেখেছিলেন এ সবই ঠিক। কিন্তু একজন সত্যিকারের গুণী স্ৰষ্টার পক্ষে ওগুলো যথেষ্ট নয়। মহীতোষবাবু। সে সবচেয়ে বেশি যেটা আশা করে সেটা হল তার গুণের আদর–যেটা না পেয়ে তড়িৎবাবুর মন ক্ৰমে ভেঙে যায়। তারপর সংকেতটা হাতে পড়ে, আর তার সমাধানও হয়ে যায়। নারায়ণী মুদ্রার কথাটা হয়তো তিনি আপনার পরিবারিক কাগজের মধ্যে পেয়েছিলেন। মোট কথা তিনি স্থির করেন যে, গুপ্তধন নিয়ে আপনার কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে যাবেন। কিন্তু সে আশা তাঁর পূর্ণ হল না।
মহীতোষবাবু যেন বেশ কষ্ট করেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সবই তো বুঝলাম মিস্টার মিত্তির, এর সবই ঠিক এবং কোনওটাই আমার শুনতে ভাল লাগছে না। কিন্তু তড়িৎকে এভাবে হত্যা করল কে? তার না হয় আমার উপর আক্রোশ ছিল, কিন্তু তার উপর কারও আক্রোশ ছিল বলে তো আমি জানি না। তড়িৎ ছাড়া আর কে এসেছিল সেদিন জঙ্গলে?
কে এসেছিল তা বোধহয় আমি বলতে পারি।
মহীতোষবাবু পায়চারি আরম্ভ করেছিলেন, ফেলুদার কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।
পারেন?
ফেলুদার দৃষ্টি ঘুরে গেল।
শশাঙ্কবাবু, আপনি সেদিন রাত্রে ট্রেফি রুম থেকে একটি উইনচেস্টার রাইফেল নিয়ে এই জঙ্গলে আসেননি? কাল রাত্রে ওটার বাঁটে সামান্য একটু মাটি লেগে রয়েছে দেখলাম, যেটা পরশু রাত্ৰে দেখিনি।
শশাঙ্কবাবুর নার্ভ বোধহয় বাঘ শিকার করেই আশ্চর্যরকম শক্ত হয়ে গিয়েছিল। উনি অদ্ভুত ঠাণ্ডাভাবে ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, যদি এসেই থাকি–আপনি তার কী মানে করতে চাইছেন সেটা বলবেন কি?
ফেলুদাও ঠিক শশাঙ্কবাবুর মতোই শাস্তভাবে বলল, বন্ধু সম্পর্কে আপনার হতাশা জাগিলেও আপনি তার গুপ্তধনের ওপর লোভ করবেন। সেটা আমি মোটেই ভাবছি না। তবে আমার ধারণা, তড়িৎবাবু যে সংকেতের সমাধান করে ফেলেছেন সেটা আপনি জানতেন, তাই না?
শশাঙ্কবাবু বললেন, শুধু তাই না, তড়িৎ গুপ্তধন পেলে তার অর্ধেক আমাকে আফার করেছিল। তড়িৎ বুঝেছিল মহীতোষ আমাদের দুজনকেই একইভাবে বঞ্চিত করছে। কিন্তু আমি তড়িতের প্রস্তাবে রাজি হইনি। শুধু তাই নয়, আমি গুপ্তধনের সন্ধানে এখানে আসতে অনেক বার বারণ করেছিলাম; কারণ ওই ম্যান-ইটার। শেষটায় সেদিন রাত্রে জানালা দিয়ে ওর টর্চের আলো দেখে আমি বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এখানে এসে দেখি গুপ্তধন পড়ে আছে, কিন্তু তড়িৎ নেই। তারপর অনুসন্ধান করে দেখলাম রক্তের দাগ, বাঘের পায়ের ছাপ। গুপ্তধন মন্দিরের ভিতর রেখে, সেই চিহ্ন ধরে আমি এগিয়ে যাই বাঁশবনের কাছাকাছি পর্যন্ত। বিদ্যুতের আলোতে দেখি বাঘ তড়িতের মৃতদেহের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। অন্ধকারে আন্দাজেই গুলি চালাই। বাঘ পালায়। তারপর…
শশাঙ্কবাবু কেন যেন চুপ করে গেলেন। ফেলুদা বলল, বাকিটা আমি বলি? এটাও অনুমান। ভুল হলে আমাকে শুধরে দেবেন।
বেশ। বলুন।
আপনিই কাল রাত্রে মাধবীলালের সঙ্গে কথা বলছিলেন না?
শশাঙ্কবাবু অস্বীকার করলেন না। ফেলুদা এবার আর একটা প্রশ্ন করল।
সেটা কি মন্দিরের পিছনে বাঘের জন্য টাপ ফেলার প্রস্তাব দিতে? ওই শিমুল গাছটার মগডালে শকুনির পাল দেখে মনে হচ্ছে ওর কাছাকাছি একটা মরা জানোয়ার পড়ে আছে।
মোষের বাচ্চা, চাপা গলায় বললেন শশাঙ্কবাবু।
তার মানে আপনি চাইছিলেন যে আজ বাঘ বেরোক, যাতে আপনি অন্তত একজন বাইরের লোকের সামনে প্ৰমাণ করে দিতে পারেন যে শিকারি আসলে হচ্ছেন আপনি, মহীতোষবাবু নন।
মহীতোষবাবু হঠাৎ ফেলুদার দিকে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত দিয়ে অনুনয়ের সুরে বললেন, মিস্টার মিত্তির, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করব, আপনাকে সেটা রাখতে হবে।