ফেলুদা অৰ্জ্জুন আর জোড়া তালের মাঝখানে গর্তটার দিকে এগিয়ে গেল। মহীতোষবাবুও গেলেন পিছন পিছন। আজ গর্তে আরও বেশি জল। ফেলুদা সেদিকে আঙুল দেখিয়ে নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে প্রথম কথা বলল।
এই গর্তে ছিল আদিত্যনারায়ণের গুপ্তধন।
কিন্তু,….সেটা গেল কোথায়? চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন মহীতোষবাবু।
কাছাকাছির মধ্যেই আছে, যদি না কালকের মধ্যে কেউ সেটা সরিয়ে থাকে।
মহীতোষবাবুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। আছে?
আপনি সত্যি বলছেন আছে?
আপনি জানেন সে গুপ্তধন কী জিনিস? ফেলুদা পালটা প্রশ্ন করল।
উত্তেজনায় মহীতোষবাবুর কপালের শিরা ফুলে উঠেছে, চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। বললেন, না জানলেও অনুমান করতে পারি। আমার পূর্বপুরুষ যশোবন্ত সিংহরায় ছিলেন। কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ ভূপের সেনাধ্যক্ষ। যশোবান্তের উপার্জিত টাকা-নিরনারায়ণের নিজের টাঁকশালের টাকা- যার নাম ছিল নারায়ণী টাকা— সেই টাকা ছিল আমাদের বাড়িতে। এক হাজারের উপর রৌপ্যমুদ্রা, চারুশো বছরের পুরনো। আদিত্যনারায়ণ যখন এ টাকা লুকিয়ে রাখেন, তখন তাঁর মাথা খারাপ হতে শুরু করেছে— ষাট বছর বয়সে ছেলেমানুর্ষি দুষ্ট-বুদ্ধি খেলছে। তিনি মারা যাবার পর সে টাকা আর আর পাওয়া যায়নি। এতদিনে এই সংকেত তার সন্ধান দিয়েছে। ও টাকা আমার চাই মিস্টার মিত্তির, ওটা হারালে চলবে না।
ফেলুদা মহীতোষবাবুর দিক থেকে ঘুরে মন্দিরের দিকে এগোচ্ছে। মন্দিরের কাছাকাছি পেঁৗছে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলল, তোপসে, বন্দুকটা ধর তো। মন্দিরের ভিতর রিভলভারই কাজ দেবে।
আমার হাত কাঁপতে শুরু করেছে। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বন্দুকটা হাতে নিলাম ! জিনিসটা যে এত অসম্ভব রকম ভারী সেটা দেখে বুঝতে পারিনি।
ফেলুদা মন্দিরের ভাঙা দরজা দিয়ে অন্ধকারের ভিতর ঢুকলা। চৌকাঠ পেরোনোর সময় লক্ষ করলাম, ও পকেটে হাত ঢোকাল।
পাঁচ গোনার মধ্যেই পর পর দু বার রিভলভারের আওয়াজে আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। তারপর মন্দিরের ভিতর থেকে ফেলুদার কথা শোনা গেল।
মহীতোষবাবু, আপনার লোকটিকে একবার পাঠান তো।
পর্বত সিং বন্দুকটা তার মনিবের হাতে দিয়ে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে এক মিনিটের মধ্যেই একটা সবঙ্গে কাদা-মাখা পিতলের ঘাড়া নিয়ে বেরিয়ে এল, তার পিছনে ফেলুদা। মহীতোষবাবু পর্বত সিং-এর দিকে ছুটে গেলেন। ফেলুদা বলল, কেউটের যে রৌপ্যমুদ্রার প্রতি মোহ থাকতে পারে এটা ভাবিনি। কালই শিসের শব্দ পেয়েছিলাম, আজ দেখি ঘড়াটাকে সস্নেহে আলিঙ্গন করে পড়ে আছেন বাবাজি।
মহীতোষবাবু হাত থেকে বন্দুক ফেলে দিয়ে সেই ঘড়াটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার ভিতর থেকে সবে একমুঠো। রুপোর টাকা বার করেছেন, এমন সময় একটা কাকর হরিণ ডেকে উঠল। আর তার ঠিক পরেই এক সঙ্গে অনেকগুলো বাঁদর আশপাশের গাছ থেকে চোঁচাতে আরম্ভ করল।
তারপরে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এতগুলো ঘটনা একসঙ্গে ঘটে গেল যে ভাবতেও মন ধাঁধিয়ে যায়। প্রথমে মহীতোষবাবুর মধ্যে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল। এক মুহূর্ত আগে যিনি একসঙ্গে এতগুলো রুপোর টাকা দেখে আহ্বাদে আটখানা হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি হাত থেকে সেই টাকা ফেলে দিয়ে ইলেকট্রিক শক্ খাওয়ার মতো করে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে এক লাফে তিন হাত পিছিয়ে গেলেন। আমরা সবাই যে যেখানে আছি সেখানেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছি। ফেলুদাই প্রথমে মুখ খুলল। কিন্তু তার গলার স্বর চাপা ফিসফিসে— তোপসে, গাছে ওঠ। লালমোহনবাবু, আপনিও।
আমার পাশেই ফোকলা ফকিরের গাছ। ফেলুদার হাতে বন্দুকটা চালান করে দিয়ে ফোকলা ফোকরে পা দিয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে একটা বড় ডাল ধরে দশ সেকেন্ডের মধ্যে আমি মাটি থেকে দশ হাত উপরে উঠে গেলাম। তার পরেই লালমোহনবাবু তার হাতের তলোয়ারটা আমার হাতে চালান দিয়ে একটা তাজ্জব ব্যাপার করলেন। অবিশ্যি উনি পরে বলেছিলেন যে ছেলেবেলায় আমতায় থাকতে নাকি অনেক গাছে চড়েছেন, কিন্তু চল্লিশ বছর। বয়সেও যে তিনি এক নিমেষে আমার চেয়ে উপরের একটা ডালে উঠে পড়তে পারবেন। এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
বাকি ঘটনাগুলো আমি উপর থেকেই দেখেছিলাম। লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ দেখে আর দেখতে পারেননি, কারণ তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন; তবে এমন আশ্চৰ্যভাবে তাঁর হাত-পা গাছের চওড়া ডালের দু দিকে ঝুলে ছিল যে তিনি মাটিতে পড়ে যাননি।
চারদিক থেকে বিশেষ বিশেষ জানোয়ার অশ্লাক্কা পাখির ডাক শুনেই বোঝা গিয়েছিল যে কাছাকাছির মধ্যে বাঘ এসে পড়েছে। অবিশ্যি বাঘ এদিকে আসার আর একটা কারণ ছিল সেটা পরে জেনেছিলাম। মোট কথা বাঘ আসছে বুঝেই ফেলুদা আমাদের গাছে চড়তে বলেছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার করলেন মহীতোষবাবু। তার এই চেহারা যে কোনওদিন দেখব সেটা ভাবিনি। অবাক হয়ে দেখলাম ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে ঘুরে দাঁতে দাঁত চেপে বলছেন, মিস্টার মিত্তির, আপনার যদি প্ৰাণের মায়া থাকে তো চলে যান।
কোথায় যাব মাহীতোষবাবু?
দুজনের হাতেই বন্দুক!
মহীতোষবাবুরটা উপর দিকে উঠছে ফেলুদার দিকে।
বলছি যান! আবার বললেন মহীতোষবাবু। জিপ রয়েছে ওই দিকে। আপনি চলে যান। আমি আদেশ করছি, আপনি—
মহীতোষবাবুর কথা শেষ হল না। একটা বাঘের গর্জনে সমস্ত বনটা কেঁপে উঠেছে। শুনলে মনে হবে না যে একটা বাঘ, মনে হবে পঞ্চাশটা হিংস্ৰ জানোয়ার একসঙ্গে গর্জন করে উঠেছে।