এবার ফেলুদা ঘরের বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল।
মাধবলাল, ফেলুদা ফিসফিস করে বলল।
যে লোকটা অপেক্ষা করছিল তাকে আমারও মাধবীলাল বলে মনে হয়েছিল, কারণ এই অন্ধকারেও হলদে শার্টের রংটা আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু যে লোকটার হাতে টর্চ সে যে কে তা বোঝা ভারী মুশকিল। সে মহীতোষবাবুও হতে পারে, ওঁর দাদাও হতে পারে, শশাঙ্কবাবুও হতে পারে, আবার অন্য লোকও হতে পারে।
এখন টর্চের আলো নিবে গেছে। কিন্তু দুজনে দাঁড়িয়ে যে খুব নিচু গলায় কথা বলছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিছুক্ষণ পর হলদে শার্টটা নড়ে উঠল। তারপর টর্চের আলোটা জ্বলে উঠে আমাদের বাড়ির দিকে চলে এল। ফেলুদা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঘরের বাতিটা জ্বলিয়ে দিল।
লালমোহনবাবু, বোধহয় নিজেই নিজের মনের মতো করে গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাচ্ছেন, তাই তিনি হঠাৎ এক ফাঁকে বারান্দায় বেরিয়ে কী যেন দেখে এলেন।
কী দেখলেন? দরজায় এখনও তালা? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ! লালমোহনবাবু অপ্ৰস্তুত হাসি হেসে বললেন।
আপনার কি ধারণা উনিই গিয়েছিলেন মাধবীলালের সঙ্গে কথা বলতে?
আমি তো গোড়াতেই বলেছি মশাই, দাদাটিকে আমার ভাল লাগছে না। পাগল জিনিসটা বড় ডেঞ্জারাস। আমাদের নৰ্থ ক্যালকাটায় এক পাগল ছিল, সে আপার সারকুলার রোডের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে ট্রাম আর বাস লক্ষ্য করে বেমক্কা টিল ষ্টুড়িত। কী ডেঞ্জারাস বলুন তো?
দেবতোষবাবুর দরজা বন্ধতে কী প্রমাণ হল?
তার মানে ভদ্রলোক নীচে যাননি।
কীি করে প্রমাণ হয় সেটা; ভদ্রলোক আদৌ ওই তালা-বন্ধ দরজার খিছনে আছেন কি না। সেটা আপনি কী করে জানলেন? সারাদিনে তাঁর কোনও সাড়াশব্দ পেয়েছেন কি?
লালমোহনবাবু যেন বেশ খানিকটা দমে গেলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মশাই, কত চেষ্টা করি, আমার চিন্তা ঠিক আপনার চিস্তার সঙ্গে এক লাইনে চালাব–কোথায় যেন গাণ্ডগোল হয়ে যায়।
গণ্ডগোল না। কোলিশন। আপনি উলটো পথে চলেন কি না। আপনি আগে ক্রিমিনাল ঠিক করে নিয়ে তার ঘাড়ে ক্রাইমটা বসাতে চেষ্টা করেন, আর আমি ক্রাইমের ধাঁচটা বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী ক্রিমিনাল খোঁজার চেষ্টা করি।
এই ব্যাপারেও তাই করছেন?
ও ছাড়া তো আর রাস্তা নেই লালমোহনবাবু;
কোনখান থেকে শুরু করেছেন?
কুরুক্ষেত্র।
এর পরে আর লালমোহনবাবু কোনও প্রশ্ন করেননি।
আমাদের মশারি বদলে দেওয়াতে ঘুমটা ভালই হচ্ছিল, কিন্তু মাঝরাত্তিরে একটা চিৎকারে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসতে হল। চিৎকারটা করেছে ফেলুদা! জেগে দেখি, ও দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের মাঝখানে, হাতে রয়েছে আদিত্যনারায়ণের তলোয়ার। বাইরে থেকে চাঁদের আলো এসে ইস্পাতের ফলাটার উপর পড়াতে সেটা ঝিলিক মারছে; যে কথাটা শুনে ঘুমটা ভেঙেছিল সেটা ফেলুদা আরও দুবার বলল, তবে অত চেঁচিয়ে নয়। ইউরেকা! ইউরেকা!
আর্কিমিডিস কী যেন একটা আবিষ্কার করে উল্লাসের সঙ্গে এই গ্রিক কথাটা বলে উঠেছিল। তার মানে হল পেয়েছি। ফেলুদা যে কী পেয়েছে সেটা বোঝা গেল না।
১১. শশাঙ্কবাবু আমাদের ঘরে এলেন
সকালে চা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শশাঙ্কবাবু আমাদের ঘরে এলেন দেখে বেশ একটু অবাক লাগল। ফেলুদা ভদ্রলোককে বেশ খাতির-টাতির করে বসতে বলে বলল, আপনার সঙ্গে আর আলাপই হল না ঠিক করে। মহীতোষবাবুর বন্ধু হিসেবে আপনারও নিশ্চয়ই অনেক রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।
শশাঙ্কবাবু টেবিলের সামনে চেয়ারটায় বসে বললেন, অভিজ্ঞতার শুরু কি সেই আজকে? মহীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব পঞ্চাশ বছরের উপর। সেই ইস্কুল থেকে।
আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
মহীতোষ সম্পর্কে?
না। তড়িৎবাবু সম্পর্কে।
বিলুন।
আপনার মতে উনি কেমন লোক ছিলেন?
চমৎকার। অত্যন্ত বুদ্ধিমান, অত্যন্ত ধীর প্রকৃতির যুবক ছিল তড়িৎ।
আর কাজের দিক দিয়ে?
অসাধারণ।
আমারও তাই ধারণ…
এবার শশাঙ্কবাবু ফেলুদার দিকে সোজা দৃষ্টি দিয়ে বললেন, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চাই।
বলুন।
শশাঙ্কবাবুকে এই প্রথম সিগারেট খেতে দেখলাম। ফেলুদারই দেওয়া একটা চারমিনার ধরিয়ে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, এই তিন দিনে আপনার অনেক রকম অভিজ্ঞতা হল। আপনি নিজেও বুদ্ধিমান, তাই সাধারণ লোকের চেয়ে নিশ্চয়ই অনেক বেশি দেখেছেন, শুনেছেন, বুঝেছেন। আজ হয়তো আপনার এখানে শেষ দিন। আজি কী ঘটবে তা জানি না। যাই ঘটুক না কেন, এই বিশেষ জায়গার এই বিশেষ জমিদার পরিবারটি সম্বন্ধে আপনি যা জেনে গেলেন, সেটা যদি আপনি গোপন রাখতে পারেন, এবং আপনার এই বন্ধুটিকেও গোপন রাখতে বলেন, তা হলে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ বোধ করব। আমি জানি মহীতোষও এটাই চাইবে। বাংলাদেশের প্রায় যে কোনও জমিদার বংশের ইতিহাস ঘাঁটলেই অনেক সব অদ্ভুত অপ্রিয় ঘটনা বেরিয়ে পড়বে সে তো আপনি জানেন। সে রকম সিংহরায় বংশের ইতিহাসেও অনেক অপ্রিয় তথ্য লুকিয়ে আছে সেটা বলাই বাহুল্য।
ফেলুদা বলল, শশাঙ্কবাবু, আমি তিনদিন ধরে মহীতোষবাবুর আতিথেয়তা ভোগ করছি। সে কারণে আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আমি কলকাতায় গিয়ে সিংহরায় পরিবার সম্পর্কে বদনাম রটাব, এটা কখনও হবে না। এ আমি কথা দিতে পারি।
এর পর একটা প্রশ্ন ফেলুদা বোধহয় না করে পারল না।
দেবতোষবাবুর ঘরের দরজা কাল থেকে বন্ধ দেখছি। এ ব্যাপারে আপনি কোনও আলোকপাত করতে পারেন কি?