তা হলে তো ষোল কলা পুরতে এখনও অনেক দিন মশাই।
আপনি শুধু চাঁদের কথা ভাবছেন কেন? সূৰ্য বলেও তো একটা জিনিস আছে। রাতটা কেটে গেলেই তো তার দেখা পাওয়ার কথা।
কালই, তার মানে, ক্লাইম্যাক্স বলছেন?
আমি আর কিছুই বলছি না লালমোহনবাবু, শুধু বলছি যে এই প্রথম একটা আলোর আভাস দেখতে পাচ্ছি। চ তোপসে, বাড়ি চ।
১০. আমরা বেরিয়েছিলাম দশটায়
আমরা বেরিয়েছিলাম দশটায়, ফিরতে ফিরতে হল পায় সাড়ে বারোটা। ফেলুদা তলোয়ারটা সোজা মহীতোষবাবুর হাতে তুলে দেবে বলে ঠিক করেছিল, কিন্তু এসে শুনলাম উনি আর শশাঙ্কবাবু বেরিয়ে গেছেন। বনবিভাগের বড় কতা নাকি এসে কালিবুনি ফরেস্ট বাংলোতে –রয়েছেন, সেখানেই গেছেন। কাজেই তলোয়ারটা এখন আমাদের ঘরে, আমাদেরই কাছে।
ঘরে আসার আগে অবিশ্যি আমরা একতলায় কিছুটা সময় কাটিয়ে এসেছি। ফেলুদার মাথায় কী যেন ঘুরছিল; ও দোতলায় না গিয়ে সোজা চলে গেল ট্রোফি রুমে। সেই যেখানে জানোয়ারের ছাল আর মাথাগুলো রয়েছে, আর র্যাকে রাখা রয়েছে বন্দুকগুলো। ফেলুদা র্যাক থেকে একটা একটা করে বন্দুক নামিয়ে সেগুলো খুব মন দিয়ে দেখল। বন্দুকের নল, বন্দুকের বাঁট, বন্দুকের ট্রিগার, সেফটি ক্যাচ–প্রত্যেকটা জিনিস ও খুব্ধ মন দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। লালমোহনবাবু কী যেন একটা বলতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ফেলুদা তাকে ধমকে থামিয়ে দিল।
এখন কথা বলার সময় নয়। লালমোহনবাবু, এখন চিন্তা করার সময়।
লালমোহনবাবু এত দিনে ফেলুদার মতিগতি খুব ভালভাবেই জেনে গেছেন, তাই আর দ্বিতীয়বার মুখ খুললেন না।
দোতলায় উঠে বারান্দা দিয়ে আমাদের ঘরের দিকে যেতে ফেলুদা থমকে থেমে গেল। তার দৃষ্টি দেবতোষবাবুর ঘরের দিকে।
সে কী, দাদার ঘরে তালা কেন?
সত্যিই তো! ভদ্রলোক ঘর ছেড়ে গেলেন কোথায়? আর তালা লাগিয়ে যাবারই বা কারণটা কী?
ফেলুদা কী ভাবল জানি না। মুখে কিছুই বলল না। আমরা আমাদের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম।
ফেলুদার এখনকার অবস্থাটা আমার খুব চেনা। জটিল রহস্যের জট ছাড়ানোর প্রথম অবস্থায় ওর ভাবটা এ রকমই হয়। দু মিনিট ভুরু কুঁচকে চুপ করে বসে থেকেই আবার উঠে দাঁড়াল, তারপর খানিকটা পায়চারি করে আবার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা হেঁট করে চোখ বুজে ডান হাতের মাঝের আঙুলের ডগা দিয়ে কপালে আস্তে আস্তে টাকা মারা, তারপর আবার হাঁটা, আবার বসা–এই রকম আর কী! এইভাবেই একবার খাট ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, কেউ যখন নেই, আর দেবতোষবাবুর ঘর যখন বন্ধ, তখন এই ফাঁকে একটু চোরা অনুসন্ধান চালালে বোধহয় মন্দ হয় না।
কথাটা বলে ফেলুদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখলাম, ও এদিক ওদিক দেখে মহীতোষবাবুর কাজের ঘরে ঢুকল।
বাঘের পায়ের ছাপ দেখে অবধি লালমোহনবাবুর সাহস অনেকটা বেড়ে গেছে। উনি এখন দিব্যি বাঘছালটার উপর চিত হয়ে শুয়ে বাঘের মাথাটা বালিশের মতো ব্যবহার করছেন। এইভাবে কিছুক্ষণ সিলিং-এর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, কী শুভক্ষণেই বইটা মহীতোষবাবুকে উৎসর্গ করেছিলাম বলে তো। এমন একটা থ্রিলিং অভিজ্ঞতা কি না হলে হত? আজ সকালের কথাটাই চিন্তা করে–বাঁশের ভেতর বুলেট, ঘাসের মধ্যে সাপ, রয়েল বেঙ্গলের পায়ের ছাপ, পোড়ো মন্দির, গুপ্তধন, জরাগ্রস্ত অশ্বত্থ গাছ–আর কত চাই? এখন একবারটি ম্যান-ইটারের মুখোমুখি পড়তে পারলেই অভিজ্ঞতা কমপ্লিট।
শেষেরটা কি সত্যি করেই চাইছেন আপনি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আর ভয় নেই, একটা বিরাট হাই তুলে বললেন, লালমোহনবাবু, মাধবলাল শিকারি। আর ফেলুমিত্তির শিকারি দুপাশে থাকলে মানুষখেকোর বাপের সাধ্যি নেই কিছু করে।
লালমোহনবাবু প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, আর আমি মহীতোষবাবুর শিকারের বইটা পড়ছিলাম, এমন সময় ফেলুদা ফিরে এল।
কিছু পেলেন?
ফেলুদার পায়ের আওয়াজ পেয়েই লালমোহনবাবু সোজা হয়ে বসেছেন।
ফেলুদা গভীর। বলল, যা খুঁজছিলাম তা পাইনি, আর সেটাই সিগনিফিক্যান্ট।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা মাটিতে ঠেকল কেন জানেন তো লালমোহনবাবু?
সেই অশ্বথামা হত ইতি গজ-র ব্যাপার তো?
হ্যাঁ। যুধিষ্ঠির পুরোপুরি সত্যি কথা বলেননি তাই। কিন্তু আজকের দিনে মিথ্যে বললেই যে চাকা মাটিতে ঠেকে যাবে এমন কোনও কথা নেই। এ যুগে মানুষের দোষের শাস্তি মানুষই দিতে পারে, ভগবান নয়।
এর পরে একটা জিপের আওয়াজ পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই চাকর এসে খবর দিল যে, ভাত বাড়া হয়েছে, বাবু এসেছেন, খেতে ডাকছেন।
মহীতোষবাবুর বাড়িতে খাওয়াটা ভালই হয়। সব সময় হয় কি না জানি না, কিন্তু আমরা যে ক’দিন রয়েছি সে ক’দিন রোজই মুরগি হয়েছে। কাল রাত্রে বিলিতি কায়দায় রোস্ট হয়েছিল, লালমোহনবাবু কাঁটা চামচ ম্যানেজ করতে পারছেন না দেখে মহীতোষবাবু বললেন। যে পাখির মাংস হাত দিয়ে খেলে নাকি কেতায় কোনও ভুল হয় না। আজকেও খাওয়ার তোড়জোড় ভালই ছিল, কিন্তু প্রথম থেকেই কথাবাতা এমন গুরুগম্ভীর মেজাজে শুরু হল যে, খাওয়ার দিকে বেশি নজর দেওয়া হল না। আমরা খাবার ঘরে ঢুকতেই মহীতোষবাবু বললেন, মিস্টার মিত্তির, সংকেতের ব্যাপারটা যখন চুকেই গেছে, তখন তো আর আপনাদের এখানে ধরে রাখার কোনও মনে হয় না। কাজেই আপনি যদি বলেন তা হলে আপনাদের ফেরার বন্দোবস্ত আমার লোক করে দিতে পারে। জলপাইগুড়িতে লোক যাচ্ছে, আপনাদের রিজার্ভেশনটা করে আনতে পারে।