যদিও এ জিনিসটা এর আগে কোনও দিন দেখিনি, তাও বুঝতে অসুবিধা হল না যে, আমরা বাঘের পায়ের ছাপ দেখছি। আমরা যেদিকে যাচ্ছি। সেই দিকেই গেছে ছাপগুলো।
কাঁপা ফিসফিসে গলায় লালমোহনবাবুর প্রশ্ন এল, এ কি দু-পেয়ে বাঘ নাকি মশাই?
মাধবলাল হেসে উঠল। ফেলুদা বলল, এইভাবেই বাঘ হাঁটে। সামনের পা আর পিছনের পা ঠিক একই জায়গায় ফেলে, তাই মনে হয় দু পায়ে হাঁটছে।
মাধকলাল এগিয়ে চলেছে, আমরা তার পিছনে। জিপের আওয়াজ আর পাচ্ছি না। বোধহয় হল ছেড়ে দিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটা কুলকুল শব্দ পাচ্ছি। একটা নালা জাতীয় কিছু আছে বোধহয় কাছাকাছির মধ্যে। লালমোহনবাবুর নতুন বুটটা প্রথম দিকে বড্ড বেশি মচমচ শব্দ করছিল, তাতে ফেলুদা মন্তব্য করেছিল, সেটা নাকি ম্যান-ইটারের কৌতুহল উদ্রেক করার পক্ষে আইডিয়াল, কিন্তু এখন কাদায় ভিজে। আওয়াজটা প্ৰায় মরে এসেছে।
একটা শিমুল গাছ পেরিয়ে কয়েক পা যেতেই মাধবলাল আবার দাঁড়িয়ে পড়ল।
আপকা পাস রিভলভার হ্যাঁয় না?
এবার আমাদের চোখ গেল হাত বিশেক দূরে সামনের ঘাসের দিকে। ঘাসগুলো চিরে কী যেন একটা জিনিস এগিয়ে আসছে।
ক্রেইৎ, বলল মাধবলাল।
নামটা জানি। অসম্ভব বিষধর সাপ।
এবার সাপটাকে দেখতে পেলাম। চলা থামিয়ে স্থির হয়ে ঘাসের উপর দিয়ে মাথাটা তুলে আমাদের দেখছে। ফণা নেই। সারা গায়ে হলদে আর কালো ডোরা।
ফেলুদা যে কখন রিভলভারটা বার করল টেরই পেলাম না। হঠাৎ একটা কনফাটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম সাপের মাথাটা ৰ্থেতলে গেল। আর একটা গুলি। এবার সব স্থির। গাছ থেকে পাখি ডেকে উঠেছে। দূরে আরেকটা গাছ থেকে বাঁদরের কিচির মিচির। মাধবলাল শুধু বলল, সাবাস, আর লালমোহনবাবু হাঁচি হাসি আর কাশি মিলিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করে একদম চুপ মেরে গেলেন।
ফেলুদা বাঁ দিকে যাচ্ছে দেখে মাধবলাল বারণ করল। বলল, ওদিকে একটা নালা আছে, সেটা পেরোলেই নাকি একটা উঁচু পাথুরে ঢিবি আর অনেকগুলো বড় বড় পাথরের চাই। ওখানে নাকি বাঘের বিশ্রামের খুব ভাল জায়গা রয়েছে, কাজেই ওদিকটায় যাওয়া খুব নিরাপদ নয়। অগত্যা ফেলুদা মাধবলালের নির্দেশ মতো সোজাই চলল।
বন যে সব জায়গায় সমান ঘন, তা নয়। বাঁ দিকে চাইলেই বোঝা যায়। ওদিকে নালা থাকার দরুন বন পাতলা হয়ে গেছে। জানোয়ারের মধ্যে এক বাঁদরই দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে— ল্যাজ পাকিয়ে গাছের ডাল থেকে দোল খাচ্ছে, এ গাছ থেকে ও গাছে দিব্যি লাফিয়ে চলে যাচ্ছে, আর আমাদের দেখলে দাঁত খিঁচোচ্ছে।
ফেলুদা নিশ্চয়ই আশা করছিল যে, আরও অনুসন্ধান করলে আরও কিছু পাবে, কিন্তু এবারে পাওয়াটা জুটে গেল। লালমোহনবাবুর কপালে। লালমোহনবাবুর বুটের ঠোক্কর খেয়ে একটা জিনিস ছিটকে প্রায় দশ হাত দূরে গিয়ে পড়তেই আমাদের চোখ সেদিকে গেল।
একটা গাঢ় ব্ৰাউন রঙের চামড়ার মানিব্যাগ। ফেলুদা সেটা খুলতেই তার ভিতর থেকে দুটো একশো টাকার নোট আর বেশ কিছু অন্য ছাট ছাট নাট বেরিয়ে পড়ল। এসব ছিল বড় খাপটায়। অন্য খাপ থেকে কয়েকটা রং চটে যাওয়া কুড়ি পয়সার ডাকটিকিট, দু-একটা ক্যাশ মেমো আরেকটা ওষুধের প্রেসক্রিপশন বেরোল। বৃষ্টিতে ভিজে ব্যাগটার অবস্থা বেশ শোচনীয় হলেও নোটগুলো এখনও দিব্যি ব্যবহার করা চলে।
ফেলুদা সব জিনিস আবার ব্যাগের মধ্যে পুরে ব্যাগটা শার্টের বুকপকেটে ঢুকিয়ে নিল।
আমরা আবার এগিয়ে চললাম।
এদিকটায় জঙ্গল বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। চারিদিকে প্ৰকাণ্ড প্ৰকাণ্ড শাল গাছ, মাঝে মাঝে অন্য গাছ— সেগুন, শিমুল, আম, কাঁঠাল, ছাতিম। অৰ্জ্জুন গাছও রয়েছে এখানে সেখানে। আমি জানি ফেলুদা সেগুলোর দিকে বিশেষভাবে চোখ রাখছে, আর এও জানি যে অৰ্জ্জুনের কাছাকাছি কোনও তাল গাছ এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। মাধবলাল এরই মধ্যে এক ফাঁকে পকেট থেকে একটা ছুরি বার করে দুটো গাছের ডাল কেটে আমাকে আর লালমোহনবাবুকে দিয়েছে; আমরা সেগুলো লাঠি হিসাবে ব্যবহার করছি। ফেলুদা হাঁটতে হাঁটতেই মাধবলালকে প্রশ্ন করল, বাঘের পায়ের ছাপ দেখে বাঘ সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানা যায়, তাই না?
মাধবলাল বলল, হ্যাঁ, এটাকে বেশ বড় বাঘ বলেই তো মনে হয়।
আমি মনে মনে ভাবছিলাম— একটা আস্ত মানুষের লাশ মুখে করে বাঘটা এতখানি পথ এসেছে, তার মানে, কী সাংঘাতিক শক্তি বাঘের! অবিশ্যি মানুষের আর কীই বা ওজন। গোরু মোষ মেরেও তো শুনেছি বাঘ ওইভাবেই মুখে করে নালা টালা লাফিয়ে ডিঙিয়ে মাইলের পর মাইল পথ চলে যায়। মহীতোষবাবুর বইতেই নাকি আছে যে বাঘের ছাল ছাড়ালেই দেখা যায় ভিতরে কেবল মাস্ল আর মাস্ল।
ফেলুদা এবার আর একটা প্রশ্ন করল মাধবলালকে।
মহীতোষবাবু এ জঙ্গলে কখনও শিকার করেননি। তাই না?
মাধবলাল বলল, মহীতোষঝাবুর কুসংস্কারের কথাটা সে জানে। তবে এ রকম কুসংস্কার নাকি অনেক শিকারির মধ্যেই দেখা যায়। আমার নিজের নেই, মাধবীলাল বলল, তবে আমার বাবার ছিল। জোয়ান বয়সে একবার বাঘ মারতে যাবার আগে হাতে বিছুটি লেগেছিল, আর সেই দিনই একটা প্রায় দশ ফুট লম্বা বাঘকে বন্দুকের এক গুলিতে ঘায়েল করেছিলেন। সেই থেকে বাঘ মারতে যাবার আগে হাতে বিছুটি ঘষে নিতেন।
ফেলুদা বলল, করবেটসাহেবেরও কুসংস্কার ছিল। ম্যান-ইটার মারুতে যাবার দিন সকালে একটা সাপ দেখলে তার মনটা খুশি হয়ে যেত।