কিন্তু ম্যান-ইটার?
সেখানে আলাদা ব্যাপার।
তাই বলুন। কিন্তু তা হলে আপনি যে…?
আমি যাচ্ছি কেন? তার কারণ দিনের বেলা বাঘ বেরোবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। যদি বেরোয় তার জন্য বন্দুক তো সঙ্গেই থাকছে। আর তেমন বেগতিক দেখলে জিপি তো রয়েইছে, উঠে পড়লেই হল।
এর পরে জিপ আসার আগে। লালমোহনবাবু শুধু একটা কথাই বলেছিলেন।
খুনের ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছি না মশাই। একেবারে টাটাল ডার্কনেস।
ফেলুদা বলল, অন্ধকারটা যাতে না দূর হয় তার জন্য চেষ্টা চলছে লালমোহনবাবু। সেই চেষ্টাকে বিফল করাই হবে আমাদের লক্ষ্য।
০৯. তড়িৎবাবুর মৃতদেহ
যেখানে তড়িৎবাবুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, আমরা সেইখানে এসে দাঁড়িয়েছি। সেদিনও এই সময়টাতেই এসেছিলাম, কিন্তু আজ কিছুক্ষণ হল মেঘ কেটে গিয়ে রোদ ওঠার ফলে আলোটা অনেক বেশি। এখানে ওখানে পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ মাটিতে পড়েছে, আর লক্ষ করছি সেদিনের চেয়ে পাখিও ডাকছে অনেক বেশি। লালমোহনবাবু অবিশ্যি যে কোনও পাখি ডেকে উঠলেই, সেটাকেই বাঘ কাছাকাছি থাকার লক্ষণ বলে মনে করছেন।
তড়িৎবাবুর মৃতদেহ সেদিনই সকালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কলকাতায় টেলিফোন করে খবর দেওয়াতে ওঁর বড় ভাই এসেছিলেন, শেষ কাজ তিনিই করে দিয়ে গেছেন। আজ আর সেই বাঁশ ঝাড়টার আশেপাশে সেদিনকার সাংঘাতিক ঘটনার কোনও চিহ্নই নেই। কিন্তু তাও ফেলুদা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে চারদিকের জমি পরীক্ষা করছে। মাধবলালও ফেলুদার সঙ্গে কাজে লেগে গেছে। মনে হল বেশ উৎসাহই পাচ্ছে। লোকটাকে যত দেখছি ততই ভাল লাগছে। চেহারাটাও বেশ। হাসলেই গালের দু পাশে দুটো খাঁজ পড়ে, আর ভুরু না কুঁচকালেও কপালে পাঁচ-ছটা লাইন পড়েই আছে। জিপে আসতে আসতে ও বলছিল, বনবিভাগ থেকে মানুষখেকোর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন শিকারি নাকি বাঘাটা মারার ইচ্ছা প্ৰকাশ করেছে। তার মধ্যে কার্সিয়াং-এর এক চা বাগানের ম্যানেজার মিস্টার সাঙ্গু নাকি আজকালের মধ্যেই এসে পড়বেন। সাপ্র নামকরা শিকারি, তেরাইয়ের জঙ্গলে নাকি এককালে অনেক বাঘ মেরেছেন। মাধবীলাল নিজেই অনেক বাঘ হরিণ বুনো শুয়োর ইত্যাদি মেরেছে, তারই একটি গল্প সে সবে বলতে আরম্ভ করেছে, এমন সময় ফেলুদা হঠাৎ বাঁশ ঝাড়ের দিক থেকে তার নাম ধরে ডাক দিল। মাধবীলাল ব্যস্তভাবে এগিয়ে গেল ফেলুদার দিকে, তার পিছন পিছন আমরাও। এটা বলা দরকার যে আমাদের দুজনের জিপ থেকে নামার ব্যাপারে ফেলুদা আজ কোনও আপত্তি করেনি।
ফেলুদা মাটিতে উবু হয়ে বসে একটা বাঁশের গোড়ার দিকে চেয়ে আছে।
দেখুন তো এটা কী ব্যাপার, ফেলুদা মাধবলালকে উদ্দেশ করে বলল।
মাধবলাল ঝুকে পড়ে এক ঝলক দেখেই বলল, বুলেট লাগা থা।
মাধবীলালের পদবি দুবে, বাড়ি সাহেবগঞ্জ, কিন্তু বাংলা বুঝতে বা বলতে কোনও অসুবিধা হয় না।
বাঁশটার গায়ে যে একটা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। লালমোহনবাবু অবাক হয়ে আমার দিকে চাইলেন। ফেলুদাও যে অবাক সেটা বোঝাই যাচ্ছে। বার তিনেক অসহিষ্ণুভাবে নিজের হাতের তেলোতে ঘুষি মেরে বলল, দাগটা পুরনো কি টাটকা সেটা বলতে পারেন?
মাধবলাল বলল, দিন দুয়েকের বেশি পুরনো হতেই পারে না।
ব্যাপারটা কী?…ব্যাপারটা কী?… ফেলুদা বিড়বিড় করে বলল, বন্দুক…তলোয়ার…সব যে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। তড়িৎবাবুকে মারুল তলোয়ারের খোঁচা, বাঘকে মারল গুলি.সে গুলি তো আবার মনে হচ্ছে বাঘের গায়ে লাগেনি। নাকি–
মাধবীলাল বাঁশ ঝাড়ের নীচ থেকেই কী যেন কুড়িয়ে নিয়েছে। এমনি চোখে ভাল দেখাই যায় না। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম, ইঞ্চি দুয়েক লম্বা লম্বা কতকগুলো রোঁয়া।
বাঘের লোম কি? বলল ফেলুদা।
বাঘের লোম, বলল মাধবলাল। গুলি বাঘের গা ঘেঁষে গিয়েছিল বলে মনে হয়।
আর তাই কি বাঘ খানিকটা মাংস খেয়েই পালিয়েছিল?
সেই রকমই মালুম হচ্ছে।
ফেলুদা দু-এক পা করে এগিয়ে যেতে শুরু করল। মাধবলালও হাতে বন্দুক নিয়ে দৃষ্টি সজাগ রেখে তাকে অনুসরণ করল। আমরা দুজনের মাঝামাঝি সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটা বেছে নিলাম। ফেলুদার পকেটে রিভলভার আছে জানি, আর তাতে টোটাও ভরা আছে। কিন্তু তাতে তো আর বাঘের কিছু হবে না। পিছন থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ শুনে বুঝলাম, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে জিপটাও এগোচ্ছে। তার ফলে ব্যবধান কিছুটা কমলেও জিপ আমাদের কাছে আসতে পারবে না, কারণ আমরা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর চলে এসেছি।
মিনিট তিনেক এভাবে হাঁটার পর ফেলুদা হঠাৎ কী যেন দেখে ডান দিকে কোনাকুনিভাবে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল।
একটা কাঁটা-ঝোপ। তার মধ্যে একটা কাপড়ের টুকরো আটকে রয়েছে। সবুজ কাপড়। নিঃসন্দেহে তড়িৎবাবুর শার্টের অংশ; মাধবীলাল না বললেও আন্দাজ করেছিলাম, বাঘ তড়িৎবাবুকে মুখে করে নিয়ে যাবার সময় ঝোপের কাঁটায় তড়িৎবাবুর শাটের একটা অংশ ছিঁড়ে আটকে গিয়ে এই চিহ্ন রেখে গেছে।
এবার দেখলাম মাধবলাল আমাদের ছাড়িয়ে নিজেই এগিয়ে গেল! বুঝলাম সে-ই এবার পথ দেখাবে, কারণ সে আন্দাজ করেছে বাঘ কোন পথে এসেছিল। বোধহয় আমাদের কথা ভেবেই মাধবীলাল ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, কারণ চারদিকে কাঁটা-ঝোপ।
সামনে একটা তেঁতুল গাছ। তার গুড়ির কাছ থেকে জমিটা ঢালু হয়ে পিছন দিকে নেমে গেছে বলেই বোধহয় সেখানটা শুকনো রয়েছে। মাধবলাল সেখানে পৌঁছে থেমে গেল, তার দৃষ্টি মাটির দিকে। আমরাও এগিয়ে গেলাম।