আবার ফেলুদার সেই চমকে উঠে কথা থেমে যাওয়ার ব্যাপার।
তড়িৎবাবুর টেবিলের উপর একটা বাংলা অভিধান ছিল না? সে চাপা গলায় বলে উঠল।
লালমোহনবাবু বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সংসদের অভিধান। লাল রং। আমারও আছে।
ওটা দেখা দরকার।
ফেলুদার পিছন পিছন আমরাও ছুটলাম মহীতোষবাবুর আপিস ঘরে।
অভিধান খুলে ফাল্গুন বার করে ফেলুদার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
ফাল্গুন–ফাল্গুন হল অৰ্জ্জুনের একটা নাম; আর অর্জন শুধু পঞ্চপাণ্ডবের একজন নয়, অৰ্জ্জুন গাছও বটে; এ জঙ্গলে অৰ্জ্জুন গাছ কালও দেখেছি।
তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? লালমোহনবাবু জিনিসটা ভাল করে না বুঝেও উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।
ফাল্গুন তাল জোড়, দুই মাঝে তুই ফোঁড়। একটা অৰ্জ্জুন গাছ আর জোড়া তাল গাছের মাঝখানে জমি খুঁড়তে হবে।
কিন্তু সে রকম গাছ কোথায় আছে সেটা জানছেন কী করে?
ফেলুদা বলল, আরেকটা কোনও বুড়ো গাছের উত্তরে পঞ্চাশ হাত গেলেই পাওয়া যাবে।
আরেকবাবা, বুড়ো গাছ। বুড়ো গাছ ছাড়া ছাকরা গাছ আছে নাকি এ জঙ্গলে? আর গাছ তো মশাই সব কেটে ফেলেছে। মহীতোষবাবুর নিজেরই তো কাঠের ব্যবসা। এ সংকেত লেখা হয়েছে। ক’দিন আগে? সত্তর পঁচাত্তর বছর হবে না?
আমরা আমাদের ঘরে ফিরে এসেছি। ফেলুদা আবার চুপ, আবার গভীর। মেঝেতে বাঘছালের দিকে চেয়ে রয়েছে। অন্যমনস্কভাবে। প্রায় মিনিটখানেক ওইভাবে থেকে বলল, যা ভাবছি। তাই যদি হয়, তা হলে বড় বাঘের ছালটা তড়িৎবাবুরই পাওয়া উচিত ছিল। সংকেত সমাধানের ব্যাপারে তড়িৎ সেনগুপ্ত ফেলু মিত্তিরের চেয়ে কম যায় না। থুড়ি, যেতেন না।
লালমোহনবাবু বললেন, কিন্তু প্যাডে যে আরও সব মহাভারতের নাম রয়েছে? কীচক, অশ্বথামা–এদের সঙ্গে সংকেতের কী সম্পর্ক?
সেই কথাই তো আমিও ভাবছি…
ফেলুদা আবার প্যাডের দিকে চাইল। তারপর বলল, অবিশ্যি এই কাগজের সব ক’টা নামই যে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। এবং এগুলো যে একই সময় লেখা সেটাও ভাবার কোনও কারণ নেই। এই দেখুন-কীচক আর নারায়ণী ডট পেন দিয়ে লেখা। দেখলেই বুঝতে পা পাবেন। কালির রং সবই এক বলে মনে হয়, কিন্তু অন্য লেখাগুলোর নীচের দিকের টা__লো ঈষৎ মোটা–যেটা ডট পেনে কখনও হয় না।
লালমোহনবাবু প্রায় গোয়েন্দার মতো করে কাগজটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তা হলে কীচক আর নারায়ণীর সঙ্গে সংকেতের–
কথাটা শেষ হবার আগেই দরজার দিক থেকে গভীর গলায় কথা এসে প্লািড়ায় লালমোহনবাবু চমকে উঠে হাত থেকে প্যাডটা ফেলেই দিলেন।
কীচকদের নিয়ে কথা হচ্ছে কি?
দেবতোষবাবু।
পর্দা ফাঁকা হল। ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে এলেন। আবার সেই বেগুনি ড্রেসিং, গাউন। ভদ্রলোকের কি আর কোনও জামা নেই? ফেলুদা বলল, আসুন দেবতোষবাবু, ভিতরে আসুন, ভদ্রলোক ফেলুদার কথায় কান না দিয়ে একটা প্রশ্ন করে বসলেন।
পৃথুরাজা দিঘির জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন কেন জান?
আপনি বলুন। আমরা জানি না। ফেলুদা বলল।
কারণ কীচকদের সংস্পর্শে এসে পাছে ধর্মনাশ হয়, সেই ভয়ে।
কীচক একটা জাতির নাম? ফেলুদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
যাযাবর জাতি। জঙ্গলে গেলে একবার একটু খোঁজ করে দেখো তো তারা এখানে আছে কি না! বনমোরগ শিকার করত তীর-ধনুক নিয়ে।
নিশ্চয়ই দেখব খোঁজ করে, ফেলুদা খুব স্বাভাবিকভাবে বলল। তারপর বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি?
দেবতোষবাবু কেমন যেন অবাক ফ্যালফ্যাল ভাব করে ফেলুদার দিকে চাইলেন।
জিজ্ঞেস করবে? আমাকে তো কেউ জিজ্ঞেস করে না!
আমি করছি। এখানে প্রাচীন গাছ বলতে কোনও বিশেষ গাছ আছে কি? আপনি স্থানীয় ইতিহাস ভাল করে জানেন বলেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।
প্রাচীন গাছ?
হ্যাঁ। মানে এমন গাছ, যাকে লোকে বুড়ো গাছ বলে জানে।
প্রাচীন গাছ শুনে, দেবতোষবাবুর ঘোলাটে চোখ আরও ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল, এখন হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল।
বুড়ো গাছ? তাই বলো। প্রাচীন গাছ আর বুড়ো গাছ কি এক হল? বুড়ো নাম তো শুধু বয়সে বুড়ো বলে নয়! গাছের গায়ে একটা ফোকর আছে, সেটা দেখতে ঠিক একটা ফোক্লাদাঁত বুড়ার হাঁ করা মুখের মতা। সেই গাছের নীচে ঠাকুরদাদার সঙ্গে গিয়ে চড়ুইভাতি করেছি। ঠাকুরদাদা বলতেন ফোকুলা ফকিরের গাছ।
গাছটা কী গাছ? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
কাটা ঠাকুরানীর মন্দির দেখেছ? সে-ও রাজুর হাত থেকে নিস্তার পায়নি। সেই মন্দিরের পশ্চিমদিকে হল ফোকুলা ফকিরের গাছ। অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছেই এক’দিন মহী–
দাদা, চলে এসো!
দেবতোষবাবু কথা শেষ করতে পারলেন না। কারণ মহীতোষবাবু দরজার বাইরে থেকে তাঁর বাজখাঁই গলায় হাঁক দিয়েছেন। পর্দা আবার ফাঁকা হল। মহীতোষবাবু গম্ভীর মুখ করে ঘরে ঢুকলেন। বুঝলাম সেই কঠিন মানুষটা আবার বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
তোমার ওষুধ খাবার কথা; খেয়েছ?
ওষুধ?
মন্মথ দেয়নি?
দেবতোষবাবুর জন্য একজন আলাদা চাকর আছে, নাম মন্মথ।
আমি তো ভাল আছি, আবার ওষুধ কেন? আমার মাথার যন্ত্রণা–
মহীতোষবাবু তাঁর দাদাকে এক রকম জোর করেই ঘাড় ধরে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেলেন। বাইরে থেকে ছোট ভাইয়ের ধমক শুনতে পেলাম।
ভাল আছ কি না-আছ সেটা ডাক্তার বুঝবে। তোমাকে যা ওষুধ দেওয়া হয়েছে, সেটা তুমি খাবে।
গলা মিলিয়ে এল; আর সেই সঙ্গে পায়ের শব্দও।