সুটকেসটায় চাবি ছিল না। ফেলুদা সেটা খুলতেই দেখা গেল তার মধ্যে খুব পরিপটি করে কাপড়াচাপড় সাজানো রয়েছে। ফেলুদা বলল, ভদ্রলোক কলকাতায় যাবার জন্য তৈরিই হয়ে ছিলেন।
মিনিট পাঁচেক পরে তড়িৎবাবুর ঘর থেকে আমরা মহীতোষবাবুর আপিস ঘরের দিকে রওনা দিলাম। যাবার পথে ফেলুদা মহীতোষবাবুকে জিজ্ঞেস করল, সেক্রেটারি বলতে ঠিক কী ধরনের কাজ করতেন তড়িৎবাবু, সেটা একটু বলবেন কি?
মহীতোষবাবু বললেন, চিঠিপত্র লেখার কাজ তো আছেই, তা ছাড়া আমার হাতের লেখা ভাল নয় বলে পাণ্ডুলিপি ও-ই কপি করে দিত। তারপরে পুফ দেখত, কলকাতায় গেলে পাবলিশারদের সঙ্গে দেখা করা, কথাবার্তা বলা, এ সবও করত। ইদানীং আমার বংশের ইতিহাস লেখার ব্যাপারে ওকে অনেক পুরনো বই কাগজপত্র দলিল চিঠি ইত্যাদি ঘটতে হয়েছে। সে-সব পড়ে তথ্য নোট করে রাখত।
এগুলো বুঝি সেই সব নোটের খাতা? ফেলুদা তড়িৎবাবুর ডেস্কের উপর রাখা গোটা আষ্ট্রেক বড় সাইজের খাতার দিকে দেখাল। মহীতোষবাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।
আর এগুলো কি আপনার নতুন শিকার কাহিনীর প্রুফ? লম্বা লম্বা কাগজের তাড়া, দেখলেই বোঝা যায় সেগুলো প্রুফ। ফেলুদা এক-তাড়া প্রুফ তুলে নিয়ে উলটাপালটে দেখছিল।
প্রুফ-দেখিয়ে হিসেবে কি খুব নির্ভরযোগ্য ছিলেন তড়িৎবাবু?
প্রশ্নটা শুনে মহীতোষবাবু বেশ অবাক হয়েই বললেন, আমার তো তাই ধারণা। আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে?
প্রথম পাতার প্রথম প্যারাগ্রাফেই দুটো ভুল দেখছি শুধরানো হয়নি।
তাই নাকি? গর্জন কথাটার রেফ বাদ রয়ে গেছে, আর হরিণের র-এ ফুটকি নেই।
আশ্চর্য…আশ্চর্য…
মহীতোষবাবু অন্যমনস্কভাবে প্রফের কাগজগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে ফেলুদাকে ফেরত দিয়ে দিলেন।
সম্প্রতি তড়িৎবাবুকে কি চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন বলে মনে হাত আপনার? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
কই, সে রকম তো কিছু লক্ষ করিনি।
ফেলুদা তড়িৎবাবুর কাজের টেবিলের উপর ঝুকে পড়ে কী যেন দেখছে। একটা প্যাড খোলা রয়েছে, তার উপর হিজিবিজি লেখা! ফেলুদা প্যাডটা হাতে তুলে নিয়ে কাগজের উপর চোখ রেখে বলল, আপনাদের বংশের ইতিহাস লেখার জন্য কি মহাভারত ঘাঁটার দরকার হচ্ছিল?
কেন বলুন তো?
তড়িৎবাবু এই প্যাডে বোধহয় অন্যমনস্কভাবেই কয়েকটা কথা লিখেছেন। এই যে দেখুন না— অৰ্জ্জুন, কীচক, নারায়ণী, উত্তর, অশ্বত্থামা। এরা সবই তো মহাভারতের নাম। নারায়ণী হল কৃষ্ণের সেনার নাম। কীচক ছিল বিরাট রাজার শালা, আর উত্তর হল বিরাটের ছেলে, অভিমন্যুর শালা।
মহীতোষবাবু বললেন, আমার কাজের জন্য ওকে মহাভারত পড়তে হয়নি, তবে ব্যাপারটা কী জানেন, তড়িৎ ছিল বইয়ের পোকা। ঠাকুরদাদার লাইব্রেরিতে কালীপ্রসন্নর মহাভারত রয়েছে। সেটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে থাকতে পারে।
আমরা মহীতোষবাবুর আপিসঘর থেকে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় একটা চেনা গুরুগম্ভীর গলায় থিয়েটারের ঢঙে কটা কথা কানে এল–
সব ধ্বংস হয়ে যাবে… সব ধ্বংস হয়ে যাবে! সত্যের ভিত টলমল করছে, সব ধ্বংস হয়ে যাবে।
শুধু গলাটাই শুনলাম, মানুষটাকে দেখতে পেলাম না। মহীতোষবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বৈশাখ মাসটা প্রতি বছরই দাদার এ রকম হয়। তারপর বিষয় এলে গরমটা কমলে কিছুটা নিশ্চিন্ত।
আমরা আমাদের ঘরের সামনে পৌঁছে গেছি। ফেলুদা বলল, কাল একবার জঙ্গলে যাব ভাবছিলাম। একটু অনুসন্ধানের প্রয়োজন। আপনি কী বলেন?
মহীতোষবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, তড়িৎকে যেখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল বাঘ, তার কাছাকাছি সে আর আসবে না বলেই তো মনে হয়। বিশেষ করে দিনের বেলা। অন্তত বাঘ সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা। তাই বলে। কাজেই আপনারা যদি ওই সম্পটের কাছাকাছি থাকেন। তা হলে বেশি রিস্ক নেই। সত্যি বলতে কী, এ জঙ্গলে যে বড় বাঘ এখনও রয়ে গেছে। সেটাই তো আমার কাছে একটা বিরাট বিস্ময়।
সঙ্গে মাধবলালকে পাওয়া যাবে তো? আর একটা জিপ…?
নিশ্চয়ই।
মহীতোষবাবু চলে গেলেন। বললেন, তলোয়ারের খবরটা ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে দিতে হবে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বিকেলের পর থেকে আকাশের মেঘ একদম কেটে গেছে। লালমোহনবাবু অনেকক্ষণ থেকে চুপচাপ ছিলেন; দেখে মনে হচ্ছিল হয়তো কোনও গল্পের প্লট মাথায় আসছে, কারণ মাঝে মাঝে পকেট থেকে লাল টুকটুকে একটা টাটার ডায়েরি বার করে কী যেন নোিট করছিলেন। ঘরে এসে পাখাটা খুলে দিয়ে খাটে বসে বললেন, কীরকম বোনাস পেয়ে গেলেন বলুন। এটা আমারই দৌলতে সেটা স্বীকার করছেন তো?
একশোবার।
ফেলুদা তড়িৎবাবুর ডেস্কের উপর থেকে সেই মহাভারতের নাম লেখা প্যাডটা। আর কোচবিহারের ইতিহাস বলে একটা বই নিয়ে এসেছিল। এখন সে খাটে বসে প্যাড়ের দিকে চেয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, সব কটাই মহাভারতের নাম তাতে সন্দেহ নেই, কেবল এই উত্তর কথাটা.। উত্তর. উত্তর। উত্তর নামও হতে পারে, উত্তরদিকও হতে পারে, আবার উত্তর মানে উত্তর কাল–পরবর্তীকাল–এও হতে পারে। আবার উত্তর মানে প্রশ্নের উত্তর… জবাব… জবাব…
ফেলুদা হঠাৎ যেন চমকে উঠল। তারপর খাটের পাশের টেবিলের উপর থেকে নিজের খাতাটা নিয়ে সংকেতের পাতাটা খুলল।
দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে।–থ্যাঙ্ক ইউ তড়িৎবাবু। আপনার উত্তর বিরাট রাজার ছেলে হতে পারে–আমার উত্তর হল উত্তরদিক। দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে। অথাৎ দিক পাও ঠিক ঠিক উত্তরে। তার মানে উত্তরদিকটাই হল ঠিক দিক। হাত গোন ভাত পাঁচ। পঞ্চান্ন হাত। উত্তরদিকে পঞ্চান্ন হাত। কিন্তু তারপর? ফাল্গুন তাল জোড়, দুই মাঝে ভুঁই ফোঁড়। ফাল্গুন…এই ফাল্গুনটা নিয়েই যত গণ্ড–