লোকেরা অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাগলা হাতি নাকি প্রায়ই বেরোয়, কিন্তু মানুষখেকো বাঘ গত ত্ৰিশ বছরের মধ্যে এই প্ৰথম। চন্দনের মতে এখানে কিছু লোক বেআইনিভাবে চোরা শিকার করে, তাদের কারুর গুলিতে হয়তো বাঘাটা জখম হয়েছিল, আর সেই থেকেই ওটা ম্যান-ইটার হয়ে গেছে। অনেক সময় বেশি বয়সে বাঘের দাঁত ক্ষয়ে গেলেও ওরা ম্যান-ইটার হয়ে যায়। আবার মাঝে মাঝে দেখা যায় যে শজারু ধরে খেতে গিয়ে তার কাঁটা এমনভাবে চাখে-মুখে ঢুকে গেছে যে, তার ফলে কাবু হয়ে বাঘ জানোয়ার ছেড়ে আরও সহজ শিকার মানুষের দিকে গেছে।
ফেলুদা বলল, এখানকার লোকেরা কি চাইছে যে মহীতোষবাবু বাঘটাকে মারুন?
চন্দন মিসির তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সে তো চাইবে, লেকিন বাবু তো এ জঙ্গলে শিকার করেননি কখনও। আসামে করিয়েছেন, ওড়িশায় করিয়েছেন—এ জঙ্গলে করেননি।
খবরটা শুনে আমরা সকলেই অবাক হলাম। ফেলুদা বলল, কেন, এখানে করেননি কেন?
চন্দন বলল, এই জঙ্গলে বাবুর দাদজি (ঠাকুরদা) বাঘের হাতে মরলেন, বাবুর বাবা ভি বাঘের হাতে মরলেন, তাই বাবু এখানে না করে দুসারা জায়গা দুসর জঙ্গলে চলে গেলেন।
মহীতোষবাবুর বাবাও যে বাঘের হাতে মরেছিলেন সেটা এই প্রথম শুনলাম। ফেলুদা জিজ্ঞেস করাতে চন্দন বলল যে, মহীতোষবাবুর বাবা নাকি মাচা থেকে বাঘকে গুলি করেছিলেন, আর দেখে মনে হয়েছিল বাঘটা মরে গেছে। মিনিট দশেক পরে মাচা থেকে নোমে বাঘের দিকে যেতেই সেটা নাকি ভদ্রলোককে আক্রমণ করে সাংঘাতিকভাবে জখম করে। ক্ষত সেপটিক হয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই নাকি ভদ্রলোক মারা যান।
খবরটা শুনে ফেলুদা কিছুক্ষণে ভুরু কুঁচকে মাটির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর খোলার বাড়িটার দিকে দেখিয়ে বলল, তুমি ওই বাড়িতে থাক?
হাঁ, হুজুর।
রাত্তিরে ঘুমেও কখন?
চন্দন প্রশ্নটা শুনে একটু থতমত খেয়ে ফেলুদার দিকে চাইল। ফেলুদা এবার আসল প্রশ্নে চলে গেল।
কাল রাত্তিরে যে বাবু খুন হলেন–
তোড়িতবাবু?
হ্যাঁ। উনি বেশ বেশি রাত্তিরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের দিকে গিয়েছিলেন। তুমি তাকে যেতে দেখেছিলে কি?
চন্দন মিসির বলল, গতকাল না দেখলেও তড়িৎবাবুকে সে তার আগের দিন, এবং তারও আগে বেশ কয়েক দিনই সন্ধেবেলা জঙ্গলের দিকে যেতে দেখেছে। গতকাল তড়িৎবাবুকে না দেখলেও আরেকজনকে দেখেছে।
কথাটা শুনে ফেলুদার মুখের ভাব বদলে গেল।
কাকে দেখেছিলে?।
তা জানি না হুজুর। তেড়িতবাবুর টর্চের মুখটা বড়-তিন সেলের পুরনো টর্চ। আর এটা ছিল ছোট টর্চ, তার মুখ ছোট। তবে তাই বলে আলো কম নয়।
তুমি কেবল আলোই দেখেছ? আর কিছু দেখনি?
নেহি হুজুর। আউর কুছ নেহি দেখা।
ফেলুদা আরও কী বিষয়ে জানি একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, এমন সময় দেখি মহীতোষবাবুর চাকর ব্যস্তভাবে দৌড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
বাবু আপনাদের ডেকেছেন। বললেন জরুরি দরকার।
আমরা ফিরে এসে দেখি, মহীতোষবাবু গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষণ করছেন। ফেলুদাকে দেখামাত্র বললেন, আপনার অনুমান ঠিক। তড়িৎকে গুণ্ডা-বদমাইশে মারেনি।
কী করে জানলেন?।
যে অস্ত্রটা দিয়ে তাকে মারা হয়েছিল সেটা আমাদেরই বাড়িতে ছিল। কাল যে তরোয়ালটা আপনাকে দেখিয়েছি, সেইটা। সেটা আর ঠাকুরদার আলমারিতে নেই।
০৭. আদিত্যনারায়ণের ঘরে
কানাই চাকরটাই আদিত্যনারায়ণের ঘরে ধুনো দিতে গিয়ে তলোয়ারের অভাবটা লক্ষ করে, আর করেই মাহীতোষবাবুকে খবর দেয়। ঘরে অনেক বইপত্তর আছে যেগুলো মহীতোষবাবুর লেখার কাজে দরকার হয়; তাই আর ঘরটায় চাবি দেওয়া হত না। চাকর সবই পুরনা আর বিশ্বাসী। চুরি এ বাড়িতে বহুকাল হয়নি, তাই ও নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাত না। তার মানে এই যে, বাড়ির যে-কেউ ইচ্ছে করলে ও তলোয়ার বার করে নিতে পারত।
আলমারিটা খুব ভাল করে পরীক্ষা করেও ফেলুদা কোনও কু বা ওই জাতীয় কিছু পেল না। শুধু তলোয়ারটাই নেই, আর সব যেখানে যেমন ছিল সেইভাবেই আছে।
পরীক্ষা শেষ হলে পর ফেলুদা বলল যে, ও তড়িৎবাবুর শোবার ঘর, আর তড়িৎবাবু যেখানে কাজ করত। সেই জায়গাটা একটু দেখতে চায়। —তবে তার আগে আপনার মনে কোনওরকম সন্দেহ হচ্ছে কি না সেটা জানতে চাই।
মহীতোষবাবু কিছুক্ষণ গভীর থেকে মাথা নেড়ে বললেন, তড়িৎকে খুন করার কোনও কারণ থাকতে পারে এমন কোনও লোক তো এখানে আছে বলে মনে হয় না। ওরা এমনিতেও মেলামেশা কম ছিল, কাজ নিয়ে থাকত; মাঝে মাঝে হেঁটে বাইরে বেড়াতে যেত। যত দূর জানি, বদ অভ্যাস-টভ্যাসও কিছু ছিল না। আর ঠাকুরদার তলোয়ার দিয়েই যদি তাকে মেরে থাকে তা হলেও তো আমাদের বাড়িরই লোক। নিঃ, আমি তো ভেবে কৃলকিনারা পাচ্ছি না।
আমরা তিনজনে মহীতোষবাবুর সঙ্গে তড়িৎবাবুর ঘর দেখতে গেলাম। আমাদের ঘরেরই মতো বড় একটা ঘর। আসবাব ছাড়া তড়িৎবাবুর নিজের জিনিসপত্র বলতে নীল রঙের একটা বড় সুটকেস, একটা কাঁধে-ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ, আলনায় টাঙানো শার্ট প্যান্ট পায়জামা গেঞ্জি তোয়ালে ইত্যাদি, একটা তাকে প্রসাধনের জিনিসপত্র, একটা ছোট টেবিলের উপর রাখা ইংরেজি আর বাংলা কিছু গল্পের বই, একটা অ্যালার্মািক্লক, একটা সুলেখা ব্লু র্যাক কালি, আর দুটো পেনসিল! এ ছাড়া খাটের পাশে একটা টেবিলের উপর রাখা ফ্লাস্ক আর জলের গেলাস, আর একটা ছোট ট্রানজিস্টার রেডিয়ো।