টিবেটান ইনস্টিটিউট থেকে বেরোবার সময় আমাদের গাইড ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘যমন্তক সম্বন্ধে হঠাৎ লোকের এত কৌতুহল কেন বুঝতে পারছি না! তোমরা ছাড়া আরেকজন জিজ্ঞেস করে গেছে।’
‘যিনি মারা গেছেন। তিনি কি?’
‘না না। তাঁর কথা বলছি না। আরেকজন।’
‘কে মনে পড়ছে না?’
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘নাঃ—শুধু প্রশ্নটা ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ছে না। আসলে সেদিন এখানে একদল আমেরিকান এসেছিলেন, আমাদের চোগিয়ালের অতিথি–তাদের নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম…’
ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে যখন জিপে উঠছি, তখন দেখি চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। ঘড়িতে পাঁচটা বাজাতে পাঁচ মিনিট। দিনের আলো এত শিগগির যাবার কথা নয়। জিপ জঙ্গল থেকে খোলা জায়গায় বেরোনো মাত্র বুঝতে পারলাম পশ্চিমে ঘন কালো মেঘই এই অন্ধকারের কারণ। ড্রাইভার বলল, ‘দিনের বেলাটা এখানে অনেক সময়ই ভাল যায়, যত দুযোগ রাত্তিরে।’ আজ আর ঘোরাঘুরির কোনও মানে হয় না, তাই আমরা হোটেলে ফিরে যাওয়াই স্থির করলাম।
গাড়িতে ফেলুদা কোনও কথা বলল না। ও যে কী ভাবছে তা বোঝার কোনও উপায় নেই, তবে ওর চোখ যে কাজ করে চলেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। চলন্ত গাড়ির জানালার বাইরের সব কিছুর দিকেই ওর সজাগ দৃষ্টি। কোনও নতুন জায়গায় এলেই, আগেও দেখেছি, ফেলুদা এইভাবেই প্রায় জায়গাটাকে গিলে খায়। আরেক দিন যদি আমরা এ রাস্তা দিয়ে যাই, আমার বিশ্বাস ফেলুদার পর পর সব দোকানের নামই মুখস্থ হয়ে যাবে। আমি যে কবে ফেলুদার চোখ আর মেমরি পাব তা জানি না। অবিশ্যি আমার বয়স এখন মাত্র পনেরো, আর ওর আঠাশ।
হোটেলে পৌঁছে যখন জিপের ভাড়া দিচ্ছি তখন আবার শশধরবাবুর সঙ্গে দেখা। এখনও সেই ব্যস্ত অন্যমনস্কভাবে বাজারের দিক থেকে ফিরছেন। প্রথমে আমাদের দেখতেই পাননি, তারপর ফেলুদার ডাক শুনে একটু চমকে হেসে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
‘সব ব্যবস্থা হয়ে গেল! কালকের ফ্লাইটেই যাচ্ছি।’
ফেলুদা বলল, ‘বম্বে গিয়ে একটা ব্যাপারে একটু খোঁজ করে দেখতে পারেন কি? মিস্টার শেলভাঙ্কার এখানে একটা তিব্বতি মূর্তি কিনেছিলেন। একটা মূল্যবান দুপ্ৰাপ্য স্পেসিমেন। সেই মূর্তিটা তাঁর জিনিসপত্রের সঙ্গে ফেরত গেছে কি না।’
শশধরবাবু বললেন, ‘নিশ্চয়ই দেখব। কিন্তু আপনি ব্যাপারটা জানলেন কী করে?’
ফেলুদা সংক্ষেপে নিশিকান্তবাবু আর হিপির কাছে যা জেনেছে সেটা বলল। সব শুনেটুনে শশধরবাবু বললেন, ‘বুক পকেটে মূৰ্তিটা রাখাটাই ওর পক্ষে স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। হি হ্যান্ড এ গ্রেট প্যাশন ফর আর্ট অবজেক্টস।’
তারপর হঠাৎ মুখের ভাব একদম বদলে ফেলুদার দিকে চেয়ে একটা অবাক হাসি হেসে বললেন, ‘ভাল কথা—আপনি যে ডিটেকটিভ সেটা তো আমাকে বলেননি৷’
আমার তো চক্ষু ছানাবড়া! ফেলুদারও দেখি মুখ হা হয়ে গেছে।
‘কী করে জানলেন?’
ভদ্ৰলোক হাসতে হাসতে তাঁর মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বার করে ফেলুদাকে দেখালেন। আমি জানি সেটা ফেলুদারই কার্ড; তাতে লেখা আছে Prodosh, C. Mitter, Private Investigator.
‘আপনি যখন জিপের শেয়ারটা দিচ্ছিলেন, তখনই বোধহয় আপনার কার্ডটা ব্যাগ থেকে সামনের সিটে পায়ের কাছে পড়ে গিয়েছিল। বাংলোয় যখন নামছি, তখন ড্রাইভারটা আমায় কার্ডটা দেয়। ভাল করে পড়ে দেখিনি, কারণ চশমাটা ছিল না হাতের কাছে। তারপর থেকে যা গণ্ডগোল–এটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এনিওয়ে, এটা আমি রাখছি।–আর এই নিন আমার কার্ড! যদি কোনও গোলমাল দেখেন, আর মনে করেন আমার আসা দরকার-একটা টেলিগ্ৰাম করে দেবেন–আলিয়েস্ট অ্যাভেইলেবল ফ্রাইটে চলে আসব।’
‘কখন যাচ্ছেন। আপনি?’
‘কাল ভোরে। হয়তো আপনাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। আসি। হ্যাভ এ গুড টাইম৷’
বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে আরম্ভ করেছে। ভদ্রলোক হাত তুলে গুড বাই করে হনহনিয়ে বাংলোর দিকে চলে গেলেন।
ঘরে এসে ফেলুদা বুট-মোজা খুলে হাত-পা ছড়িয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়ে বলল—উফ্ফ!
সত্যিই, আজ এই প্রথম দিনে এত রকম ঘটনা ঘটল যে উষ্ণু ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
‘ভেবে দ্যাখ’, ফেলুদা সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একটা ক্রিমিন্যালের যদি ন’টা মাথা হত তা হলে কী সাংঘাতিক ব্যাপার হত। পেছন থেকে এসে খপ করে ধরার আর কোনও উপায় থাকত না।’
‘আর চৌত্ৰিশটা হাত?’
‘সেও সাংঘাতিক। চৌত্ৰিশ জোড়া হাতকড়া না হলে অ্যারেস্ট করা যেত না।’
বাইরে বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেছে।
ঘরের আলোটা জ্বলিয়ে দিলাম।
ফেলুদা তার হাতবাক্সটা খুলে তার থেকে তার বিখ্যাত নীল খাতাটা বের করল। তারপর শোয়া অবস্থাতেই খাতাটা খুলে বুকের উপর রেখে পকেট থেকে কলামটা বার করে লেখার জন্য তৈরি হল। শেলভাঙ্কার যেভাবেই মরে থাকুক না কেন, ফেলুদা যে অলরেডি রহস্যের গন্ধ পেয়েছে আর তদন্ত শুরু করে দিয়েছে, সেটা আমার বুঝতে বাকি রইল না।
‘বল তো, এখানে এসে এখন পর্যন্ত কার কার সঙ্গে আলাপ হল?’
প্রশ্নটার জন্য মোটেই তৈরি ছিলাম না, তাই প্রথমটা কী রকম হকচকিয়ে গেলাম। ঢোক গিলে বললাম, ‘একেবারে বাগডোগরা থেকে শুরু করতে হবে নাকি?’
‘দূর গর্দভ। এখন যারা গ্যাংটকে রয়েছে, তার মধ্যে বল৷’
‘এক—শশধরবাবু।’
‘পদবি?’
‘দত্ত।‘