‘ তোমার মনে কি কোনও সন্দেহ হচ্ছে? উত্তর পাব কি না জানি না, তাও প্রশ্নটা না করে পারলাম না।
‘কীসের সন্দেহ?’
‘যে মিস্টার শেলভাঙ্কার স্বাভাবিকভাবে মারেননি৷’
‘এখনও সেটা ভাববার বিন্দুমাত্র কারণ ঘটেনি।’
‘তবে যে মূর্তিটা পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘তাতে কী হল? লোকটা পাথর চাপা পড়ে জখম হয়েছে, পকেট থেকে মূর্তি গড়িয়ে পড়েছে, যারা তাকে উদ্ধার করেছে তাদের মধ্যে কেউ সেটিকে দেখতে পেয়ে ট্যাঁকস্থ করেছে—ব্যস ফুরিয়ে গেল। খুন করা এমনিতেই সহজ না, তার উপর মাত্র এক হাজার টাকার একটা মূর্তির জন্যে খুন–এ তো ভাবাই যায় না।’
আমি আর কিছু বললাম না। খালি মনে মনে বললাম—একটা রহস্য যদি গজিয়ে ওঠে, তা হলে ছুটিটা জমবে ভাল।
সারি সারি দাঁড়ানো জিপের একটার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার নেপালি ড্রাইভারকে ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘ভাড়া যায়গা?’
লোকটা বলল, ‘কাঁহা যায়গা?’
‘টিবেটান ইনস্টিটিউট মালুম হ্যায়?
‘হ্যায়। বৈঠ যাইয়ে৷’
আমরা দুজনেই সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম। ড্রাইভারটা গলায় মাফলারটা জড়িয়ে নিয়ে মাথায় একটা কাপ চাপিয়ে, জিপটা ঘুরিয়ে যো-পথে আমরা শহরে এসে ঢুকেছিলাম, সেই পথে উলটোমুখে চলতে লাগল।
ফেলুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে লোকটার সঙ্গে বাতচিত আরম্ভ করে দিল। কথা অবিশ্যি হিন্দিতেই হল; আমি সেটা বাংলায় লিখছি।
‘এখানে সেদিন যে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে সেটার কথা তুমি জান?’
‘সবাই জানে৷’
‘সে ড্রাইভার তো বেঁচে আছে, তাই না?’
‘ওঃ-ওর খুব ভাগ্য ভাল। গত বছর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়, সেও পাথর পড়ে—তাতে
‘তুমি এ ড্রাইভারকে চেন?’
‘চিনব না? এখানে সবাই সবাইকে চেনে৷’
‘সে কী করছে এখন?’
‘আবার অন্য একটা ট্যাক্সি চালাচ্ছে—SKM 463। নতুন ট্যাক্সি।’
‘অ্যাক্সিডেন্টের জায়গাটা তুমি দেখেছ?ট
‘হ্যাঁ, ও তো নর্থ সিকিম হাইওয়েতে। এখান থেকে দশ কিলোমিটার৷’
‘কাল একবার নিয়ে যেতে পারবে?’
‘কোন পারব না?’
‘তা হলে এক কাজ করো। আটটা নাগাত বেরোব–সকালে। আমরা স্নো-ভিউ হোটেলে থাকি—তুমি চলে এসে৷’
‘বহুৎ আচ্ছা৷’
একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খাড়াই পথ ধরে উঠে গিয়ে টিবেটান ইনস্টিটিউট। ড্রাইভার বলল জঙ্গলে নাকি খুব ভাল আর্কিড আছে—কিন্তু সে সব দেখবার সময় এখন নয়। গাড়ি একেবারে সোজা ইনস্টিটিউটের দরজার সামনে গিয়ে থামল। প্ৰকাণ্ড দোতলা বাড়ি, তার গায়ে বোধহয় তিব্বতি ধাঁচেরই সব নকশা করা। চারদিক এত নির্জন আর নিস্তব্ধ যে, একবার মনে হল ইনস্টিটিউট হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি দরজা খোলা।
দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখি একটা প্ৰকাণ্ড হলঘরে এসে পড়েছি, তার দেয়ালে লম্বা লম্বা ছবি ঝুলছে (এগুলোকেই বলে থাঙ্কা), আর মেঝেতে রয়েছে। নানারকম খুঁটিনাটি জিনিসপত্রে বোঝাই সারি সারি কাচের আলমারি আর শো-কেস।
কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না, এমন সময় একজন ঢোল সিকিমি পোশাক আর চশমা-পরা ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
ফেলুদা তাকে ভীষণ ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘ডক্টর গুপ্ত আছেন কি?’
ভদ্রলোক ইংরেজিতে উত্তর দিলেন, ‘দুঃখের বিষয় কিউরেটর সাহেব আজ অসুস্থ। আমি তাঁর অ্যাসিসট্যান্ট। কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি, বলুন।’
ফেলুদা বলল, ‘না, মানে, একটা বিশেষ ধরনের তিব্বতি মূর্তি সম্বন্ধে আমি একটু ইনফরমেশন চাচ্ছিলাম। নামটা জানি না, তবে কোনও এক দেবতার মূর্তি। তার ন’টা মাথা আর চৌত্ৰিশটা হাত৷’
ভদ্রলোক হেসে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ইয়েস ইয়েস—যমন্তক, যমন্তক। টিবেট ইজ ফুল অফ ষ্ট্রেঞ্জ গডস। আমাদের কাছে একটা যমন্তকের মূর্তি আছে, এসো দেখাচ্ছি। কিন্তু ওর বেস্ট স্পেসিমেন এই কিছুদিন আগে একটি ভদ্রলোক আমাদের দেখাতে এনেছিলেন। আনফরচুনেটলি হি ইজ ডেড নাউ।’
‘আই সি।’
প্রয়োজনে ফেলুদার অ্যাকটিং দেখবার মতো।
আমরা ভদ্রলোকের পিছন পিছন একটা আলমারির দিকে এগিয়ে গেলাম। যে মূর্তিটা ভদ্রলোক বার করে আমাদের সামনে ধরলেন সেটার চেহারা ভয়ঙ্কর। ন’টা মুখের প্রত্যেকটাতেই একটা হিংস্ৰ ভাব-প্রায় রাক্ষসের মতো।
এবার ভদ্রলোক মূর্তিটাকে চিত করে দেখালেন তার তলায় একটা ফুটো। এই ফুটোর ভিতরে নাকি মন্ত্র লেখা কাগজ পাকিয়ে ঢুকিয়ে রাখা হয়, আর তাকে বলে নাকি ‘সেক্রেড ইনটেসটাইন৷’
মূর্তিটাকে আলমারিতে রেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘যিনি মারা গেছেন, তাঁর মূর্তিটা ছিল মাত্র তিন ইঞ্চি লম্বা, কিন্তু কী আশ্চর্য সুন্দর কারুকার্য! সোনার মূর্তি, আর তাতে নানারকম পাথর বসানো। চোখ দুটো ছিল রুবি পাথরের। আমরা এত সুন্দর মূর্তি এর আগে কখনও দেখিনি।‘
ফেলুদা বলল, ‘কী রকম দাম হতে পারে সে মূর্তির?’
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘হি পেড় এ থাউজ্যান্ড রুপিজ। আমার মতে জলের দরে পেয়েছিলেন। ওর দাম দশ হাজার টাকা হলেও বেশি হত না। আমাদের কিউরেটার নিজে তিব্বত গেছেন, দলাইলামার সঙ্গে বসে মড়ার মাথার খুলিতে চা খেয়েছেন, কিন্তু তিনিও অত ভাল মূর্তি কখনও দেখেননি।’
ভদ্রলোক এর পরে আমাদের আরও অনেক জিনিস দেখিয়ে অনেক কিছু বোঝালেন। ফেলুদা সে সব মন দিয়ে শুনলেও, আমার কোনও কথাই কানে ঢুকাল না; আমি শুধু ভাবছি—শেলভাঙ্কারের মূর্তির দাম ছিল দশ হাজার টাকা। এক হাজার নয়, দশ হাজার। দশ হাজার টাকার মূর্তির লোভে কি একজন আরেকজনকে খুন করতে পারে না? অবিশ্যি তার পরেই আবার মনে পড়ল যে পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ে তার জিপে লাগার ফলেই শেলভাঙ্কার মারা গিয়েছিল। তাই যদি হয়, তা হলে তো খুনের কথাটা আসেই না।