‘তা হোটেলের ঘরের দরজায় চাবি দেওয়া ভাল। তবে চুরি-চামারি এখানে নেই বললেই চলে। সারা সিকিমে মাত্র একটি জেলখানা, আর সেটা গ্যাংটকেই। খোঁজ নিয়ে দেখুন-চারটির বেশি কয়েদি নেই সেখানে।’
হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখি তখনও কুয়াশা কাটেনি। ফেলুদা এদিক-ওদিক দেখে বলল, ‘একটা ভুল হয়ে গেল—দুজনের জন্যই এক জোড়া করে হান্টিং বুট কিনে আনা উচিত ছিল। যা বুঝছি, এখানে বাদলা হবে। তার মানেই রাস্তাঘাট পেছল। আর জুতোয় গ্রিপ না থাকলে পাহাড়ে ওঠা মুশকিল৷’
আমি বললাম, ‘এখানে পাওয়া যাবে না?’
‘তা যেতে পারে। বাটার দোকান তো সর্বত্রই আছে। সন্ধে নাগাত ফিরে এসে কিনে নেব। আপাতত চল একটু এক্সপ্লোর করা যাক৷’
বাজার থেকে শহরের দিকে যেতে হলে চড়াই উঠতে হয়। কিছু দূর গিয়েই বুঝলাম, এদিকটায় লোকের ভিড় আর বাড়ির ভিড় আরও অনেকটা কম। অল্প যে সব লোক চলাচল করছে, তার মধ্যে কিছু স্কুলের ইউনিফর্ম-পরা ছেলে মেয়েও দেখলাম। দার্জিলিং-এর মতো ঘোড়া দেখলাম না। এখানে, তবে জিপ চলে ওখানের চেয়ে অনেক বেশি। সেটা বোধহয় মিলিটারিরা থাকার দরুন। গ্যাংটক থেকে ষোলো মাইল দূরে ১৪,০০০ ফুট হাইটে নাথুলা। নাথুলাতে চিন আর ভারতের মধ্যের সীমারেখা। এদিকে ভারতীয় সৈন্য, আর ওদিকে পঞ্চাশ গজের মধ্যে চিন সৈন্য।
আরও কিছু দূর হেঁটে যাবার পর একটা মোড়ের মাথায় এসে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হঠাৎ একটা ঝলমলে রং চোখে পড়ল। একটু এগোতেই বুঝলাম সেটা আর কিছুই না—একটা লোক, ভারী বাহারের পোশাক পরে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার পা থেকে মাথা অবধি রঙের বাহার। পায়ে হলদে জুতো, প্যান্টটা হল নীল রঙের জিনস, সোয়েটারটা টকটকে লাল, আর তার গলার ফাঁক দিয়ে ভিতরে সবুজ শার্টের কলার দুটো বেরিয়ে আছে। শার্টের ঠিক উপরেই, থুতনির নীচে, একটা সাদার উপর কালো নকশা করা স্কার্ফ। লোকটার মুখের রং হালকা হলদে আর ফ্যাকাসে গোলাপি মেশানো, আর চুল—শুধু চুল নয়, গোঁফদাড়িও-বাদামি রঙের। দেখেই বোঝা যায় ইনি একজন বিদেশি হিপি। দাড়ি থাকার ফলে বয়স বোঝা মুশকিল, তবে মুখের চামড়া একটুও কুঁচকোয়নি। মনে হয় ফেলুদারই বয়সী—মানে ত্ৰিশের একটু নীচেই।
ভদ্রলোক আমাদের দেখে মৃদু হেসে ঠাণ্ডা মোলায়েম সুরে বললেন, ‘হ্যালো।’
ফেলুদাও উত্তরে ‘হ্যালো’ বলল। এবার লক্ষ করলাম হিপির কাঁধ থেকে দুটো ক্যামেরা ঝুলছে, আর তার সঙ্গে একটা চামড়ার ব্যাগে। তাতেও হয়তো ক্যামেরারই জিনিসপত্র রয়েছে। একটা ক্যামেরার নাম ‘ক্যানন’ দেখে বুঝলাম সেটা জাপানি। ফেলুদার সঙ্গেও তার জাপানি ক্যামেরাটা ছিল, আর সেটা দেখেই বোধহয় হিপি বললেন, ‘নাইস ডে ফর কালার৷’
ফেলুদা হেসে বলল, ‘তোমাকে কিছু দূর থেকে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখে আমারও সেই কথাটাই মনে পড়ছিল, তবে দুঃখের বিষয় ভাল কালার ফিল্ম এখন আমাদের দেশে দুষ্প্রাপ্য না হলেও দুর্মুল্য৷’
হিপি বলল, ‘সেটা জানি। আমার কাছে কালারের স্টক আছে, প্রয়োজন হলে আমাকে বোলো৷’
হিপি যদিও ইংরেজিতে কথা বলছিল, উচ্চারণ শুনে তার জাতটা বুঝতে পারলাম না। ফরাসি অথবা আমেরিকান হলে চন্দ্ৰবিন্দুটা একটু বেশি ব্যবহার করত, আর ইংরেজ হলে তো বোঝাই যেত। ইনি কিন্তু ওই তিনটি জাতের একটিও নন।
ফেলুদা বলল, ‘তুমি কি বেড়াতে এসেছ?’
হিপি বলল, ‘আমি ছবি তুলতে এসেছি। সিকিম সম্বন্ধে একটা বই করার ইচ্ছে। আমি একজন প্রেফেশনাল ফটোগ্রাফার৷’
‘কদিন আছে। এখানে?’
‘এসেছি নাইনথ; পাঁচদিন হল। তিনদিনের ভিসা ছিল, বলে-কয়ে বাড়িয়ে নিয়েছি। আরও দিন-সাতেক থাকার ইচ্ছে৷’
‘কোথায় উঠেছা?
‘ডাকবাংলো। এই যে রাস্তাটা ডান দিকে উঠে গেছে–এইটে দিয়ে একটু উঠে গিয়েই ডাকবাংলো৷’
ডাকবাংলো শুনেই আমার কানটা খাড়া হয়ে উঠল। শেলভাঙ্কারও তো বোধহয় ডাকবাংলোতেই ছিলেন।
‘তা হলে যে-ভদ্রলোকটি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন, তার সঙ্গে তোমার নিশ্চয়ই আলাপ ছিল?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
হিপি আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বুললেন, ‘ভেরি স্যাড। আমার সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ হয়েছিল। হি ওয়াজ এ ফাইন ম্যান, অ্যান্ড–’
এইটুকু বলেই হিপি থেমে গেল। দেখে মনে হল সে হঠাৎ কেন জানি চিন্তিত হয়ে পড়েছে। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সে প্রায় আপন মনেই বলল, ‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ।’
‘কী ব্যাপার?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘উনি এখানে এসে একটা আশ্চর্য মূর্তি সংগ্রহ করেছিলেন একটি বাঙালি ভদ্রলোকের কাছ থেকে। হি পেড ওয়ান থাউজ্যান্ড রুপিজ ফর ইট।’
‘এক হাজার!’ ফেলুদা অবাক হয়ে বলল।
‘হ্যাঁ। জিনিসটা কেনার পর ও এখানকার টিবেটন ইনস্টিটিউটে সেটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তারা নাকি বলেছিল মূর্তিটা একটা আশ্চর্য উঁচু দরের দুপ্রাপ্য জিনিস। কিন্তু ভদ্রলোক গভীর হয়ে আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আমার খটকা লাগছে। এই ভেবে যে, মূর্তিটা গেল কোথায়?’
‘তার মানে?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। ‘তার ডেড বডি তো শুনলাম বম্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তার জিনিসপত্রও নিশ্চয়ই সেই সঙ্গেই গেছে।–তাই নয় কি?’
হিপি মাথা নাড়ল।’অন্য সব জিনিস ফেরত গেছে সেটা ঠিকই, কিন্তু মিস্টার শেলভাঙ্কার মূর্তিটা সব সময়ে তাঁর কোটের বুক-পকেটে রাখতেন। বলতেন, এটা আমার ম্যাসকট—আমার ভাগ্য ফিরিয়ে দেবে। সেদিন যখন বেরোন, তখনও সেটা ওঁর পকেটেই ছিল। এটা আমি জানি! অ্যাক্সিডেন্টের পর ওঁকে হাসপাতালে আনা হয়; তখন আমি সেখানে ছিলাম। ওঁর জামাকাপড় খুলে ওঁর পকেট থেকে সব জিনিসপত্র বার করে ফেলা হয়। একটা নোটবুক বেরোয়, মানিব্যাগ বেরোয়, খাপের মধ্যে ভাঙা অবস্থায় ওঁর চশমাটা বেরোয়, কিন্তু মূর্তি বেরোয়নি। অবিশ্যি এমন হতে পারে যে, মূর্তিটা পকেট থেকে বেরিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল; হয়তো সেটা সেখানেই পড়ে আছে, আর না হয় যারা তাকে তুলে আনে তাদেরই কেউ সেটাকে পকেটস্থ করেছে।‘